চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডের সমুদ্র উপকূলের ১০ কিলোমিটারের বেশি এলাকায় চলছে নির্বিচার বালু উত্তোলন। সাগরের মধ্যে ড্রেজার বসিয়ে এই বালু তোলা হচ্ছে। সাগর থেকেই এসব বালু নৌযানে করে বিক্রি হচ্ছে। মূলত বিকেল থেকে রাতভর চলে বালু তোলার কাজ। নির্বিচার বালু তোলার কারণে সীতাকুণ্ডের কুমিরার আলেকদিয়া থেকে শুরু করে দক্ষিণে চার কিলোমিটার বেড়িবাঁধ ইতিমধ্যে বিলীন হয়ে গেছে। হুমকিতে পড়েছে উপকূলের জনবসতি।

বালুমহাল ও মাটি ব্যবস্থাপনা আইন ২০১০ অনুযায়ী, বালু বা মাটি উত্তোলনের ক্ষেত্রে যথাযথভাবে ঢাল সংরক্ষণ করতে হবে। সুষম স্তরে খনন করা যায় তেমন ড্রেজার ব্যবহার করতে হবে। এ জন্য যথাযথ কর্তৃপক্ষের অনুমতিও নিতে হবে। তবে এ নিয়ম মানা হচ্ছে না। নেওয়া হচ্ছে না অনুমতি। কারখানা ও জাহাজভাঙা ইয়ার্ড সচল করার নামে বালু তোলা হলেও আদতে সেখানে বালুর ব্যবসা চলছে বলে অভিযোগ করেছেন উপকূলের বাসিন্দারা।

জানতে চাইলে পরিবেশ অধিদপ্তর চট্টগ্রাম অঞ্চলের পরিচালক মো.

নুর আলম বলেন, ‘বালু তোলার বিষয়টি সাধারণত এসি ল্যান্ড দেখবেন। আমরাও অভিযান করি। তবে সে ক্ষেত্রে উপজেলা প্রশাসনের সাহায্য নিতে হয়।’

বালু উত্তোলনের কথা স্বীকার করে সীতাকুণ্ড উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা কে এম রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘দুটি প্রতিষ্ঠান বন্দর থেকে বালু তোলার অনুমতি পেয়েছে বলে আমাকে জানিয়েছে। তবে সেগুলো সঠিক কি না, তা যাচাই করে দেখা হয়নি। বন্দর থেকেও কারা কারা বালু তোলার অনুমতি পেয়েছে, সে বিষয়ে কোনো চিঠির অনুলিপি আমাদের দেওয়া হয়নি। সে জন্য অভিযানও করা হয়নি।’

কারখানা ও ইয়ার্ড সচল রাখার জন্য বালু উত্তোলনের অনুমতি দেওয়া হলেও তা বিক্রি করা যাবে না বলে জানিয়েছে বন্দর কর্তৃপক্ষ। চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের চিফ হাইড্রোগ্রাফার কমান্ডার মোহাম্মদ শামসিত তাবরীজ প্রথম আলোকে বলেন, ‘কিছু প্রতিষ্ঠানকে আমরা তাদের কারখানা কিংবা ইয়ার্ড সচল রাখার স্বার্থে অনুমতি দিয়েছি, কিন্তু তা বাণিজ্যিকভাবে বিক্রির জন্য নয়। তবে অনেকে অবৈধভাবে বালু উত্তোলন করছে। তা বাণিজ্যিকভাবে বিক্রিও করছে। তাদের বিরুদ্ধে অভিযান অব্যাহত রয়েছে।’

