সর্বস্তরে বাংলা চাই, কিন্তু ৮ ফাল্গুনকে ২১ ফেব্রুয়ারি হিসেবে মনে রেখেছি
Published: 20th, February 2025 GMT
ভাষাসংগ্রামী আহমদ রফিক। ব্যক্তিজীবনে চিকিৎসক হলেও কবি-প্রাবন্ধিক ও রবীন্দ্র গবেষক হিসেবেই অধিক পরিচিত। ছাত্রজীবন থেকেই তিনি রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। ১৯৫২ সালে মেডিকেল কলেজের ছাত্র থাকাকালীন ভাষা আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা রাখেন। এই ভাষাসংগ্রামী সংরক্ষণ করেছেন ভাষার ইতিহাস। লিখেছেন একুশের উপাখ্যান। ১৯৯৫ সালে একুশে পদকে ভূষিত হন। এ ছাড়া রবীন্দ্রতত্ত্বাচার্য উপাধি পেয়েছেন টেগোর রিসার্চ ইনস্টিটিউট, কলকাতা থেকে। ১৯২৯ সালের ১২ সেপ্টেম্বর তিনি জন্মগ্রহণ করেন। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সমকালের জ্যেষ্ঠ সহসম্পাদক আশিক মুস্তাফা ও সহসম্পাদক এমদাদুল হক মিলটন
সমকাল: ভাষা অন্দোলনের ৭৩ বছর পূর্ণ হলো। ২১ ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃত। আপনারা যে স্বপ্ন নিয়ে ভাষা আন্দোলন করেছিলেন, তার কতটা পূরণ হয়েছে?
আহমদ রফিক: রাষ্ট্রভাষা বাংলা হয়েছে; এটি সাফল্য। কিন্তু আন্দোলনের সময় আমরা তিনটি স্লোগান দিতাম– ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’, ‘রাজবন্দিদের মুক্তি চাই’ ও ‘সর্বস্তরে বাংলা চালু করো’। কিন্তু সর্বস্তরে বাংলা চালু হয়নি। সর্বস্তরে বাংলা চালুকরণের স্লোগানটি বুঝেশুনে দিয়েছি বলে এখন আর আমার মনে হয় না। হয়তো আবেগে বলেছিলাম। তখনকার বাস্তবতাটাও খেয়াল করিনি। ২১ ফেব্রুয়ারি আমরা ৮ ফাল্গুন তো করিনি ওই সময়। করিনি কেন? কেন একুশে ফেব্রুয়ারি করেছি? তার মানে আমাদের জীবনে যে কনট্রাডিকশন, সেটাকে আমরা মান্য করে নিয়েছি। আন্দোলনকালে এবং পরবর্তী সময়ে আমি ঢাকা কলেজ, তৎকালীন জগন্নাথ কলেজসহ যেখানেই বক্তৃতা দিতে গিয়েছি, সেখানেই শিক্ষার্থীদের মা-বাবা বলেছেন, কী সব কথাবার্তা বলেন আপনারা– সর্বস্তরে বাংলা ভাষা চালু করার। এটা আবার চলে নাকি? এখন মনে হয়, তারা তো সঠিক কথাই বলেছিলেন। কোনো কোনো বুদ্ধিমতী নারী বলেছেন, আমরা তো কাজকর্ম সবই করি খ্রিষ্টীয় হিসাবে। যা হোক, রাষ্ট্রভাষা বাংলাটাই হলো; বাকিগুলো আধা আধা হলো। এটা মেনেই আমরা চললাম।
সমকাল: ভাষা আন্দোলন সম্পর্কে আপনার মূল্যবান বেশ কিছু গ্রন্থ রয়েছে। এসব গ্রন্থে ভাষা আন্দোলনের পূর্ণাঙ্গ ইতিহাস পাওয়া যায় না কেন?
