দেখতে দেখতে ১৮তম দিন পার করে ফেলল বাঙালির প্রাণের মেলাখ্যাত অমর একুশে বইমেলা। ধীরে ধীরে বাড়ছে বইয়ের বিক্রি। অনেকেই এখন আগে সংগ্রহ করা তালিকা দেখে বই কিনতে শুরু করেছেন। আবার অনেকে এখনও বিভিন্ন স্টল থেকে বইয়ের তালিকা নিচ্ছেন। মেলার শেষ দিকে তারা পছন্দের বইগুলো সংগ্রহ করবেন বলে জানিয়েছেন। 

মেলায় ক্রেতা ও পাঠকের পাশাপাশি দর্শনার্থীর সংখ্যাও কম নয়। গতকাল মঙ্গলবার  বিকেলে মেলার কালীমন্দির প্রবেশ গেটে বেশ ভিড় দেখা গেল। ওই প্রবেশ গেটের পাশেই শিশু চত্বর। কর্মদিবসে শিশু চত্বরে ছুটির দিনগুলোর মতো ভিড় তেমন নেই। স্টলগুলোতে বেশ কিছু শিশুকে দেখা গেল বাবা-মায়ের সঙ্গে ঘুরে বই কিনতে। বিভিন্ন কার্টুনের কাটআউটের সঙ্গে ছবি তোলার আবদার তো ছিলই।

শিশু চত্বর পার হয়ে সামনে হেঁটে যেতে যেতে চোখে পড়বে অক্ষর, পাঞ্জেরী পাবলিকেশন্সসহ বিভিন্ন স্টল। বিশেষত পাঞ্জেরীতে কমিকস পাওয়া যাওয়ায় সেখানে কিশোর ক্রেতার সংখ্যা বেশি। ওই স্টলে কমিকস কিনতে আসা কলেজ শিক্ষার্থী মো.

আতিউর বলেন, কমিকস সহজে বুঝি বলে পড়তে মজা লাগে। বইমেলায় কিছুটা কম দামে কমিকস পাওয়া যায় বলে অপেক্ষা করি এখান থেকেই কেনার।

অন্যদিকে জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশন স্টলের সামনে বৃহৎ আকৃতির স্ক্রিনে জুলাই-আগস্ট গণঅভ্যুত্থানের বিভিন্ন ফুটেজ দেখানো হয়। বেঞ্চে বসে সেগুলো দেখছিলেন আতিউর নামে এক ব্যক্তি। তিনি বলেন, মেলায় ঘুরতে এসেছি। এখন বিশ্রামের ফাঁকে গত বছরের জুলাইয়ের ঘটনাগুলো দেখছি। 

এর পরই পুঁথিনিলয়, গতিধারা, ঐতিহ্য, বাতিঘর, অন্যপ্রকাশসহ নামকরা স্টলগুলোতে ভিড় লক্ষ্য করা যায়। পাঠক ও দর্শনার্থীদের কেউ কেউ ছবি তুলছেন। আবার কাউকে দেখা যায় তালিকা করে আনা বই খুঁজতে। অন্যপ্রকাশের সামনে কথা হয় উত্তরা থেকে আসা গৃহিণী হাসনা ইসলামের সঙ্গে। তিনি বলেন, আসলে একটি চিন্তিত সময় পার করছি। তাই বাচ্চাদের নিয়ে মেলায় আসতে ভয় পাচ্ছিলাম। কিন্তু না এসেও থাকতে পারলাম না। প্রতি বছর হুমায়ূন আহমেদের বই কিনি আমি। 

একে একে কবি প্রকাশনী, ছাপাখানা কিংবা বিদ্যাপ্রকাশের সাদাকালো স্টলগুলোর সামনে দেখা যায়, নানা বয়সী মানুষ ছবি তুলছে। শুধু ছবি তুলে চলে যাওয়ার কারণ জানতে চাইলে তরুণী শিপলু বলেন, আমার প্রথমবার মেলায় আসা। তাই ছবি তুলে স্মৃতি রাখছি।

মেলার বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণের চিত্র একটু ভিন্ন। সেখানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের চেয়ে ভিড় তুলনামূলক কম। বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে যে দর্শক ও পাঠকরা এসেছেন, তাদের অনেকেই জানান, মূলত একাডেমির ঐতিহ্য, বর্ধমান হাউস এবং বইমেলার প্রথম প্রাঙ্গণ ঘুরে দেখতেই এসেছেন। বর্ধমান হাউসের সামনে দাঁড়িয়ে মেয়ের ছবি তুলছিলেন বাবা জসিম আলম। তিনি বলেন, মেয়েকে নিয়ে বইমেলায় আসি প্রতি বছর। বাংলা একাডেমিতে আসি নিজের ছেলেবেলার স্মৃতিচারণ করতে।

