আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর দলের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুবউল-আলম হানিফ পালিয়ে যান। তাঁর অপকর্মের সাথি পুলিশের তালিকাভুক্ত ‘শীর্ষ চরমপন্থি’ জাহাঙ্গীর কবির লিপটনকে নিয়ে এলাকায় নতুন করে আতঙ্ক ছড়াচ্ছে। ৫ আগস্টের পর লিপটন গা-ঢাকা দেন। কিছুদিন আড়ালে থাকলেও এখন জেলা বিএনপির এক নেতার ছত্রছায়ায় আবারও প্রকাশ্যে আসার চেষ্টা করছেন। 
আলোচিত সাবেক সেনা কর্মকর্তা জিয়াউল আহসানের ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত এই চরমপন্থি র‍্যাবের সোর্স পরিচয় দিয়ে কুষ্টিয়া ও আশপাশের জেলায় ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেন। তাঁর নিজ এলাকা কুষ্টিয়া সদর উপজেলার দূর্বাচারার লোকজনও অত্যাচার-নির্যাতন থেকে রক্ষা পায়নি। আওয়ামী লীগ আমলে বিএনপি-জামায়াতের লোকজনকে র‍্যাব দিয়ে নানাভাবে হয়রানি, অত্যাচার করা হয়েছে।  
নব্বইয়ের দশকে কলেজে পড়ার সময় ছাত্রলীগ করা এই লিপটন পরবর্তী সময়ে গণমুক্তিফৌজে নাম লেখান। কুষ্টিয়া শহরে প্রকাশ্যে জামাই বাবুসহ একাধিক ব্যক্তিকে হত্যা করে আলোচনায় আসেন লিপটন। এর পর তাঁর অপরাধ জগৎ ছড়িয়ে পড়ে আশপাশের জেলায়। কয়েক বছর আগে র‍্যাব-১২ কুষ্টিয়া ক্যাম্পে কোম্পানি কমান্ডার পদে কর্মরত ছিলেন– এমন একজন কর্মকর্তা বলেন, ‘র‍্যাবের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা লিপটনকে সব ধরনের সহযোগিতা করতেন। ওই কর্মকর্তার নির্দেশ অনুযায়ী লিপটন কুষ্টিয়ায় এলে তাঁকে পাহারা দিয়ে রাখা হতো। গ্রামের বাড়ি গেলেও সেখানে র‍্যাবের পাহারা থাকত। লিপটন বিগত সময়ে র‍্যাবের নাম ব্যবহার করে অস্ত্র ব্যবসা, চাঁদাবাজি, নিরীহ লোকজনকে অস্ত্র দিয়ে ফাঁসিয়ে দেওয়ার মতো বহু ঘটনা ঘটালেও তাঁর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া যায়নি।’ 
বেশ কয়েক বছর আগে হানিফকে তাঁর এলাকায় ফুলের তোড়া দেওয়ার মাধ্যমে প্রকাশ্যে আসেন এই চরমপন্থি। বড় জনসভা করে হানিফকে সংবর্ধনা দেওয়া হয়। এর পর ঢাকায় হানিফের অফিসে বেশির ভাগ সময় কাটাতেন লিপটন। এ ছাড়া হানিফের চাচাতো ভাই আতাউর রহমান আতার সঙ্গে সখ্য গড়ে তুলে এলাকার রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করতেন তিনি। নিজ এলাকার নিরীহ এক ইউপি মেম্বারকে র‍্যাবের মাধ্যমে তুলে এনে অস্ত্র রাখার অভিযোগ দিয়ে কারাগারে পাঠানোর পর হাজার হাজার নারী-পুরুষ তাঁর বিরুদ্ধে মহাসড়ক অবরোধ করে মিছিল-সমাবেশ করেছিল। এ ছাড়া ২০১৫ সালে জেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাধারণ সম্পাদক সাজ্জাদ হোসেন সবুজকে গাজীপুরের একটি রিসোর্ট থেকে র‍্যাব তুলে নিয়ে যায়। এর পর তাঁর আর কোনো খোঁজ মেলেনি। এ ঘটনার জন্য সবুজের পরিবার হানিফকে দায়ী করে মামলা করেছে। অভিযোগ করা হয়, র‍্যাবকে দিয়ে সবুজকে অপহরণের পেছনে কলকাঠি নাড়েন লিপটন। ভয়ে লিপটনের বিরুদ্ধে মামলা করতে পারেনি পরিবার। 
জানা গেছে, জিয়াউল আহসান র‍্যাবে কর্মরত থাকার সময় লিপটন সোর্স হিসেবে কাজ করেন। র‍্যাবের গাড়িতে সব সময় ঘুরতে দেখা যেত তাঁকে। লিপটন সব সময় একটা কালো ব্যাগ বহন করতেন। সেই ব্যাগে অস্ত্র থাকত বলে র‍্যাবের একটি সূত্র জানিয়েছে। পাশাপাশি র‍্যাবের নাম দিয়ে কোটি কোটি টাকা চাঁদাবাজি করেছেন। ৫ আগস্টের আগে ছাত্র-জনতার বিপক্ষে অবস্থান নিয়ে র‍্যাবকে দিয়ে অনেককে বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে যাওয়ার অভিযোগ আছে তাঁর বিরুদ্ধে। 
জানা গেছে, আওয়ামী লীগের পতনের পর লিপটন কয়েক মাস পালিয়ে থেকে এখন জেলা বিএনপির এক নেতার অফিসে মাঝেমধ্যে আসেন বলে একটি গোয়েন্দা সংস্থা তাদের প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে। সেই বিএনপি নেতার মাধ্যমে আবারও এলাকায় প্রকাশ্যে আসা ও প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করছেন। এ নিয়ে অনেকেই আতঙ্ক প্রকাশ করেছেন।
আলামপুর ইউনিয়নের দরবেশপুর গ্রামের আরজান আলীর ছেলে বক্কার আলীকে লিপটন বিভিন্ন সময় হেনস্তা করলেও ভয়ে কথা বলতে রাজি হননি। ভবানীপুর গ্রামের ধান ব্যবসায়ী রাশিদুল ইসলাম বলেন, ‘এলাকার একটি মারামারি নিয়ে মামলায় সাক্ষী হওয়ার জেরে আমাকে হেনস্তা করা হয়। লিপটন র‍্যাবকে দিয়ে দোকানে বসে চা খাওয়া অবস্থায় তুলে নিয়ে যায়। দুটি অস্ত্র দিয়ে চালান করা হয়। চার মাস পর জামিন পেয়েছিলাম। এখনও হাজিরা দিচ্ছি।’ শুধু এই ব্যবসায়ীকেই নয়, গত এক যুগে নিজ এলাকাসহ বিভিন্ন স্থানের অর্ধশতাধিক মানুষকে র‍্যাব দিয়ে ফাঁসিয়েছেন লিপটন। 
পুলিশের গোয়েন্দা শাখার এক কর্মকর্তা বলেন, ‘চরমপন্থি লিপটন তাদের তালিকাভুক্ত। তার নামে বিভিন্ন সময় মামলা ও জিডি আছে। আমাদের খাতায় সে এখনও পলাতক।’
জেলা বিএনপির আহ্বায়ক কুতুব উদ্দিন বলেন, ‘বিএনপিতে কোনো দাগি সন্ত্রাসীকে প্রশ্রয় দেওয়ার প্রশ্নই আসে না। কেউ যদি এমন করে থাকে, এর দায়ভার তার।’ 
কুষ্টিয়ার পুলিশ সুপার মিজানুর রহমান বলেন, ‘চরমপন্থি সন্ত্রাসীদের কোনো ছাড় নেই। পলাতক কোনো চরমপন্থি যদি প্রকাশ্যে আসার চেষ্টা করে, তাকেও আইনের আওতায় আনা হবে।’

