বীরনিবাস প্রকল্পের অনিশ্চয়তা কাটছে
Published: 19th, February 2025 GMT
অসচ্ছল বীর মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য সারাদেশে ‘বীরনিবাস’ নির্মাণ নিয়ে অনিশ্চয়তা কাটছে। বীরনিবাস বরাদ্দের তালিকায় সচ্ছল মুক্তিযোদ্ধাদের অন্তর্ভুক্তির অভিযোগ থাকায় গত ছয় মাসে প্রকল্প বাস্তবায়ন অনেকটা থমকে ছিল। এরই মধ্যে ডিসেম্বরে প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হওয়া ১৬ হাজার ৮৭১টি বীরনিবাস নির্মাণ নিয়েও দেখা দেয় অনিশ্চয়তা। বরাদ্দের তালিকা যাচাই-বাছাইয়ের পর আবারও প্রকল্প বাস্তবায়নের কার্যক্রম শুরু হয়েছে। তৃতীয় দফায় মেয়াদ বাড়িয়ে প্রকল্প বাস্তবায়নের লক্ষ্য ধরা হয়েছে আগামী ডিসেম্বর পর্যন্ত।
প্রকল্প-সংশ্লিষ্ট মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সারসংক্ষেপ পর্যালোচনায় দেখা যায়, বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে বরাদ্দের জন্য তালিকাভুক্ত ২৪৩টি উপজেলার ১১ হাজার ২৪৮ বীর মুক্তিযোদ্ধার তথ্য যাচাই করেছে অন্তর্বর্তী সরকার। ওই তালিকা থেকে ১৯১ জনকে সচ্ছল মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে শনাক্ত করেছে উপজেলা প্রশাসন। তবে তাদের সচ্ছলতার ধরন নিয়ে প্রতিবেদনে বিস্তারিত উল্লেখ করা হয়নি। এ জন্য মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক উপদেষ্টার নেতৃত্বাধীন এডিপির সভায় সচ্ছল মুক্তিযোদ্ধাদের বিষয়ে সংশ্লিষ্ট জেলা প্রশাসকের মাধ্যমে উপজেলা প্রশাসনের কাছে বিস্তারিত তথ্য চাওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে। বিস্তারিত প্রতিবেদনে ১৯১ জন ‘সচ্ছল’ প্রমাণ হলে, তাদের বীরনিবাস বরাদ্দের তালিকা থেকে বাদ দেওয়া হবে।
এ ছাড়া যেসব বীরনিবাস বরাদ্দের জন্য ইতোমধ্যে টেন্ডার সম্পন্ন হয়েছে, সেগুলো প্রকৃত অসচ্ছল মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য নির্মাণ করা হচ্ছে কিনা, তা যাচাই-বাছাই করার সিদ্ধান্ত হয়েছে। এর সংখ্যা ১ হাজার ৩১৭। গত ২৭ জানুয়ারি মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে এ-সংক্রান্ত সভা হয়।
জানতে চাইলে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক উপদেষ্টা ফারুক-ই-আজম সমকালকে বলেন, প্রকল্পের কার্যক্রম নিয়ে অভিযোগ থাকায় এর কার্যক্রম স্থগিত রাখা হয়েছিল। এর মধ্যে প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হয়ে যায়। আমরা বরাদ্দের তালিকা যাচাই-বাছাই করছি। এর আলোকে প্রকল্পের মেয়াদ বাড়িয়ে কার্যক্রম অব্যাহত রাখার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। আর বরাদ্দের তালিকায় থাকা মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে যাদের নাম ‘সচ্ছল’ হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে, তাদের তথ্য আরও একবার যাচাই করা হবে। যদি তারা সচ্ছল প্রমাণ হন, তাহলে তাদের বাদ দিয়ে অসচ্ছল মুক্তিযোদ্ধাদের বরাদ্দ দেওয়া হবে।
বেড়েছে ব্যয়
মন্ত্রণালয়ের কার্যপত্র পর্যালোচনায় দেখা গেছে, মুজিববর্ষ ও স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উপলক্ষে অসচ্ছল মুক্তিযোদ্ধা ও বীরাঙ্গনাদের আবাসনের জন্য ২০২১ সালের মার্চে ৩০ হাজার বীরনিবাস নির্মাণে প্রকল্প নেয় তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার। তখন জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় ৪ হাজার ১২৩ কোটি টাকা ব্যয় ধরে প্রকল্প অনুমোদন হয়। মেয়াদ শেষ হওয়ার কথা ছিল ২০২৩ সালের ৩১ অক্টোবর। কিন্তু সময় মতো কাজ এগোয়নি। পরে দ্বিতীয় দফা প্রকল্পের মেয়াদ ধরা হয় গত বছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত। এ জন্য প্রকল্পের ব্যয় বাড়ানো হয় ১ হাজার ৮২২ কোটি ২০ লাখ টাকা। ফলে প্রকল্পের ব্যয় দাঁড়ায় ৬ হাজার ৯৬ কোটি ৫৩ লাখ টাকায়। কিন্তু গত ডিসেম্বর পর্যন্ত বীরনিবাস নির্মাণকাজ সম্পন্ন হয় মাত্র ১৩ হাজার ১২৯টি। নির্মাণাধীন ছিল আরও ৯ হাজার ১০২টি।
মূলত ৫ আগস্ট রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর পুরো প্রকল্পের কার্যক্রমই বন্ধ হয়ে যায়। এর মধ্যে ডিসেম্বরে প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হয়ে গেলে বরাদ্দের জন্য তালিকাভুক্ত অসচ্ছল মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে ক্ষোভের সঞ্চার হয়। সমকালে গত ১০ ডিসেম্বর এ নিয়ে প্রতিবেদনও প্রকাশ হয়েছিল। তখন মন্ত্রণালয় থেকে জানানো হয়, বরাদ্দের তালিকা যাচাই-বাছাই করে প্রকল্পের ভবিষ্যৎ নিয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। এর আলোকে এবার তৃতীয় দফায় প্রকল্পের মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে। তবে ব্যয় বাড়ানো হয়নি। এ দফায় ৩০ হাজারের মধ্যে অবশিষ্ট ৭ হাজার ৭৬৯টি বীরনিবাস নির্মাণের লক্ষ্য রয়েছে।
বীরনিবাসের ধরন
বীরনিবাস প্রকল্পের বাড়িগুলো উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাদের (ইউএনও) তত্ত্বাবধানে বরাদ্দ ও নির্মাণ হয়েছে। বর্তমানে প্রতিটি বাড়ি নির্মাণে বরাদ্দ ১৮ লাখ ৫৮ হাজার টাকা। ২০২১ সালে এর জন্য বরাদ্দ ছিল ১৪ লাখ ৮০ হাজার টাকা। এই বাড়ি মুক্তিযোদ্ধাদের জমিতেই নির্মাণ করা হয়। আর যাদের জমি নেই, তাদের ক্ষেত্রে উপজেলা প্রশাসন খাসজমিতে বাড়ি নির্মাণের ব্যবস্থা করে থাকে। চার ডেসিমাল জমিতে ৭৩২ বর্গফুট আয়তনের একতলাবিশিষ্ট বাড়িতে দুটি বেডরুম, একটি ড্রইং ও একটি ডাইনিং, দুটি বাথরুম এবং একটি বারান্দা রয়েছে। এ ছাড়া একটি উঠান, একটি নলকূপ, গবাদি পশু, হাঁস-মুরগি পালনের জন্য পৃথক শেড আছে।