আহমদ রফিক: ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস লিখেছি আমি। কিন্তু পূর্ণাঙ্গ ইতিহাস আমার পক্ষে লেখা সম্ভব নয়। এটা একক কোনো ব্যক্তির পক্ষেই সম্ভব নয়। এর জন্য যে পরিমাণ অর্থশক্তি ও জনশক্তি প্রয়োজন, সেটা কোনো একজন ব্যক্তির পক্ষে অসম্ভব। তাছাড়া ইতিহাসের চেয়ে ভাষা আন্দোলনের দলিলপত্রের গুরুত্ব অনেক বেশি। পরবর্তীকালে দলিলপত্রের চরিত্র ও বৈশিষ্ট্য নিয়ে গবেষকরা গবেষণা করতে পারবে।
সমকাল: আপনি বিভিন্ন সময়ে ভাষা আন্দোলনের স্মৃতিবিজড়িত স্থানগুলো সংরক্ষণের কথা বলেছেন। ভাষাসংগ্রামীর তালিকাই যেখানে প্রকাশ করা হয়নি ৭৩ বছরে, সেখানে এসব স্থান সংরক্ষণ তো দূরের বিষয়।
আহমদ রফিক: আমার জানামতে, ভাষাসংগ্রামীর তালিকা করার চেষ্টা চলছে। হাইকোর্ট এটা নিয়ে নির্দেশনাও দিয়েছেন। তাও অনেক আগের কথা। তবে শঙ্কাও আছে, ভাষা আন্দোলনের ৭৩ বছর পরে এই তালিকা কি সঠিকভাবে করা সম্ভব? ভাষাসংগ্রামীদের মধ্যে কতজন জীবিত আছেন? ভাষা আন্দোলনের সত্যিকার ঘটনা এখন আর কোনোভাবেই কি নির্ণয় করা সম্ভব? যারা প্রত্যক্ষদর্শী ও প্রতিবাদকারী তাদের সংখ্যা এখন কত? এই তালিকা প্রণয়নের আগে দরকার ছিল ভাষা আন্দোলনের স্মৃতিবিজড়িত স্থানগুলো সংরক্ষণ করা। এতে আগ্রহীরা গবেষণা করতে পারতেন। আন্দোলন-পরবর্তী সময়ে এই সম্পর্কিত গবেষণায় কেউ কাজ করেন, আবার কেউ করেন না। অপ্রাসঙ্গিক কথা বলি, মানুষ কিন্তু চায় যুগ যুগ ধরে সে জীবিত থাকুক। কীভাবে? সন্তানসন্ততি দিয়ে। পরিবার ও বন্ধুবান্ধবকে দিয়ে। ইতিহাস দিয়ে। ইতিহাস মনে রাখে। আন্দোলন সব সময় হয় না। ট্রোজান যুদ্ধ, দাস বিদ্রোহে কত মানুষ যে মারা গেছে, তার ইয়ত্তা নেই। আন্দোলন সঠিকভাবে পরিচালনা করতে গেলে বিভিন্ন পেশার মানুষ তাতে যদি যুক্ত হন, তাহলে সেটা সঠিক পথে চালিত হওয়ার সম্ভাবনা বাড়ে। আজ যদি এসব স্মৃতি সংরক্ষণ করা যেত তবে গবেষকরা গবেষণা করে আরও অনেক কিছু বের করে আনতে পারতেন। আমার কাছে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী এবং শিক্ষকরা আসে। আমি তাদের বলি এই নিয়ে গবেষণা করতে। গবেষণার বিকল্প কিছুই নেই!
সমকাল: আপনি কখন এবং কীভাবে ভাষা আন্দোলনে জড়িয়েছিলেন; মনে পড়ে?