জাহাজভাঙা ইয়ার্ডে বালুর ব্যবসা

বাংলাদেশ শিপ ব্রেকার্স রিসাইক্লিং অ্যাসোসিয়েশন সূত্র জানায়, দেড় শতাধিক ইয়ার্ডের মধ্যে বর্তমানে ৩৫টির মতো সচল রয়েছে। কিন্তু জাহাজ আছে ১০ থেকে ১৫টিতে। ব্যবসার মন্দাভাব চলছে দীর্ঘদিন ধরে। এখন জাহাজ আনার বদলে ইয়ার্ড সচল রাখার নাম দিয়ে বালু উত্তোলনে ঝুঁকেছেন ইয়ার্ডের মালিকেরা। চর জেগে ওঠার কারণে জাহাজ ভিড়তে পারে না বলে অজুহাত দেন ইয়ার্ডের মালিকেরা। এই অজুহাতে তারা বালু তোলেন। তবে এ ক্ষেত্রে সবাই অনুমতি নেন না।

বর্তমানে শামা ইন্টারন্যাশনাল, রাইজিং স্টিল, সেভেন বিসহ বিভিন্ন ইয়ার্ড এখন এই বালু তোলার ব্যবসায় নেমেছে। অবৈধভাবে বালু তোলার দায়ে কুমিরা ঘাটসংলগ্ন ডব্লিউ ডব্লিউ ট্রেডিং নামে জাহাজভাঙা ইয়ার্ডকে তিনবার জরিমানা করা হয়েছিল। তবে এরপরও বালু উত্তোলন চলছে।

যেভাবে হাতবদল বালুর ব্যবসা

১০ বছর ধরে সীতাকুণ্ডে বালু তোলার কাজ চলছে। তখন উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সাবেক সংসদ সদস্য এস এম আল মামুন এবং তাঁর অনুসারীরা এই কাজে জড়িত ছিলেন। ৫ আগস্ট ক্ষমতার পটপরিবর্তনের পর বালু তোলা এবং বেচাবিক্রি চলে গেছে বিএনপি ও জামায়াত নেতাদের হাতে।

এর আগে আওয়ামী লীগ আমলে এস এম আল মামুন ও তাঁর অনুসারী বাঁশবাড়িয়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান শওকত আলী জাহাঙ্গীর ও বাড়বকুণ্ড ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ছাদাগাত উল্লাহ মিয়াজীর বিরুদ্ধে বালুর ব্যবসা নিয়ন্ত্রণের অভিযোগ ছিল। এ ছাড়া মাদার স্টিলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আবুল কাশেমও বালু তুলতেন। অবৈধভাবে বালু তোলার দায়ে ২০২২ সালে এই চারজনকে পরিবেশ অধিদপ্তর জরিমানা করেছিল।

এখন বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব আসলাম চৌধুরীর ভাই আমজাদ হোসেন চৌধুরীর নিয়ন্ত্রণে বালু তোলার কাজ চলছে বলে অভিযোগ। তবে আমজাদ চৌধুরী দাবি করেছেন, তিনি অনুমতি নিয়ে কুমিরা এলাকায় বালু তুলছেন। বালু উত্তোলনে খরচ পড়ে প্রতি ফুট সাড়ে তিন টাকা। বিক্রি করা হয় প্রতি ফুট সাড়ে সাত থেকে আট টাকা।

সরেজমিনে দেখা যায়, কুমিরা ঘাট, আলেকদিয়া ও আকিলপুর এলাকায় দেখা যায়, উপকূলের পানিতে পাঁচ–ছয়টি ড্রেজার দিয়ে বালু তোলার কাজ চলছে। বালু তুলে তা ভাসমান বাল্কে রাখা হয়। এরপর আমজাদ চৌধুরীর মালিকানাধীন তিনটি শিপব্রেকিং ইয়ার্ডে এই বালুগুলো খালাস করা হয়। সেখান থেকে বালু বিক্রি চলে। এই তিনটি ইয়ার্ড হচ্ছে ‘বারআউলিয়ার রাইজিং এন্টারপ্রাইজ’ ও ‘রাইজিং অ্যাডভান্স’ এবং ‘কুমিরার সেভেন বি ইয়ার্ড’। ‘রাইজিং স্টিল’ এবং ‘প্রিমিয়ার এলপি গ্যাস লিমিটেড’ নামে বালু তোলার দুটি অনুমতিপত্র রয়েছে আমজাদ চৌধুরীর।

