অনেক সময় আমাদের শরীরের বিভিন্ন হাড়ে অতিরিক্ত হাড় গজায়। এর মধ্যে ক্যালকেনিয়াম (পায়ের হাড়) অন্যতম। এ বাড়তি হাড় গোড়ালির নিচে ও পেছনে গজায়। একে ক্যালকেনিয়াম স্পার বলে। গোড়ালির সবচেয়ে বড় হাড় ক্যালকেনিয়াম, যা দাঁড়ালে বা হাঁটলে প্রথম মাটির সংস্পর্শে আসে ও শরীরের পূর্ণ ওজন বহন করে। এর যেকোনো ক্ষুদ্র অসংগতিতেও বিভিন্ন ধরনের উপসর্গ দেখা দেয়। ফলে স্বাভাবিকভাবে হাঁটা যায় না ও খুঁড়িয়ে হাঁটতে হয়।

 

গোড়ালির হাড় বাড়ে কেন

বলা হয়, অসংগতিপূর্ণ জুতা পরলে ক্যালকেনিয়াম স্পার হয়।

পায়ের পেশি দুর্বল হলে পায়ের ওপর বাড়তি চাপ পড়ে। ফলে স্পার তৈরি হয়।

দীর্ঘদিন ধরে প্লান্টার ফাসা ও টেনডনের প্রদাহ হলে গোড়ালিতে অতিরিক্ত হাড় গজায়।

শরীরে অতিরিক্ত ওজন থাকলে স্পার হওয়ার আশঙ্কা থাকে।

বিভিন্ন ধরনের আর্থ্রাইটিসে হিল স্পার হতে পারে।

অনেকের এ সমস্যা বংশানুক্রমিকভাবে হতে পারে।

লক্ষণ

প্রধান উপসর্গ হলো ব্যথা। সকালে ঘুম থেকে ওঠার পর বা অনেকক্ষণ বসার পর পা ফেলতে গেলেই ব্যথা শুরু হয়। কিছুক্ষণ হাঁটাহাঁটি করলে ব্যথা আস্তে আস্তে কমে। বিশ্রামরত অবস্থায় ব্যথা থাকে না।

অনেক সময় ব্যথা এত তীব্র হয় যে পায়ে ভর দেওয়া যায় না। অতিরিক্ত হাড় পেশি, টেনডন, ফাসা, রক্তনালি ও সড়বায়ুকে ট্রাকশন ইনজুরি করে। ফলে ব্যথাসহ টিস্যু জমে থাকে।

কখনো কখনো পায়ের তলা লাল হয়, হিলপ্যাড শুকিয়ে যায় এবং পা ফ্ল্যাট হয়; অর্থাৎ পায়ের আর্চ নষ্ট হয়ে যায়।

চিকিৎসা

ব্যথানাশক ওষুধ সেবনে ব্যথা কমে আসবে। কখনো কখনো স্থানীয়ভাবে স্টেরয়েড ইনজেকশন পুশ করলে ব্যথা দ্রুত নিরাময় হয়। ইনজেকশন পুশ করার সময় সতর্কতা দরকার। অন্যথায় হিলপ্যাড (গোড়ালি) শুকিয়ে যাবে ও রোগ ত্বরান্বিত হবে।

ফিজিক্যাল থেরাপি, যেমন এসডব্লিউডি, ইউএসটি এবং ওয়াক্স বাথ ব্যবহারেও উপকার পাওয়া যায়।

চিকিৎসায় ভালো না হলে, রোগের পুনরাবৃত্তি হলে, হিলপ্যাড শুকিয়ে গেলে, পায়ে ভর দিতে অসুবিধা হলে ও হাড় বাড়তে থাকলে আর্থ্রোস্কোপিক সার্জারি প্রয়োজন হয়। এতে রোগের উপসর্গ দ্রুত লাঘব হয়।

প্রতিকার

উপযুক্ত মাপের ও নরম জুতা ব্যবহার করা উচিত।

সকালে ঘুম থেকে ওঠার পর আড়াআড়িভাবে পায়ের তলা ম্যাসাজ করতে হবে।

দিনে দুবার কুসুম গরম পানির সেঁক বা ঠান্ডা সেঁকে উপসর্গ নিরাময় হবে।

পায়ের তলা ও লেগের পেশির স্ট্রেচিং, নমনীয় ও শক্তিশালী হওয়ার ব্যায়াম করতে পারেন। পাশাপাশি একজন অর্থোপেডিক ও ট্রমা সার্জনের পরামর্শ নিয়ে রাখা ভালো।

ডা.

