সাফজয়ী সাবিনাদের হাতে মর্যাদার একুশে পদক
Published: 20th, February 2025 GMT
গত বছর সাফ নারী চ্যাম্পিয়নশিপের শিরোপা জেতা বাংলাদেশ জাতীয় নারী ফুটবল দলের হাতে উঠল দেশের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বেসামরিক পুরস্কার একুশে পদক।
আজ দুপুর ১২টা ৪০ মিনিটে রাজধানীর ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাছ থেকে দলের পক্ষে মর্যাদার এই পদক গ্রহণ করেন অধিনায়ক সাবিনা খাতুন ও সহ-অধিনায়ক মারিয়া মান্দা। এ সময় মঞ্চে উপস্থিত ছিলেন সর্বশেষ সাফজয়ী বাংলাদেশ নারী দলের অন্য ফুটবলাররাও।
শুরুতে পদকের জন্য নারী ফুটবল দলের ১১ জনকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিল সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়। কিন্তু কোন ১১ জন পাঠাবে—এ সিদ্ধান্ত নিতে গিয়ে বিপদেই পড়ে যায় তারা। পরে ফেডারেশন দলের ৩২ সদস্যকে আমন্ত্রণ জানানোর জন্য সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়কে অনুরোধ করে। শেষ পর্যন্ত বিষয়টি বিবেচনা করে ২৩ ফুটবলারের পাশাপাশি কোচ-কর্মকর্তাসহ আরও ৯ জনকে আমন্ত্রণ জানায় মন্ত্রণালয়।
গত বছরের অক্টোবরে সাফ নারী চ্যাম্পিয়নশিপে নেপালকে হারিয়ে টানা দ্বিতীয়বারের মতো চ্যাম্পিয়ন হয় বাংলাদেশ। যে দলে ছিলেন রুপনা চাকমা, ইয়ারজান বেগম, মিলি আক্তার, মাসুরা পারভীন, কোহাতি কিসকু, আফিদা খন্দকার, নিলুফা ইয়াসমিন, শামসুন্নাহার সিনিয়র, শিউলি আজিম, মনিকা চাকমা, মারিয়া মান্ডা, মুনকি আক্তার, স্বপ্না রানী, আইরিন আক্তার, মাতসুশিমা সুমাইয়া, শাহেদা আক্তার রিপা, ঋতুপর্ণা চাকমা, তহুরা খাতুন, শামসুন্নাহার জুনিয়র, সাবিনা খাতুন, কৃষ্ণা রানী সরকার, সানজিদা আক্তার ও মোসাম্মাৎ সাগরিকা।
এর আগে কোনো ক্রীড়া দল একুশে পদক পায়নি। সংস্থা হিসেবে ২০০১ সালে স্বাধীনতা পদক পেয়েছিল বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড (বিসিবি)। তবে স্বাধীনতা পদকের জন্য স্বাধীন বাংলা ফুটবল দল অনেকবারই আবেদন করেছিল; কিন্তু তারা এখনো পুরস্কারের জন্য মনোনীত হয়নি।
.উৎস: Prothomalo
এছাড়াও পড়ুন:
সংস্কৃতির ভুবন আলোকিত করে সন্জীদা খাতুনের বিদায়
আজীবন দেশের সংস্কৃতির ভুবন আলোকিত করার গুরুদায়িত্ব পালন করে বিদায় নিলেন সন্জীদা খাতুন। গতকাল মঙ্গলবার ৯২ বছর পূর্ণ করার কিছু আগে প্রয়াত হলেন দেশের এই অগ্রগণ্য সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব। আগামী ৪ এপ্রিল তিনি ৯৩ বছরে পদার্পণ করতেন। জন্মদিনের পরিবর্তে সেদিনে হবে তাঁর স্মরণসভা।
রাজধানীর স্কয়ার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় গতকাল বেলা ৩টা ১০ মিনিটে হৃৎস্পন্দন থেমে যায় সন্জীদা খাতুনের (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)। তাঁর ছেলে পার্থ তানভীর নভেদ ও পুত্রবধূ লাইসা আহমদ লিসা জানিয়েছেন, তাঁর হৃদ্যন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ (হার্ট অ্যাটাক) হয়েছিল। বেশ কিছুদিন ধরেই তিনি সুস্থ ছিলেন না। তাঁর ছিল কিডনির জটিল রোগ। নিউমোনিয়াতেও আক্রান্ত হয়েছিলেন। ১৯ মার্চ তাঁকে স্কয়ার হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। এরপর নেওয়া হয় আইসিইউতে। অবস্থার বিশেষ উন্নতি হয়নি।