বিপাকে মন্ত্রণালয় ও প্রশাসন
সূত্র জানায়, ৫ আগস্ট রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর বীরনিবাসের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ঠিকাদারদের অধিকাংশ এখনও লাপাত্তা। কেউ কেউ অর্থ বরাদ্দ না থাকায় কাজ বন্ধ রেখেছেন। সব মিলিয়ে নির্মাণাধীন পর্যায়ে বীরনিবাসের সংখ্যা ৯ হাজার ১০২। সংশ্লিষ্ট ঠিকাদারদের অধিকাংশ বিগত সরকারের সমর্থক। অনেকের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক মামলাও হয়েছে। আবার ঠিকাদারদের অনেকে সাব-কন্ট্রাকে অন্য কাউকে ঘর নির্মাণের কাজ দিয়েছেন। এমন পরিস্থিতিতে নির্মাণাধীন বীরনিবাস নিয়ে বিপাকে সংশ্লিষ্ট উপজেলা প্রশাসন। প্রকল্পের মেয়াদ বাড়ানোর পর অর্থ বরাদ্দ শুরু হলে, কাজ শুরু করবেন বলে দাবি ঠিকাদারদের।
মন্ত্রণালয়ের সারসংক্ষেপ পর্যালোচনায় দেখা গেছে, নির্মাণকাজ চূড়ান্ত হওয়া ২ হাজার ৫০৬টি বীরনিবাসের বিল পরিশোধের সিদ্ধান্ত হয়েছে। অন্যগুলোর বিষয়ে পর্যায়ক্রমে পরিশোধের কথা বলা হয়েছে।
নোয়াখালীর কোম্পানীগঞ্জ উপজেলায় ২৯ বীর মুক্তিযোদ্ধার জন্য বীরনিবাস নির্মাণকাজ শুরু হয় ২০২২ সালে। পাঁচ ঠিকাদারের সবাই লাপাত্তা। কোম্পানীগঞ্জের ভুক্তভোগী প্রয়াত বীর মুক্তিযোদ্ধা আবদুল মান্নানের ছেলে নজরুল ইসলাম টিপু সমকালকে বলেন, ২০২২ সালে বীরনিবাস নির্মাণকাজ শুরু হয়। প্রায় ১১ মাস আগে ছাদ ঢালাই দিয়ে ঠিকাদার ঘর ফেলে রেখেছেন। দীর্ঘদিন পর চলতি সপ্তাহে ঠিকাদারের লোকজন এসেছিলেন। তারা পানির লাইন ও মোটর স্থাপনের জন্য মাপজোখ নিয়ে গেছেন।
২০২১ সালে ফরিদপুরের বোয়ালমারী উপজেলায় ৬৮ বীর মুক্তিযোদ্ধার নামে বীরনিবাস নির্মাণকাজ শুরু হয়। তিন বছরে গুনবহা ও ময়না ইউনিয়নের ১২টি বীরনিবাসের একটিরও কাজ শেষ হয়নি।
গুনবহা ইউনিয়নের গুরদিয়া গ্রামের প্রয়াত মুক্তিযোদ্ধা আবদুল হক মুন্সীর ঘরও কয়েক বছর ধরে নির্মাণাধীন। ঢাকা সেনানিবাসে কর্মরত তাঁর ছেলে মোস্তাফিজুর রহমান মনির বলেন, ‘বাবা সাড়ে তিন বছর প্যারালাইজড হয়ে বিছানায় ছিলেন। অনেক দেনা রেখে গেছেন। ঘরের নির্মাণকাজ শেষ না হওয়ায় মা ও প্রতিবন্ধী এক বোন বাড়িতে কষ্টে আছেন। ঘরের কাজ শেষ করার জন্য ইউএনও অফিসে গেলেও কোনো জবাব মিলছে না।’
জানতে চাইলে বোয়ালমারীর ইউএনও তানভীর হাসান চৌধুরী বলেন, প্রকল্প বাস্তবায়নে অর্থ বরাদ্দ না থাকায় ঠিকাদাররা কাজ করছেন না। বরাদ্দ পাওয়া গেলে নির্মাণাধীন বীরনিবাসের কার্যক্রম সম্পন্ন করা হবে।