মো. মেহেদী হাসান, অর্থোপেডিক বিশেষজ্ঞ ও ট্রমা সার্জন, জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠান (নিটোর), ঢাকা

আরও পড়ুনডিস্ক প্রলাপস কেন হয়, সতর্কতা ও চিকিৎসা কী১৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৫

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: উপসর গ

এছাড়াও পড়ুন:

তামিম রক্ষা পেলেন, আমাদের করণীয় কী

বাংলাদেশের তারকা ক্রিকেটার তামিম ইকবাল খেলার মাঠে হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েন। তারকা এই ক্রিকেটারের জন্য হেলিকপ্টার আনা হলো। কিন্তু তাঁর শারীরিক অবস্থার দ্রুত অবনতি হচ্ছিল। নিকটস্থ কেপিজে ফজিলাতুন্নেছা বিশেষায়িত হাসপাতালে নিয়ে গেলে সেখানকার কার্ডিয়াক টিম তাঁকে দ্রুত চিকিৎসা দিয়ে পরবর্তী সময়ে হার্টে দুটি রিং পরায়।

আমি নিজে চিকিৎসক। বর্ণনা থেকে বুঝলাম, তামিম ইকবাল ম্যাসিভ হার্ট অ্যাটাক বা অ্যাকিউট করোনারি সিনড্রোমে আক্রান্ত হয়েছিলেন। তাঁকে যে চিকিৎসাটি প্রদান করা হয়েছে, চিকিৎসাশাস্ত্রের পরিভাষায় তাকে বলা হয় প্রাইমারি পিসিআই। এতে হার্ট অ্যাটাকে আক্রান্ত ব্যক্তিকে দ্রুততম সময়ে বিশেষায়িত ক্যাথল্যাবে নিয়ে গিয়ে অ্যানজিওগ্রাম করে কালপ্রিট ভ্যাসেল, মানে আক্রান্ত রক্তনালিতে রিং বা স্টেন্ট পরিয়ে দেওয়া হয়।

উন্নত বিশ্বের এ চিকিৎসাটি এখন বাংলাদেশে অত্যন্ত সাফল্যের সঙ্গে সম্পন্ন হচ্ছে। এই প্রাইমারি পিসিআইয়ের মাঝখানে তামিম ইকবালকে লম্বা সময় সিপিআর, মানে বুকে চাপ দিয়ে হার্টের কার্যকারিতা চালু করার চিকিৎসাসহ ডিসি শক দিয়ে তাঁর বন্ধ হয়ে যাওয়া হার্টকে ফিরিয়ে আনা হয়েছে। অভিজ্ঞতা থেকে বুঝতে পারি যে অল্পের জন্য রক্ষা পেয়েছেন এই আন্তর্জাতিক খ্যাতিমান ক্রিকেট তারকা। তবে তিনি এখনো সংকটমুক্ত নন।

বাংলাদেশে অর্ধশতাধিক কার্ডিয়াক সেন্টার রয়েছে, যেখানে হৃদ্‌রোগের সব চিকিৎসা ও সার্জারি সফলভাবে সম্পন্ন হচ্ছে। একসময় একটা অ্যানজিওগ্রাম করার জন্য অন্তত পাশের দেশ ভারতে যেতে হতো।

একজন তারকা ক্রিকেটার হওয়ার সুবাদে এবং কেপিজে হাসপাতালে কার্ডিয়াক সুবিধা থাকার কারণে হয়তো তামিম দ্রুততম সময়ে এই উন্নত চিকিৎসা পেয়ে প্রাণে বেঁচে গেলেন। গর্বের কথা বলি। যে প্রাইমারি পিসিআই চিকিৎসাটি বাংলাদেশে তামিমের ক্ষেত্রে সফলভাবে দেওয়া হয়েছে, ইংল্যান্ড বা আমেরিকার মতো উন্নত দেশে কোনো খেলোয়াড় এ রকম অসুস্থ হলেও সেই একই চিকিৎসা তাঁদের দেওয়া হবে। অর্থাৎ হৃদ্‌রোগ চিকিৎসায় বাংলাদেশ এখন গর্ব করতে পারে। তামিমের সফল চিকিৎসার এ ঘটনা বাংলাদেশের চিকিৎসার আধুনিকায়নের একটি উজ্জ্বল উদাহরণ হয়ে থাকবে।

উপমহাদেশের প্রখ্যাত কার্ডিয়াক সার্জন দেবী শেঠি বাংলাদেশে এসে এ দেশের হৃদ্‌রোগ চিকিৎসার ভূয়সী প্রশংসা করেছিলেন। প্রশ্ন হচ্ছে, তামিম ইকবাল একজন ভিআইপি। তাই দ্রুততম সময়ে সর্বোচ্চ চিকিৎসা পেয়ে মৃত্যুর দুয়ার থেকে ফিরে এসেছেন। একজন সাধারণ মানুষের হার্ট অ্যাটাক হলে তিনি কোথায় যাবেন? কী চিকিৎসা নেবেন? তাঁদের জন্য তো আর হেলিকপ্টার চলে আসবে না।

