চট্টগ্রাম মহানগরকে জলাবদ্ধতামুক্ত করতে হাজার হাজার কোটি টাকার প্রকল্পের কাজ চলছে কয়েক বছর ধরে। সেনাবাহিনীর ৩৪ ইঞ্জিনিয়ার কনস্ট্রাকশন ব্রিগেডের সহযোগিতা নিয়ে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (সিডিএ) এই প্রকল্প বাস্তবায়নের কাজ করছে। এই প্রকল্পের প্রথম সংশোধিত ডিপিপি অনুযায়ী কাজগুলো সম্পন্ন হলে বন্দর নগরের বেশি কিছু অঞ্চল জলাবদ্ধতার কবল থেকে রেহাই পাবে বলে আশা করছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। এই স্বপ্নে দিন গুনছে এখানে বসবাসকারী প্রায় ৭০ লাখ মানুষ।

এখন বসন্তকাল। শুষ্ক মৌসুমের দিন শেষ হতে চলেছে। এবার বৃষ্টির মৌসুম এলে আগের মতো জনজীবন ডুবিয়ে দেওয়ার মতো পরিস্থিতি সৃষ্টি হবে না বলে স্বপ্ন দেখছে তারা। কিন্তু পরিবেশবাদী, নগর পরিকল্পক ও অভিজ্ঞজনেরা বলছেন ভিন্ন কথা। তাঁরা বলছেন, জলাবদ্ধতা নিরসনের কাজ শেষ হলে প্রথম কয়েক বছর হয়তো মানুষ কিছুটা স্বস্তিতে থাকবেন। কিন্তু কয়েক বছরের মধ্যে আবার পুরোনো জটিল অবস্থায় ফিরে যাওয়ার আশঙ্কা খুব বেশি। কারণ, জলাবদ্ধতার অন্যতম প্রধান কারণ বর্জ্য। চট্টগ্রামের বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় চলছে চরম নৈরাজ্য ও বিশৃঙ্খল অবস্থা। এটাকে শৃঙ্খলায় আনতে না পারলে, সুষ্ঠু নিয়মের মধ্যে আনা না গেলে ক্রমবর্ধমান বর্জ্যের বিশাল স্তূপ নদী, খালগুলো অচিরেই ভরাট হয়ে পূর্বাবস্থায় ফিরে যাবে। ফলে প্রকল্পের বিশাল কর্মযজ্ঞ ব্যর্থতায় পর্যবসিত হবে।

স্থানীয় একটি পত্রিকার খবর অনুযায়ী চট্টগ্রামে বছরে ১৮ লাখ ৯০ হাজার ৭০০ টন বর্জ্য উৎপাদন হয়। ৯ লাখ ১৩ হাজার ৭০০ টন বর্জ্য সিটি করপোরেশন সংগ্রহ করলেও বাকি প্রায় ১০ লাখ টন বর্জ্য নালা-খালে পড়ছে। সেখান থেকে যাচ্ছে কর্ণফুলীতে। শুধু নগর নয়, কর্ণফুলী নদী সংলগ্ন গ্রাম এলাকার বর্জ্যও এসে পড়ছে খাল ও নদীতে। বর্জ্যের পরিমাণ দিন দিন বাড়ছে। এই সব বর্জ্যের বেশির ভাগই অপচনশীল পলিথিন, প্লাস্টিক। শুধু মানুষের ব্যবহার্য বর্জ্য নয়, কর্ণফুলীর তীরে তীরে কাপ্তাই থেকে পতেঙ্গা পর্যন্ত ৮০ কিলোমিটার জুড়ে অন্তত ৩০০টি কারখানা বা শিল্প স্থাপনা রয়েছে। এর মধ্যে অন্তত ৮৪টি কারখানার বর্জ্য সরাসরি নদীতে ফেলা হচ্ছে। কারখানার বিষাক্ত রাসায়নিকের মিশ্রণে সীতাকুণ্ডের কুমিরা খালের পানি মারাত্মক দূষিত হয়ে পড়েছে। এতে করে জমির ফসল নষ্ট হচ্ছে। মানুষ আক্রান্ত হচ্ছে রোগে।

সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ এমন ক্ষতিকর কর্মকাণ্ডের দিকে নজর না দেওয়ায় কুমিরা খালে কারখানা বেড়েই চলেছে। ফলে বর্জ্যও বাড়ছে। এই বিপুল পরিমাণ বর্জ্যের কারণে খনন করা খালগুলো ভরাট হতে খুব বেশি দিন সময় লাগার কথা নয়। ইতিমধ্যে আমাদের পরিবেশ–প্রতিবেশের মারাত্মক ক্ষতি সাধন করেছে এই সব বর্জ্য। দূষণের কবলে পড়ে কর্ণফুলী, আনোয়ারা, পটিয়া, বাঁশখালী, রাঙ্গুনিয়া, সীতাকুণ্ডসহ বিভিন্ন উপজেলায় খাল নদীগুলোও ভরাট হয়েছে। ক্ষীণ হয়েছে এসবের স্রোতোধারা। শুকনা মৌসুমে সেচ ও গৃহস্থালির কাজের জন্য পানির উৎস কমছে অথচ বর্ষায় শুরু হয় জলাবদ্ধতার ভোগান্তি।

