তিন মাসের সুমাইয়ার পৃথিবীজুড়ে শূন্যতা, একরাশ হাহাকার। মা-বাবা বেঁচে নেই তার। আদর-স্নেহ বুঝে ওঠার আগেই পৃথিবী ছাড়লেন তারা। বছর চারেকের বড় ভাই সোয়ায়েদও আগুনে দগ্ধ। ক্ষত নিয়ে হাসপাতালের বিছানায় ছটফট করছে ছোট্ট শিশুটি।

গত ১৫ ফেব্রুয়ারি রাতে ঢাকার অদূরে সাভারের আশুলিয়ার বাসায় গ্যাসের চুলার আগুন হঠাৎ ছড়িয়ে পড়ে সারা বাসায়। আতঙ্কে প্রাণে বাঁচতে অন্যদের মতো ছোটাছুটি করছিল পোশাককর্মী সুমন মিয়ার পরিবারও। তিন মাসের সুমাইয়া তখনও ঘুমে। সুমন তাঁর দুই সন্তান নিয়ে দ্রুত ঘর থেকে বের হয়ে যান। এই ঘটনায় ১১ জন দগ্ধ হন। তাদের মধ্যে তিনজন মারা যান। বর্তমানে চিকিৎসাধীন আছেন আটজন। তাদের মধ্যে তিনজনের অবস্থা আশঙ্কাজনক। তাদের সবার বাড়ি শরীয়তপুরে।

আগুনে সুমাইয়ার শরীরের ৭ শতাংশ ঝলসে গেছে। রাজধানীর জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, সে এখনও শঙ্কামুক্ত নয়। 

গতকাল বুধবার সন্ধ্যায় জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে চিকিৎসাধীন অবস্থায় সুমাইয়ার মা শারমিন মারা যান। হাসপাতালের জরুরি বিভাগের আবাসিক চিকিৎসক শাওন বিন রহমান বলেন, ৪২ শতাংশ পোড়া নিয়ে শারমিন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন। তাঁর অবস্থা আগে থেকেই জটিল হওয়ায় তাঁকে ভেন্টিলেশনে রাখা হয়েছিল। বুধবার সকালেও অস্ত্রোপচার করা হয়েছে। সর্বোচ্চ চেষ্টা করেও তাঁকে বাঁচানো যায়নি। 

এর আগে গত রোববার ভোরে সুমাইয়ার চাচি শিউলি আক্তার এবং দুপুরে তার বাবা সুমন মারা যান। 

এই হাসপাতালে চিকিৎসা চলছে সুমাইয়ার। বার্ন ইনস্টিটিউটের পাঁচতলার ৫২০ নম্বর শয্যায় ভর্তি রয়েছে সে। ক্ষুধা পেলেই কাঁদছে শিশুটি। নিরুপায় স্বজন শিশুটির কান্না থামাতে সুমনের সহকর্মী রাশেদের স্ত্রী শারমিন সুলতানার বুকের দুধ দিচ্ছেন। শুধু সুমাইয়াকে দুধ খাওয়ানোর জন্য তার পাশের শয্যায় শুরু থেকেই আছেন তিনি।

শারমিন সুলতানা সমকালকে বলেন, আমার নিজেরও একটা আট মাসের সন্তান রয়েছে। সন্তানের কষ্ট আমি বুঝি। বুকের দুধের অভাবে শিশুটি কষ্ট পাবে– এটি মেনে নিতে পারছিলাম না। স্বামীর সহকর্মী দগ্ধ হওয়ার খবর শুনে হাসপাতালে ছুটে এসেছি।

বার্ন ইনস্টিটিউটে এখনও আটজনের চিকিৎসা চলছে। তারা হলেন– জহুরা বেগম (৭০), মনির হোসেন (৪৫), সূর্য বানু (৫০), সোহেল মিয়া (৩৮), শামিম (১৫), মাহাদী (৭) ও সোয়ায়েদ (৪)। 

.

