ইউরোপ কি উগ্র ডানপন্থীদের মূলধারায় পুনর্বাসন করছে
Published: 19th, February 2025 GMT
২৩ ফেব্রুয়ারি জার্মানিতে ফেডারেল নির্বাচন। এর মাত্র কয়েক সপ্তাহ আগেই দেশটিকে একটি রাজনৈতিক ভূমিকম্পের মুখোমুখি হতে হয়েছে। সেখানে এই প্রথমবারের মতো প্রধান বিরোধী দল মধ্যডানপন্থী ক্রিশ্চিয়ান ডেমোক্রেটিক ইউনিয়নকে (সিডিইউ) পার্লামেন্টে একটি প্রস্তাব পাস করতে চরম ডানপন্থী অলটারনেটিভ ফর জার্মানির (এএফডি) সমর্থন নিতে হয়েছে।
সিডিইউ নেতা ফ্রিডরিখ মের্জ এএফডির সমর্থন নেওয়ার পক্ষে সাফাই গেয়েছেন। তিনি বলেছেন, অভিবাসন সমস্যা নিয়ে অন্য দলগুলো কার্যকর পদক্ষেপ নিতে ব্যর্থ হওয়ায় সিডিইউ এ সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হয়েছে। যদিও এ প্রস্তাবের ফলে কোনো সরাসরি পরিবর্তন হয়নি, তবে এটি জার্মানির রাজনীতিতে বড় একটি পরিবর্তনের ইঙ্গিত দিচ্ছে।
এত দিন পর্যন্ত দেশটির গণতান্ত্রিক দলগুলো চরম ডানপন্থীদের সঙ্গে কোনো ধরনের সহযোগিতা করতে রাজি ছিল না। কিন্তু এ ঘটনার পর সেই নৈতিক বাধা ভেঙে গেছে। ফলে জার্মানি আর দাবি করতে পারবে না যে তারা এখনো চরম ডানপন্থার ‘স্বাভাবিকীকরণ’ থেকে মুক্ত রয়েছে।
প্রশ্ন হলো ‘স্বাভাবিকীকরণ’ আসলে কী এবং কেন এটি নিয়ে উদ্বেগ থাকা উচিত? প্রথমত, এটি ‘মূলধারায় নিয়ে আসা’ বা ‘মেইনস্ট্রিমিং’-এর মতো কিছু নয়। এখন স্বাভাবিকীকরণ বলতে বোঝায় কোনো বিদ্যমান নিয়ম ভাঙার বিষয়টিকে যৌক্তিক হিসেবে তুলে ধরা। গণতন্ত্রের জন্য হুমকিস্বরূপ চরম ডানপন্থী দলগুলোর সঙ্গে আঁতাত করাকে এখন ‘স্বাভাবিকীকরণ’ বলে ধরে নেওয়া হচ্ছে।
অন্যদিকে এখন ‘মূলধারা’ বলতে সেই জিনিসকে বোঝায়, যা সবচেয়ে সাধারণ বা সবচেয়ে বেশি গ্রহণযোগ্য। এটি নির্দিষ্ট কোনো আদর্শের ওপর নির্ভর করে না, বরং সময়ের সঙ্গে কী বেশি প্রচলিত হয়ে উঠেছে, সেটির ওপর নির্ভর করে।
সেদিক থেকে ধরলে চরম ডানপন্থী কোনো দলের সঙ্গে জোট গঠন করা বা তাদের সমর্থনে আইন পাস করানোকে স্বাভাবিকীকরণের একটি উদাহরণ বলা যেতে পারে। অন্যদিকে চরম ডানপন্থীদের বক্তব্য বা মতাদর্শ অনুসরণ করা মূলধারায় নিয়ে আসার (মেইনস্ট্রিমিং) একটি উদাহরণ।
কোনো বিষয়কে মূলধারায় নিয়ে আসা মানে সেটিকে জনগণের সামনে গুরুত্ব দিয়ে তুলে ধরা এবং তা চরম ডানপন্থীদের দৃষ্টিভঙ্গি অনুযায়ী উপস্থাপন করা। এ জন্য সমাজবিজ্ঞানীরা দীর্ঘদিন ধরে সতর্ক করে আসছেন, যদি কোনো নির্বাচনী প্রচারে চরম ডানপন্থীদের তোলা ইস্যুগুলোই প্রধান হয়ে ওঠে, তাহলে তারা নির্বাচনে ভালো ফল করে থাকে।
গণতন্ত্রপন্থী রাজনীতিকেরা সাধারণত নিজেদের স্বার্থপর বা সুবিধাবাদী হিসেবে দেখাতে চান না। সে কারণে তাঁরা চরম ডানপন্থীদের স্বাভাবিক করে তোলার (নরমালাইজেশন) ব্যাপারে নানা যুক্তি দেখান। ঘুরিয়ে–ফিরিয়ে তাঁরা বলার চেষ্টা করেন, নিয়ম ভাঙা হয়নি; বরং সব ঠিক আছে। যেমন মের্জ দাবি করেছেন, তাঁর আসল লক্ষ্য হলো এএফডির জনপ্রিয়তা কমানো। কিন্তু এটি খুবই খোঁড়া যুক্তি।
