চট্টগ্রামের আনোয়ারা উপজেলার গুয়াপঞ্চক গ্রামের বাসিন্দা নুরুল আবছার। পেশায় মুদি দোকানি। ১৬ ফেব্রুয়ারি রাত ১১টার দিকে ঘরের দরজা খুলতেই দেখেন, সামনে দাঁড়িয়ে আছে বিশাল এক হাতি! ঘরের দরজায় এভাবে হাতি দেখেই মূর্ছা যাওয়ার অবস্থা তাঁর। কিছু বুঝে ওঠার আগেই শুঁড় দিয়ে পেঁচিয়ে আবছারকে কিছুদূর টেনে নিয়ে যায়। শুঁড় থেকে ফেলে হাতিটির একটা পা তাঁর পায়ে রাখতেই ভেঙে যায় সেই পা। তাঁর চিৎকারে ছুটে আসেন প্রতিবেশীরা। এক পর্যায়ে পালিয়ে যায় হাতি, প্রাণে বেঁচে যান নুরুল আবছার। তাঁকে ভর্তি করা হয় চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে।

নুরুল আবছারের ভাগনে হেলাল উদ্দিন বলেন, ‘রাতে হঠাৎ কোনো সাড়াশব্দ ছাড়াই বন্যহাতিটি ঘরের সামনে চলে আসে। এ সময় মামা দরজা খুলতেই হাতিটি শুঁড় দিয়ে তাঁকে টেনে নিয়ে যায়। এভাবে রাতের পাশাপাশি দিনেও হাতি নেমে আসছে লোকালয়ে। ফলে হাতি-আতঙ্ক এখন আমাদের নিত্যসঙ্গী হয়ে উঠেছে।’

একসময় গাছগাছালি আর ঘন বন-জঙ্গলে ভরপুর ছিল দক্ষিণ চট্টগ্রামের পাহাড়গুলো। যেখানে ছিল বিভিন্ন প্রজাতির পশুপাখি। ছিল আশ্রয়, আর পর্যাপ্ত খাবারও। গাছপালা কেটে সাফ করে ফেলায় ধ্বংস হয়ে গেছে পশুপাখির আবাসভূমি। স্থানীয় বাসিন্দারা বলছেন, আশ্রয় হারিয়ে, খাবার না পেয়ে হাতির পাল যখন-তখন নেমে আসছে লোকালয়ে। এতে হাতির হানায় মানুষ যেমন মারা যাচ্ছে, তেমনি মানুষের রোষানলে পড়ে মারা যাচ্ছে হাতিও। 

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে দক্ষিণ চট্টগ্রামের বোয়ালখালী, পটিয়া, আনোয়ারা, কর্ণফুলী, বাঁশখালীসহ বিভিন্ন উপজেলায় প্রায়ই দিনে বা রাতে লোকালয়ে হাতি নেমে আসার ঘটনা ঘটছে। 

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, আনোয়ারা-কর্ণফুলী উপজেলায় ২০১২ সালের ১ মার্চ আনোয়ারায় হাতির হামলায় শাহ মীরপুরের জুয়েল দাশ নামে এক শিশু নিহত হয়। এর পর বিভিন্ন সময় আরও হতাহতের ঘটনা ঘটে। ২০১৮ সালের জুলাই থেকে এখন পর্যন্ত দক্ষিণ চট্টগ্রামের আনোয়ারা ও কর্ণফুলী উপজেলায় ১৭ জন নিহত হয়েছেন হাতির আক্রমণে। এ ছাড়া আহত হন অনেকে। একইভাবে গত ১০ বছরে মানুষের হাতে মারা পড়েছে ১৯টি হাতি।

কেইপিইজেডে আতঙ্ক 

আনোয়ারা উপজেলার পাহাড়ে হাতির ডেরায় গড়ে তোলা হয়েছে কোরিয়ান এক্সপোর্ট প্রসেসিং জোন  (কেইপিজেড)। প্রায় সময় হাতি হাজির হচ্ছে কলকারখানার সামনে। এখানেও হাতির হানায় হতাহতের ঘটনা ঘটছে। হাতির আক্রমণে কেইপিজেডের আশপাশের গ্রামে কয়েক বছরে অন্তুত ২০ নারী-পুরুষের প্রাণহানি হয়েছে।

কেইপিজেডে দেশি-বিদেশি প্রায় ৩৩ হাজার কর্মকর্তা-কর্মচারী রয়েছেন। সম্প্রতি এখানে মো.

