সর্বস্তরে বাংলা চাই, কিন্তু ৮ ফাল্গুনকে ২১ ফেব্রুয়ারি হিসেবে মনে রেখেছি
Published: 20th, February 2025 GMT
ভাষাসংগ্রামী আহমদ রফিক। ব্যক্তিজীবনে চিকিৎসক হলেও কবি-প্রাবন্ধিক ও রবীন্দ্র গবেষক হিসেবেই অধিক পরিচিত। ছাত্রজীবন থেকেই তিনি রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। ১৯৫২ সালে মেডিকেল কলেজের ছাত্র থাকাকালীন ভাষা আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা রাখেন। এই ভাষাসংগ্রামী সংরক্ষণ করেছেন ভাষার ইতিহাস। লিখেছেন একুশের উপাখ্যান। ১৯৯৫ সালে একুশে পদকে ভূষিত হন। এ ছাড়া রবীন্দ্রতত্ত্বাচার্য উপাধি পেয়েছেন টেগোর রিসার্চ ইনস্টিটিউট, কলকাতা থেকে। ১৯২৯ সালের ১২ সেপ্টেম্বর তিনি জন্মগ্রহণ করেন। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সমকালের জ্যেষ্ঠ সহসম্পাদক আশিক মুস্তাফা ও সহসম্পাদক এমদাদুল হক মিলটন
সমকাল: ভাষা অন্দোলনের ৭৩ বছর পূর্ণ হলো। ২১ ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃত। আপনারা যে স্বপ্ন নিয়ে ভাষা আন্দোলন করেছিলেন, তার কতটা পূরণ হয়েছে?
আহমদ রফিক: রাষ্ট্রভাষা বাংলা হয়েছে; এটি সাফল্য। কিন্তু আন্দোলনের সময় আমরা তিনটি স্লোগান দিতাম– ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’, ‘রাজবন্দিদের মুক্তি চাই’ ও ‘সর্বস্তরে বাংলা চালু করো’। কিন্তু সর্বস্তরে বাংলা চালু হয়নি। সর্বস্তরে বাংলা চালুকরণের স্লোগানটি বুঝেশুনে দিয়েছি বলে এখন আর আমার মনে হয় না। হয়তো আবেগে বলেছিলাম। তখনকার বাস্তবতাটাও খেয়াল করিনি। ২১ ফেব্রুয়ারি আমরা ৮ ফাল্গুন তো করিনি ওই সময়। করিনি কেন? কেন একুশে ফেব্রুয়ারি করেছি? তার মানে আমাদের জীবনে যে কনট্রাডিকশন, সেটাকে আমরা মান্য করে নিয়েছি। আন্দোলনকালে এবং পরবর্তী সময়ে আমি ঢাকা কলেজ, তৎকালীন জগন্নাথ কলেজসহ যেখানেই বক্তৃতা দিতে গিয়েছি, সেখানেই শিক্ষার্থীদের মা-বাবা বলেছেন, কী সব কথাবার্তা বলেন আপনারা– সর্বস্তরে বাংলা ভাষা চালু করার। এটা আবার চলে নাকি? এখন মনে হয়, তারা তো সঠিক কথাই বলেছিলেন। কোনো কোনো বুদ্ধিমতী নারী বলেছেন, আমরা তো কাজকর্ম সবই করি খ্রিষ্টীয় হিসাবে। যা হোক, রাষ্ট্রভাষা বাংলাটাই হলো; বাকিগুলো আধা আধা হলো। এটা মেনেই আমরা চললাম।
সমকাল: ভাষা আন্দোলন সম্পর্কে আপনার মূল্যবান বেশ কিছু গ্রন্থ রয়েছে। এসব গ্রন্থে ভাষা আন্দোলনের পূর্ণাঙ্গ ইতিহাস পাওয়া যায় না কেন?