আরেকটি বিকল্প হলো নীতি বা আদর্শকে অবৈধ ঘোষণা করা। আগে ইতালিয়ান সোশ্যাল মুভমেন্ট (এমএসআই) ও কমিউনিস্ট পার্টি—এই দুটি রাজনৈতিক দল ছিল, যারা ইতালির যুদ্ধোত্তর গণতান্ত্রিক সংবিধানকে মেনে নেয়নি। তাই দল দুটিকে দীর্ঘদিন মূলধারার রাজনৈতিক দল বলে গণ্য করা হতো না। ফ্যাসিবাদ ও মুসোলিনির প্রতি শ্রদ্ধা জানানো এমএসআইয়ের মূল মতবাদ ছিল। তাই তাদের অনেক সময় মূলধারার রাজনীতির বাইরে রাখা হতো।
কিন্তু সাবেক প্রধানমন্ত্রী সিলভিও বেরলুসকোনি এ ধারণা চ্যালেঞ্জ করে বসেন। তিনি দাবি করেন, ফ্যাসিবাদবিরোধী ঐক্য এখন আর প্রাসঙ্গিক বা প্রয়োজনীয় নয়; এটি মূলত ডানপন্থীদের দমিয়ে রাখতে বামপন্থীদের একটি কৌশলমাত্র।
আসলে যখন কোনো দল বা রাজনৈতিক গোষ্ঠী মূলধারার সমাজে স্বাভাবিকভাবে গ্রহণযোগ্য হয়ে ওঠে (যেমন যখন নেতারা বা রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব একটি দলের সঙ্গে সম্পর্ক তৈরি করে বা তাদের সমর্থন দেন), তখন সাধারণ জনগণের মধ্যে সেই দলের প্রতি গ্রহণযোগ্যতা বাড়ে। তবে এই প্রক্রিয়া বোঝার ক্ষেত্রে জনসাধারণের সচেতনতা এবং গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের ভূমিকা অনেক গুরুত্বপূর্ণ। যদি কোনো জনপ্রিয় নেতা বা রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব একটি দলকে ‘স্বাভাবিক’ বলে মেনে নেন, তখন তা জনগণের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে এবং সাধারণ মানুষও সেই দলকে স্বাভাবিক হিসেবে দেখতে শুরু করে।
দুশ্চিন্তার বিষয়, জার্মানিসহ ইউরোপের অনেক দেশ এখন এই রোগে আক্রান্ত হতে শুরু করেছে।
● জ্যঁ ভার্নার ম্যুলার প্রিন্সটন ইউনিভার্সিটির রাজনীতি বিভাগের অধ্যাপক
স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট, অনুবাদ: সারফুদ্দিন আহমেদ
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: স ব ভ ব ক করণ স ব ভ ব ক কর র র জন ত র জন ত ক
এছাড়াও পড়ুন:
তারা যখন সংস্কারের ‘স’ উচ্চারণ করেনি, তখন খালেদা জিয়া ভিশন-২০৩০
তারা যখন সংস্কারের দন্তস্য উচ্চারণ করেননি, তখন খালেদা জিয়া ভিশন ২০৩০ দিয়েছেন বলে মন্তব্য করেছেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান।
বৃহস্পতিবার (১৭ এপ্রিল) সকালে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে বিএনপির আলোচনার শুরুতে নজরুল ইসলাম খান এ কথা বলেন। সংস্কারের গুরুত্বপূর্ণ সুপারিশগুলো নিয়ে বিএনপির সঙ্গে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের আলোচনা সকাল সাড়ে ১০টার দিকে জাতীয় সংসদের এলডি হলে শুরু হয়।
