জুলাই গণহত্যা, গুম, খুনসহ মানবতাবিরোধী অপরাধে জড়িত নন, এমন আওয়ামী লীগ নেতারা ক্ষমা চাইলে রাজনীতিতে ফেরার সুযোগ পেতে পারেন। জাতিসংঘের মানবাধিকার সংস্থাসহ বিভিন্ন উন্নয়ন সহযোগীর প্রস্তাবে এ রকম চিন্তাভাবনাই করছে অন্তর্বর্তী সরকার।

শেখ হাসিনা সরকারের পতন ঘটানো গণঅভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেওয়া ছাত্রনেতারাও অপরাধী নন, এমন নেতাকে রাজনীতিতে ফেরার সুযোগ দিতে ‘রিডিম এবং রিকনসিলিয়েশন’-এ রাজি। তবে আপত্তি রয়েছে বিএনপির তরফ থেকে। দলটি ছাত্রনেতাদের এ চাওয়াকে নতুন দল গঠনের সুবিধা নেওয়ার চেষ্টা হিসেবে দেখছে। জামায়াতের ভাষ্য, আগে দায়ীদের চিহ্নিত ও বিচার করা হোক; তারপর ক্ষমার চিন্তা হতে পারে। 

একাধিক রাজনৈতিক সূত্র সমকালকে জানিয়েছে, ক্ষমার সুযোগ দিয়ে আওয়ামী লীগকে স্থায়ীভাবে বিভক্ত করার চেষ্টা রয়েছে। যারা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে থাকবে, তারা হবে একটি দল। যারা ১৫ বছরের কৃতকর্মের জন্য ক্ষমা চাইবে, তারা হবে আরেকটি দল। ক্ষমা চাওয়া অংশকে রাজনীতিতে বাধা দেওয়া হবে না। তাদের আওয়ামী লীগের মূলধারা হিসেবে স্বীকার করে নেওয়া হবে। এই অংশের নির্বাচনে অংশ নিতেও বাধা থাকবে না। বিভক্ত আওয়ামী লীগ অন্যদের জন্য যেমন হুমকি হতে পারবে না, তেমনি রাজনীতিতেও শক্তিশালী হওয়ার সুযোগ পাবে না। 

ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানকালে মানবাধিকারবিরোধী অপরাধের তদন্ত প্রক্রিয়ায় যুক্ত একটি সূত্র সমকালকে নিশ্চিত করেছে, আওয়ামী লীগের একাধিক নেতা দোষ স্বীকার করে নিষ্কৃতি পেতে চান। তারা শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে সাক্ষী হতে রাজি। বিদেশ পালিয়ে যাওয়া কয়েকজন নেতা ক্ষমা প্রার্থনার বিনিময়ে স্বাভাবিক জীবনে ফেরার সুযোগ পেলে দেশে ফিরতে চান। 

শেখ হাসিনার সাড়ে ১৫ বছরের কর্তৃত্ববাদী শাসনে ২ হাজার ২৬২টি বিচারবহির্ভূত হত্যার অভিযোগ রয়েছে। গুম-সংক্রান্ত কমিশনে ১ হাজার ৬০০-এর বেশি অভিযোগ জমা পড়েছে। সারাদেশে অন্তত ২২টি গোপন বন্দিশালার খোঁজ পেয়েছে কমিশন। 

জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশনের তথ্যানুসন্ধান বলছে, ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে ১ জুলাই থেকে ১৫ আগস্ট পর্যন্ত ১ হাজার ৪০০ মানুষকে হত্যা করা হয়েছে। এর মধ্যে ১২ থেকে ১৩ শতাংশ শিশু। শেখ হাসিনাকে ক্ষমতায় টিকিয়ে রাখতে নিরাপত্তা বাহিনী শিশুদের ‘টার্গেট কিলিং’ করে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে গণঅভ্যুত্থান দমনে আওয়ামী লীগ এবং এর অঙ্গ সংগঠনের নেতাকর্মী অস্ত্র হাতে ছিল। এগুলোকে মানবতাবিরোধী অপরাধ হিসেবে চিহ্নিত করে জাতিসংঘ। শেখ হাসিনাসহ জ্যেষ্ঠ নেতাকর্মী ও কর্মকর্তাদের সরাসরি তত্ত্বাবধানে গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘিত হয়েছে। 