সন্জীদা খাতুনের বড় মেয়ে অপালা ফরহাদ নভেদ আগেই প্রয়াত। ছেলে পার্থ তানভীর নভেদ আর মেয়ে রুচিরা তাবাসসুম নভেদসহ অনেক আত্মীয়স্বজন ও দেশ-বিদেশে অসংখ্য গুণগ্রাহী রেখে গেছেন বহু গুণের অধিকারী অনাড়ম্বর জীবন যাপন করা এই মানুষটি। তাঁর ছেলেমেয়েরা জানিয়েছেন, মরদেহ রাতে হিমঘরে রাখা হবে।
সর্বজনের শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য আজ বুধবার দুপুর সাড়ে ১২টায় আনা হবে তাঁর হাতে গড়া দেশের অগ্রগণ্য সংগীত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ছায়ানট সংস্কৃতি–ভবনে। সন্জীদা খাতুনের অনেক নাতি–নাতনি ও ঘনিষ্ঠ বহু আত্মীয় বিদেশে অবস্থান করছেন। তাঁরা শেষবিদায় জানাতে আসবেন। সে কারণে দাফনের দিনক্ষণ পরে ঠিক করা হবে। ৪ এপ্রিল সন্জীদা খাতুনের জন্মদিনে ছায়ানটে স্মরণসভা করার পরিকল্পনা করা হলেও সময় এখনো ঠিক হয়নি।
সন্জীদা খাতুনের কীর্তির ধারা বিচিত্র। তিনি ছিলেন একাধারে শিক্ষক, গবেষক, শিল্পী, সংগীতজ্ঞ, সংগঠক ও সক্রিয় সাংস্কৃতিক নেত্রী। ছিলেন ছায়ানট ও রবীন্দ্রসঙ্গীত সম্মিলন পরিষদের সভাপতি। ব্যতিক্রমী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নালন্দার প্রতিষ্ঠাতা। জনসাধারণের সাংস্কৃতিক বোধের উন্নয়ন এবং মুক্ত–উদার মানবিক সমাজ নির্মাণের অবিরাম প্রচেষ্টাই ছিল তাঁর জীবনের ব্রত। তাঁর মৃত্যুর সংবাদ ছড়িয়ে পড়ার পরে দেশের শিল্প–সাংস্কৃতিক অঙ্গনে শোকের ছায়া নেমে আসে। আত্মীয়স্বজন ছাড়াও তাঁর সহযোদ্ধা, সহশিল্পী, ছাত্রছাত্রী ও গুণমুগ্ধরা শোকার্ত চিত্তে স্কয়ার হাসপাতালে ছুটে যান। অনেকেই ছিলেন অশ্রুসিক্ত।
মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি মফিদুল হক হাসপাতালে প্রথম আলোকে বললেন, তিনি দীর্ঘ জীবন পেয়েছিলেন এবং জীবনকালটা মানুষের জন্য উজাড় করে দিয়েছেন। জনমানসে সংগীত, শিল্প, সাহিত্যের বোধ সৃষ্টি এবং এর সঙ্গে সামাজিক–সাংস্কৃতিক দায়বদ্ধতার বোধ সঞ্চার করে গেছেন। বিপুলভাবে তিনি বাঙালির জীবন সমৃদ্ধ করে তোলার কাজ করেছেন। তাঁর মতো দ্বিতীয় কেউ নেই।
রবীন্দ্রসঙ্গীত সম্মিলন পরিষদের সহসভাপতি ও শিল্পী বুলবুল ইসলাম বলেন, দেশে রবীন্দ্রসংগীতের প্রসার ও সংস্কৃতিচর্চার ক্ষেত্রে ওয়াহিদুল হক, জামিল চৌধুরী ও সন্জীদা খাতুন—এই তিনজনের ভূমিকা পথিকৃতের মতো। তাঁরা সাংস্কৃতিক আন্দোলনের মাধ্যমে রাজনৈতিক আন্দোলনের পথ সুগম করেছেন। দুজন আগেই প্রয়াত। এখন তৃতীয়জনও চলে গেলেন। নিজেকে অভিভাবকহীন মনে হচ্ছে।
ছায়ানটের তবলার শিক্ষক এনামুল হক ওমর বললেন, যে অসাধারণ সাংগঠনিক দক্ষতায় তিনি সারা দেশের সাংস্কৃতিক কর্মী ও শিল্পীদের সংগঠিত করেছেন, ছায়ানটকে পরিচালনা করেছেন, তার তুলনা হয় না। তাঁর প্রয়াণ জাতির জন্য অপরিমেয় ক্ষতি।