রাত পৌনে ৮টার দিকে শুরু হয় বৃষ্টি। এ সময় তড়িঘড়ি করে প্রকাশক ও বিক্রয়কর্মীদের ভেজা থেকে রক্ষা করতে বই গোছাতে দেখা যায়। মিনিট ১৫ স্থায়ী হওয়া বৃষ্টিতে তেমন কোনো ক্ষতির খবর পাওয়া যায়নি। সূচীপত্র প্রকাশনীর স্বত্বাধিকারী সাঈদ বারী বলেন, বিগত কয়েক বছর ধরে মেলার সময় হঠাৎ বৃষ্টিতে আমাদের অনেক ক্ষতি হয়। যদিও আমরা চেষ্টা করি স্টলের ওপর পলিথিনসহ অনেক কিছু দিয়ে সুরক্ষিত করতে; কিন্তু তাতে তেমন কাজ হয় না। প্রকৃতির ওপর কিইবা করতে পারি।

এদিকে গতকাল মেলার ১৮তম দিনে নতুন বই এসেছে ৭৯টি। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো– প্রতিভা প্রকাশ থেকে আকাশ মণির ‘স্বপ্ন ভাঙার শব্দ হয় না’, অমরাবতী থেকে হোসনেয়ারা বেগমের ‘জাগো জাগো শিশুদল’, পাণ্ডুলিপি প্রকাশন থেকে মোহাম্মদ মোশতাক চৌধুরীর ‘সিলেটি কথ্যভাষার অভিধান’, চারু সাহিত্যাঙ্গন থেকে ইসা নিজামের ‘সোনালী সম্ভার’, কবিতাচর্চা থেকে আব্দুস সালাম মণ্ডলের ‘মানুষ প্রয়োজন’।

এ দিন মেলার মূলমঞ্চে অনুষ্ঠিত হয় ‘বেলাশেষের শহীদ কাদরী’ শীর্ষক আলোচনা অনুষ্ঠান। কবি হাসান হাফিজের সভাপতিত্বে প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন তারানা নূপুর। আলোচনায় অংশগ্রহণ করেন শামস আল মমীন এবং আহমাদ মাযহার। লেখক বলছি অনুষ্ঠানে নিজেদের নতুন বই নিয়ে আলোচনা করেন কবি হাসান হাফিজ এবং গবেষক খান মাহবুব।  সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে কবিতা আবৃত্তি করেন কবি ফজলুল হক এবং আশিকুল কাদির। সংগীত পরিবেশন করেন নওশিন তাবাসসুম স্মরণ, মমিনুল ইসলাম, মনিরুল ইসলামসহ অনেকেই।

আজ বুধবার বিকেল ৪টায় মেলার মূলমঞ্চে অনুষ্ঠিত হবে ‘জন্মশতবর্ষ: রোকনুজ্জামান খান দাদাভাই’ শীর্ষক আলোচনা অনুষ্ঠান।
 

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: বইম ল অন ষ ঠ ন এক ড ম র স মন বইম ল

এছাড়াও পড়ুন:

হাত জোড় করছি, ফিরিয়ে দিন সন্তানদের

‘কোনো মায়ের বুক যেন খালি না হয়। দোষ থাকলে, অন্যায় করলে উপযুক্ত শাস্তি দিন। তবু সন্তান হারানোর বেদনা যেন কারও বুকে না লাগে। আমি হাত জোড় করছি, আমাদের সন্তানদের ফিরিয়ে দিন।’

গতকাল বৃহস্পতিবার সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে দেওয়া স্ট্যাটাসে এমন আকুতিই জানান অপহৃত দিব্যি চাকমার মা ভারতী দেওয়ান। বিজু উৎসব শেষে খাগড়াছড়ির কুকিছড়া থেকে ফেরার পথে গত বুধবার ভোর ৬টার দিকে পাহাড়ি পাঁচ শিক্ষার্থী অপহৃত হন। এ অপহরণের জন্য পার্বত্য চট্টগ্রাম পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ (পিসিপি) সশস্ত্র গোষ্ঠী ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট- ইউপিডিএফকে (প্রসীত) দায়ী করছে। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, অপহৃতদের উদ্ধরে বিশেষ অভিযান চালানো হচ্ছে।

পিসিপির কেন্দ্রীয় শাখার সভাপতি নিপন ত্রিপুরা বৃহস্পতিবার সমকালকে বলেন, ‘আমরা পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে যোগাযোগ করে জানতে পেরেছি, ইউপিডিএফ অপহৃতদের অভিভাবকদের একটি স্থানে ডেকেছে। বিকেলে অভিভাবকরা সেখানকার উদ্দেশে রওনা হন। পরে আর তাদের সঙ্গে যোগাযোগ হয়নি।’ তিনি অবিলম্বে অপহৃতদের সুস্থ শরীরে নিঃশর্ত মুক্তির দাবি জানান।