আহমদ রফিক: ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস লিখেছি আমি। কিন্তু পূর্ণাঙ্গ ইতিহাস আমার পক্ষে লেখা সম্ভব নয়। এটা একক কোনো ব্যক্তির পক্ষেই সম্ভব নয়। এর জন্য যে পরিমাণ অর্থশক্তি ও জনশক্তি প্রয়োজন, সেটা কোনো একজন ব্যক্তির পক্ষে অসম্ভব। তাছাড়া ইতিহাসের চেয়ে ভাষা আন্দোলনের দলিলপত্রের গুরুত্ব অনেক বেশি। পরবর্তীকালে দলিলপত্রের চরিত্র ও বৈশিষ্ট্য নিয়ে গবেষকরা গবেষণা করতে পারবে।
সমকাল: আপনি বিভিন্ন সময়ে ভাষা আন্দোলনের স্মৃতিবিজড়িত স্থানগুলো সংরক্ষণের কথা বলেছেন। ভাষাসংগ্রামীর তালিকাই যেখানে প্রকাশ করা হয়নি ৭৩ বছরে, সেখানে এসব স্থান সংরক্ষণ তো দূরের বিষয়।
আহমদ রফিক: আমার জানামতে, ভাষাসংগ্রামীর তালিকা করার চেষ্টা চলছে। হাইকোর্ট এটা নিয়ে নির্দেশনাও দিয়েছেন। তাও অনেক আগের কথা। তবে শঙ্কাও আছে, ভাষা আন্দোলনের ৭৩ বছর পরে এই তালিকা কি সঠিকভাবে করা সম্ভব? ভাষাসংগ্রামীদের মধ্যে কতজন জীবিত আছেন? ভাষা আন্দোলনের সত্যিকার ঘটনা এখন আর কোনোভাবেই কি নির্ণয় করা সম্ভব? যারা প্রত্যক্ষদর্শী ও প্রতিবাদকারী তাদের সংখ্যা এখন কত? এই তালিকা প্রণয়নের আগে দরকার ছিল ভাষা আন্দোলনের স্মৃতিবিজড়িত স্থানগুলো সংরক্ষণ করা। এতে আগ্রহীরা গবেষণা করতে পারতেন। আন্দোলন-পরবর্তী সময়ে এই সম্পর্কিত গবেষণায় কেউ কাজ করেন, আবার কেউ করেন না। অপ্রাসঙ্গিক কথা বলি, মানুষ কিন্তু চায় যুগ যুগ ধরে সে জীবিত থাকুক। কীভাবে? সন্তানসন্ততি দিয়ে। পরিবার ও বন্ধুবান্ধবকে দিয়ে। ইতিহাস দিয়ে। ইতিহাস মনে রাখে। আন্দোলন সব সময় হয় না। ট্রোজান যুদ্ধ, দাস বিদ্রোহে কত মানুষ যে মারা গেছে, তার ইয়ত্তা নেই। আন্দোলন সঠিকভাবে পরিচালনা করতে গেলে বিভিন্ন পেশার মানুষ তাতে যদি যুক্ত হন, তাহলে সেটা সঠিক পথে চালিত হওয়ার সম্ভাবনা বাড়ে। আজ যদি এসব স্মৃতি সংরক্ষণ করা যেত তবে গবেষকরা গবেষণা করে আরও অনেক কিছু বের করে আনতে পারতেন। আমার কাছে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী এবং শিক্ষকরা আসে। আমি তাদের বলি এই নিয়ে গবেষণা করতে। গবেষণার বিকল্প কিছুই নেই!
সমকাল: আপনি কখন এবং কীভাবে ভাষা আন্দোলনে জড়িয়েছিলেন; মনে পড়ে?