আলোচনায় বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহ উদ্দিন আহমদ, নজরুল ইসলাম খান, বিএনপির চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ইসমাঈল জবিউল্লাহ, আইনজীবী রুহুল কুদ্দুস কাজল, সাবেক সচিব নিরুজ্জামান খান অংশ নেন।
আরো পড়ুন:
মার্কিন উপসহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ
ডিসেম্বরের আগেও নির্বাচন সম্ভব, মনে করছে বিএনপি
প্রধান উপদেষ্টাকে বিএনপির চিঠি, কী আছে বর্ণনায়
নজরুল ইসলাম খান বলেন, আমরা গতকাল প্রধান উপদেষ্টাকে বলেছি বিএনপি সংস্কারের বিপক্ষে নয়, বিএনপি সংস্কারেরই দল। কিন্তু কেউ কেউ নানান কথা বলেন। তারা যখন সংস্কারের দন্তস্য উচ্চারণ করেননি তখন দেশনেত্রী খালেদা জিয়া ভিশন ২০৩০ দিয়েছেন।
বিএনপির এই নেতা বলেন, বিএনপি সংস্কারের বিপক্ষে নয় বরং বিএনপি সংস্কারেরই দল। তবে সবকিছুর মূলে জনগণ। জনগণের সম্মতিতে যেন সব হয়।
গণতন্ত্রের জন্য দীর্ঘ আন্দোলন সংগ্রামের ইতিহাস তুলে ধরে নজরুল ইসলাম খান বলেন, আমাদের সামনে আরেকবার একটা সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে, আমরা তা কাজে লাগাতে চাই। আমরা এই কমিশনকে সহযোগিতা করছি। এই সরকারকে সহযোগিতা করছি, সেই প্রত্যাশা নিয়েই।
যদি ঐকমত্য কমিশনের কোনো সনদ নাও হয়, বিএনপির জন্য সংস্কারের সনদ রয়েছে বলেন নজরুল ইসলাম খান। সবকিছুর মূলে জনগণ এবং জনগণের সম্মতিতে যেন সব হয় বলেন তিনি। আরো বলেন, আর জনগণ কার মাধ্যমে সম্মতি জানায় আমরা জানি।
এদিকে আলোচনার শুরুতে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ বলেন, আমাদের লক্ষ্য হচ্ছে জাতীয় সনদ তৈরি করা। যাতে করে বাংলাদেশে একটি স্থায়ী গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করতে পারি।
আজ দিনব্যাপী এই আলোচনা চলতে পারে বলে ঐক্য কমিশন সূত্রে জানা গেছে। আজ আলোচনার শেষ না হলে প্রয়োজনে আগামী সপ্তাহে আবারো বিএনপির সঙ্গে আলোচনায় বসবে কমিশন।
সংস্কার বিষয়ে জাতীয় ঐকমত্য গঠনের লক্ষ্যে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন জাতীয় ঐকমত্য কমিশন গত ১৫ ফেব্রুয়ারি থেকে কাজ শুরু করে। প্রথম পর্যায়ে গঠিত সংস্কার কমিশনগুলোর মধ্যে সংবিধান, জনপ্রশাসন, নির্বাচনব্যবস্থা, বিচার বিভাগ, এবং দুর্নীতি দমন কমিশন সংস্কার কমিশনের গুরুত্বপূর্ণ ১৬৬টি সুপারিশের বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মতামত চায় ঐকমত্য কমিশন। সুপারিশগুলোর স্প্রেডশিট আকারে ৩৮টি রাজনৈতিক দলের কাছে পাঠানো হয়। ১৩ মার্চের মধ্যে দলগুলোকে মতামত দিতে বলা হয়েছিল। মতামতের ভিত্তিতে ইতিমধ্যে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলাদাভাবে আলোচনা শুরু করেছে ঐকমত্য কমিশন। রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনার মধ্য দিয়ে একটি জাতীয় সনদ তৈরি করবে ঐকমত্য কমিশন এর ভিত্তিতেই হবে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন।
ঢাকা/এনএইচ