আহমদ রফিক: ভাষা আন্দোলনের স্মৃতিমেদুরতায় ভুগি সবসময়। আসলে স্কুলজীবন থেকে ছাত্র রাজনীতির সঙ্গে জড়িয়ে পড়ি। সেটা অবিভক্ত বঙ্গে। সে সময় পাকিস্তানপন্থি রাজনীতি করিনি, বাম রাজনীতি করেছি। ১৯৪৭ সালে কলেজ জীবনে এসেও সেই পথে হেঁটেছি। ’৪৯ সালে ঢাকায় এসে স্বভাবতই সব গণআন্দোলনে অংশগ্রহণ করেছি। তারই ধারাবাহিকতায় ভাষা আন্দোলনে যোগ দিই। হয়তো এ জন্যই একুশের আন্দোলন সম্পর্কে শুনতে ভালো লাগে; বলতে ভালো লাগে। তাই নয়? যারা আন্দোলন নিয়ে বলেন, তারা আমার কাছের মানুষ হয়ে যান। তবে একুশ নিয়ে অনেকেই অনেক কিছু লিখছেন, যার সব ঠিক নয়। আমি শুধু একটা উদাহরণ দেব। ভাষা আন্দোলন নিয়ে কেউ কেউ বলেন, ২১ তারিখ সকালবেলায় আমরা মিছিল করে এসেছি। আসলে এটা ভুল তথ্য। একুশের সকালবেলা আমি ও আমার শাহজাদপুরের সিনিয়র বন্ধু বেরিয়ে দেখেছি– চারদিক সুনসান। কিছু নেই। দুই-একটা গরু ও ছাগল চরছে। আর ওই যে দূরে একটি রিকশা ও একজন যুবক যাচ্ছে। হয়তো স্টেশনে যাবে। এ রকম অবস্থার মধ্যে যদি কেউ বলে, আমরা সকালবেলায় স্লোগান দিতে দিতে এসেছি। এটি ভুল। এটি আমি সব সময় বলে এসেছি। আমি জোর গলায় বলতে পারি, যে জন্য আমি এবং আমার সিনিয়র বন্ধু আলী আজগর মিলে যখন গেলাম শহীদ মিনারে, তখন দেখেছি স্লোগান দিয়ে মিছিল আসছে। সেটা হয়েছে সকাল ১০টার পরে। সবাইকে বলা হয়েছিল, যেহেতু ১৪৪ ধারা দেওয়া হয়েছে– স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় থেকে একসঙ্গে না বেরিয়ে দুই-তিনজন করে বের হওয়ার জন্য। যেহেতু চারজনের বেশি হলে ১৪৪ ধারা ভাঙা হয়, সে জন্য দুই-তিনজন করে বেরোনোর কথা আমরা বলেছি। আমার মনে আছে, পেছনের তৎকালীন রেললাইন ধরে অনেকে এসেছিল আমাদের পেছন পেছন। তো এভাবে ঢালাও যা কিছু লিখে দিলাম তা একুশের ইতিহাস হয়ে গেল, সেটা করা ঠিক নয়। লিখতে গেলে তথ্য সংগ্রহ দরকার। দালিলিক প্রমাণের প্রয়োজন পড়ে। কতটা সত্য আছে; সত্য নেই– তা দেখে নেওয়া দরকার। একুশের ইতিহাস লিখতে গেলে সঠিকভাবে লিখতে হবে। সবার কাছে এটিই আমার অনুরোধ।
সমকাল: ২০২৪ সালে জুলাই গণঅভ্যুত্থান হয়েছে। তরুণরা এই আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছে। ভাষা আন্দোলনের সময় আপনারাও তো তরুণ ছিলেন।
আহমদ রফিক: হ্যাঁ, আমরা তরুণ ছিলাম। আমি খুব যে এই বিষয়ে খবর রেখেছি, তা নয়। তবে যে একেবারেই জানি না, তাও না। আমি আমার অভিজ্ঞতার আলোকে বলি, সবার কাছে অনুরোধ– যুগ যুগ ধরে যারাই আন্দোলন করেছেন; আন্দোলনের পরে আন্দোলন করেছেন। তার পরেও আন্দোলন করেছেন। সবার কাছেই আমাদের আহ্বান, সবাই মিলে ঐক্যবদ্ধ হোন। মিলিত হয়ে কাজ করুন। আন্দোলনের যেই ফল তা যেন সঠিকভাবে পরিচালিত হয়। তরুণদের পাশাপাশি যে কোনো আন্দোলনের মতো নিশ্চয় এই আন্দোলনেও বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ যুক্ত ছিলেন। তাই বলি, সব বয়সের মানুষের মাঝে যেন আমরা সংযোগ সেতু তৈরি করতে পারি। এর মধ্যে যাতে ভুলভ্রান্তি যুক্ত না হয়; সেটা দেখা সব মানুষের একান্ত কর্তব্য। এই সংযোগ সেতুটা তৈরি করার জন্য আমি বরাবরই বলি। বলে আসছি। যে ক’দিন বেঁচে আছি বরাবরই বলব যে, মানসিক ঐক্যটা দরকার। এই আন্দোলনটা যাতে ভুল পথে না যায়। সঠিক পথে চলে। সঠিক পরিণামে পৌঁছায়। আমরা এক জাতি এক প্রাণ একতাবদ্ধ হয়ে যদি এগোতে পারি, আমাদের স্বপ্ন কিছু মাত্রায় হলেও সফল হবে।
সমকাল: আপনি রাজনীতি ছেড়ে লেখক জীবন বেছে নিয়েছিলেন একসময়। একজন সার্বক্ষণিক লেখকের জীবনে একাকিত্ব কি দুর্বিষহ?