আহমদ রফিক: ভাষা আন্দোলনের স্মৃতিমেদুরতায় ভুগি সবসময়। আসলে স্কুলজীবন থেকে ছাত্র রাজনীতির সঙ্গে জড়িয়ে পড়ি। সেটা অবিভক্ত বঙ্গে। সে সময় পাকিস্তানপন্থি রাজনীতি করিনি, বাম রাজনীতি করেছি। ১৯৪৭ সালে কলেজ জীবনে এসেও সেই পথে হেঁটেছি। ’৪৯ সালে ঢাকায় এসে স্বভাবতই সব গণআন্দোলনে অংশগ্রহণ করেছি। তারই ধারাবাহিকতায় ভাষা আন্দোলনে যোগ দিই। হয়তো এ জন্যই একুশের আন্দোলন সম্পর্কে শুনতে ভালো লাগে; বলতে ভালো লাগে। তাই নয়? যারা আন্দোলন নিয়ে বলেন, তারা আমার কাছের মানুষ হয়ে যান। তবে একুশ নিয়ে অনেকেই অনেক কিছু লিখছেন, যার সব ঠিক নয়। আমি শুধু একটা উদাহরণ দেব। ভাষা আন্দোলন নিয়ে কেউ কেউ বলেন, ২১ তারিখ সকালবেলায় আমরা মিছিল করে এসেছি। আসলে এটা ভুল তথ্য। একুশের সকালবেলা আমি ও আমার শাহজাদপুরের সিনিয়র বন্ধু বেরিয়ে দেখেছি– চারদিক সুনসান। কিছু নেই। দুই-একটা গরু ও ছাগল চরছে। আর ওই যে দূরে একটি রিকশা ও একজন যুবক যাচ্ছে। হয়তো স্টেশনে যাবে। এ রকম অবস্থার মধ্যে যদি কেউ বলে, আমরা সকালবেলায় স্লোগান দিতে দিতে এসেছি। এটি ভুল। এটি আমি সব সময় বলে এসেছি। আমি জোর গলায় বলতে পারি, যে জন্য আমি এবং আমার সিনিয়র বন্ধু আলী আজগর মিলে যখন গেলাম শহীদ মিনারে, তখন দেখেছি স্লোগান দিয়ে মিছিল আসছে। সেটা হয়েছে সকাল ১০টার পরে। সবাইকে বলা হয়েছিল, যেহেতু ১৪৪ ধারা দেওয়া হয়েছে– স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় থেকে একসঙ্গে না বেরিয়ে দুই-তিনজন করে বের হওয়ার জন্য। যেহেতু চারজনের বেশি হলে ১৪৪ ধারা ভাঙা হয়, সে জন্য দুই-তিনজন করে বেরোনোর কথা আমরা বলেছি। আমার মনে আছে, পেছনের তৎকালীন রেললাইন ধরে অনেকে এসেছিল আমাদের পেছন পেছন। তো এভাবে ঢালাও যা কিছু লিখে দিলাম তা একুশের ইতিহাস হয়ে গেল, সেটা করা ঠিক নয়। লিখতে গেলে তথ্য সংগ্রহ দরকার। দালিলিক প্রমাণের প্রয়োজন পড়ে। কতটা সত্য আছে; সত্য নেই– তা দেখে নেওয়া দরকার। একুশের ইতিহাস লিখতে গেলে সঠিকভাবে লিখতে হবে। সবার কাছে এটিই আমার অনুরোধ।
সমকাল: ২০২৪ সালে জুলাই গণঅভ্যুত্থান হয়েছে। তরুণরা এই আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছে। ভাষা আন্দোলনের সময় আপনারাও তো তরুণ ছিলেন।
আহমদ রফিক: হ্যাঁ, আমরা তরুণ ছিলাম। আমি খুব যে এই বিষয়ে খবর রেখেছি, তা নয়। তবে যে একেবারেই জানি না, তাও না। আমি আমার অভিজ্ঞতার আলোকে বলি, সবার কাছে অনুরোধ– যুগ যুগ ধরে যারাই আন্দোলন করেছেন; আন্দোলনের পরে আন্দোলন করেছেন। তার পরেও আন্দোলন করেছেন। সবার কাছেই আমাদের আহ্বান, সবাই মিলে ঐক্যবদ্ধ হোন। মিলিত হয়ে কাজ করুন। আন্দোলনের যেই ফল তা যেন সঠিকভাবে পরিচালিত হয়। তরুণদের পাশাপাশি যে কোনো আন্দোলনের মতো নিশ্চয় এই আন্দোলনেও বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ যুক্ত ছিলেন। তাই বলি, সব বয়সের মানুষের মাঝে যেন আমরা সংযোগ সেতু তৈরি করতে পারি। এর মধ্যে যাতে ভুলভ্রান্তি যুক্ত না হয়; সেটা দেখা সব মানুষের একান্ত কর্তব্য। এই সংযোগ সেতুটা তৈরি করার জন্য আমি বরাবরই বলি। বলে আসছি। যে ক’দিন বেঁচে আছি বরাবরই বলব যে, মানসিক ঐক্যটা দরকার। এই আন্দোলনটা যাতে ভুল পথে না যায়। সঠিক পথে চলে। সঠিক পরিণামে পৌঁছায়। আমরা এক জাতি এক প্রাণ একতাবদ্ধ হয়ে যদি এগোতে পারি, আমাদের স্বপ্ন কিছু মাত্রায় হলেও সফল হবে।
সমকাল: আপনি রাজনীতি ছেড়ে লেখক জীবন বেছে নিয়েছিলেন একসময়। একজন সার্বক্ষণিক লেখকের জীবনে একাকিত্ব কি দুর্বিষহ?