দক্ষিণ আফ্রিকায় বর্ণবাদী শাসনের অবসানের পর জাতীয় ঐক্যের জন্য নোবেলজয়ী ডেসমন্ড টুটুর নেতৃত্বে ‘ট্রুথ অ্যান্ড রিকনসিলিয়েশন কমিশন’ করেছিলেন প্রেসিডেন্ট নেলসন ম্যান্ডেলা। এ কমিশন ১৯৬০ থেকে ১৯৯৪ সাল পর্যন্ত সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধ তদন্ত করে প্রায় ৭ হাজার রাজনৈতিক হত্যার তথ্য পায়। বর্ণবাদী শাসনের নিরাপত্তা পুলিশের হেফাজতে ৭৩ জনের মৃত্যু, ১৯ হাজার ৫০টির বেশি মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা আসে কমিশনে। ক্ষমা চেয়ে আবেদন করা ব্যক্তির মাধ্যমে ২ হাজার ৯৭৫ জন ক্ষতিগ্রস্তের তথ্য আসে। 

অপরাধের পূর্ণাঙ্গ সত্য এবং অনুশোচনা প্রকাশের কারণে কমিশন ৮৪৯ জনকে ক্ষমা করে। শুধু বর্ণবাদী শাসনের সময় কৃষ্ণাঙ্গদের দমনপীড়নে জড়িত শ্বেতাঙ্গরা নয়, সেই সময়ে প্রতিরোধ লড়াইয়ে কৃষ্ণাঙ্গরা শ্বেতাঙ্গদের বিরুদ্ধে যেসব মানবতাবিরোধী অপরাধ করেছিল, সেগুলোও কমিশনে আসে। অনুশোচনা প্রকাশের মাধ্যমে তারা ক্ষমা পায়। 

শেখ হাসিনার শাসনামলে মানবাধিকার লঙ্ঘন এবং গণঅভ্যুত্থানের সময় মানবতাবিরোধী অপরাধে জড়িত নন, আওয়ামী লীগের এমন নেতাকর্মী ক্ষমা চাইলে রাজনীতিতে ফেরার সুযোগ দেওয়ার বিষয়ে আইন উপদেষ্টা ড.

আসিফ নজরুল সমকালকে বলেন, ‘বিভিন্ন মহল থেকে এসেছে এ ধরনের অনেক প্রস্তাব। বিশেষ করে বিদেশি উন্নয়ন সহযোগী এবং জাতিসংঘের বিভিন্ন সংস্থা থেকে এসেছে। এর সম্ভাব্যতা, কীভাবে করা যায়, তা নিয়ে প্রাথমিক চিন্তাভাবনা রয়েছে। এখনও খুব কংক্রিট সিদ্ধান্ত হয়নি।’ 

অন্তর্বর্তী সরকারের সূত্র সমকালকে জানিয়েছে, একাধিক উপদেষ্টা এ প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত। গণঅভ্যুত্থানের ছাত্রনেতারা গত শনিবার প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে আলেচনায় আওয়ামী লীগের নিবন্ধন বাতিলের দাবি তোলেন। এর আগে উপদেষ্টা মাহফুজ আলম বলেছিলেন, আওয়ামী লীগকে আগামী নির্বাচনে অংশ নিতে দেওয়া হবে না। সরকারের পক্ষে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম একাধিকবার জানান, জুলাই গণহত্যার বিচার না হওয়া পর্যন্ত রাজনীতি এবং নির্বাচনে ফিরতে পারবে না আওয়ামী লীগ। 

