তথ্যপ্রযুক্তি খাতে নতুন সূচনা যেভাবে সম্ভব
Published: 20th, February 2025 GMT
তথ্যপ্রযুক্তি খাত আমাদের অসীম সম্ভাবনার স্বপ্ন দেখিয়েছে বারবার। স্বপ্নচারিতায় বিভোর হয়ে আমরা কখনও অতিপ্রত্যয়ে ভুগেছি, কখনও অবিমৃষ্যকারী সিদ্ধান্ত নিয়েছি। দুর্নীতির কারণেও পিছিয়ে পড়েছি। ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ স্বপ্নটিও ছিল বহুলাংশে রাজনৈতিক বাগাড়ম্বরপূর্ণ।
২০২৪ সালের জুলাই-আগস্ট আন্দোলনের সময় সারাদেশে যেভাবে টানা পাঁচ দিন ইন্টারনেট বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল এবং চাপের মুখে চালু করা হলেও গতি এতই কমিয়ে রাখা হয়েছিল যে, বেশির ভাগ রপ্তানিমূলক কাজ চরমভাবে ব্যাহত হয়েছিল। এতে বিদেশি ক্রেতাদের মধ্যে আস্থার যে সংকট দেখা দিয়েছিল, তা এখনও বিদ্যমান। অনেক বিদেশি সেবাগ্রহীতা তাদের আউটসোর্সড কাজগুলো ভারত, শ্রীলঙ্কা, ভিয়েতনাম, ফিলিপাইনে সরিয়ে নিয়ে গিয়েছিল। সেগুলোর বেশির ভাগ এখনও আমাদের কাছে ফিরে আসেনি।
বিদেশি ক্লায়েন্টদের চুক্তি পূরণে ব্যর্থ হওয়ায় অর্ডার বাতিল, নেতিবাচক রিভিউ এবং র্যাঙ্কিং হারানোর মতো দীর্ঘস্থায়ী সমস্যায় ভুগতে হয়েছে দেশের ফ্রিল্যান্সার, আইটি ও বিপিও কোম্পানিগুলোকে। বিভিন্ন বিপিও এবং আউটসোর্সিং কোম্পানির দুই শতাধিক কর্মী নেপাল, ব্যাংকক, থাইল্যান্ড ও ভারতে চলে গিয়ে সেখান থেকে কাজ চালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছিল। কয়েকটি বিদেশি বিপিও কোম্পানি তাদের হেড অফিস বা রিজিওনাল অফিস বাংলাদেশ থেকে অন্যত্র সরিয়ে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। বাংলাদেশে যখন একাধিক আন্তর্জাতিক ডেটা সেন্টার স্থাপনের কাজ হচ্ছিল, সেই মুহূর্তে ইন্টারনেট যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হওয়া সেই প্রচেষ্টাকে ব্যাহত করেছিল।
ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তাসহ পুরো এফ-কমার্স খাতে ১ হাজার ৭৫০ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে ইন্টারনেট বন্ধ করে দেওয়ায়। সফটওয়্যার রপ্তানি খাতে ৫০০ কোটি টাকার আর্থিক ক্ষতির পাশাপাশি আন্তর্জাতিক ক্লায়েন্টদের আস্থা হারানোর ফলে জব মার্কেটেও এর নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে।
বিদায়ী বছরে সাইবার নিরাপত্তাও বড় সংকট হিসেবে দেখা দিয়েছিল। ব্যাংক, সংবাদমাধ্যমসহ বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান সাইবার হামলার শিকার হয়েছে, যা দেশের তথ্যপ্রযুক্তি অবকাঠামোর দুর্বলতা উন্মোচিত করেছে। এ ছাড়াও সাইবার আক্রমণ সাধারণ মানুষের নিরাপত্তা ও আস্থাকে চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলছে।
এসব সমস্যা সমাধানে চলতি বছর কিছু গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নিতে হবে। বরাদ্দকৃত অর্থের স্বচ্ছ ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করে প্রকৃত আইটি কোম্পানিগুলোর সঙ্গে অংশীদারিত্ব গড়ে তুলতে হবে।
