আমলাতন্ত্রের দোরগোড়ায় আটকে যায় সব সংস্কার
Published: 20th, February 2025 GMT
বাংলাদেশের রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক সমস্যা সম্পর্কে সবাই কমবেশি অবগত। অনেক আলোচনা হয়েছে। এমনকি তা নিয়ে অর্থনীতিবিদ ও বিশেষজ্ঞদের মধ্যে একধরনের ঐকমত্যও আছে। কিন্তু শেষমেশ কোনো সমাধান খুঁজে পাওয়া যায় না।
দেশে নীতিপ্রণেতা, পরামর্শক ও বাস্তবায়নকারীদের মধ্যে একধরনের দূরত্ব আছে। এমনকি বিদ্যায়তনের মানুষের কথা রাজনীতিবিদেরা মেনে নিলেও কিছু হয় না। তাতে শেষমেশ দেখা যায়, আমলাতন্ত্রের দোরগোড়ায় গিয়ে সব সংস্কার আটকে যায়।
অর্থনীবিদ সেলিম জাহানের দুটি বইয়ের প্রকাশনা অনুষ্ঠানে আজ বৃহস্পতিবার বক্তারা এ কথাগুলো বলেন। বাঙলার পাঠশালা আয়োজিত এই অনুষ্ঠান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আর সি মজুমদার মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত হয়। বই দুটির মধ্যে জাগৃতি প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত হয়েছে‘বাংলাদেশের অর্থনীতি: বর্তমান ও ভবিষ্যৎ’ এবং মাওলা ব্রাদার্স থেকে প্রকাশিত হয়েছে ‘বাংলাদেশ: কনটেমপোরারি ডেভেলপমেন্ট ইস্যুস’।
প্রকাশনা অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন গবেষণাপ্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান রেহমান সোবহান। সভাপতিত্ব করেন ডেইলি স্টার সম্পাদক মাহ্ফুজ আনাম। সঞ্চালনা করেন বাঙলার পাঠশালার প্রতিষ্ঠাতা আহমেদ জাভেদ। আর বক্তব্য দেন সিপিডির সম্মাননীয় ফেলো অধ্যাপক রওনক জাহান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক মাসুদা ইয়াসমিন, সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক রোবায়েত ফেরদৌস, প্রথম আলোর হেড অব অনলাইন শওকত হোসেন প্রমুখ।
রেহমান সোবহান বলেন,‘ দেশের সমস্যা কী এবং তার সমাধনই-ই বা কী, তা নিয়ে এক ধরনের ঐকমত্য আছে। আমরা জানি, স্বাস্থ্য ও শিক্ষা খাতে আরও বিনিয়োগ করা দরকার। কিন্তু শেষমেশ কোনোটি হয় না।’ কেন বারবার অনেক প্রচেষ্টা সত্ত্বেও কোনো সমাধানে পৌঁছানো যায় না, এখন তার ভেতরের গল্প তুলে ধরার আহ্বান জানান তিনি।
পৃথিবীর অনেক দেশে সহিংসতা ও অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বের কারণে অনেক প্রতিষ্ঠান ভেঙে পড়েছে এবং তারপর তারা অনেকেই আবার ঘুরে দাঁড়িয়েছে। সেলিম জাহান বৈশ্বিক পরিসরে কাজ করেছেন। এই পরিপ্রেক্ষিতে রওনক জাহান আহ্বান জানান, তিনি যেন সেই অভিজ্ঞতার আলোকে বাংলাদেশের প্রসঙ্গে লেখেন। অর্থাৎ বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠানগুলো কীভাবে আবার কার্যকর করা যায়, তা বৈশ্বিক অভিজ্ঞতার আলোকে লেখার আহ্বান জানান।
সংস্কার প্রসঙ্গে সব সরকারই বিশেষজ্ঞদের কথা অগ্রাহ্য করেছে বলে অভিযোগ করেন মাহ্ফুজ আনাম। তিনি বলেন, ১৯৯১ সালে প্রধান বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদের নেতৃত্বাধীন প্রথম তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় ২৯টি টাস্কফোর্স গঠনে রেহমান সোবহান যুক্ত ছিলেন। টাস্কফোর্সগুলোর উদ্দেশ্য ছিল অর্থনীতি ও প্রশাসনপ্রক্রিয়ার নানা সমস্যার সমাধান করা। টাস্কফোর্সগুলোয় ছিলেন সেই সময়কার দেশের ২৫৫ জন সেরা পেশাদার ব্যক্তি। কিন্তু সেই টাস্কফোর্সের প্রতিবেদন পরবর্তী অর্থমন্ত্রী সাইফুর রহমান সম্ভবত পড়েও দেখেননি।
আলোচনায় অংশ নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের শিক্ষক ও গবেষণাপ্রতিষ্ঠান সানেমের নির্বাহী পরিচালক সেলিম রায়হান চলমান সংস্কারের গতি-প্রকৃতি নিয়ে কথা বলেন। তিনি বলেন, সংস্কারের চাপ দেওয়ার জন্য সমাজে নানা রকম গোষ্ঠী আছে, বিষয়টি সে রকম নয়। বরং নির্দিষ্ট কিছু গোষ্ঠী ছাড়া সমাজে আরও কেউ সংস্কার চায়, তেমনটা মনে হচ্ছে না।