ছাত্রনেতারা প্রায়ই আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধের দাবি তুলেছেন। তবে জাতিসংঘসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার মনোভাব ভিন্ন। জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশনের প্রতিবেদনে শেখ হাসিনাকে মূল হোতা হিসেবে চিহ্নিত করা হলেও কোনো রাজনৈতিক দলকে নিষিদ্ধ না করার কথা বলেছে। একাধিক সূত্র সমকালকে জানিয়েছে, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের এ মনোভাবের কারণে ছাত্রনেতারাও আওয়ামী লীগের যারা অপরাধী নন, তাদের রাজনীতিতে ফেরার সুযোগ দিতে রাজি। 

প্রতিবেদন তৈরিতে সম্পৃক্ত জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশনের জ্যেষ্ঠ গবেষক জুলিয়া ব্লেকনার সমকালকে বলেন, ‘আওয়ামী লীগকে নির্বাচন থেকে নিষিদ্ধের দাবি উদ্বেগের। এতে বাংলাদেশিরা হয়তো আরেকটি নির্বাচন পেতে যাচ্ছে, যেখানে তারা পছন্দের প্রার্থীকে ভোট দিতে পারবে না।’ নিষিদ্ধের বদলে কী ব্যবস্থা নেওয়া যেতে পারে– প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘সঠিক উপায়ে তদন্ত করে অভিযোগ গঠন করে বিচার করা।’ 

স্থানীয় সরকার উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া গত মঙ্গলবার তথ্য ও সম্প্রচার উপদেষ্টা নাহিদ ইসলামকে উদ্ধৃত করে বলেন, ‘যারা আওয়ামী লীগ করেছেন, কিন্তু কোনো অন্যায় এবং গণহত্যা কিংবা অপরাধের সঙ্গে যুক্ত নন, তারা ক্ষমা চেয়ে আবার মূলধারায় স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসতে পারেন।’ 

একই দিনে একই অভিমত জানান ছাত্রনেতাদের রাজনৈতিক প্ল্যাটফর্ম জাতীয় নাগরিক কমিটির মুখ্য সমন্বয়ক সারজিস আলম। তিনি বলেন, ‘আওয়ামী লীগের নিবন্ধন এবং গণহত্যায় দায়ীদের নিষিদ্ধের দাবি জানিয়েছি। দল হিসেবে আওয়ামী লীগ, খুনি শেখ হাসিনা এবং নৌকাকে ভোট দেওয়া ২৫ থেকে ৩০ শতাংশ মানুষ আলাদা।’

অপরাধী নয়, এমন আওয়ামী লীগ নেতাদের রাজনীতিতে পুনর্বাসনের সুযোগ দিয়ে ছাত্রনেতারা নিজেদের দল গঠন করতে চাইছেন– বিএনপির এ সমালোচনার পর গতকাল বুধবার আগের দিনের বক্তব্যের ব্যাখ্যা দেন আসিফ মাহমুদ। তিনি নিজের ভেরিফায়েড ফেসবুকে লিখেছেন, ‘আওয়ামী লীগ হিসেবে নির্বাচনে অংশগ্রহণের সুযোগের কথা বলা হয়নি। বিচারের আগে এ প্রশ্ন অবান্তর। অনেকেই বলছেন, অন্যায় না করলে ক্ষমা চাইবে কেন? অবশ্যই ক্ষমা চাইতে হবে, আওয়ামী লীগের সঙ্গে যে কোনোভাবে জড়িত থাকার কারণে। সুবিধাভোগী হিসেবেই ক্ষমা চাইতে হবে। এ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে হবে স্বচ্ছ, উন্মুক্তভাবে এবং ধাপে ধাপে। ট্রুথ কমিশন কিংবা বিশ্বের যেসব নজির রয়েছে তা অনুসরণ করে।’ এই বক্তব্যকে ব্যক্তিগত বলে আখ্যা দিয়েছেন উপদেষ্টা।

