সরকারের অবস্থান সম্পর্কে ভুল বার্তা দেয়
Published: 19th, February 2025 GMT
অন্তর্বর্তী সরকারকে ছয় মাসে ২০০টির বেশি আন্দোলন মোকাবিলা করতে হয়েছে। প্রতিদিনই কোনো না কোনো পক্ষ তাদের দাবিদাওয়া নিয়ে রাজধানী ঢাকায় সড়ক আটকে আন্দোলনে নামছে। ফলে চিরভোগান্তির নগরীতে নাগরিক ভোগান্তি আরও তীব্র হচ্ছে এবং সরকারের ওপর চাপ বাড়ছে। কিন্তু তাই বলে অন্যায় ও অযৌক্তিক চাপে কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া কিংবা সিদ্ধান্ত নেওয়ার পর সেখান থেকে সরে আসা শেষ বিচারে সরকারের দুর্বলতা এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণে দোদুল্যমানতার বহিঃপ্রকাশ।
এটা সত্য যে বিগত সরকারের আমলে ক্ষমতার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বিশেষ গোষ্ঠীর বাইরে নাগরিকদের প্রায় সব অংশকে বঞ্চিত করা হয়েছিল। ৫ আগস্টের পর তারা দাবিদাওয়া নিয়ে আন্দোলনে নামছে। তাদের অনেকের দাবিদাওয়া ন্যায্য ও যৌক্তিক। কিন্তু সড়ক বন্ধ করে নাগরিকদের জিম্মি করে তারা যেভাবে প্রতিবাদে নামছে, সেটা কতটা যৌক্তিক? কেননা প্রায় প্রতিদিনই রাজধানীর অন্যতম কেন্দ্র শাহবাগে সড়ক অবরোধ হচ্ছে। অথচ এর আশপাশের এলাকায় পিজি, বারডেমের মতো গুরুত্বপূর্ণ হাসপাতাল রয়েছে।
জনভোগান্তির কথা চিন্তা করে ২২ অক্টোবর, আইনশৃঙ্খলা–সংক্রান্ত উপদেষ্টা কমিটির সভায় শাহবাগের বদলে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সভা-সমাবেশ করার সিদ্ধান্ত এসেছিল। কিন্তু সেটা শুধু কাগজে-কলমের সিদ্ধান্ত হয়ে রয়ে গেছে। সরকার কিংবা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পক্ষ থেকে সেটা বাস্তবায়নে কোনো তৎপরতা দেখা যায়নি। যে সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করার উদ্যোগই নেই, সেই সিদ্ধান্ত কেন গ্রহণ করা হবে?
অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার ১১ দিনের মাথায় পরীক্ষার্থীদের একাংশ সচিবালয়ে ঢুকে বিক্ষোভ করলে তঁাদের দাবির মুখে এইচএসসির কয়েকটি পরীক্ষা বাতিল করা হয়। নীতিগত ও কৌশলগত বিবেচনায় এটি ছিল নতুন সরকারের জন্য ভুল একটা পদক্ষেপ। ফলে অনেকের মধ্যে ধারণা জন্মে যায়, যৌক্তিক, অযৌক্তিক যেকোনো দাবিতে আন্দোলন করলে সরকার মেনে নেবে।
অভ্যুত্থানের অল্প কিছুদিন পর আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি যে নাজুক অবস্থায় ছিল, তাতে সরকার হয়তো চাপের মুখে এ ধরনের সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হয়েছিল। কিন্তু ছয় মাস পরও এসে একই ধারা কেন অব্যাহত থাকবে? সর্বশেষ ঘটনাটি আমরা দেখলাম, রাজধানীর সিএনজিচালিত অটোরিকশা চলাচলের ক্ষেত্রে যে নৈরাজ্য রয়েছে, তা বন্ধে মালিক ও চালকদের জরিমানা কার্যকর করার সিদ্ধান্তকে কেন্দ্র করে। সিএনজিচালিত অটোরিকশার ভাড়া ও জমার হার কার্যকর করতে বিআরটিএ শাস্তিমূলক ব্যবস্থার উদ্যোগ নিলেও জনগণকে জিম্মি করে মালিক ও চালকদের আন্দোলনের মুখে সরকারকে পিছু হটতে হয়েছে।
প্রথম আলোর খবর জানাচ্ছে, ঢাকায় অটোরিকশা সেবায় নৈরাজ্য ও অব্যবস্থাপনা দীর্ঘদিনের। ২০০৩ সালে এই সেবা চালুর পর পাঁচ দফা বাড়ানো হয়েছে ভাড়া ও দৈনিক জমা। কিন্তু কোনোবারই মানেননি মালিক ও চালকেরা। একেকটি অটোরিকশার জন্য সরকার নির্ধারিত জমা ৯০০ টাকা। অথচ মালিকেরা নেন এর দ্বিগুণ। আর চালকেরা মিটারে তো চলেন-ই না, যাত্রীদের কাছ থেকে আদায় করেন দেড় থেকে দুই গুণ বেশি ভাড়া। কোন গন্তব্যে যাবেন, আর কোন গন্তব্যে যাবেন না, সে ক্ষেত্রেও তাঁরা নিজেদের মর্জিমাফিক চলেন। বলা চলে, তাঁদের খেয়ালখুশিতে জিম্মি যাত্রীরা।