হাকিম নামে এক নিরাপত্তারক্ষী হাতির কবলে পড়ে গুরুতর আহত হন। এর আগে গত বছরের ৬ সেপ্টেম্বর কেইপিজেডের গলফ কোর্সে হাতির আক্রমণে ডি হাং কং নামে এক কোরিয়ান বিনিয়োগকারী আহত হন। 

কেইপিজেডের একটি কারখানায় কাজ করেন শাহিদা বেগম। তিনি বলেন, ‘কেইপিজেডে কয়েকটি হাতি সব সময় ঘোরাফেরা করে থাকে। কারখানা থেকেও এগুলোকে দেখা যায়। দেখে ভয়ে গা শিউরে ওঠে। অনেক সময় আমরা হাতির সামনে পড়ে যাই। তখন কোনো না কোনো কারখানায় ঢুকে পড়ি।’

কেইপিজেড কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য প্রশাসনের বিভিন্ন দপ্তরে একাধিকবার চিঠি দেওয়া হয়েছে। করণীয় নির্ধারণে উচ্চ পর্যায় থেকে কমিটিও হয়েছে। কিন্তু কোনো সুরাহা হচ্ছে না। বর্তমানে ৪৭টি কারখানা রয়েছে। এসব কারখানার কর্মচারীদের অনেকেই হেঁটে কারখানায় যাতায়াত করেন। তারা সব সময় হাতির ভয়ে থাকেন। 

কেপিইজেড সূত্রে জানা যায়, গত বছরের অক্টোবরে কেইপিজেডে মানুষ আর হাতির দ্বন্দ্ব নিরসনে করণীয় নির্ধারণে একটি উচ্চ পর্যায়ের কমিটি গঠন করা হয়। কমিটি ইপিজেড এলাকাকে হাতির আবাসস্থল হিসেবে চিহ্নিত করে সেখানে হাতি রেখেই সংকট নিরসনের সুপারিশ করেছে। হাতির আশ্রয় ও খাবারের ব্যবস্থা করার কথা বলা হয়েছে। একই সঙ্গে ক্যামেরা ও জিপিএস ট্র্যাকিংয়ের মাধ্যমে হাতিগুলোকে পর্যবেক্ষণে রাখতে বলা হয়।

কোরিয়ান ইপিজেডের উপমহাব্যবস্থাপক মুশফিকুর রহমান সমকালকে বলেন, ‘বন্যহাতির সুরক্ষায় যে বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠন করা হয়, তারা কীভাবে কেইপিজেড থেকে হাতি অপসারণ করা যায়, তা নিয়ে কাজ করছেন। তবে হাতিগুলোকে নিয়ন্ত্রণে না আনা পর্যন্ত কেইপিজেডে যে ৩২ হাজারের বেশি  শ্রমিক-কর্মচারী রয়েছেন, তাদের হাতি-আতঙ্ক কাটবে না।’

তিনি আরও বলেন, ‘একটা হাতির দৈনিক ২৫ কিলোমিটার হাঁটাচলা করতে হয়। কেইপিজেডে এক কিলোমিটার জায়গাও হবে না। তার মধ্যে হাতি রাখলে প্রতিনিয়ত দুর্ঘটনা ঘটবে। তাই কেইপিজেডের বিনিয়োগকারী থেকে শুরু করে শ্রমিক-কর্মচারীসহ স্থানীয়দের কথা চিন্তা করে দ্রুত হাতি অপসারণ করা উচিত।’

হাতির অভয়ারণ্য না রেখে ইপিজেড

চট্টগ্রাম শহর থেকে ৪০ কিলোমিটার দূরে দক্ষিণ-পূর্ব আনোয়ারা উপজেলার ২ হাজার ৪৯২ একর পাহাড়ি বনের বাঁশখালী থেকে লোহাগাড়ার চুনতি পর্যন্ত হাতি চলাচলের করিডোর। এই করিডোরেই গড়ে তোলা হয়েছে ইপিজেড। কথা ছিল, এই বনাঞ্চলের ৫২ ভাগ বন্যপ্রাণীদের জন্য সংরক্ষণ করা হবে। কিন্তু সেটি মানা হয়নি। 

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ফিরোজ জামান বলেন, হাতির আবাসস্থলে ইপিজেড গড়ে তোলা হয়েছে। ফলে হাতি চলাচলের পথ হারিয়ে ফেলেছে। পাশাপাশি গা-ঢাকা দেওয়ার মতো স্থান ও খাবারের উৎসগুলোও ধ্বংস হয়ে গেছে। হাতির জন্য বনাঞ্চল ও যেসব খাবার খায় সেগুলো ব্যবস্থা করা গেলে ভারসাম্য ফিরে আসবে।

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: ব যবস থ উপজ ল র ঘটন

এছাড়াও পড়ুন:

গণহত্যার প্রতিবাদ করে গাজাবাসীর জন্য রাইখানদের প্রার্থনা

গণহত্যার প্রতিবাদ করে জালিম ইসরায়েলের আগ্রাসন থেকে মজলুম গাজাবাসীর মুক্তির জন্য প্রার্থনা করেছে পটুয়াখালীর রাখাইন সম্প্রদায়।

গাজায় গণহত্যা ও নির্বিচার হত্যাকাণ্ডের শিকার ফিলিস্তিনি জনগোষ্ঠীর জন্য কুয়াকাটায় মাহা সাংগ্রাই জলকেলি উৎসবে এক মিনিট নীরাবতা পালন করে রাখাইন সম্প্রদায়।