তবে বিএনপির একাধিক নেতার ভাষ্য, আওয়ামী লীগ নেতাদের ক্ষমা প্রার্থনার বিনিময়ে রাজনীতিতে ফেরার সুযোগ দেওয়ার কথা বলা হচ্ছে ছাত্রদের দল গঠনের সুবিধার জন্য। যাতে ছাত্ররা ক্ষমা চাওয়া ওই নেতাদের নিজ দলে ভেড়াতে পারেন। তবে প্রকাশ্যে এ বক্তব্য দিতে কোনো নেতা রাজি হননি।

বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, ‘স্থানীয় সরকার উপদেষ্টা যিনি আছেন তিনি বলেছেন, ফ্যাসিস্টদের লোকেরা যদি কেউ মাফ চেয়ে নির্বাচনে অংশ নিতে চান, তাহলে তারা অংশ নিতে পারবেন। এর থেকে এটাই প্রমাণিত– তারা নিজেদের স্বার্থে ফ্যাসিস্টদের জায়গা দিতে চান। তাহলে কি আমরা মনে করব, তারা সরকারে থেকে তাদের দল গোছানোর জন্য বিভিন্ন রকম কৌশল নিচ্ছেন?’

জাতীয় নাগরিক কমিটির আহ্বায়ক মুহাম্মদ নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী এই ভাষ্যকে নাকচ করেছেন। তিনি সমকালকে বলেন, ‘আওয়ামী লীগের কোনো সুবিধাভোগীকে নিয়ে ছাত্র-জনতার রাজনৈতিক দল গঠনের প্রশ্নই আসে না। আওয়ামী লীগের পুনর্বাসন চব্বিশের অভ্যুত্থানের চেতনার বিরোধী; শহীদের রক্তের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা। আমরা স্পষ্ট করে বলেছি, যারা অন্যায়, গণহত্যা, মানবতাবিরোধী অপরাধ করেননি, শুধু সেসব আওয়ামী লীগ নেতা ক্ষমা চাইলে রাজনীতিতে ফেরার সুযোগ পেতে পারেন। দেশের নিরপরাধ নাগরিকের অধিকার হরণের পক্ষে নয় ছাত্র-জনতা।’ 

জামায়াতের নায়েবে আমির ডা. সৈয়দ আবদুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের সমকালকে বলেন, ‘আগে সাড়ে ১৫ বছরের অপকর্ম, মানবতাবিরোধী অপরাধ, গণহত্যায় দায়ীদের চিহ্নিত এবং বিচার করা হোক। তারপর অন্য ভাবনা।’ 

একাধিক ছাত্রনেতা সমকালকে বলেন, আওয়ামী লীগ সরকার জামায়াতকে কোণঠাসা করে রাখলেও রাজনৈতিক স্বার্থে টিকিয়ে রাখার যে ভুল করেছিল, এর পুনরাবৃত্তি করা যাবে না। কোণঠাসা ও ধরপাকড়ের শিকার জামায়াত অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে ঐক্যবদ্ধ ছিল। আওয়ামী লীগ যাতে এ সুযোগ নিতে না পারে, তা নিশ্চিত করতে অপকর্মের অভিযোগ নেই এমন নেতাদের সুযোগ দেওয়া উচিত। তবে ক্ষমা চাওয়া অংশকে অবশ্যই শেখ হাসিনা এবং তাঁর অনুগতদের নিয়ন্ত্রণমুক্ত রাখতে হবে।

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: গণহত য গণঅভ য ত থ ন ম নবত ব র ধ ন উপদ ষ ট ছ ত র জনত র র জন ত র জন ত ক র জন ত ত এমন ন ত গণহত য দল গঠন র জন য এক ধ ক ন ত কর আওয় ম গঠন র সরক র অপর ধ ব এনপ

এছাড়াও পড়ুন:

গণহত্যা বন্ধ ও স্বাধীন ফিলিস্তিন দাবি

যুদ্ধবিরতি নয়—গণহত্যা বন্ধ করতে হবে। আন্তর্জাতিক আদালতে গণহত্যার দায়ে ইসরায়েলের বিচার করা এবং ১৯৬৭ সালের পূর্ববর্তী ভূমি ফিরিয়ে দিয়ে ফিলিস্তিনিদের রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠার পথ উন্মুক্ত করার দাবি জানানো হয় মার্চ ফর গাজা কর্মসূচিতে।

