দীর্ঘ পাঁচ বছর ইরাকে থাকার কারণে আরবি ভাষা কিছুটা রপ্ত করেছিলাম। স্থানীয়দের সঙ্গে কাজ চালিয়ে নিতে ওটা ছাড়া গত্যন্তর ছিল না। স্থানীয়রা বাংলাদেশি, পাকিস্তানি, ভারতীয়, শ্রীলঙ্কান, থাই, ফিলিপিনোদের ‘রফিক’ বলেই সম্বোধন করত। রফিক বঙ্গানুবাদে বন্ধু। এক দিন ইতালির নাগরিক একজনকে ‘সাদিক’ বলে সম্বোধন করায় আমার খটকা লেগেছিল।
ইতালীয়কে জড়িয়ে ধরে অনেকক্ষণ খোশগল্প করেছিল, আমার উপস্থিতিতে। আমার দিকে তখন ইরাকির কোনো আগ্রহ দেখিনি; বরং উপেক্ষাই লক্ষ্য করেছি। ইতালীয় নাগরিক বিদায় নেওয়ার পর আমার সঙ্গে কথা বলার সুযোগ না দিয়ে তাকে জিজ্ঞেস করি, আমাকে তুমি রফিক বলো, অথচ ইতালীয়কে সাদিক বললে কেন? সে হেসে বলে, তোমরা অর্থাৎ ‘খাতাইয়া’ দরিদ্র দেশের মানুষেরা রফিক। আর উন্নত দেশের মানুষদের আমরা সাদিক বলে থাকি। এটি শুধু আমি নই, এখানকার সবাই তা বলে।
সাদিক অর্থ কী? জিজ্ঞেস করলে বলে– সম্ভ্রান্ত বন্ধু। অর্থাৎ বন্ধু শব্দটিও শ্রেণিনিরপেক্ষ নয়, শ্রেণিবিভাজিত। সেটি প্রথম ওই ইরাকির কাছ থেকেই জেনেছিলাম। বন্ধু শব্দও যে শ্রেণিবিভাজিত, তা আগে জানা ছিল না। ওই দিনই প্রথম জেনেছিলাম। বন্ধুত্বের মধ্যে শ্রেণিবিভাজন থাকা স্বাভাবিক। কেননা, আমরা একটি শ্রেণিবিভক্ত সমাজে বসবাস করছি। প্রত্যক্ষ-অপ্রত্যক্ষ শ্রেণির ভূমিকা ও শ্রেণির প্রভাব পদে পদে অনুভব করে থাকি। বন্ধুত্বের নিকটবর্তিতা এবং দূরবর্তিতা শ্রেণিগত অবস্থানের ওপরেই নির্ভর করে। শ্রেণির ভূমিকা যে কতটা শক্তিশালী, সেটা ভুক্তভোগী মাত্রই জানে এবং তার শিকারও হয়।
আদিম যুগে কিন্তু শ্রেণিবিভাজন ছিল না। ছিল না শ্রেণিশোষণও। প্রকৃতির নানাবিধ প্রতিকূলতা, হিংস্র-বন্যপ্রাণীর আগ্রাসন-আক্রমণ থেকে নিজেদের সংগঠিত উপায়ে রক্ষা করত আদিম মানুষ। একত্রে শিকার করে সমবণ্টনে আহার করত। গুহায় একত্রে বসবাস করত। শ্রেণিসমতার আদিম যুগকে তাই আদিম সাম্যবাদী সমাজ ব্যবস্থা নামে অভিহিত করা হয়। সভ্যতার বিকাশের ধারাবাহিকতায় মানুষের ব্যক্তিগত চাওয়া-পাওয়া, আশা-আকাঙ্ক্ষা, স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি লাভ, উত্তরাধিকারের সংস্কৃতির মধ্য দিয়েই শ্রেণিবিভাজন সূচিত হয়েছে। নারীও পিতৃতান্ত্রিকতার বৃত্তে আবদ্ধ হয়ে ব্যক্তিমালিকানায় চলে যায়।
শ্রেণিস্বার্থ, ব্যক্তিগত সম্পত্তির মোহ, ভোগ-বিলাসের তাড়নায় সহজেই মানুষ আকৃষ্ট হয়। পথভ্রষ্ট হয়ে পড়ে। শ্রেণির এই আকাঙ্ক্ষায় আদর্শচ্যুত মানুষের অভাব নেই দেশে কিংবা বিদেশে। শ্রেণিগত বিষয়টি তাই অতীব গুরুত্বপূর্ণ। শ্রেণি ত্যাগ করা আপাত সহজ নয়। শ্রেণিচ্যুতি মানে কিন্তু গরিব হওয়া নয়। শ্রেণিচ্যুতির মূল বিষয় হচ্ছে শ্রেণিস্বার্থ পরিত্যাগ করে সমষ্টিগত স্বার্থকে প্রধান করে দেখা। আমাদের ভূখণ্ডের ইতিহাসে শ্রেণিত্যাগী অনেকেই ছিলেন বটে, কিন্তু শ্রেণির টানেই পথভ্রষ্ট হয়েছেন এবং হচ্ছেনও। আমরা একই সমাজে বসবাস করলেও শ্রেণিবৈষম্যের কারণেই পরস্পর নিকটবর্তী হতে পারি না; বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ি। শ্রেণিবিভাজন সামাজিক জীবনেই কেবল নয়; পরিবারের অভ্যন্তরে পর্যন্ত ক্রিয়াশীল। মানুষ শ্রেণিস্বার্থ ত্যাগ করতে না পারার আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ হচ্ছে, বিদ্যমান ব্যবস্থা। যে ব্যবস্থা ব্যক্তিগত মালিকানায়, ব্যক্তিগত উন্নতিতে উৎসাহ জুগিয়ে থাকে। অর্থাৎ পুঁজিবাদী ব্যাধি আমাদের ক্রমান্বয়ে জরাগ্রস্ত করে তুলেছে। সামাজিক ও সামষ্টিক চিন্তা-চেতনার বিপরীতে কেবলই আত্মকেন্দ্রিকতার বৃত্তে আটকে ফেলতে উৎসাহিত করা হচ্ছে। এই বৃত্ত ভাঙা তাই দুর্লঙ্ঘ্য বটে, তবে ভাঙা যে একেবারেই অসাধ্য, তা কিন্তু নয়।
বিকাশমান মানব সভ্যতার বিবর্তনের বাঁকে একে একে নানা ধর্মমত এসেছে। কিন্তু শ্রেণিবিভাজন বিলোপে কোনো ধর্মমতেই নির্দিষ্ট অনুশাসন নেই। শ্রেণিবিভাজন ও বৈষম্য সহনীয় পর্যায়ের জন্য কিছু সংস্কারের কথা বলা হলেও, শ্রেণিবিভক্ত সমাজ ব্যবস্থার পক্ষেই ধর্মমতের অবস্থান নির্ধারিত। এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে ঘৃণিত ব্যবস্থাটি আরোপিত হয়েছে সনাতন ধর্মের বর্ণাশ্রম প্রথায়। যেটি প্রকারান্তরে শ্রেণিশোষণের উদ্দেশ্যে আরোপ করা হয়েছিল; মনুসংহিতায়। বৈদিক যুগে বর্ণভেদ না থাকলেও পৌরাণিক যুগে জাতবৈষম্যকে বংশপরম্পরারূপে স্বীকার করা হয়। আর্য সমাজের ভিত্তিমূলে ছিল বর্ণ প্রথা, জাতবৈষম্য। প্রকারান্তরে যেটি শ্রেণিশোষণই বটে। ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ও শূদ্র– এই চার জাত বিভাজনে মানুষকে বিভক্তিকরণে আর্য সমাজ গড়ে উঠেছিল। ব্রাহ্মণ স্রষ্টার মুখ, ক্ষত্রিয় বাহু, বৈশ্য ঊরু এবং ঈশ্বরের দুই পা থেকে সৃষ্ট শূদ্র। হরিবংশ, মহাভারত, পদ্মপুরাণে এ তথ্য রয়েছে। জাত-বর্ণ প্রসঙ্গে মহাভারতের শ্লোক উদ্ধৃত করে সমাজপতি শ্রেণিশোষকরা গাত্রবর্ণের নমুনায় বলেন, ব্রাহ্মণ শুভ্র, ক্ষত্রিয় লোহিত, বৈশ্য পীত এবং শূদ্র কৃষ্ণ বর্ণের। এই বর্ণ বিভাজনেই সমাজে তাদের সামাজিক মর্যাদা, জীবিকা, জীবনযাপন নির্ধারিত হয়। উদ্দেশ্য ওই শ্রেণিশোষণকে নিশ্চিত করাই। অস্পৃশ্যরা ওই চার বর্ণের অন্তর্গত নয় বলেই তারা অসৎ, শূদ্র, ইতরবিশেষ।
বৈদিক সাহিত্য ‘রামায়ণ’ ও ‘মহাভারত’-এ যারা পতিত ব্রাত্য শ্রেণি ছিল; আজকের যুগেও তারা দলিত হরিজন, অস্পৃশ্য, নমঃশূদ্র, নিম্নবর্গীয়। একমাত্র হিন্দু ধর্মমতেই মানুষের জীবন-জীবিকা নির্ধারিত। রজক, চর্মকার, নট, বরুড়, মেদ, ভিল্ল ও কৈবর্ত্য– এই সাত পেশাজীবী সমাজে ঘৃণিত ব্রাত্য-নমঃশূদ্র। বর্ণের শ্রেণিবিভাজনে ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য উচ্চবর্ণ; আর মেহনতি-শ্রমজীবীরা ব্রাত্য-নমঃশূদ্র। অস্পৃশ্যরা বর্ণহীন পাণ্ডব বর্ণবিশেষ। অথচ সভ্যতার চালিকাশক্তি অন্ত্যজ শ্রেণির ব্রাত্যরাই উৎপাদকরূপে সমাজ ও সভ্যতার অগ্রগতিতে সর্বাধিক অবদান রাখার পরও তাদের সামাজিক মর্যাদা বলে বাস্তবে কিছু নেই। সমাজের দাস, সেবকরূপে কৃষি, শিল্প থেকে উৎপাদনে এই ব্রাত্য শ্রেণির মানুষই মানুষের অন্ন, বস্ত্র, আহার জোগান দিয়ে আসছে যুগ-যুগান্তর থেকে। অথচ ধর্মমতে এরা অন্ত্যজ-ব্রাত্য। মনুসংহিতা বিধান দিয়েছে, বিশ্বের সব সম্পদ ও সম্পত্তি ব্রাহ্মণের। কারণ ব্রাহ্মণরা ঈশ্বরের মুখ থেকে সৃষ্ট। শূদ্রদের ওপর আরোপিত দায়িত্ব, কর্তব্য, কর্ম করতে তারা বাধ্য। না