অসচ্ছল বীর মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য সারাদেশে ‘বীরনিবাস’ নির্মাণ নিয়ে অনিশ্চয়তা কাটছে। বীরনিবাস বরাদ্দের তালিকায় সচ্ছল মুক্তিযোদ্ধাদের অন্তর্ভুক্তির অভিযোগ থাকায় গত ছয় মাসে প্রকল্প বাস্তবায়ন অনেকটা থমকে ছিল। এরই মধ্যে ডিসেম্বরে প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হওয়া ১৬ হাজার ৮৭১টি বীরনিবাস নির্মাণ নিয়েও দেখা দেয় অনিশ্চয়তা। বরাদ্দের তালিকা যাচাই-বাছাইয়ের পর আবারও প্রকল্প বাস্তবায়নের কার্যক্রম শুরু হয়েছে। তৃতীয় দফায় মেয়াদ বাড়িয়ে প্রকল্প বাস্তবায়নের লক্ষ্য ধরা হয়েছে আগামী ডিসেম্বর পর্যন্ত।

প্রকল্প-সংশ্লিষ্ট মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সারসংক্ষেপ পর্যালোচনায় দেখা যায়, বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে বরাদ্দের জন্য তালিকাভুক্ত ২৪৩টি উপজেলার ১১ হাজার ২৪৮ বীর মুক্তিযোদ্ধার তথ্য যাচাই করেছে অন্তর্বর্তী সরকার। ওই তালিকা থেকে ১৯১ জনকে সচ্ছল মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে শনাক্ত করেছে উপজেলা প্রশাসন। তবে তাদের সচ্ছলতার ধরন নিয়ে প্রতিবেদনে বিস্তারিত উল্লেখ করা হয়নি। এ জন্য মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক উপদেষ্টার নেতৃত্বাধীন এডিপির সভায় সচ্ছল মুক্তিযোদ্ধাদের বিষয়ে সংশ্লিষ্ট জেলা প্রশাসকের মাধ্যমে উপজেলা প্রশাসনের কাছে বিস্তারিত তথ্য চাওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে। বিস্তারিত প্রতিবেদনে ১৯১ জন ‘সচ্ছল’ প্রমাণ হলে, তাদের বীরনিবাস বরাদ্দের তালিকা থেকে বাদ দেওয়া হবে।

এ ছাড়া যেসব বীরনিবাস বরাদ্দের জন্য ইতোমধ্যে টেন্ডার সম্পন্ন হয়েছে, সেগুলো প্রকৃত অসচ্ছল মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য নির্মাণ করা হচ্ছে কিনা, তা যাচাই-বাছাই করার সিদ্ধান্ত হয়েছে। এর সংখ্যা ১ হাজার ৩১৭। গত ২৭ জানুয়ারি মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে এ-সংক্রান্ত সভা হয়। 

জানতে চাইলে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক উপদেষ্টা ফারুক-ই-আজম সমকালকে বলেন, প্রকল্পের কার্যক্রম নিয়ে অভিযোগ থাকায় এর কার্যক্রম স্থগিত রাখা হয়েছিল। এর মধ্যে প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হয়ে যায়। আমরা বরাদ্দের তালিকা যাচাই-বাছাই করছি। এর আলোকে প্রকল্পের মেয়াদ বাড়িয়ে কার্যক্রম অব্যাহত রাখার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। আর বরাদ্দের তালিকায় থাকা মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে যাদের নাম ‘সচ্ছল’ হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে, তাদের তথ্য আরও একবার যাচাই করা হবে। যদি তারা সচ্ছল প্রমাণ হন, তাহলে তাদের বাদ দিয়ে অসচ্ছল মুক্তিযোদ্ধাদের বরাদ্দ দেওয়া হবে।