আহমদ রফিক: এক অর্থে হ্যাঁ। তবে এটা ভালো যে, এখন আগের মতো লোকজন আসছে না। আমিও নিতে পারছি না। এতে পরিশ্রম কমে গেছে। আরেক অর্থে সময়টা অসহনীয়। কেউ আসে না, খোঁজ নেয় না। পৃথিবীতে কেউই হয়তো এ জীবন চায় না!
সমকাল: আপনি পাঁচ মিনিট কথা বলবেন, বলেছিলেন। এখন তো পৌনে এক ঘণ্টা হয়ে গেল। কথা বলতে কষ্ট হচ্ছে?
আহমদ রফিক: বলছিলাম না, ভাষা নিয়ে কেউ কথা বলতে এলে তিনি আমার আপন হয়ে যান। আপনারাও আমার আপন হয়ে গেছেন।
সমকাল: ভাষা প্রসঙ্গে ফিরে আসি। ভাষা, আন্দোলন ও বাংলা নিয়ে যদি কিছু বলেন?
আহমদ রফিক: যুগে যুগে আন্দোলন হয়েছে। আমি দাস বিদ্রোহের কথা বলেছি। এ নিয়ে সিনেমাও হয়েছে। কী ভয়াবহতা! মানুষ যে কত নিষ্ঠুর হতে পারে– সেটার যেমন প্রমাণ পাওয়া যায়। আবার মানুষ যে কতটা মানবিক হতে পারে– সেটাও নানাভাবে মানুষ প্রমাণ করেছে; এটাও বলেছি। আসলে মানবিক হতে গেলে কিছু বিষয় হিসাব করে চলতে হয়। মানুষের মানবিক দিকগুলো আমাদের যে কোনো যুগে হোক না কেন, সেগুলো একটু প্রাধান্য দিয়ে চলতে পারলে ভালো হয় বলে আমি মনে করি। আর সবাইকে আবারও বলি, আন্দোলনের যেই ফল তা যেন সঠিকভাবে পরিচালিত হয়। সঠিক পরিণামে পৌঁছায়। সব বয়সের মানুষের মাঝে যেন আমরা মানসিক সংযোগ সেতু তৈরি করতে পারি। এতে দেশ যেমন এগিয়ে যাবে, তেমনি এগিয়ে যাবে আমাদের বাংলা ভাষাও।
সমকাল: আমাদের সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ।
আহমদ রফিক: আপনাদেরও ধন্যবাদ। সমকালকে ধন্যবাদ। ধন্যবাদ পাঠকদেরও।
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: র জন য র জন ত এক শ র আম দ র কর ছ ন আপন র সমক ল দরক র
এছাড়াও পড়ুন:
৭০০ ব্যান্ডের নিলাম: বিনিয়োগকারীদের উদ্বেগের জবাব দিল সরকার
দেশের টেলিযোগাযোগ খাতে বিনিয়োগ ও প্রযুক্তিগত উন্নয়নের স্বার্থে ৭০০ মেগাহার্টজ ব্যান্ডের নিলামে শর্তসাপেক্ষে ১০ শতাংশ পর্যন্ত মূল্যছাড়ের ইঙ্গিত দিয়েছে সরকার। সেই সঙ্গে স্পেকট্রামের দাম নির্ধারণের বেঞ্চমার্ক ডলারে হওয়াকে বাস্তবসম্মত বলা হয়েছে।
৭০০ মেগাহার্টজ ব্যান্ডে স্পেকট্রাম নিলামের মানদণ্ড নিয়ে দেশের টেলিযোগাযোগ খাতে বৈশ্বিক বিনিয়োগকারীদের উদ্বেগের জবাবে বিভিন্ন বিষয়ের প্রেক্ষাপট ও ব্যাখ্যা তুলে ধরা হয়েছে।
বৃহস্পতিবার (২৭ মার্চ) ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়েছে।
মঙ্গলবার ২৫ মার্চ এ বিষয়ে চিঠি পাঠিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব। তিনি ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে আছেন।