নাগরিকেরা চান সিএনজিচালিত অটোরিকশাসহ গণপরিবহনব্যবস্থায় যে অব্যবস্থাপনা ও নৈরাজ্য চলে আসছে, তার অবসান। নাগরিকেরা প্রত্যাশা করেন, সরকার এ ক্ষেত্রে জনবান্ধব সিদ্ধান্ত নেবে এবং তা বাস্তবায়নে কার্যকর উদ্যোগ নেবে। কিন্তু জনবান্ধব কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়ার পর সেটা যদি বাস্তবায়িত না হয় কিংবা অন্যায় চাপের মুখে সিদ্ধান্ত বদলাতে হয়, তাহলে তাদের ভেতর হতাশা জন্ম হতে বাধ্য। শেষ বিচারে সেটা সরকারের অবস্থান সম্পর্কে জনমনে ভুল বার্তাও দেয়।
সরকারের সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও বাস্তবায়নে অবশ্যই বিচক্ষণ ও কঠোর হওয়ার বিকল্প নেই।
.উৎস: Prothomalo
এছাড়াও পড়ুন:
র্যাবের নাম ও পোশাক বদলানো হচ্ছে, প্রয়োজনে নতুন করে গঠন
র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের (র্যাব) নাম ও পোশাক পরিবর্তন করা হচ্ছে। নাম পরিবর্তনের একটি ধারণা দেওয়া হয়েছে আইনশৃঙ্খলা-সংক্রান্ত উপদেষ্টা পরিষদ কমিটিকে। প্রয়োজনে র্যাবকে নতুন করে গঠন করা হবে। এ বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হবে আইনশৃঙ্খলা-সংক্রান্ত উপদেষ্টা পরিষদ কমিটির পরবর্তী সভায়। এসব তথ্য জানিয়েছেন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লে. জেনারেল (অব.) জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী।
গতকাল মঙ্গলবার সচিবালয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সম্মেলনকক্ষে আইনশৃঙ্খলা-সংক্রান্ত উপদেষ্টা পরিষদ কমিটির সপ্তম সভা শেষে সাংবাদিকদের এ কথা বলেন তিনি। এ সময় প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী খোদা বকস চৌধুরী উপস্থিত ছিলেন।
মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে ২০২১ সালের ১০ ডিসেম্বর র্যাব ও র্যাবের সাত কর্মকর্তার ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার দিবস উপলক্ষে পৃথকভাবে এ নিষেধাজ্ঞা দেয় যুক্তরাষ্ট্রের ট্রেজারি ডিপার্টমেন্ট (রাজস্ব বিভাগ) ও পররাষ্ট্র দপ্তর। নিষেধাজ্ঞার আওতায় আসা কর্মকর্তাদের মধ্যে র্যাবের সাবেক মহাপরিচালক বেনজীর আহমেদ ছিলেন। বেনজীর আহমেদের ওপর যুক্তরাষ্ট্র প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে দেশটির পররাষ্ট্র দপ্তর। পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্রের ট্রেজারি ডিপার্টমেন্টের নিষেধাজ্ঞার আওতায় পড়েন তিনি।
গত বছরের ১ জুলাই থেকে ১৫ আগস্ট সংঘটিত ঘটনাপ্রবাহ বিশ্লেষণ করে জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনারের দপ্তর যে তথ্যানুসন্ধান প্রতিবেদন দিয়েছে, তাতে র্যাবকে বিলুপ্ত করার সুপারিশও রয়েছে। র্যাব বিলুপ্তির সুপারিশ করে আসছে নিউইয়র্কভিত্তিক মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস ওয়াচ (এইচআরডব্লিউ)।
সম্প্রতি অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত পুলিশ সংস্কার কমিশনের সুপারিশে বলা হয়, পুলিশের জবাবদিহি নিশ্চিত করতে এবং জনবান্ধব পুলিশি ব্যবস্থা গড়ে তুলতে র্যাবের অতীত কার্যক্রম ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ পর্যালোচনা করে এর প্রয়োজনীয়তা পুনর্মূল্যায়ন করা যেতে পারে।