আজ শনিবার রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ‘প্যালেস্টাইন সলিডারিটি মুভমেন্ট বাংলাদেশ’ ঘোষিত কর্মসূচির ঘোষণাপত্রে এসব দাবি জানানো হয়েছে। 

এর আগে বিকেল ৩টার কিছুক্ষণ পরে এই কর্মসূচি শুরু হয়। বিকেল ৪টার দিকে ঘোষণাপত্র পাঠের মাধ্যমে এই কর্মসূচি শেষ হয়। আমার দেশ পত্রিকার সম্পাদক মাহমুদুর রহমান ঘোষণাপত্র পাঠ করেন ও বক্তব্য দেন।

ঘোষণাপত্রের প্রথম অংশে জাতিসংঘ এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতি। দ্বিতীয় অংশে মুসলিম বিশ্বের সরকার এবং উম্মাহের প্রতি। তৃতীয় অংশে বাংলাদেশ সরকারের প্রতি পৃথক দাবি জানানো হয়।

জাতিসংঘ এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতি উদ্দেশ্য করে ঘোষণাপত্রে বলা হয়, পশ্চিমা শক্তিবলয়ের অনেক রাষ্ট্র সরাসরি দখলদারকে অস্ত্র, অর্থ ও কূটনৈতিক সহায়তা দিয়ে এই গণহত্যাকে দীর্ঘস্থায়ী করেছে। এই বিশ্বব্যবস্থা দখলদার ইসরাইলকে প্রশ্নবিদ্ধ না করে বরং তাকে রক্ষা করার প্রতিযোগিতায় নেমেছে। 

তাই আমরা জাতিসংঘ ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতি বলছি-

১. জায়নবাদী ইজরায়েলের গণহত্যার বিচার আন্তর্জাতিক আদালতে নিশ্চিত করতে হবে। 
২. যুদ্ধবিরতি নয়—গণহত্যা বন্ধে কার্যকর ও সম্মিলিত পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। 
৩. ১৯৬৭ সালের পূর্ববর্তী ভূমি ফিরিয়ে দেয়ার জন্য বাধ্যবাধকতা তৈরি করতে হবে। 
৪. পূর্ব জেরুজালেমকে ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের রাজধানী হিসেবে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃতি দিতে হবে। 
৫. ফিলিস্তিনিদের আত্মনিয়ন্ত্রণ, নিরাপত্তা, এবং রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠার পথ উন্মুক্ত করতে হবে।

দ্বিতীয় দাবিগুলো মুসলিম উম্মাহর নেতাদের প্রতি জানানো হয়। এতে বলা হয়, যেহেতু আমরা বিশ্বাস করি, ফিলিস্তিন কেবল একটি ভূখণ্ড নয়- এটি মুসলিম উম্মাহর আত্মপরিচয়ের অংশ। গাজা এখন কেবল একটি যুদ্ধবিধ্বস্ত শহর নয়- এটি আমাদের সম্মিলিত ব্যর্থতার বেদনাদায়ক প্রতিচ্ছবি। ভারতের হিন্দুত্ববাদ আজ এই অঞ্চলে জায়নবাদী প্রকল্পের প্রতিনিধিতে পরিণত হয়েছে। মুসলমানদের বিরুদ্ধে সুপরিকল্পিত দমন-নির্যাতন চালিয়ে যাচ্ছে। ভারতে সম্প্রতি ওয়াকফ সম্পত্তি আইনে হস্তক্ষেপের মাধ্যমে মুসলিমদের ধর্মীয় ও ঐতিহাসিক অধিকার হরণ করা হয়েছে, যা মুসলিম উম্মাহর জন্য একটি স্পষ্ট সতর্কবার্তা।