পার্বত্য চট্টগ্রাম পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি অন্বেষ চাকমা বলেন, অপহরণকারীরা সকালে একটি স্থানের নাম বলেছিল অভিভাবকদের। পরে পরিবর্তন করে আরেকটি স্থানে ডাকে। বিকেল থেকে আর যোগাযোগ করা যাচ্ছে না। ফোন বন্ধ পাওয়া যাচ্ছে। 

অপহৃতরা হলেন– চবির আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের শিক্ষার্থী ও পিসিপির চবি শাখার সদস্য রিশন চাকমা, চারুকলা ইনস্টিটিউটের শিক্ষার্থী অলড্রিন ত্রিপুরা, একই বিভাগের মৈত্রীময় চাকমা, নাট্যকলা বিভাগের শিক্ষার্থী দিব্যি চাকমা ও প্রাণিবিদ্যা বিভাগের শিক্ষার্থী লংঙি ম্রো। তাদের মধ্যে রিশন চাকমার বাড়ি রাঙামাটির জুরাছড়ির মৈদং ইউনিয়নের জামেরছড়িতে। লংঙি ম্রোর বাড়ি বান্দরবানের আলীকদমের কুরুকপাতা ইউনিয়নে; একই জেলায় বাড় অলড্রিন ত্রিপুরার; রাঙামাটির বরকল সদরের চাইল্যাতুলিতে দিব্যি চাকমা ও একই জেলার বাঘাইছড়ির বটতলায় মৈত্রীময় চাকমার।

এর আগে অপহৃত পাঁচ শিক্ষার্থী বিজু উৎসব উপলক্ষে রাঙামাটির বাঘাইছড়িতে বেড়াতে যান। উৎসব শেষে গত মঙ্গলবার তারা চট্টগ্রামে ফেরার উদ্দেশ্যে বাঘাইছড়ি থেকে দীঘিনালা হয়ে খাগড়াছড়ি সদরে আসেন। সেখানে বাসের টিকিট না পাওয়ায় খাগড়াছড়ি শহর থেকে কিছুদূরে পানছড়ি সড়কের কুকিছড়ায় এক আত্মীয়ের বাড়িতে রাতযাপন করেন। গত বুধবার ভোরে কুকিছড়া থেকে অটোরিকশায় খাগড়াছড়ি সদরে আসার পথে গিরিফুল নামক জায়গায় দুর্বৃত্তরা অস্ত্রের মুখে তাদের অপহরণ করে। 

এ ঘটনায় তীব্র নিন্দা ও অপহৃতদের দ্রুত মুক্তির দাবি জানিয়ে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজে অধ্যয়নরত ১৮৩ আদিবাসী শিক্ষার্থী যৌথ বিবৃতি দিয়েছেন। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষাথী ভুবন চাকমার স্বাক্ষরিত বিবৃতিতে বলা হয়, অপহৃত পাঁচ শিক্ষার্থী বিজু উৎসব শেষে খাগড়াছড়ি থেকে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে যাওয়ার পথে অপহরণের শিকার হলেও তাদের খোঁজ এখনও পাওয়া যায়নি। সাধারণ শিক্ষার্থীদের এমন অপহরণের ঘটনা পার্বত্য চট্টগ্রামসহ সারাদেশে মানবাধিকারবিরোধী ও গণতান্ত্রিক পরিবেশ রক্ষার পরিপন্থি। অপহৃতদের উদ্ধারে দ্রুত পদক্ষেপ নিতে প্রশাসনের প্রতি জোর দাবি জানানো হয় বিবৃতিতে।

ইতোমধ্যে অপহৃতদের উদ্ধারে জোর তৎপরতা শুরু করেছেন নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা। সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। গতকাল ঢাকা সেনানিবাসে এক সংবাদ সম্মেলনে সেনাসদর মিলিটারি অপারেশনস ডাইরেক্টরেটের স্টাফ কর্নেল মো. শফিকুল ইসলাম এ বিষয়ে বলেন, খাগড়াছড়ি থেকে অপহরণের শিকার চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঁচ শিক্ষার্থীকে উদ্ধারে বিশেষ অভিযান চালানো হচ্ছে। তাদের অবস্থান কিছুটা শনাক্ত করা গেছে।

খাগড়াছড়ির পুলিশ সুপার মো. আরেফিন জুয়েল বলেন, বিভিন্নভাবে জানার চেষ্টা করা হচ্ছে আসলে ঘটনাটি কী, কাদের হেফাজতে তারা রয়েছে। যৌথ অভিযানে উদ্ধারের চেষ্টা চলছে।

সম্পর্কিত নিবন্ধ