আহমদ রফিক: এক অর্থে হ্যাঁ। তবে এটা ভালো যে, এখন আগের মতো লোকজন আসছে না। আমিও নিতে পারছি না। এতে পরিশ্রম কমে গেছে। আরেক অর্থে সময়টা অসহনীয়। কেউ আসে না, খোঁজ নেয় না। পৃথিবীতে কেউই হয়তো এ জীবন চায় না!
সমকাল: আপনি পাঁচ মিনিট কথা বলবেন, বলেছিলেন। এখন তো পৌনে এক ঘণ্টা হয়ে গেল। কথা বলতে কষ্ট হচ্ছে?
আহমদ রফিক: বলছিলাম না, ভাষা নিয়ে কেউ কথা বলতে এলে তিনি আমার আপন হয়ে যান। আপনারাও আমার আপন হয়ে গেছেন।
সমকাল: ভাষা প্রসঙ্গে ফিরে আসি। ভাষা, আন্দোলন ও বাংলা নিয়ে যদি কিছু বলেন?
আহমদ রফিক: যুগে যুগে আন্দোলন হয়েছে। আমি দাস বিদ্রোহের কথা বলেছি। এ নিয়ে সিনেমাও হয়েছে। কী ভয়াবহতা! মানুষ যে কত নিষ্ঠুর হতে পারে– সেটার যেমন প্রমাণ পাওয়া যায়। আবার মানুষ যে কতটা মানবিক হতে পারে– সেটাও নানাভাবে মানুষ প্রমাণ করেছে; এটাও বলেছি। আসলে মানবিক হতে গেলে কিছু বিষয় হিসাব করে চলতে হয়। মানুষের মানবিক দিকগুলো আমাদের যে কোনো যুগে হোক না কেন, সেগুলো একটু প্রাধান্য দিয়ে চলতে পারলে ভালো হয় বলে আমি মনে করি। আর সবাইকে আবারও বলি, আন্দোলনের যেই ফল তা যেন সঠিকভাবে পরিচালিত হয়। সঠিক পরিণামে পৌঁছায়। সব বয়সের মানুষের মাঝে যেন আমরা মানসিক সংযোগ সেতু তৈরি করতে পারি। এতে দেশ যেমন এগিয়ে যাবে, তেমনি এগিয়ে যাবে আমাদের বাংলা ভাষাও।
সমকাল: আমাদের সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ।
আহমদ রফিক: আপনাদেরও ধন্যবাদ। সমকালকে ধন্যবাদ। ধন্যবাদ পাঠকদেরও।
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: র জন য র জন ত এক শ র আম দ র কর ছ ন আপন র সমক ল দরক র
এছাড়াও পড়ুন:
কতগুলো বিষয়ে একমত, তা এখনই বলতে পারব না: সালাহউদ্দিন আহমদ
বিভিন্ন বিষয়ে সংস্কার নিয়ে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে আজ বৃহস্পতিবার দিনভর বৈঠক করেছে বিএনপি। সেখানে প্রজাতন্ত্র, রাষ্ট্রের মূলনীতি, মৌলিক অধিকারসমূহ, আইন বিভাগের সংস্কারসহ বিভিন্ন বিষয় নিয়ে দুই পক্ষের কথা হয়েছে। বৈঠক শেষে বিকেলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ বলেন, আলোচনায় কিছু কিছু বিষয়ে তাঁরা একমত হয়েছেন, তবে সেগুলো এখন সুনির্দিষ্ট করে বলতে পারবেন না।