ইন্টারনেটকে ‘জরুরি সেবা’ হিসেবে অবিলম্বে ঘোষণা দিতে হবে। একই সঙ্গে ইন্টারনেট পরিষেবার ওপর থেকে ভ্যাটসহ সব শুল্ক প্রত্যাহার করতে হবে। এতে ইন্টারনেটের ব্যবহার বাড়বে, অনলাইনে লেনদেন বাড়বে, নতুন ব্যবসা ও ব্যবসার সম্প্রসারণ হবে। ফলে সরকারের রাজস্ব বৃদ্ধি পাবে। এ ধরনের দূরদর্শী সিদ্ধান্ত একটি প্রযুক্তিবান্ধব সমাজ তৈরিতে অবদান রাখবে।
সাইবার নিরাপত্তার জন্য একটি কেন্দ্রীয় কাঠামো তৈরি করে সাইবার নিরাপত্তায় দক্ষ জনশক্তি বাড়াতে হবে। ফায়ারওয়াল ও অন্যান্য নেটওয়ার্ক সিকিউরিটির জন্য প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতির ওপর থেকে শুল্ক ন্যূনতম পর্যায়ে নামাতে হবে। বিভিন্ন প্রশিক্ষণমূলক প্রজেক্টে নিয়মিত অডিট চালানো জরুরি। শিক্ষার্থীরা কতটা প্রশিক্ষিত হলো, তা তৃতীয় পক্ষের মূল্যায়ন প্রয়োজন। দক্ষতার ঘাটতি পূরণে ইন্ডাস্ট্রি-একাডেমিয়া অংশীদারিত্বের মাধ্যমে প্রশিক্ষণ কার্যক্রম উন্নত করতে হবে।
সব বিদেশি পক্ষের সঙ্গে করা সরকারি চুক্তিতে পরিমার্জন এনে দেশীয় ভ্যালু অ্যাডিশন নিশ্চিত করতে হবে। ভবিষ্যতে সব ধরনের হার্ডওয়্যার ক্রয়ে স্থানীয় সংযোজন বাধ্যতামূলক করতে হবে। এ ছাড়াও যেসব বেসরকারি প্রতিষ্ঠান দেশীয় সফটওয়্যার বা দেশে সংযোজিত হার্ডওয়্যার ক্রয় ও ব্যবহার করবে, তাদের জন্য বিশেষ প্রণোদনার ব্যবস্থা রাখা যেতে পারে।
আইটি উদ্যোক্তাদের কাছে বড় চ্যালেঞ্জগুলোর অন্যতম হলো ব্যাংক ঋণ পাওয়া। স্থাবর সম্পত্তি জামানত দিতে সক্ষম না হওয়ায় বেশির ভাগ উদ্যোক্তাই ঋণ পেতে অপারগ হন। তাই মেধাস্বত্ব মূল্যায়নের ব্যবস্থা করে সেটাকে অ্যাসেট হিসেবে দেখানোর বিধান করা প্রয়োজন। সেই সঙ্গে যদি সরকার অন্তত ৫০ শতাংশ গ্যারান্টি নিশ্চিত করতে পারে, তাহলে ব্যাংকগুলো ঋণ দিতে উৎসাহিত হবে। ক্ষতিগ্রস্ত উদ্যোক্তাদের জন্য আর্থিক সহায়তা ও প্রযুক্তি প্রশিক্ষণ প্রোগ্রাম চালু করা গেলে ইমেজ সংকট কাটিয়ে উঠে তথ্যপ্রযুক্তি খাত নতুনভাবে ঘুরে দাঁড়াতে পারবে। মধ্যস্বত্বভোগী বাদ দিয়ে ট্রান্সমিশন খরচ কমিয়ে গ্রামাঞ্চলে ইন্টারনেট সুবিধা সম্প্রসারণ করে এবং নারী ও প্রান্তিক জনসাধারণের জন্য বিশেষ উদ্যোগ গ্রহণের মাধ্যমেও ডিজিটাল বিভাজন দূর করা সম্ভব হবে।
তরুণ জনগোষ্ঠীর এই দেশে আইসিটি সেক্টরে রয়েছে অপার সম্ভাবনা। দূরদর্শী পরিকল্পনা ও সুষ্ঠু বাস্তবায়নের মাধ্যমে এ খাতকে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের অন্যতম চালিকাশক্তি হিসেবে গড়ে তোলা সম্ভব। বিগত বছরের অভিজ্ঞতা এবং চ্যালেঞ্জগুলো থেকে শিক্ষা নিয়ে চলতি বছর হতে পারে আইসিটি সেক্টরের জন্য একটি নতুন সূচনা।
সৈয়দ আলমাস কবীর: উদ্যোক্তা, পলিসি অ্যাডভোকেট ও আইটি পরামর্শক
.উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: আইস ট খ ত র জন য চ ত কর ব যবস সরক র
এছাড়াও পড়ুন:
বন্ধুগো শোনো...