র্যাবের বিলুপ্তি চেয়েছে বিএনপিও। গত বছরের ১০ ডিসেম্বর গুলশানে দলের চেয়ারপারসনের কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য হাফিজ উদ্দিন আহমদ র্যাবের অতীত কর্মকাণ্ড তুলে ধরে এই বাহিনীকে বিলুপ্ত করার সুপারিশ করেন। ২০০৪ সালে খালেদা জিয়ার সরকারের আমলে পুলিশের এই বিশেষ বাহিনী গঠন করা হয়। বিএনপির আমলে গঠিত এই বাহিনীকে সংস্কার না করে কেন বিলুপ্ত করতে চায়, প্রশ্ন করা হলে হাফিজ উদ্দিন আহমদ তখন বলেছিলেন, এটা মেডিকেল বিদ্যাতেও আছে, যখন একেবারে গ্যাংগ্রিন হয়ে নষ্ট হয়ে যায়, তখন কেটে ফেলা ছাড়া কোনো উপায় থাকে না।
র্যাবের বিতর্কিত কর্মকাণ্ড নিয়ে আলোচনা প্রতিষ্ঠার পর থেকে বিভিন্ন সময়ে র্যাবের বিতর্কিত কর্মকাণ্ড নিয়ে গতকালের আইনশৃঙ্খলা-সংক্রান্ত উপদেষ্টা পরিষদ কমিটির সভায় আলোচনা হয়। সবার বক্তব্যে উঠে আসে গত ২০ বছরে র্যাব ক্ষমতার অপব্যবহার করেছে। বহু মানুষকে গুম, খুন করেছে। বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডে জড়িয়েছে। যে কারণে এলিট ফোর্সকে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নিষেধাজ্ঞার মধ্যে পড়তে হয়েছে। ভবিষ্যতে সংস্থাটি যাতে একই অপরাধে না জড়ায়, সে জন্য ফ্রান্স, ইতালি, জার্মানি, ইংল্যান্ড, তুরস্কের মতো দেশে এ ধরনের এলিট ফোর্স কীভাবে কাজ করে, তা পর্যালোচনা করতে বলা হয়েছে।
এদিকে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি সম্পর্কে এক সাংবাদিকের প্রশ্নের জবাবে উপদেষ্টা বলেন, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি হচ্ছে। তবে আরও উন্নতি করতে হবে। আরেক সাংবাদিক প্রশ্ন করেন, আপনারা প্রতি সভাতেই একই কথা বলছেন। আসলে কি আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি হচ্ছে? জবাবে উপদেষ্টা বলেন, ‘আপনারা গণমাধ্যমে দেখছেন কতটা উন্নতি হচ্ছে। আপনারাই বলবেন উন্নতি হচ্ছে কি না।’
গত সোমবার রাতে রাজধানীর উত্তরায় রামদা দিয়ে প্রকাশ্যে এক দম্পতিকে কোপানোর ঘটনা প্রসঙ্গে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার কাছে জানতে চান সাংবাদিকেরা। উপদেষ্টা বলেন, ‘এ ঘটনায় যারা জড়িত, তাদের দ্রুত আইনের আওতায় আনা হয়েছে। কেউ অপরাধ করার পর যদি আমরা অ্যাকশনে না যাই, তখন বলতে পারতেন যে আমরা কাজ করছি না।’
স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা দাবি করেন, কিশোর গ্যাংয়ের দৌরাত্ম্য, ছিনতাই আগের চেয়ে কমেছে। তবে সহনীয় পর্যায়ে আসেনি। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির কীভাবে উন্নতি করা যায়, সভায় সে বিষয়ে আলোচনা হয়েছে বলে জানান তিনি।
স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা বলেন, ‘আমাদের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে জনগণের বিভিন্ন দাবিদাওয়া শুনতে শুনতে তাদের মূল যে কাজ, সেটা না করে অন্য কাজে সম্পৃক্ত হতে হচ্ছে। এর ফলে তাদের শক্তি কমে যাচ্ছে।’ তিনি দাবিদাওয়ার বিষয়ে আন্দোলনকারীদের নির্দিষ্ট জায়গায় অথবা সোহরাওয়ার্দী উদ্যান ব্যবহারের পরামর্শ দিয়ে বলেন, রাস্তাঘাট বন্ধ করে জনগণের ভোগান্তি কেউ চায় না।