কর্ণফুলীর দুই তীরের নগর ও গ্রামের মানুষের একই রকম ভোগান্তি শুরু হলো। বর্জ্যের কারণে ক্রমেই মুমূর্ষু হয়ে পড়ছে নদীটি। তার জীববৈচিত্র্য কমছে। ইতিমধ্যে ৩৫ প্রজাতির মাছ হারিয়ে গেছে এই নদীর কোল থেকে। মাছ কমে যাওয়া মানে শুধু জীববৈচিত্র্য কমে যাওয়া নয়। এর সঙ্গে যুক্ত রয়েছে শত শত মানুষের জীবিকা। বহু বছর ধরে কর্ণফুলীর তীরেই গড়ে উঠেছে ৫০টির মতো জেলেপল্লি। কর্ণফুলীর দূষণে সবচেয়ে বেশি শঙ্কিত এই সব পেশাজীবী মানুষ।

গ্রামের খালগুলো মানুষের বর্জ্যে ভরে যাচ্ছে। আর শহরের খালগুলো ভরাট হয়ে এখন রাস্তাও দখল করেছে। শহরের প্রায় সব গুরুত্বপূর্ণ বাঁকে কিংবা মোড়ে বর্জ্যের ভাগাড় পরিপূর্ণ থাকে। অনেক সড়কের অর্ধেক অংশ জুড়ে দিনরাত পড়ে থাকে আবর্জনা। ১৮৬৩ সালে নগর হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়ার পর ১৬২ বছর অতিক্রম করেছে চট্টগ্রাম মহানগর। দেড় শ বছরের বেশি সময়ে একটা নিজস্ব বিজ্ঞান ও স্বাস্থ্যসম্মত পরিবেশবান্ধব বর্জ্য ব্যবস্থাপনা গড়ে তুলতে পারিনি আমরা। এটা আমাদের জন্য লজ্জা ও দুঃখের ব্যাপার।

নগরের জলাবদ্ধতা নিরসনের প্রকল্পের নাম ‘চট্টগ্রাম শহরের জলাবদ্ধতা নিরসনকল্পে খাল পুনঃখনন, সম্প্রসারণ, সংস্কার ও উন্নয়ন। এই প্রকল্পের ব্যয় বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৮ হাজার ৬০০ কোটি টাকা। বর্জ্য ব্যবস্থাপনার দুর্বলতার কারণে এত বিপুল পরিমাণ টাকা ব্যয়ের পর যদি জলাবদ্ধতার স্থায়ী কোনো সমাধান না হয়, তবে তা হবে সত্যিকারের এক দুর্ভাগ্যের ব্যাপার। এই দুর্ভাগ্য সহ্য করা যাবে না। সুতরাং আগে থেকেই আমাদের সতর্ক হওয়া খুব জরুরি। জলাবদ্ধতার নিরসন প্রকল্পের সঙ্গে যুক্ত করতে হবে বর্জ্য ব্যবস্থাপনার আধুনিকায়ন। নতুন রাষ্ট্রকাঠামোতে সব ক্ষেত্রে সংস্কারের আওয়াজ উঠেছে। সেই আওয়াজ যেন এ রকম মৌলিক বিষয়গুলোকেও স্পর্শ করলেই সংস্কার মানুষের চোখে মূর্ত হয়ে উঠবে।

আশার কথা, সরকার ইতিমধ্যে চট্টগ্রামের এই প্রধান সংকট নিয়ে মাথা ঘামাতে শুরু করেছে। সরকারের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা ইতিমধ্যে চট্টগ্রামের খাল নদী ও চলমান প্রকল্পের কাজ সরেজমিন দেখে যান। দেখার পর গত ১৯ জানুয়ারি চট্টগ্রাম সার্কিট হাউসে অন্তর্বর্তী সরকারের বিদ্যুৎ, জ্বালানি, সড়ক, সেতু ও রেলওয়ে বিষয়ক উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান সরকারি দপ্তর ও সংস্থা, শিক্ষক, গবেষকসহ অন্য অংশীজনদের সঙ্গে চট্টগ্রাম সার্কিট হাউসে মতবিনিময় সভায় মিলিত হন। তাঁরা জলাবদ্ধতার কারণ চিহ্নিত করেন। কী করতে হবে, তা–ও নির্ধারণ করেন।