উৎস: Samakal

এছাড়াও পড়ুন:

বৈশাখজুড়ে শতবর্ষী মেলা

বাঙালির নানা রূপের চিরায়ত লোকজ সংস্কৃতির মধ্যে বৈশাখী মেলা একটি। ঐতিহাসিকভাবে মেলার জন্য বিখ্যাত চলনবিল অধ্যুষিত জনপদ তাড়াশ। তাড়াশের কলেজশিক্ষক মোছা. মাসুমা খাতুন বলেন, ‘যেহেতু এই গ্রামীণ জনপদেই জন্ম, সেহেতু চৈত্রসংক্রান্তিতে শ্মশান থেকে হাজরা ছোটা, বৈশাখী মেলায় গিয়ে নাগরদোলায় দোল খেলা, বায়োস্কোপে বিপ্লবী ক্ষুদিরাম বসুর ফাঁসির দৃশ্য দেখে কষ্ট পাওয়া, পতুল নাচ, মৃত্যুকূপে মোটরসাইকেল খেলা, জাদু খেলা দেখা বা সার্কাসের ইয়া বড় হাতি দর্শন জীবনের এক বড় অধ্যায় হয়ে রয়েছে। সেই সঙ্গে ছোট ভাইদের জন্য টিন বা কাঠের বন্দুক, বাঁশের বাঁশি, বেলুন, আম কাটার চাকু, নিজের ও বোনদের কাচের লাল চুড়ি, চুল বাঁধার ফিতা, বনানী নামের স্নো কেনাসহ উপভোগ্য বহু ঘটনা এখনও আমায় স্মৃতিকাতর করে।’
স্থানীয় একাধিক প্রবীণ ব্যক্তি জানান, আশি ও নব্বই দশকেও তাড়াশে অনুষ্ঠিত হওয়া বেশ কয়েকটি বড় মেলায় সন্ধ্যারাত থেকে কুপি বাতি, হারিকেন, হ্যাজাক জ্বালিয়ে চলত নানা অনুষ্ঠান, হরেক রকমের পণ্যের বিকিকিনি। এখন তা চলছে বিদ্যুতের বাতিতে। তাড়াশের ২৯টি বার্ষিক মেলার সবই দিনক্ষণ নির্ধারিত হয় চান্দ্রক্ষণের ওপর নির্ভর করে। মূলত সিরাজগঞ্জ জেলার তাড়াশ উপজেলায় চৈত্র, বৈশাখ ও জ্যৈষ্ঠ– এ তিন মাসে ২৯টি মেলার আয়োজন হয় বিভিন্ন গ্রামে; যার অধিকাংশ মেলার স্থান শত বা অর্ধশত বছর আগে নির্ধারিত। এগুলোর মধ্যে উপজেলা প্রশাসন মেলার ব্যাপকতা, লোক সমাগম ও গুরুত্ব বিবেচনা করে শতবর্ষী বা শতবর্ষের কাছাকাছি ১৭টি মেলাকে একদিনের বিশেষ হাট হিসেবে ইজারা দিয়ে রাজস্ব আদায় বা টোল আদায় করে থাকে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য– বেহুলার স্মৃতি বাঁচিয়ে রাখতে বৈশাখী পূর্ণিমায় বিনসাড়া গ্রামে বসে তিন দিনের বেহুলা সুন্দরীর ‘চাঁদের মেলা’। চৈত্রের পূর্ণিমার রাতে তাড়াশের ‘বারুহাঁসের ভাদাই মেলা’, বৈশাখের তৃতীয় মঙ্গলবার বসা বড় ও ছোট ‘গুড়মা মেলা’ এবং কৃষ্ণা দিঘির ‘কৃষ্ণপুরের মেলা’ অন্যতম। অন্যদিকে জ্যৈষ্ঠের শুরুতে বসে ‘গোনতা মেলা’, ‘মাঝদক্ষিণা মেলা’, ‘রানীর হাট মেলা’, ‘আড়ংগাইল মেলা’, ‘দোবিলা মেলা’, ‘বস্তল মেলা’, ‘কুন্দইল মেলা’, ‘গুড়পিপুলের নিশানের মেলা’ প্রভৃতি।