প্রকল্পের মেয়াদ বাড়ানোর বিষয়ে তিনি বলেন, মন্ত্রণালয়ের এ-সংক্রান্ত কোনো সিদ্ধান্ত আসেনি। প্রকল্পের মেয়াদ বাড়লে বরাদ্দের জন্য তালিকাভুক্ত অবশিষ্ট বীরনিবাস নির্মাণের কাজও শেষ করা হবে।
.উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: প রকল প র ম য় দ ব ড় বর দ দ র ত ল ক ন ত হয় ছ ড স ম বর র পর য উপজ ল সরক র
এছাড়াও পড়ুন:
কুয়াকাটায় জলকেলিতে মাতলেন রাখাইন তরুণ-তরুণীরা
পবিত্র জলে গাঁ ভিজিয়ে পটুয়াখালীর কুয়াকাটায় শুরু হয়েছে রাখাইনদের শত বছরের ঐতিহ্যবাহী সাংগ্রাই জলকেলি উৎসব।
শুক্রবার (১৮ এপ্রিল) বিকেল সাড়ে ৪টার দিকে শ্রী মঙ্গল বৌদ্ধ বিহার সংলগ্ন রাখাইন মার্কেটে তিন দিনব্যাপী এ উৎসবের উদ্বোধন করেন কলাপাড়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) রবিউল ইসলাম।
অনুষ্ঠানের শুরুতে ফিলিস্তিনের গাজায় ইসরায়েলের আগ্রাসনের প্রতিবাদে এক মিনিট নিরবতা পালন করেন রাখাইন জনগোষ্ঠী।
আরো পড়ুন:
বৈশাখে চিড়িয়াখানায় দর্শনার্থীদের উচ্ছ্বাস
রঙে-আলোয় উজ্জ্বল বর্ষবরণ
বর্ষবরণের জলকেলি উৎসব উপলক্ষে নাচে-গানে মাতোয়ারা হয়ে ওঠেন রাখাইন তরুণ-তরুণীরা। পরে তারা মাঠের মধ্যে রাখা একটি নৌকার পানি একে অপরের শরীরে ছিটিয়ে জলকেলিতে মেতে ওঠেন।
অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করা অং চো বলেন, “কক্সবাজার থেকে এ অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণের জন্য এসেছি। নাচ, গান আর জলকেলি উৎসবে অংশগ্রহণ করেছি। দিনটি আমাদের দারুন কেটেছে। প্রতিবছর এ অনুষ্ঠানের ধারাবাহিকতা রক্ষা করার অনুরোধ জানাচ্ছি।”
কেরানিপাড়ার রাখাইন তরুণী ম্যাসুয়েন বলেন, “বর্ষবরণ উপলক্ষে দিনভর নানা আয়োজন ছিল। এখানে সব অনুষ্ঠানে অংশ নিয়েছি। বিশেষ করে জলকেলির সঙ্গে নাচ আর গান দারুনভাবে উপভোগ করেছি। এমন আয়োজন করার জন্য উপজেলা প্রশাসনসহ সবাইকে ধন্যবাদ জানাই।”
কলাপাড়ার ইউএনও রবিউল ইসলাম বলেন, “উপজেলা প্রশাসনের অর্থায়নে ও রাখাইনদের সহযোগিতায় তিন দিনব্যাপী এ অনুষ্ঠানটির আয়োজন করা হয়েছে। রাখাইনদের ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি ধরে রাখার জন্য সব ধরনের সহযোগিতা করা হবে। এ অনুষ্ঠানের নিরাপত্তার জন্য ট্যুরিস্ট পুলিশ, নৌ-পুলিশ ও থানা পুলিশের পাশাপাশি উপজেলা প্রশাসন তৎপর রয়েছে।”
পটুয়াখালী রাখাইন বুড্ডিস ওয়েলফেয়ার এ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি এমং তালুকদারের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখেন- সরকারি মোজাহার উদ্দিন অনার্স কলেজের অধ্যক্ষ প্রফেসর ড. ফাতেমা হেরেন, কুয়াকাটা ট্যুরিস্ট পুলিশ রিজিয়নের সহকারী পুলিশ সুপার হাবিবুর রহমান, মহিপুর থানার ওসি তরিকুল ইসলাম ও কুয়াকাটা পৌর বিএনপির সাধারণ সম্পাদক মতিউর রহমান।
ঢাকা/ইমরান/মাসুদ