নির্ধারিত কাজগুলো হলো চট্টগ্রাম শহরের সব ধরনের পাহাড় কাটা বন্ধ করা, চট্টগ্রাম শহরের প্রাইমারি, সেকেন্ডারি ও টারশিয়ারি ড্রেনগুলো পরিষ্কারের ব্যবস্থা নেওয়া, পানিনিষ্কাশনের জন্য নির্মাণাধীন স্লুইসগেট–রেগুলেটরগুলোর নির্মাণকাজ দ্রুত সম্পন্ন করা, চট্টগ্রাম শহরের খালগুলো পরিষ্কার করা, খালগুলো অবৈধ দখলমুক্ত করে এগুলোর খননকাজ দ্রুত সম্পন্ন করা, যেখানে–সেখানে ময়লা ফেলা বন্ধ করার প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেওয়া, কর্ণফুলী নদীর প্রয়োজনীয় নাব্যতা ও গভীরতা বজায় রাখার জন্য মেইনটেন্যান্স ড্রেজিং করা এবং জলাবদ্ধতার হটস্পটগুলোয় পাম্পহাউস চালু করা।

এই বৈঠকে যা আলোচিত হয়েছে, তাতে চট্টগ্রামের মানুষের মনের কথাই প্রতিধ্বনিত হয়েছে। যদি এই সব অতি জরুরি করণীয় সত্যি সত্যিই বাস্তবায়িত হয়, তবেই হবে প্রকৃত সংস্কার। এ রকম সংস্কারই সবার কাম্য। সরকারের সদিচ্ছা থাকলে যেকোনো অসম্ভবকে সম্ভব করে তুলে পারে। এই সব কাজকে সমর্থন দিতে মানুষ সব সময় প্রস্তুত। নতুন শতাব্দীর উপযোগী একটি উন্নত বর্জ্য ব্যবস্থাপনা চট্টগ্রামকে পরিণত করতে পারে পরিবেশবান্ধব একটি শহরে। যে শহর অবাধে ঘটবে সবুজের বিস্তার। পাহাড়ে, সমুদ্রে, নদীতে চট্টগ্রাম হয়ে উঠতে পারে পৃথিবীর সেরা শহরগুলোর একটি।

ওমর কায়সার প্রথম আলোর চট্টগ্রামের বার্তা সম্পাদক

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: প রকল প র ন বর জ য র বর জ য বর জ য র পর ব শ র জন য সরক র

এছাড়াও পড়ুন:

বীরশ্রেষ্ঠ মুন্সী আব্দুর রউফের সমাধিতে বিজিবির শ্রদ্ধা

মহান স্বাধীনতা ও জাতীয় দিবস উপলক্ষে রাঙামাটির নানিয়ারচরের বুড়িঘাটে বীরশ্রেষ্ঠ মুন্সী আব্দুর রউফের সমাধিতে বর্ডার গার্ড বাংলাদশ (বিজিবি) এর পক্ষ থেকে গভীর শ্রদ্ধা জানানো হয়েছে।  

বুধবার (২৬ মার্চ) সকালে বুড়িঘাটে বীরশ্রেষ্ঠের সমাধিতে পুষ্পস্তবক অর্পণ করা হয়। স্বাধীনতার এই বীর সেনানীর সমাধীতে বিজিবি মহাপরিচালকের পক্ষে পুষ্পস্তবক অর্পণ করেন রাঙামাটির সেক্টর কমান্ডার কর্নেল মোহাম্মদ ইফতেখার হোসেন। এরপর রাঙামাটি সদর সেক্টরের পক্ষে পুষ্পস্তবক অর্পন করা হয়। 

এসময় বিজিবির কাপ্তাই জোন কমান্ডার লেফটেন্যান্ট কর্নেল কাওসার মেহেদী, বীরশ্রেষ্ঠ মুন্সী আব্দুর রউফের ছিন্নভিন্ন দেহ সমাহিত করা ও শনাক্তকারী দয়াল কৃঞ্চ চাকমা, বীরশ্রেষ্ঠ মুন্সী আব্দুর রউফ ফাউন্ডেশনের উদ্যোক্তা ও পরিচালক ইয়াসিন রানা সোহেলসহ অন্যান্যরা উপস্থিত ছিলেন।  

এসময় বিউগলের করুণ সুর বাজিয়ে সশস্ত্র সালাম প্রদান করে গভীর শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করা হয় জাতির এই সূর্য সন্তানকে। এছাড়া, বীরশ্রেষ্ঠের আত্মার প্রতি শান্তি কামনা করে মোনাজাত করা হয়। পরে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, সামাজিক সংগঠনের পক্ষ থেকে পুষ্পমাল্য অর্পণ করা হয়। পরে দয়াল কৃঞ্চ চাকমাকে আর্থিক অনুদান প্রদান করেন বিজিবি রাঙামাটির সেক্টর কমান্ডার।   

এদিকে, মহান স্বাধীনতা ও জাতীয় দিবস উপলক্ষে রাঙামাটিতে নানা আনুষ্ঠানিকতা পালন করা হয়।

ঢাকা/শংকর হোড়/ইভা 

সম্পর্কিত নিবন্ধ