এ ক্ষেত্রেও ভালো সংবাদ আছে। বাংলাদেশে অর্ধশতাধিক কার্ডিয়াক সেন্টার রয়েছে, যেখানে হৃদ্‌রোগের সব চিকিৎসা ও সার্জারি সফলভাবে সম্পন্ন হচ্ছে। একসময় একটা অ্যানজিওগ্রাম করার জন্য অন্তত পাশের দেশ ভারতে যেতে হতো। অথচ আজ বাংলাদেশে অ্যানজিওগ্রাম, অ্যানজিপ্লাস্টি (রিং পরানো), বাইপাস সার্জারি, ভাল্‌ভ সার্জারি, এমনকি বুক না কেটে মিনিমাল ইনভেসিভ কার্ডিয়াক সার্জারি সফলতার সঙ্গে প্রতিদিন সম্পন্ন হচ্ছে।

তবু আকস্মিক মৃত্যু থেমে নেই। এর একমাত্র কারণ ম্যাসিভ হার্ট অ্যাটাক। হৃদ্‌রোগে আকস্মিক মৃত্যু বাংলাদেশসহ সারা বিশ্বে একটি গুরুতর স্বাস্থ্য সমস্যা। বাংলাদেশে প্রতিবছর প্রায় ২ লাখ ৭৩ হাজার মানুষ হৃদ্‌রোগে মারা যান, যার ৫৪ শতাংশের জন্য উচ্চ রক্তচাপ দায়ী। এ ছাড়া তামাক ব্যবহার ও বায়ুদূষণ হৃদ্‌রোগের ঝুঁকি বাড়ায়।

আন্তর্জাতিকভাবে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, প্রতিবছর বিশ্বব্যাপী প্রায় ১ কোটি ৭৯ লাখ মানুষ হৃদ্‌রোগে মারা যায়, যা মোট মৃত্যুর প্রায় ৩১ শতাংশ। এর মধ্যে তামাকের কারণে হৃদ্‌রোগে বছরে ১৯ লাখ মানুষ মৃত্যুবরণ করে।

বুকে ব্যথা, চোয়ালে ব্যথা, ঘাম হওয়া, মাথা ঝিমঝিম করা, অবসন্নতার মতো উপসর্গ বা কোনো উপসর্গ ছাড়াই আকস্মিক হার্ট বিকল হয়ে মানুষ মারা যাচ্ছে। হার্টের অসুখ নিয়ে অনেক রোগী হাসপাতাল পর্যন্ত পৌঁছাতে পারে না। পথিমধ্যেই মারা যায়। তাহলে এ রকম পরিস্থিতি থেকে পরিত্রাণের উপায় কী?

বুকে ব্যথা হলে গ্যাসের ব্যথা ভেবে কালক্ষেপণ না করে দ্রুততম সময়ে হৃদ্‌রোগের সব সাপোর্ট আছে, এমন হাসপাতালে পৌঁছাতে হবে। ঢাকার বাইরে কিছু কিছু বিভাগীয় শহরে ক্যাথল্যাব ও কার্ডিয়াক সার্জারির সুবিধা আছে। বাংলাদেশে বেসরকারি হেলিকপ্টার যৌক্তিক মূল্যে অত্যন্ত সহজলভ্য। মনে রাখতে হবে, হার্টের চিকিৎসায় সময় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আপনি যদি বুকে ব্যথা নিয়ে সঠিক সময়ে কোনো কার্ডিয়াক হাসপাতালে পৌঁছাতে পারেন, তাহলে বেঁচে যাওয়ার সম্ভাবনা অনেকখানি।

তাহলে করণীয় কী? উত্তর একটাই, নিয়মিত হেলথ চেকআপ। আপনার দেহে উপসর্গ থাকুক আর না থাকুক, বছরে কমপক্ষে দুবার হেলথ চেকআপ করতে হবে। এ ছাড়া সুষম খাদ্যাভ্যাস, প্রতিদিন কমপক্ষে ৩০ মিনিট হাঁটার অভ্যাস, ওজন কমানো, ধূমপান ও তামাকজাতীয় পণ্য বর্জনের পাশাপাশি ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ ও কোলেস্টেরল নিয়ন্ত্রণ করা অত্যন্ত জরুরি। আর দরকার এ বিষয়ে সচেতনতামূলক কর্মকাণ্ড।

ডা. আশীষ কুমার চক্রবর্ত্তী ব্যবস্থাপনা পরিচালক, ইউনিভার্সেল কার্ডিয়াক হাসপাতাল, মহাখালী, ঢাকা

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • তামিম রক্ষা পেলেন, আমাদের করণীয় কী