আমজাদের হয়ে এসব কাজ তদারক করেন বাপ্পি ও বাবুল নামের দুই ব্যক্তি। এ ছাড়া সোনাইছড়ি এলাকায় মো. রবিউল নামে স্থানীয় এক বিএনপি নেতা বালু তোলার তদারক করেন।

অভিযোগ প্রসঙ্গে রাইজিং গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আমজাদ চৌধুরী বলেন, ‘দুটি অনুমতিপত্রের অধীনে আমার তিনটি ড্রেজার রয়েছে। ইয়ার্ডের উন্নয়নের জন্য এবং গ্যাস ফিল্ডের রক্ষণাবেক্ষণের জন্য এই বালু তোলা হচ্ছে। অন্য কারা কীভাবে বালু তুলছে জানি না।’

দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সমুদ্রবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মো. শাহনেওয়াজ চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, অপরিকল্পিতভাবে যদি বালু তোলা হয়, তাতে বেড়িবাঁধ ঝুঁকিতে পড়বে। এভাবে নির্বিচার বালু উত্তোলন বন্ধ করা জরুরি।

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: আমজ দ চ ধ র ব ল র ব যবস উপক ল র এই ব ল র জন য এল ক য় সচল র

এছাড়াও পড়ুন:

ঈদের জামাত নিয়ে কথা কাটাকাটির জেরে ছুরিকাঘাত, নিহত ১

হবিগঞ্জের নবীগঞ্জ উপজেলায় এক মসজিদে ঈদের জামাত নিয়ে কথা কাটাকাটির জেরে ছুরিঘাতে আব্দুল কাইয়ুম (৫৫) নামে এক ব্যক্তি নিহত হয়েছেন। শুক্রবার রাতে উপজেলার দেবপাড়া ইউনিয়নের সদরঘাট দক্ষিণ পাড়া জামে মসজিদের মধ্যে তারাবি নামাজে কথা কাটাকাটির জেরে এই ঘটনা ঘটনা বলে জানা গেছে।

নিহত আব্দুল কাইয়ুম দেবপাড়া ইউনিয়নের সদরঘাট দক্ষিণ পাড়ার মজুদ উল্লাহর ছেলে। আর ছুরিকাঘাতে অভিযুক্ত ব্যক্তির নাম মুজাহিদ আলী (৩৫)। তিনি একই গ্রামের কাজী সুন্দর আলীর ছেলে।

স্থানীয়রা জানান, মসজিদের মধ্যে তারাবি নামাজের সময় আব্দুল কাইয়ুম ও মুজাহিদ আলীর কথা কাটাকাটি হয়। পরে বাড়ি ফেরার পথে কাইয়ূমকে ছুরিকাঘাত করেন মুজাহিদ আলী। এতে সে গুরুতর আহত হলে তাকে সিলেট ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে রাত ১২টার দিকে মারা যান তিনি। এ ঘটনাটি নিয়ে এলাকায় চরম উত্তেজনা বিরাজ করছে।

স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান শাহ রিয়াজ নাদির সুমন বলেন, দুইজনের মধ্যে ঈদের জামাত সংক্রান্ত বিষয় নিয়ে কথা কাটাকাটির জেরে এ ঘটনা হয়েছে বলে শুনেছি। আমি ঘটনাস্থলে যাচ্ছি।

নবীগঞ্জ থানার ওসি কামাল হোসেন সমকালকে বলেন, আমি এখন ঘটনাস্থলে আছি। পুলিশ এলাকার পরিস্থিতি স্বাভাবিক করেছে। নিহতের মরদেহ থানায় নেওয়া হবে, তারপর সুরতহাল করে হবিগঞ্জ সদর হাসপাতাল মর্গে পাঠানো হবে।

সম্পর্কিত নিবন্ধ