এর আগে ১৬ মার্চ গ্রামীণফোন, রবি ও বাংলালিংকের মূল বিনিয়োগকারীরা ফয়েজ আহমদ তৈয়্যবের কাছে চিঠি দেন। এর জবাবে বিনিয়োগকারীদের কাছে পাঠানো চিঠিতে প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী বলেছেন, ৭০০ মেগাহার্টজ ব্যান্ডের ডিভাইস প্রবৃদ্ধির নিম্নহার বিবেচনায় রেখে সরকার ৫ থেকে ১০ শতাংশ মূল্যছাড়ের বিষয়টি যৌক্তিকভাবে বিবেচনা করতে পারে, যা নির্ভর করবে অপারেটরদের অবকাঠামো উন্নয়ন, নাগরিকদের জন্য মানসম্মত সেবা ও প্রতিযোগিতামূলক মূল্য নির্ধারণের প্রতিশ্রুতির ওপর।
স্পেকট্রাম মূল্য নিয়ে বিনিয়োগকারীদের উদ্বেগের বিষয়ে তিনি বলেছেন, গত তিন বছরে বাংলাদেশি টাকা মার্কিন ডলারের বিপরীতে প্রায় ৪০ শতাংশ অবমূল্যায়িত হয়েছে। এই মুদ্রা অবমূল্যায়ন বিবেচনায় নেওয়ার পর বর্তমান স্পেকট্রাম মূল্যায়ন বাজার পরিস্থিতির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ রয়েছে। বাংলাদেশের টেলিযোগাযোগ খাতে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ বিদেশি মালিকানা আছে এবং বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠানগুলো সাধারণত তাদের মুনাফা মার্কিন ডলারে রেমিট্যান্স করে থাকে। ফলে, স্পেকট্রামের মূল্য নির্ধারণে ডলারভিত্তিক মূল্যায়ন কার্যকর পদ্ধতি, যা মুদ্রা বিনিময় ঝুঁকি কমাবে এবং আন্তর্জাতিক মানদণ্ডের সঙ্গে সামঞ্জস্য রাখবে।
চিঠিতে বলা হয়, অপারেটরদের জন্য পর্যাপ্ত পরিমাণে স্পেকট্রাম সরবরাহ করাকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে দেখে মন্ত্রণালয়। বর্তমানে ৪৫ (২x৪৫) মেগাহার্টজ ব্যান্ডের মধ্যে মাত্র ২৫ (২x২৫) মেগাহার্টজ নিলামে অন্তর্ভুক্ত হওয়ার বিষয়ে যে উদ্বেগ রয়েছে, তাও সরকার গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করছে। বাকি স্পেকট্রাম যথাসময়ে দেওয়ার বিষয়ে কাজ করা হচ্ছে, যেন এটি প্রযুক্তিগত ও বাণিজ্যিকভাবে টেকসই হয়।
ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব বলেন, ফোরজি ও ফাইভজি প্রযুক্তির বিস্তারে ৭০০ ব্যান্ড প্রিমিয়াম ফ্রিকোয়েন্সি, যা প্রযুক্তিগত নিরপেক্ষতার সুবিধা দেয়। বৃহৎ কাভারেজ পরিধি ও নিম্ন ফ্রিকোয়েন্সির কারণে এই ব্যান্ডটি ফোরজি, ফাইভজি এবং আইওটি নেটওয়ার্ক স্থাপনার জন্য অত্যন্ত কার্যকর। বর্তমানে সামগ্রিক ফোরজি হ্যান্ডসেটের প্রায় ৫০ শতাংশ ডিভাইস ৭০০ ব্যান্ড সমর্থন করে। তবে, এই সংখ্যা আরো বাড়াতে বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন একটি গুরুত্বপূর্ণ নীতি নিয়েছে। ফলে, দেশীয় উৎপাদক এবং আমদানিকারকরা এখন থেকে এমন কোনো নতুন মোবাইল হ্যান্ডসেট বাজারে আনতে পারবে না, যা ৭০০ ব্যান্ড সমর্থন করে না।