মার্চ ফর গাজা কর্মসূচির ঘোষণাপত্রে মুসলিম বিশ্বের সরকার ও ওআইসিসহ মুসলিম উম্মাহর প্রতিনিধিত্বকারী সংগঠনগুলোর কাছে দৃঢ়ভাবে আহ্বান জানানো হয়-

১. ইসরায়েলের সঙ্গে অর্থনৈতিক, সামরিক ও কূটনৈতিক সব সম্পর্ক অবিলম্বে ছিন্ন করতে হবে।
২. জায়নবাদী রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে বাণিজ্যিক অবরোধ ও নিষেধাজ্ঞা আরোপ করতে হবে।

৩. গাজার মজলুম জনগণের পাশে চিকিৎসা, খাদ্য, আবাসন ও প্রতিরক্ষা সহযোগিতাসহ সর্বাত্মক সহযোগিতা নিয়ে দাঁড়াতে হবে।

৪. আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ইসরায়েলকে একঘরে করতে সক্রিয় কূটনৈতিক অভিযান শুরু করতে হবে।

৫. জায়নবাদের দোসর ভারতের হিন্দুত্ববাদী শাসনের অধীনে মুসলিমদের অধিকার হরণ, বিশেষকরে ওয়াকফ আইনে হস্তক্ষেপের মতো রাষ্ট্রীয় আগ্রাসনের বিরুদ্ধে ওআইসি ও মুসলিম রাষ্ট্রগুলোকে দৃঢ় প্রতিবাদ ও কার্যকর কূটনৈতিক অবস্থান নিতে হবে।

তৃতীয় অংশে বলা হয়, আমরা বাংলাদেশের সরকারের প্রতি ছয়টি দাবি জানানো হয়। এতে উল্লেখ করা হয়-

১. বাংলাদেশি পাসপোর্টে ‘এক্সেপ্ট ইসরায়েল’ শর্ত পুনর্বহাল করতে হবে এবং ইসরায়েলকে রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি না দেওয়ার অবস্থান আরও সুস্পষ্টভাবে প্রকাশ করতে হবে

২. সরকারের ইসরায়েলি কোনো প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যত চুক্তি হয়েছে, তা বাতিল করতে হবে।

৩. রাষ্ট্রীয়ভাবে গাজায় ত্রাণ ও চিকিৎসা সহায়তা পাঠানোর কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে।

৪. সব সরকারি প্রতিষ্ঠানে এবং আমদানি নীতিতে জায়নবাদী কোম্পানির পণ্য বর্জনের নির্দেশনা দিতে হবে।
৫. জায়নবাদের দোসর ভারতের হিন্দুত্ববাদী সরকারের অধীনে মুসলিম ও অন্যান্য সংখ্যালঘুদের ওপর চলমান নির্যাতনের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রীয়ভাবে প্রতিবাদ জানাতে হবে। 

৬. পাঠ্যবই ও শিক্ষানীতিতে আল-আকসা, ফিলিস্তিন এবং মুসলিমদের সংগ্রামী ইতিহাসকে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।

ঘোষণাপত্র পাঠকালে মাহমুদুর রহমান আরও বলেন, সর্বশেষ দাবিগুলো নিজেদের প্রতি, যা মূলত একটি অঙ্গীকারনামা। আজ যদি আমরা প্রস্তুত না হই, তাহলে কাল আমাদের সন্তানেরা হয়তো এমন এক বাংলাদেশ পাবে; যেখানে হিন্দুত্ববাদ ও জায়নবাদী একত্রে নতুন গাজা তৈরি করবে।

নিজেদের প্রতি জানানো দাবিগুলো হলো- 

১. আমরা সবাই স্বতঃস্ফূর্তভাবে বয়কট করবো-প্রত্যেক সেই পণ্য, কোম্পানি ও শক্তিকে যারা ইসরায়েলের দখলদারিত্বকে টিকিয়ে রাখে।

২. আমরা আমাদের সমাজ এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে প্রস্তুত করবো-যারা ইসলাম ও মুসলিম উম্মাহর সব প্রতীক ও নিদর্শনকে সংরক্ষণ ও পুনরুদ্ধার করবে।