সন্জীদা খাতুনের মৃত্যুতে শোক জানিয়েছে ছায়ানট, উদীচী, চারণ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগসহ বিভিন্ন সাংস্কৃতিক সংগঠন।
সন্জীদা খাতুনের জন্ম ১৯৩৩ সালের ৪ এপ্রিল। তাঁর বাবা কাজী মোতাহার হোসেন ছিলেন জাতীয় অধ্যাপক। মা সাজেদা খাতুন গৃহিণী। সন্জীদা খাতুন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৫৪ সালে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে স্নাতক, ১৯৫৫ সালে ভারতের বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর এবং ১৯৭৮ সালে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন। শিক্ষকতা দিয়ে তাঁর কর্মজীবন শুরু। দীর্ঘকাল অধ্যাপনা করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে।
বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের শুরুতেই এতে জড়িয়ে পড়েন। মুক্তিযুদ্ধকালে কলকাতায় সংগঠিত করেন বাংলাদেশের শিল্পীদের। শিল্পী কামরুল হাসানের নেতৃত্বে সন্জীদা খাতুন ব্রতচারী আন্দোলনে যোগ দিয়েছিলেন।
সন্জীদা খাতুনের প্রথম গানের গুরু ছিলেন সোহরাব হোসেন। তাঁর কাছে তিনি দীক্ষা নেন নজরুলসংগীত, আধুনিক বাংলা গান ও পল্লিগীতির। প্রথমে রবীন্দ্রসংগীত শিখেছেন প্রখ্যাত হুসনে বানু খানমের কাছে। এরপর তালিম নেন শৈলজারঞ্জন মজুমদার, আবদুল আহাদ, কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়, নীলিমা সেনদের মতো বিখ্যাত রবীন্দ্রসংগীতশিল্পীদের কাছ থেকে।
আইয়ুব খানের কঠোর শাসনকালে নানা বাধা অগ্রাহ্য করে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্মশতবর্ষ উদ্যাপনে তিনি ও সংগীতজ্ঞ ওয়াহিদুল হক অন্যতম ভূমিকা পালন করেছিলেন। এরই ধারাবাহিকতায় দেশের ঐতিহ্যবাহী সংগীত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ছায়ানটের যাত্রা শুরু। ১৯৬৭ সালে তাঁরা রমনার বটমূলে প্রথমবারের মতো বাংলা নববর্ষের প্রথম দিন পয়লা বৈশাখে আয়োজন করে প্রভাতি গানের আসর। ছায়ানটের এই অনুষ্ঠান থেকেই প্রাণিত হয়ে নববর্ষ উদ্যাপন এখন দেশজুড়ে বিপুল এক অসাম্প্রদায়িক উৎসব। ধর্মীয় উগ্রবাদীরা ছায়ানটের এই প্রভাতি গানের আসরে ২০০১ সালে ভয়াবহ বোমা হামলা চালালেও অনুষ্ঠানের ধারাবাহিকতায় ছেদ পড়েনি।
এসব সাংগঠনিক কর্মকাণ্ডের বাইরে সন্জীদা খাতুনের গবেষণা ও রচনার কাজও কম নয়। তাঁর রচিত গ্রন্থের সংখ্যা ২০টির অধিক। রবীন্দ্রসংগীতের ভাবসম্পদ, কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত, স্বাধীনতার অভিযাত্রা, সাহিত্য কথা সংস্কৃতি কথা, নজরুল মানস ইত্যাদি তাঁর উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ।
সন্জীদা খাতুন দেশে একুশে পদক ও বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার পেয়েছেন। এ ছাড়া সম্মানিত হয়েছেন ভারত সরকারের পদ্মশ্রী পদক, পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকারের দেশিকোত্তম পুরস্কার এবং কলকাতার টেগোর রিসার্চ ইনস্টিটিউটের রবীন্দ্র–তত্ত্বাচার্য উপাধিতে।