আজ সকাল সাড়ে ১০টায় জাতীয় সংসদের এলডি হলে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজসহ অন্যদের সঙ্গে আলোচনায় বসেন বিএনপির প্রতিনিধিদলের সদস্যরা। এই দলে সালাহউদ্দিন আহমদ ছাড়াও বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান, বিএনপির চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ইসমাইল জবিউল্লাহ, আইনজীবী রুহুল কুদ্দুস কাজল, সাবেক সচিব নিরুজ্জামান খান অংশ নেন। দুপুরে মধ্যাহ্নবিরতি দিয়ে বিকেল পৌনে পাঁচটার দিকে এদিনের মতো আলোচনা শেষ হয়।
এরপর জাতীয় সংসদের এলডি হলে আলোচনা নিয়ে সাংবাদিকদের ব্রিফ করেন সালাহউদ্দিন আহমদ। তিনি বলেন, ‘আমরা আলোচনা শুরু করেছিলাম সংবিধান সংস্কার বিষয়ে এবং এর পরবর্তী সময়ে কিছুক্ষণ আগে আমরা বিচার বিভাগ নিয়ে আলোচনা করেছি। এগুলো বিস্তারিত দফাওয়ারি আমরা আলোচনা করে যাচ্ছি। সে ক্ষেত্রে এখন আমি স্পেসিফিক আপনাদের বলতে পারব না, আমরা কতটা একমত।’
সংবিধান সংস্কার নিয়ে আলোচনা প্রসঙ্গে বিএনপির স্থায়ী কমিটির এই সদস্য বলেন, ‘আমরা সংবিধান সংস্কার বিষয়ে প্রজাতন্ত্র, রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি, ফান্ডামেন্টাল রাইটস এগুলোর ক্ষেত্রে অনেক বিষয়ে একমত হয়েছি এবং কিছু কিছু বিষয়ে আমরা আমাদের সুচিন্তিত মতামত তুলে ধরেছি, ওনারাও আমাদের মতামতের ভিত্তিতে পুনরায় সিদ্ধান্ত নিয়ে জানাবেন বলে জানিয়েছেন।’
রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতির বিষয়ে বিএনপি পঞ্চদশ সংশোধনীর পূর্বের অবস্থায় ফিরে যেতে চায় বলে জানান সালাহউদ্দিন আহমদ। তিনি বলেন, ‘ওইখানে ধর্মনিরপেক্ষতা নেই। আল্লাহর ওপর আস্থা ও বিশ্বাস আছে। ওইখানে গণতন্ত্র ,জাতীয়তাবাদসহ সবকিছু আছে রাষ্ট্র ও সংবিধানের মূলনীতি হিসেবে। দুইটা দুই জিনিস। আমরা বহুত্ববাদের পক্ষে নই, ধর্মনিরপেক্ষতা নীতির পক্ষেও নই। আমরা বহুত্ববাদের বিরোধিতা করেছি। তবে সাম্য, মানবিক মর্যাদা এবং সামাজিক ন্যায়বিচারের যে কথাগুলো স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে উল্লেখ করা আছে, সেই সমস্ত বিষয়ে ওনারা প্রস্তাবনায় এবং রাষ্ট্রীয় মূলনীতিতে অন্তর্ভুক্ত করা যায়, এখানে প্রস্তাব করেছেন। আমরা বলেছি, এ বিষয়ে আমরা নীতিগতভাবে একমত তবে আমরা দলীয়ভাবে সিদ্ধান্ত নিয়ে সেটা আপনাদেরকে পরে জানাব।’
বিষয়গুলো নিয়ে বিএনপির দলীয় ফোরামেও আলোচনা হবে জানিয়ে সালাহউদ্দিন আহমদ বলেন, ‘আমরা সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ নিয়ে আমাদের মতামত জানিয়েছি, ওনারাও ওনাদের মতামত জানিয়েছেন, কতটুকু গ্রহণ করবেন, সেটা পরবর্তী সময়ে দেখা যাবে। ৭০ অনুচ্ছেদের অর্থবিল ছাড়া বাকি সব যদি হয়, তাহলে সরকারের স্থায়িত্ব থাকবে না, রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে ব্যাপক বাধা আসতে পারে। সে জন্য আমরা বলেছি, অর্থবিল, সংবিধান সংশোধন বিল, আস্থা ভোট এবং জাতীয় নিরাপত্তা বিধানসংশ্লিষ্ট বিষয় বাদে সংসদ সদস্যরা বাকি সব বিষয়ে আলোচনা করতে পারেন।’