৩. আমরা আমাদের সন্তানদের এমনভাবে গড়ে তুলবো- যারা নিজেদের আদর্শ ও ভূখণ্ড রক্ষায় জান ও মালের সর্বোচ্চ ত্যাগে প্রস্তুত থাকবে।

৪. আমরা বিভাজিত হবো না। কারণ, আমরা জানি, বিভক্ত জনগণকে দখল করতে দেরি হয় না। আমরা ঐক্যবদ্ধ থাকবো, যাতে এই বাংলাদেশ কখনো কোনো হিন্দুত্ববাদী প্রকল্পের পরবর্তী গাজায় পরিণত না হয়।

এর আগে আজ সকাল থেকেই রাজধানী ও আশপাশের বিভিন্ন জেলাসহ দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসতে শুরু করেছেন নানা শ্রেণি-পেশার মানুষ। মিছিলে অংশ নেওয়া অধিকাংশের হাতে ফিলিস্তিনের পতাকা ও বিভিন্ন স্লোগানসম্বলিত প্ল্যাকার্ড দেখা গেছে।

ফেসবুকে ‘মার্চ ফর গাজা’ নামে একটি ইভেন্ট পেজ তৈরি করেছে প্যালেস্টাইন সলিডারিটি মুভমেন্ট, বাংলাদেশ। কর্মসূচিতে বিএনপি, জামায়াত, এনসিপিসহ প্রায় সব রাজনৈতিক দল, আলেম-ওলামা সমাজসহ সব অঙ্গনের মানুষ সংহতি জানিয়েছেন। ফলে সকাল থেকে জনতার স্বতঃস্ফুর্ত অংশগ্রহণে লোকারণ্য হয়ে ওঠে উদ্যান।

সোহরাওয়াদী উদ্যানের আশেপাশের এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, উদ্যানের রমনা কালিমন্দির গেট, টিএসসি সংলগ্ন গেট, রমনা ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউট সংলগ্ন গেট, ভিআইপি গেট দিয়ে কিছুক্ষণ পরপরই মিছিলসহ সমাবেশস্থলে আসছেন অংশগ্রহণকারীরা।

এ সময় ‘ফিলিস্তিন মুক্ত করো’, ‘গাজা রক্তে রঞ্জিত, বিশ্ব কেন নীরব’, ‘তুমি কে আমি কে, ফিলিস্তিন ফিলিস্তিন’ স্লোগান দিতে থাকেন কর্মসূচিতে আসা লোকজন।

বেলা ১১টার দিকে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান, রমনা পার্ক, মৎসভবন, হাইকোর্টের সামনের এলাকা, ঢাবির কার্জন হল, কেন্দ্রীয় লাইব্রেরি এলাকা, শাহবাগ, কাটাবন, বাংলামোটর লোকে লোকরণ্য হতে দেখা যায়। এসব এলাকাগুলো দিয়ে কোনো যান চলাচল করতে দেখা যায়নি। বন্ধ ছিল রিকশাও।

এদিকে দেখা যায়, রাজধানীর বিভিন্ন মোড়ে মোড়ে পানির ট্যাংক দেখা গেছে। মার্চ ফর গাজা কর্মসূচিতে অংশ নেওয়া লোকজনদের পানি খাওয়ানো হচ্ছে। বিভিন্ন ট্রাফিক পয়েন্টগুলোতে কোনো পুলিশ দেখা যায়নি। তবে লোকে লোকারণ্য হওয়ায় ট্রাফিক ব্যবস্থা অকেজো হয়ে গেছে বলে জানায় ডিএমপির ট্রাফিক বিভাগ।   

দুপুরের দিকে উদ্যান ও এর আশেপাশের এলাকা পূর্ণ হয়ে গেলে মূল মঞ্চ থেকে মাইকে ঘোষণা দেওয়া হয়, ‘সোহরাওয়ার্দী উদ্যান ভরে গেছে, আপনারা যে যেখানে আছেন, সেখানে বসে পড়ুন।’ এরপর থেকে মিছিল উদ্যানের দিকে আসা বন্ধ হয়।