এসব মেলা ঘিরে রয়েছে বিভিন্ন আঞ্চলিক রেওয়াজ; যা কমবেশি আজও বিদ্যমান। মেলার আগেই ঝি, জামাই, কাছের-দূরের আত্মীয়-স্বজনকে নাইওর আনার প্রচলন রয়েছে এ জনপদে। আজও ‘বারুহাঁস’, ‘গুড়মা’, ‘রানীর হাট’, ‘বেহুলার মেলা’সহ অনেক মেলা বসার আগেই স্থানীয় প্রায় প্রতিটি বাড়িতে মেয়ে জামাই, আত্মীয়-স্বজনে ঠাসা থাকে। এলাকাজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে বৈশাখী মেলার সতেজ আমেজ। সে আমেজে রেওয়াজ মেনে শ্বশুরবাড়ির পক্ষ থেকে শাশুড়ির হাত দিয়ে নতুন-পুরোনো সব জামাইকে মেলার ‘পরবি’ (নগদ টাকা) এবং মেলা শেষে বাড়ি ফিরে যাওয়ার সময় নতুন পোশাক, বিশেষ করে দামি লুঙ্গি উপহার দেওয়া এবং মেলার ঝুরি, মুড়কি, শাঁস, শুকনা মিষ্টি, রান্না করা খাবার বেঁধে আত্মীয় বাড়িতে পাঠানোর চল এখনও রয়েছে। নাইওরে আসা জামাইদেরও এসব মেলায় বড় অঙ্কের টাকা খরচ হয়। মেলা থেকে হাঁড়িভর্তি মিষ্টি, বড় মাছ, মাংস, শাশুড়ির জন্য পান-সুপারি কিনে শ্বশুরবাড়িতে নিয়ে যেতে হয়। সে ক্ষেত্রে অনেক জামাই শ্বশুরের নাম রাখতে প্রতিযোগিতা করে মেলার সবচেয়ে বড় মাছ কিনে থাকেন। এ ছাড়া শ্যালক-শ্যালিকা ও তাদের সন্তানসহ ছোটদের মেলার পরবি দেওয়া বা অন্য উপহারের আবদার মেটানোও জামাইদের পুরোনো রেওয়াজ। তাড়াশের বৈশাখী মেলায় চিনি দিয়ে তৈরি সুস্বাদু হাতি, ঘোড়া, হরিণ, পাখি আকৃতির ছাঁচ, খাগড়াই, বাতাসা, কদমা প্রচুর পরিমাণে বিক্রি হয়। আরও রয়েছে বাহারি মিষ্টি রসগোল্লা, চমচম, ছানার জিলাপি, রসমালাই, শাহি, ক্ষীরশা দই। এ ছাড়া মেলায় শত শত মণ ঝুরি বিক্রি হয়। বাঁশ-বেতের জিনিস, কাঠের আসবাব, মসলা, শীতলপাটি, মৃৎ পাত্র, খেলনা, কসমেটিক সামগ্রী, কৃষিজ উপকরণ– হরপাট, কারাল, ডালি, টুপরি, চালুন, কুলা এমনকি হাতপাখা, চুন, পান-সুপারি ইত্যাদি তো আছেই। সব মিলিয়ে তাড়াশের ২৯টি মেলায় দুই-আড়াই মাসের মধ্যে কয়েক কোটি টাকার পণ্য কেনাবেচা হয়। তাড়াশের নওগাঁ জিন্দানী ডিগ্রি কলেজের বাংলা বিভাগের প্রভাষক সনাতন দাশ বলেন, ‘এটা শুধু অর্থনৈতিক বিষয় নয়। সব বয়সী লাখো মানুষের মেলাকেন্দ্রিক বাঙালি সংস্কৃতির অদৃশ্য খোরাক পূরণ হয় এসব মেলায়। উৎসবের মূল্যের কাছে অর্থের মূল্য অতি নগণ্য।’ 

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • আইফেল টাওয়ারে ‘শান্তির বার্তা’
  • বৈশাখজুড়ে শতবর্ষী মেলা
  • দর্শনা চেকপোস্টের কক্ষে ঝুলছিল পুলিশ সদস্যের লাশ
  • দর্শনা চেকপোস্টে নিজ ঘরে ঝুলছিল পুলিশ সদস্যের মরদেহ
  • দুধপত্রীর নারী উদ্যোক্তারা ও ক্ষীণাঙ্গী শালিগঙ্গা
  • বন্দির স্মৃতিতে বাংলাদেশের গোপন কারাগার
  • চলতি মাসেই আইএমএফের ঋণের কিস্তির বিষয়ে সমঝোতা, জুনে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত
  • পুলিশ পরিদর্শক মামুন হত্যায় দুবাইয়ের সোনা ব্যবসায়ী আরাভসহ আটজনের যাবজ্জীবন
  • শিশু জুঁই হত্যা: অপরাধীদের গ্রেপ্তার দাবিতে শিক্ষার্থীদের মানববন্ধন 
  • চীনের বাণিজ্যযুদ্ধের হাতিয়ার মিলতে পারে বাংলাদেশেও