সংস্কার প্রসঙ্গে বক্তারা বলেন, এ বিষয়ে বৃহত্তর ঐকমত্য দরকার, তা না হলে কোনো উদ্যোগই আলোর মুখ দেখবে না। এর আগে ২০০৭ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারে আমলেও সংস্কার নিয়ে অনেক আলোচনা হয়েছে। কিছু কাজ সেই সরকার করেছিল; কিন্তু শেষমেশ তার কিছুই টেকেনি।
বই দুটি নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে সেলিম জাহান বলেন, এগুলো গবেষণাধর্মী বই নয়। একদম সাধারণ মানুষ যেন পড়ে বাংলাদেশের অর্থনীতির হালচাল বুঝতে পারেন, সে উদ্দেশ্যে এই বই দুটি লেখা।
আলোচনায় প্রথম আলোর হেড অব অনলাইন শওকত হোসেন বলেন, বাংলোদেশের অর্থনীতির বর্তমান ও ভবিষ্যৎ বইটি সাংবাদিকদের পড়া উচিত। উন্নয়ন ও অগ্রগতির মধ্যে কী ফারাক, তা বোঝার জন্য এই বই পড়া জরুরি।
.উৎস: Prothomalo
এছাড়াও পড়ুন:
এনসিপির প্রস্তাব: ভোটারের বয়স ১৬, প্রার্থীর ২৩
ভোটার হওয়ার বয়স ১৮ থেকে কমিয়ে ১৬ করার প্রস্তাব করবে জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)। নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার ন্যূনতম বয়স ২৫ থেকে কমিয়ে ২৩ করারও প্রস্তাব দেবে নতুন দলটি। দলটির ভাষ্য, শেখ হাসিনার পতন ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে ঘটিয়েছে জেন-জি। তাদের এত বড় অংশীদারিত্বের পরও শুধু বয়সের কারণে মতামতের প্রতিফলন ঘটাতে না পারাটা হবে অযৌক্তিক।
গতকাল শনিবার রাজধানীর বাংলামটরে এনসিপির কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলনে দলটির নেতারা এ অবস্থান তুলে ধরেন। আজ রোববার দুপুরে অন্তর্বর্তী সরকারের জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের কাছে সংস্কার প্রস্তাব জমা দেবে দলটি।
অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস রাষ্ট্র সংস্কারে ১১টি কমিশন গঠন করেন। ছয়টি কমিশনের প্রতিবেদনে কীভাবে কতটুকু সংস্কার হবে, তার সুপারিশ রয়েছে। ঐকমত্য কমিশন ৬ মার্চ সংবিধান, নির্বাচন ব্যবস্থা, জনপ্রশাসন, দুর্নীতি দমন ও বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশনের গুরুত্বপূর্ণ ১৬৬ সুপারিশের বিষয়ে মতামত চেয়ে ৩৭টি রাজনৈতিক দলকে ‘স্প্রেডশিট’ পাঠায়।
সংবাদ সম্মেলনে এনসিপির সংস্কার সমন্বয় কমিটির সমন্বয়ক এবং যুগ্ম আহ্বায়ক সারোয়ার তুষার বলেন, সংবিধান সংস্কার কমিশন চায় সংসদ নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার ন্যূনতম বয়স ২১ বছর। এনসিপি মনে করে, এটা ২৩ বছর হতে পারে। সে ক্ষেত্রে ভোট দেওয়ার বয়স ১৬ বছর হতে পারে। লাতিন আমেরিকা, অস্ট্রিয়াসহ বিভিন্ন দেশে ১৬ বছর বয়সে ভোট দেওয়ার নজির রয়েছে।
সংস্কার কীভাবে বাস্তবায়ন করা যাবে– এ-সংক্রান্ত বিকল্প দিয়েছে ঐকমত্য কমিশন। সারোয়ার তুষার বলেন, যেসব সংশোধনীর ক্ষেত্রে সংবিধানের সম্পর্ক নেই, সেগুলো নির্বাচনের আগে অধ্যাদেশ কিংবা প্রশাসনিক ব্যবস্থার মাধ্যমে করা যেতে পারে। এনসিপি শুরু থেকেই গণতান্ত্রিক সংবিধান বা সংবিধান পুনর্লেখন চায়। এ জন্য দলটি চাইছে গণপরিষদ নির্বাচন।
সংস্কার প্রস্তাবের ক্ষেত্রে শহীদ পরিবার এবং আহতদের আকাঙ্ক্ষা জানতে চেয়েছেন বলে জানান সারোয়ার তুষার। তিনি বলেন, একজন শহীদের মা বলেছেন– পুলিশ যেন কোনো আন্দোলনে গুলি চালাতে না পারে। এ মতামতের প্রতিফলন ঘটানোর চেষ্টা করবে এনসিপি।
১৬৬ সুপারিশের বিষয়ে এনসিপি বলছে, কোনো ক্ষেত্রে আমরা পুরোপুরি, কোনো ক্ষেত্রে আংশিক, কিছু ক্ষেত্রে আমরা একমত হতে পারিনি। আবার কিছু ক্ষেত্রে বাড়তি মন্তব্য প্রয়োজন মনে হয়েছে। তা আমরা বিস্তারিত লিখিতভাবে জমা দেব।
সারোয়ার তুষার বলেন, ১৬৬ সুপারিশের মধ্যে ১১১টি সংলাপ ছাড়াই বাস্তবায়ন সম্ভব বলে কমিশন মনে করছে। কীসের ভিত্তিতে আলোচনা ছাড়া ১১১টি বাছাই করলেন তারা। এ ছাড়া স্থানীয় সরকার এবং পুলিশ সংস্কার প্রস্তাব কেন স্প্রেডশিটে নেই– তা জানতে চাইব।
সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন এনসিপির যুগ্ম আহ্বায়ক এবং সংস্কার সমন্বয় কমিটির সদস্য মনিরা শারমিন, জাবেদ রাসিন, যুগ্ম সদস্য সচিব সালেহ উদ্দিন সিফাত ও সংগঠক আরমান হোসাইন।