দুপুর আড়াইটার দিকে দেখা যায়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা, নীলক্ষেত, নিউমার্কেট মোড়, আজিমপুর বাসস্ট্যান্ড, বুয়েট এলাকা, চানখারপুল, গুলিস্তান, বায়তুল মোকারমের চারপাশ, জিরো পয়েন্ট, পল্টন মোড়, দৈনিক বাংলা মোড়, ফকিরাপুল, নয়াপল্টন এলাকা, শান্তিনগর, মালিবাগ, মৌচাক, মগবাজার, ফার্মগেট, কাওরান বাজার মোড়, বাংলামোটর, সায়েন্স ল্যাব, কাঁটাবন মোড় এলাকায় মানুষের ভিড় দেখা যায়। এসব এলাকায় যানবাহন চলাচল বন্ধ রয়েছে।

ঢাকা মহানগর ট্রাফিক পুলিশের ডিসি মো. শফিকুল ইসলাম সমকালকে বলেন, সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের মার্চ ফর গাজা কর্মসূচি ঘিরে ঢাকার ট্রাফিকব্যবস্থা অকার্যকর হয়ে পড়েছে। সোহরাওয়ার্দী উদ্যান ঘিরে আশেপাশের প্রায় তিন কিলোমিটার এলাকাজুড়ে কোনো যানবাহন চলছে না।

তিনি বলেন, সকালের দিকে আমরা বিকল্প সড়ক দিয়ে চলাচলের পরামর্শ দেই। পরে বিকল্প সড়কও বন্ধ হয়ে যাওয়ায় ঢাকা যেন থমকে যায়।

ডিসি মো. শফিকুল ইসলাম আরও বলেন, আমরা এখন ভাবছি, কর্মসূচি শেষ হয়ে গেলে এসব মানুষ কিভাবে যাবে, তা নিয়ে ভাবছি।

এদিকে মগবাজার এলাকায় দেখা যায়, মানুষের চাপে রামপুরা সড়কে যান চলাচল বন্ধ হয়ে গেছে। মৌচাক থেকে শান্তিনগর ফ্লাইওভার দিয়েও আসছে নারী, পুরুষ, শিশু বৃদ্ধসহ সববয়সী মানুষ। এর ফলে ফ্লাইওভার দিয়েও যান চলাচল বন্ধ হয়ে গেছে। 

এদিকে জমায়েত ঘিরে উদ্যানের আশপাশে জমে উঠেছে ফিলিস্তিনের পতাকা, মাথার ব্যাজ ও টি-শার্ট বিক্রি। আর আগ্রহ নিয়েই সেসব কিনছেন আগত অনেকেই।

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • গণঅভ্যুত্থানে শহীদদের প্রতি ড্রোন শো’র মাধ্যমে শ্রদ্ধা
  • জুলাই আন্দোলনে গুলির নির্দেশ: সহকারী কমিশনার ও অতিরিক্ত এসপি গ্রেপ্তার
  • সুরে-গানে-তালে বৈশাখকে বরণ করল রাবি
  • ট্রাইব্যুনালের মামলায় অতিরিক্ত পুলিশ সুপার অনির্বান ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট সাইফুল ইসলাম গ্রেপ্তার
  • শোভাযাত্রায় তরমুজের মোটিফ দিয়ে ফিলিস্তিনের প্রতি সংহতি
  • ‘মার্চ ফর গাজা’ বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় ঐক্য: সারজিস
  • রাবিতে বর্ষবরণের শেষ সময়ের প্রস্তুতিতে ব্যস্ত শিক্ষার্থীরা, আয়োজন সীমিত
  • গণহত্যার প্রতিবাদ জানাতে রাজধানীতে জনতার ঢল
  • গণহত্যার প্রতিবাদে সরব বাংলাদেশ
  • গণহত্যা বন্ধ ও স্বাধীন ফিলিস্তিন দাবি