হলে ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্যের জীবন সুখকর থাকবে না। যোগ্যতা-ক্ষমতার পরও শূদ্রদের সম্পদের কোনো অধিকার নেই। কেননা, শূদ্ররা সম্পদের অধিকারী হলে উচ্চবর্ণের স্বাচ্ছন্দ্যে বিঘ্ন ঘটবে। হিন্দু ধর্মই একমাত্র ধর্ম, যেটি জাতি প্রথার ভিত্তিতে সমাজে শ্রেণিশোষণকে স্বীকৃতি দিয়েছে। অন্য কোনো ধর্মমতে এমনটি নেই সত্য, তবে শ্রেণিবৈষম্যের স্থায়ী নিরসনের পক্ষেও অপরাপর ধর্মমতে সুনির্দিষ্ট অনুশাসনের কথা বলা নেই। যেটি আছে সেটি কেবলই সংস্কার। অর্থাৎ কিছুটা সহনশীলতার আবরণ মাত্র; শ্রেণিসমতা প্রতিষ্ঠা নয়।
শ্রেণির প্রভাব যে কত তীব্র-অমানবিক, সেটা এসব ঘটনায় আঁচ করা যায়। শ্রেণিপার্থক্যই মানুষের প্রতি মানুষের দূরত্বের প্রধান কারণ। শুধু মানুষে মানুষে নয়; আপন পরিবার, আত্মীয়-পরিজনের মধ্যে আন্তঃসম্পর্ক থাকা না-থাকার ক্ষেত্রেও শ্রেণিগত অবস্থান চরম ক্রিয়াশীল। শ্রেণিসমস্যা নিরসনের একমাত্র পথ বিদ্যমান ব্যবস্থার বদল। বিদ্যমান ব্যবস্থা চালু রেখে সংকট থেকে উত্তরণের বিকল্প কোনো পন্থা নেই।
মযহারুল ইসলাম বাবলা: নির্বাহী সম্পাদক, নতুন দিগন্ত
.উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: শ র ণ ব ভ জন ব যবস থ বর ণ র
এছাড়াও পড়ুন:
জাতীয় স্মৃতিসৌধে প্রধান উপদেষ্টার শ্রদ্ধা নিবেদন
মহান স্বাধীনতা ও জাতীয় দিবস উপলক্ষ্যে সাভারের জাতীয় স্মৃতিসৌধে ৭১ এর শহীদ বীর শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস।
বুধবার সকাল ৬টার দিকে তিনি ফুল দিয়ে বীর শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানান।
পুষ্পস্তবক অর্পণের পর ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের বীর শহীদদের স্মৃতির প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা জানাতে সেখানে কিছু সময় নীরবে দাঁড়িয়ে থাকেন প্রধান উপদেষ্টা।
এ সময় বাংলাদেশ সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী ও বিমানবাহিনীর সমন্বয়ে গঠিত একটি চৌকস দল রাষ্ট্রীয় অভিবাদন জানায়। প্রধান উপদেষ্টা স্মৃতিসৌধ প্রাঙ্গণে রাখা দর্শনার্থী বইয়ে স্বাক্ষর করেন।
এর আগে ভোর ৫টা ৫০ মিনিটের দিকে ৭১ এর বীর মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি শ্রদ্ধা জানান রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন। পুষ্পস্তবক অর্পণের পর ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের বীর শহীদদের স্মৃতির প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা জানাতে সেখানে কিছু সময় নীরবে দাঁড়িয়ে থাকেন রাষ্ট্রপতি।
প্রধান উপদেষ্টার পর উপদেষ্টা পরিষদের সদস্যরা এবং মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক উপদেষ্টার নেতৃত্বে বীরশ্রেষ্ঠ পরিবার, যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা ও বীর মুক্তিযোদ্ধারা পুষ্পস্তবক অর্পণ করেন।
এরপর একে একে বিদেশি কূটনীতিক, বিভিন্ন রাজনৈতিক–সামাজিক সংগঠনসহ সর্বস্তরের মানুষ স্মৃতিসৌধে পুষ্পস্তবক অর্পণ করে শহীদ বীর মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি শ্রদ্ধা জানান।