তিনি আশা করেন, সরকারের এই উদ্যোগ আগামী কয়েক প্রান্তিকের মধ্যে ৭০০ ব্যান্ডে সমর্থিত ডিভাইসের প্রবৃদ্ধি উল্লেখযোগ্যভাবে বাড়াবে, যা ভবিষ্যৎ ফাইভজি সম্প্রসারণ ও ডিজিটাল সংযোগ উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।
চিঠিতে উল্লেখ করা হয়, ‘বাংলাদেশে মোবাইল অপারেটরদের বিভিন্ন ফ্রিকোয়েন্সি ব্যান্ডের ব্যবহারের মধ্যে বৈষম্য রয়েছে। নিম্ন-ফ্রিকোয়েন্সি ব্যান্ডগুলোর ব্যবহার হার ৮৪ থেকে ৯৮ শতাংশ, যেখানে উচ্চ-ফ্রিকোয়েন্সি ব্যান্ডগুলোর ব্যবহার তুলনামূলকভাবে কম, মাত্র ৭ থেকে ১৮ শতাংশ। এই অসমতা নির্দেশ করে যে, উচ্চ ফ্রিকোয়েন্সি ব্যান্ডগুলো ব্যবহারের মাধ্যমে নির্ধারিত এলাকায় সক্ষমতা বৃদ্ধির যে প্রত্যাশা ছিল, তা এখনো পূরণ হয়নি। এর অন্যতম কারণ— যথাযথভাবে বেজব্যান্ড ইউনিট এবং রেডিও রিসোর্স ইউনিট স্থাপনে ঘাটতি আছে, ফলে ধারাবাহিক সক্ষমতা স্তর তৈরি হয়নি। এতে মানসম্মত সেবার ক্ষেত্রে বিঘ্ন সৃষ্টি হয়েছে। ফলে, গ্রাহকরা নিম্নমানের সেবার পাচ্ছেন—যার মধ্যে ধীরগতির ইন্টারনেট, দুর্বল সংযোগের স্থায়িত্ব, মোবিলিটি ও কলড্রপের হার বৃদ্ধি উল্লেখযোগ্য। এছাড়া, উচ্চমূল্যের ইন্টারনেট প্যাকেজের কারণে ইন্টারনেট ব্যবহারের হার বৃদ্ধির পথে বাধা তৈরি হয়েছে। উচ্চ ফ্রিকোয়েন্সি ব্যান্ডগুলোর নিম্ন ব্যবহারের পরিপ্রেক্ষিতে অপারেটররা এখনো গ্রাহকদের জন্য উপযুক্ত মূল্যে ইন্টারনেট প্যাকেজ সরবরাহে আগ্রহ দেখায়নি। পাশাপাশি, জাতীয় ইন্টারনেট প্যাকেজের খুবই স্বল্প মেয়াদী ভ্যালিডিটি ব্যাপক সমালোচনা তৈরি করছে। এটি এমন একটি পরিকল্পিত দুষ্টুচক্রের ইঙ্গিত দেয়, যেখানে অপারেটররা কৃত্রিমভাবে ইন্টারনেট ব্যবহারের প্রবৃদ্ধি সীমিত রেখে চলেছে।
ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব বলেন, জাতীয় সম্পদ হিসেবে স্পেকট্রামের কার্যকর ব্যবহার নিশ্চিত করতে, নিরবচ্ছিন্ন ক্যাপাসিটি লেয়ার তৈরিতে বেজব্যান্ড ইউনিট এবং রেডিও রিসোর্স ইউনিট স্থাপন, ইন্টারনেট খরচ কমানো এবং ডিজিটাল বৈষম্য হ্রাসে সরকার এই খাতের সবার সঙ্গে কার্যকর আলোচনা করে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেবে।
ঢাকা/হাসান/রফিক