সব বিষয়ে গণভোটের প্রয়োজন নেই বলে মনে করে বিএনপি। সালাহউদ্দিন আহমদ বলেন, শুধু রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি বিষয়ে গণভোট হতে পারে। এরপরও ভবিষ্যতে সংসদ যদি কোনো বিষয়ে গণভোট আয়োজনের প্রয়োজনীয়তা মনে করে, তাহলে তারা সেটা চিন্তা করতে পারে। ঢালাওভাবে গণভোট হওয়া অনুচিত হবে। এসব বিষয়ে আলোচনা হয়েছে।
এক প্রশ্নের জবাবে বিএনপির এই নেতা বলেন, আজ জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিল (এনসিসি) নিয়ে আলোচনা হয়নি। তবে দলের পক্ষ থেকে প্রস্তাবগুলোর ওপর যে মতামত দেওয়া হয়েছিল, সেখানে তাঁরা বলেছেন, এই ধারণার সঙ্গে বিএনপি একমত নয়। কারণ, বাংলাদেশে কখনো এনসিসির প্রয়োগ ছিল না। এখন প্রবর্তন করা হলে দেশের রাজনৈতিক ইতিহাস ও সংসদের ইতিহাসে এটা নতুন হবে।
এ প্রসঙ্গে সালাহউদ্দিন আহমদ আরও বলেন, ‘হঠাৎ করে এমন কোনো ব্যবস্থা হলে সেটা অন্যান্য ক্ষেত্রে নির্বাহী বিভাগ ও আইন সভাকে দুর্বল করে দিচ্ছে কি না, রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে, যখন সংসদ থাকবে না অথবা ভেঙে যায়, সে ক্ষেত্রে দেখা যাবে সেই কমিশন খুব বেশি ক্ষমতাপ্রাপ্ত হয়ে অন্য কিছু করে কি না, এগুলো আমরা চিন্তাভাবনা করেছি। তারপরও আমরা বলেছি, বিষয়টা পরবর্তী নির্বাচিত সংসদে বিস্তর আলোচনার মধ্য দিয়ে গ্রহণ করা হবে কি হবে না, সেটা তখন দেখা যাবে। এখন আমরা নীতিগতভাবে একমত নই।’
আগে দ্বিমত ছিল, এখন একমত হয়েছেন, এমন কিছু আছে কি না—এ প্রশ্নের জবাবে সালাহউদ্দিন আহমদ বলেন, ‘অনেক বিষয় আছে। এগুলো কম্পাইল (একসঙ্গে করে) করে আমরা জানাব।’
যেসব বিষয়ে একমত হয়েছেন, তার বাস্তবায়নটা কীভাবে হবে—এ প্রশ্নের জবাবে বিএনপির এই নেতা বলেন, ‘জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের কাজটা কী? সবার সঙ্গে আলোচনা করে জাতীয় ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে যেসব বিষয়ে, সেগুলো একত্র করে ওনারা রিপোর্ট তৈরি করবে। হয়তো যারা যারা একমত হয়েছে, সেই পক্ষগুলোকে স্বাক্ষর হয়তো করতে বলবে। এটাকে ওনারা জুলাই চার্টার বলবে কি না, এটা ওনাদের বিষয়।’
আগামী রোববার বেলা ১১টা থেকে একই স্থানে কমিশনের সঙ্গে বিএনপির আবার আলোচনায় বসার কথা রয়েছে।