বেড়েছে ব্যয়
মন্ত্রণালয়ের কার্যপত্র পর্যালোচনায় দেখা গেছে, মুজিববর্ষ ও স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উপলক্ষে অসচ্ছল মুক্তিযোদ্ধা ও বীরাঙ্গনাদের আবাসনের জন্য ২০২১ সালের মার্চে ৩০ হাজার বীরনিবাস নির্মাণে প্রকল্প নেয় তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার। তখন জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় ৪ হাজার ১২৩ কোটি টাকা ব্যয় ধরে প্রকল্প অনুমোদন হয়। মেয়াদ শেষ হওয়ার কথা ছিল ২০২৩ সালের ৩১ অক্টোবর। কিন্তু সময় মতো কাজ এগোয়নি। পরে দ্বিতীয় দফা প্রকল্পের মেয়াদ ধরা হয় গত বছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত। এ জন্য প্রকল্পের ব্যয় বাড়ানো হয় ১ হাজার ৮২২ কোটি ২০ লাখ টাকা। ফলে প্রকল্পের ব্যয় দাঁড়ায় ৬ হাজার ৯৬ কোটি ৫৩ লাখ টাকায়। কিন্তু গত ডিসেম্বর পর্যন্ত বীরনিবাস নির্মাণকাজ সম্পন্ন হয় মাত্র ১৩ হাজার ১২৯টি। নির্মাণাধীন ছিল আরও ৯ হাজার ১০২টি।

মূলত ৫ আগস্ট রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর পুরো প্রকল্পের কার্যক্রমই বন্ধ হয়ে যায়। এর মধ্যে ডিসেম্বরে প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হয়ে গেলে বরাদ্দের জন্য তালিকাভুক্ত অসচ্ছল মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে ক্ষোভের সঞ্চার হয়। সমকালে গত ১০ ডিসেম্বর এ নিয়ে প্রতিবেদনও প্রকাশ হয়েছিল। তখন মন্ত্রণালয় থেকে জানানো হয়, বরাদ্দের তালিকা যাচাই-বাছাই করে প্রকল্পের ভবিষ্যৎ নিয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। এর আলোকে এবার তৃতীয় দফায় প্রকল্পের মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে। তবে ব্যয় বাড়ানো হয়নি। এ দফায় ৩০ হাজারের মধ্যে অবশিষ্ট ৭ হাজার ৭৬৯টি বীরনিবাস নির্মাণের লক্ষ্য রয়েছে।

বীরনিবাসের ধরন
বীরনিবাস প্রকল্পের বাড়িগুলো উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাদের (ইউএনও) তত্ত্বাবধানে বরাদ্দ ও নির্মাণ হয়েছে। বর্তমানে প্রতিটি বাড়ি নির্মাণে বরাদ্দ ১৮ লাখ ৫৮ হাজার টাকা। ২০২১ সালে এর জন্য বরাদ্দ ছিল ১৪ লাখ ৮০ হাজার টাকা। এই বাড়ি মুক্তিযোদ্ধাদের জমিতেই নির্মাণ করা হয়। আর যাদের জমি নেই, তাদের ক্ষেত্রে উপজেলা প্রশাসন খাসজমিতে বাড়ি নির্মাণের ব্যবস্থা করে থাকে। চার ডেসিমাল জমিতে ৭৩২ বর্গফুট আয়তনের একতলাবিশিষ্ট বাড়িতে দুটি বেডরুম, একটি ড্রইং ও একটি ডাইনিং, দুটি বাথরুম এবং একটি বারান্দা রয়েছে। এ ছাড়া একটি উঠান, একটি নলকূপ, গবাদি পশু, হাঁস-মুরগি পালনের জন্য পৃথক শেড আছে।