পটুয়াখালীর কলাপাড়ার কুয়াকাটায় শুক্রবার রাখাইন জলকেলি উৎসবের শুরুতে গাজায় গণহত্যার শিকার ফিলিস্তিনিদের জন্য এক মিনিট নীরবতা পালন করা হয়। ছবি: রাইজিংবিডি 

আরো পড়ুন:

প্রধান উপদেষ্টার উপ-প্রেস সচিব
বিশ্বে পূর্বশত্রুদের মিত্রে পরিণত হওয়ার অনেক উদাহরণ রয়েছে

অবশেষে জিম্বাবুয়ে সিরিজ সম্প্রচারকারী চ্যানেল পেলো বিসিবি

শুক্রবার দুপুরে (১৮ এপ্রিল) কলাপাড়ার কুয়াকাটায় শ্রীমঙ্গল বৌদ্ধবিহার-সংলগ্ন রাখাইন মাঠে জলকেলি উৎসবের প্রারম্ভে সবাই দাঁড়িয়ে এই নীরবতা পালন করেন।

রাখাইনদের অন্যান্য ধর্মীয় অনুষ্ঠানে গাজাবাসীর জন্য বিশেষ দোয়ার আয়োজন করা হয় বলেও জানিয়েছেন সম্প্রদায়টির ধর্মগুরুরা।

গণহত্যা অভিযানে গাজা ও ফিলিস্তিন নিশ্চিহ্ন করতে ইসরায়েলের বর্বর আগ্রাসনের বিরুদ্ধে রাখাইনদের এসব উদ্যোগ মানবতার জন্য, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির জন্য দৃষ্টান্ত বলে মনে করছেন সেখানকার মানুষ।

রাখাইন জলকেলি উৎসব দেখতে আসা কলাপাড়ার আলীপুর এলাকার বাসিন্দা মো. হোসেন মিয়া বলেন, “আজ জলকেলি দেখতে রাখাইন মাঠে এসেছি। এখানে এসে একেবারেই অবাক হয়েছি। তারা অনুষ্ঠানের শুরুতেই গাজাবাসীর জন্য নীরবতা পালন করেছে।”

“নিপীড়িত গাজাবাসীর জন্য তাদের সহমর্মিতা আমাকে আপ্লুত করেছে,” বলেন হোসেন মিয়া।

মহিপুর থেকে আসা মো. আবদুস সালাম বলেন, “এমনিতেই রাখাইনদের সঙ্গে আমাদের একটি সম্প্রীতির বন্ধন রয়েছে। আজ তারা গাজাবাসীর জন্য প্রার্থনা করেছে। তাদের প্রতি আমাদের সম্মান আরো বেড়ে গেল।”

মিশ্রীপাড়া সীমা বৌদ্ধবিহারের উপাধ্যক্ষ উত্তম মহাথের বলেন, “আমাদের ধর্মীয় অনুষ্ঠানগুলোতে গাজাবাসীর জন্য প্রায়ই বিশেষ প্রার্থনা করি। শুধু গাজাবাসীই নয়, পৃথিবীর সকল দাঙ্গা-হাঙ্গামাসহ যুদ্ধ বন্ধ হোক- এটাই আমাদের প্রার্থনা।”

“ আমরা মানুষ হিসেবে সবাইকে সবার প্রতি সৌহার্দ্যপূর্ণ আচরণের অনুরোধ জানাচ্ছি,” বলেন উত্তম মহাথের।

কলাপাড়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা রবিউল ইসলাম বলেন, “গাজাবাসীর প্রতি রাখাইন সম্প্রদায়ের পক্ষ থেকে এক মিনিট নীরবতার মাধ্যমে মানবতার সঙ্গে যে সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্প্রীতি তারা দেখিয়েছেন, এ জন্য তাদের উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি।”

“রাখাইন সম্প্রদায় ভিন্ন ধর্মালম্বী হলেও মানবতার ধর্ম সবার এক। তাই রাখাইন সম্প্রদায় এই নীরবতা পালনের মধ্য দিয়ে আজ ফিলিস্তিনের পক্ষে তাদের সম্প্রীতি আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশ করল।”

শুক্রবার পটুয়াখালীর কলাপাড়ার কুয়াকাটায় শুরু হয়েছে তিন দিনব্যাপী রাখাইন জলকেলি উৎসব, যাতে শামিল হচ্ছেন দেশের বিভিন্ন প্রান্তের মানুষ, সেই সঙ্গে যুক্ত হচ্ছেন বিদেশিরাও।

উৎসব শুরুর দিন ঐতিহ্যবাহী জলকেলিতে মেতে উঠতে দেখা যায় রাখাইনদের। তরুণ-তরুণী ও কিশোর-কিশোরীদের আনন্দ করতে দেখা যায়। উৎসবে সহায়তা করছে স্থানীয় প্রশাসন।

ঢাকা/ইমরান/রাসেল 

সম্পর্কিত নিবন্ধ