শ্রোতা প্রাণ খুলে গাইছে, কখনও ফেটে পড়ছে উল্লাসে– এমন দৃশ্যের সাক্ষী হতে চান প্রায় সব শিল্পী। দিলশাদ নাহার কনা এর ব্যতিক্রম নন। নন্দিত এই শিল্পীর চাওয়া পূরণ হয়েছে বহু বছর আগেই; বরং তাঁর গাওয়া গানগুলোর সঙ্গে অনুরাগীদের উল্লাসে মেতে ওঠার দৃশ্য প্রতিনিয়ত দেখা যায়। শুধু তাই নয়, এমন অনেক গান আছে, যা দীর্ঘ সময় শ্রোতামনে অনুরণন তুলে যাচ্ছে। যার সুবাদে কনা নিজেও রপ্ত করে ফেলেছেন উৎসব আয়োজনগুলো জমকালো করে তোলার মন্ত্র। বেশি দূরের নয়, সদ্য পেরিয়ে আসা ঈদ আর বৈশাখী আয়োজনের দিকে যদি নজর দিই। তাহলে দেখা যাবে এই দুই উৎসবের জনপ্রিয় গানগুলোর বেশির ভাগই কনার গাওয়া। শ্রোতার মুখে মুখে ফিরছে ‘জ্বীন-৩’ সিনেমায় ইমরানের সঙ্গে গাওয়া তাঁর ‘কন্যা’ গানটি। পাশাপাশি ঈদের সিনেমা ‘জংলি’-তে নন্দিত সুরকার প্রিন্স মাহমুদের কথা-সুর ও সংগীতায়োজনে গাওয়া ‘বন্ধুগো শোনো’ গানটিও প্রশংসা কুড়িয়ে নিচ্ছে। এই গানেও কনার সহশিল্পী ইমরান। এর বাইরেও আসিফ আকবরের সঙ্গে দ্বৈত কণ্ঠে গাওয়া অডিও গান ‘ভীষণরকম ভালোবাসি’, আরিটিভির ‘আর মিউজিকে’ অনুষ্ঠানে গাওয়া ফিউশন গান ‘বাউলা কে বানাইলো রে’, ‘মন দিতে চাই’ নাটকে ইমরানের সঙ্গে গাওয়া ‘ভালোবাসা এমনই হয়’, ‘পায়েল’ নাটকে সালমান জাইমের সঙ্গে গাওয়া ‘বুকে লাগে টান’, ‘মন দুয়ারী’ নাটকে নাজির মাহমুদের সঙ্গে গাওয়া ‘তোমার ব্যথায় আমি’ এবং ‘হৃদয়ে রেখেছি গোপনে’ নাটকে ইমরানের সঙ্গে গাওয়া ‘তুই আমার ভালোবাসা’সহ আর বেশ কিছু গান শ্রোতার মনোযোগ কেড়ে নিয়েছে। তাই সময়টা যে এখনও কনার দখলে, তা নতুন করে বলার প্রয়োজন পড়ে না। প্রায় দুই দশক ধরে গানের ভুবনে কনার বিচরণ। দীর্ঘ সংগীত সফরে শিশুশিল্পী থেকে হয়ে উঠেছেন একজন পরিণত ভার্সেটাইল শিল্পী। তা সম্ভব হয়েছে গানের প্রতি অগাধ ভালোবাসা আর নিরলস সংগীতচর্চার মধ্য দিয়ে। শ্রোতার কাছে তার সব নিবেদন। সে কারণে আমরা তাঁকে দেখি, দিনমান দেশ-বিদেশের মঞ্চে ছুটে বেড়াতে। গানে গানে সিনেমা, নাটক, অ্যালবাম, বিজ্ঞাপনের জিঙ্গেল থেকে শুরু করে রেডিও, টিভি আয়োজনসহ সব মাধ্যমে ছড়িয়ে দিচ্ছেন তাঁর কণ্ঠ। খ্যাতির মোহে নাকি সাত সুরের মায়াজালে বাঁধা পড়েছেন বলে এই ব্যস্ততা? সে প্রশ্ন করলে কনা হেসে বলেন, ‘খ্যাতির মোহে না, শিল্পী পরিচয় ভালোবাসি বলেই সংগীতে ডুবে আছি। শ্রোতার ভালোবাসা পেয়েছি বলে তাদের প্রত্যাশা পূরণের দায় অনুভব করি। তাই শ্রোতা যতদিন নতুন কিছু চাইবেন এবং চেষ্টা করে যাব তাদের নতুন কিছু দেওয়ার।’ প্রত্যাশা পূরণ করতে গিয়ে এসব মাধ্যমে সরব থাকার চেষ্টা, তা কি মনের মধ্যে বাড়তি কোনো চাপ তৈরি করে না? ‘একদমই না। কারণ যখন যা করি, তা আনন্দ নিয়েই করি। তাই কোনো কাজে আলাদা কোনো চাপ অনুভব করি না। তা ছাড়া জনপ্রিয়তার মোহে যে কোনো কাজ করার ইচ্ছা কখনও ছিল না। তাই প্রতিটি কাজে থাকে যত্ন ও ভালোবাসার ছাপ।’ কনার এ কথায় বোঝা গেল, সংগীতের সঙ্গে তাঁর সম্পর্কটা নিবিড় ভালোবাসার। তাই দিনরাত গানের আয়োজন নিয়ে ব্যস্ত থাকতে ভালোবাসেন। এ কারণে গায়কীতে বারবার নিজেকে ভেঙে নতুনভাবে উপস্থাপন করে চলেছেন। সে কারণে আধুনিক মেলো-রোমান্টিক গান থেকে শুরু করে রক, পপ, টোকনো, ফোক ফিউশনসহ বিভিন্ন ধাঁচের গান তাঁর কণ্ঠে শোনার সুযোগ পান সংগীতপ্রেমীরা। আগামীতেও সেই সুযোগ পাবেন– সেই প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন কনা নিজে।