বিপাকে মন্ত্রণালয় ও প্রশাসন
সূত্র জানায়, ৫ আগস্ট রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর বীরনিবাসের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ঠিকাদারদের অধিকাংশ এখনও লাপাত্তা। কেউ কেউ অর্থ বরাদ্দ না থাকায় কাজ বন্ধ রেখেছেন। সব মিলিয়ে নির্মাণাধীন পর্যায়ে বীরনিবাসের সংখ্যা ৯ হাজার ১০২। সংশ্লিষ্ট ঠিকাদারদের অধিকাংশ বিগত সরকারের সমর্থক। অনেকের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক মামলাও হয়েছে। আবার ঠিকাদারদের অনেকে সাব-কন্ট্রাকে অন্য কাউকে ঘর নির্মাণের কাজ দিয়েছেন। এমন পরিস্থিতিতে নির্মাণাধীন বীরনিবাস নিয়ে বিপাকে সংশ্লিষ্ট উপজেলা প্রশাসন। প্রকল্পের মেয়াদ বাড়ানোর পর অর্থ বরাদ্দ শুরু হলে, কাজ শুরু করবেন বলে দাবি ঠিকাদারদের।

মন্ত্রণালয়ের সারসংক্ষেপ পর্যালোচনায় দেখা গেছে, নির্মাণকাজ চূড়ান্ত হওয়া ২ হাজার ৫০৬টি বীরনিবাসের বিল পরিশোধের সিদ্ধান্ত হয়েছে। অন্যগুলোর বিষয়ে পর্যায়ক্রমে পরিশোধের কথা বলা হয়েছে।

নোয়াখালীর কোম্পানীগঞ্জ উপজেলায় ২৯ বীর মুক্তিযোদ্ধার জন্য বীরনিবাস নির্মাণকাজ শুরু হয় ২০২২ সালে। পাঁচ ঠিকাদারের সবাই লাপাত্তা। কোম্পানীগঞ্জের ভুক্তভোগী প্রয়াত বীর মুক্তিযোদ্ধা আবদুল মান্নানের ছেলে নজরুল ইসলাম টিপু সমকালকে বলেন, ২০২২ সালে বীরনিবাস নির্মাণকাজ শুরু হয়। প্রায় ১১ মাস আগে ছাদ ঢালাই দিয়ে ঠিকাদার ঘর ফেলে রেখেছেন। দীর্ঘদিন পর চলতি সপ্তাহে ঠিকাদারের লোকজন এসেছিলেন। তারা পানির লাইন ও মোটর স্থাপনের জন্য মাপজোখ নিয়ে গেছেন।

২০২১ সালে ফরিদপুরের বোয়ালমারী উপজেলায় ৬৮ বীর মুক্তিযোদ্ধার নামে বীরনিবাস নির্মাণকাজ শুরু হয়। তিন বছরে গুনবহা ও ময়না ইউনিয়নের ১২টি বীরনিবাসের একটিরও কাজ শেষ হয়নি।

গুনবহা ইউনিয়নের গুরদিয়া গ্রামের প্রয়াত মুক্তিযোদ্ধা আবদুল হক মুন্সীর ঘরও কয়েক বছর ধরে নির্মাণাধীন। ঢাকা সেনানিবাসে কর্মরত তাঁর ছেলে মোস্তাফিজুর রহমান মনির বলেন, ‘বাবা সাড়ে তিন বছর প্যারালাইজড হয়ে বিছানায় ছিলেন। অনেক দেনা রেখে গেছেন। ঘরের নির্মাণকাজ শেষ না হওয়ায় মা ও প্রতিবন্ধী এক বোন বাড়িতে কষ্টে আছেন। ঘরের কাজ শেষ করার জন্য ইউএনও অফিসে গেলেও কোনো জবাব মিলছে না।’

জানতে চাইলে বোয়ালমারীর ইউএনও তানভীর হাসান চৌধুরী বলেন, প্রকল্প বাস্তবায়নে অর্থ বরাদ্দ না থাকায় ঠিকাদাররা কাজ করছেন না। বরাদ্দ পাওয়া গেলে নির্মাণাধীন বীরনিবাসের কার্যক্রম সম্পন্ন করা হবে।

প্রকল্পের মেয়াদ বাড়ানোর বিষয়ে তিনি বলেন, মন্ত্রণালয়ের এ-সংক্রান্ত কোনো সিদ্ধান্ত আসেনি। প্রকল্পের মেয়াদ বাড়লে বরাদ্দের জন্য তালিকাভুক্ত অবশিষ্ট বীরনিবাস নির্মাণের কাজও শেষ করা হবে।

.

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: প রকল প র ম য় দ ব ড় বর দ দ র ত ল ক ন ত হয় ছ ড স ম বর র পর য উপজ ল সরক র

এছাড়াও পড়ুন:

মদ বিক্রিতে আয় ৫ হাজার কোটি, দুধ বিক্রিতে মাত্র ২১০ কোটি রুপি আয়

চলতি অর্থবছরে মদের উপর কর থেকে পাঁচ হাজার কোটি রুপিরও বেশি আয় করেছে দিল্লি। অপরদিকে, দুধ ও দুগ্ধজাত পণ্য থেকে মাত্র ২১০ কোটি রুপি করা আদায় করা হয়েছে। শনিবার এনডিটিভি অনলাইন এ তথ্য জানিয়েছে।

দিল্লি বিধানসভায় বিজেপি বিধায়ক অভয় ভার্মার প্রশ্নের জবাবে সরকার জানিয়েছে, ২০২৪-২৫ অর্থবছরে মদ বিক্রির উপর আবগারি শুল্ক এবং ভ্যাট (মূল্য সংযোজন কর) থেকে তারা পাঁচ হাজার ৬৮ দশমিক ৯২ কোটি রুপি রাজস্ব আয় করেছে। দুধ ও দুগ্ধজাত পণ্য থেকে জিএসটি বাবদ ২০৯ দশমিক ৯ কোটি রুপি আয় হয়েছে। দুটি পরিসংখ্যানই ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত।

এই প্রশ্নটি এমন এক সময়ে এসেছে যখন বিজেপি কথিত মদ নীতি কেলেঙ্কারি নিয়ে আম আদমি পার্টিকে (এএপি) আক্রমণ চালিয়ে যাচ্ছে। সাবেক মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরিওয়াল এবং তার উপ-মুখ্যমন্ত্রী মনীশ সিসোদিয়া ছিলেন এএপি নেতাদের মধ্যে যারা কথিত কেলেঙ্কারির সাথে জড়িত থাকার অভিযোগে জেলে গিয়েছিলেন। গত মাসে দিল্লি বিধানসভা নির্বাচনে দলটির পরাজয়ের ক্ষেত্রে এই বিষয়টি একটি বড় ভূমিকা পালন করেছিল বলে মনে করা হচ্ছে।

রেখা গুপ্তার নেতৃত্বাধীন নতুন বিজেপি সরকার জানিয়েছে, ২০২৩-২৪ সালে মদের উপর কর বাবদ পাঁচ হাজার ১৬৪ কোটি রুপি, ২০২২-২৩ সালে পাঁচ হাজার ৫৪৭ কোটি রুপি এবং ২০২১-২২ সালে পাঁচ হাজার ৪৮৭ কোটি রুপি আদায় করা হয়েছে। সরকার জানিয়েছে, ২০২১ সালের নভেম্বর থেকে ২০২২ সালের আগস্ট পর্যন্ত এএপি-এর অধীনে দিল্লিতে নতুন মদ নীতি বাস্তবায়নের কারণে, শুধুমাত্র ব্যক্তিগত দোকানগুলোকে মদ বিক্রি করার অনুমতি দেওয়া হয়েছিল। তবে, ২০২২ সালের সেপ্টেম্বরে পুরাতন মদ নীতি পুনঃপ্রবর্তন করা হলে, সরকারি মদের দোকানগুলো পরিচালনার অনুমতি দেওয়া হয়।

ঢাকা/শাহেদ

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • মদ বিক্রিতে আয় ৫ হাজার কোটি, দুধ বিক্রিতে মাত্র ২১০ কোটি রুপি আয়