.

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: চরমপন থ ব এনপ ব যবস

এছাড়াও পড়ুন:

বাংলাদেশ হউক বহুপক্ষীয়

বায়ান্নর একুশে ফেব্রুয়ারি কেবল বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষা নহে; জাতিসত্তা রক্ষার আন্দোলনেও অমর দিবসরূপে দেদীপ্যমান। মাতৃভাষার মর্যাদা রক্ষায় বুকের তাজা রক্ত ঢালিয়া দিয়া ভাষাশহীদগণ কেবল দেশপ্রেমের অনন্য উদাহরণই সৃষ্টি করেন নাই; দিবসটি বাংলা ছাপাইয়া সকল ভাষার মর্যাদার স্মারক হইয়া উঠিয়াছে। একুশের চেতনা দেশ-কাল-পাত্রভেদে অধিকার আদায়ে প্রেরণার উৎসরূপে ক্রিয়াশীল। আমরা দেখিয়াছি, অধিকার আদায়ে বাঙালি ভাষা আন্দোলনের যেই সংগ্রাম রচনা করিয়াছিল, সেই পথপরিক্রমায়ই সূচিত হয় একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ। অকুতোভয় বাঙালি জনগোষ্ঠী এই ভূখণ্ডের অপরাপর জাতিগোষ্ঠীকে লইয়া দীর্ঘ ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে অর্জন করে স্বাধীনতা। স্বাধীনতার পরও যুগ যুগ ধরিয়া আন্দোলনের প্রেরণা হইয়া রহিয়াছে ভাষা আন্দোলন। এমনকি চব্বিশের গণঅভ্যুত্থানও উহার বাহিরে নহে। বায়ান্নতে ছাত্র-জনতা মুখের ভাষা রক্ষায় সোচ্চার হইয়া আন্দোলনে ঝাঁপাইয়া পড়িয়াছিল। চব্বিশের গণঅভ্যুত্থানেও তাহারা প্রেরণা হইয়া উঠিয়াছিল। জুলাই-আগস্টের আন্দোলনে দেয়ালে দেয়ালে মায়ের ভাষায় লিখিত গ্রাফিতি মানুষকে উজ্জীবিত করিয়াছিল। মাতৃভাষায় উচ্চারিত স্লোগান যে কতটা শক্তিশালী হইয়া উঠিতে পারে; যুগে যুগ দাবি আদায়ের আন্দোলনে উহা প্রমাণিত। যেই কারণে ঐতিহাসিক দিবসটি সাত দশক অতিক্রম করিলেও উহার চেতনা চিরঅমলিন।

আমাদের রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের প্রধান দুইটি দাবি ছিল– রাষ্ট্রভাষা বাংলা এবং সর্বস্তরে বাংলা ভাষার প্রচলন। ১৯৫৪ সালেই আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় তৎকালীন পাকিস্তান গণপরিষদে বাংলা রাষ্ট্রভাষারূপে স্বীকৃতির মাধ্যমে প্রথম দাবি পূরণ হইলেও দ্বিতীয় দাবিটি এখনও প্রত্যাশিত মাত্রায় পূরণ হয় নাই। সর্বত্র বাংলা প্রচলনের প্রশ্নটা আমরা ফি বৎসরই করিয়া আসিতেছি। কিন্তু রাষ্ট্রের প্রতিটা পর্যায়ে, প্রতিটা ক্ষেত্রে আমাদের মাতৃভাষার প্রচলন কতটা হইয়াছে? যেই জাতির মানুষ ভাষার তরে জীবন দিয়াছে, সেই জাতির কোটি কোটি মানুষের পড়িতে ও লিখিতে না পারিবার বিষয় বেদনাদায়কই বটে। একই সঙ্গে মাতৃভাষা এখনও আমাদের সর্বত্র শিক্ষার বাহন হইয়া উঠিতে পারে নাই। উচ্চশিক্ষার পুস্তকসহ অনেক বিষয় আমরা এখনও বাংলায় করিতে পারি নাই। মাতৃভাষারূপে বাংলার দাপ্তরিক ব্যবহার বৃদ্ধি পাইয়াছে সত্য, কিন্তু আদালতের কর্মকাণ্ড এখনও ইংরাজিনির্ভর। 

তবে ১৯৯৯ সালে জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতিবিষয়ক সংস্থা ইউনেস্কোর একুশে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের ঘোষণায় বাঙালি জাতি ও বাংলা ভাষার ভাবমূর্তিই কেবল উজ্জ্বল হয়নি, একই সঙ্গে বিশ্বের সব মাতৃভাষাই বিশেষ মর্যাদা ও মনোযোগ লাভ করিয়াছে। জাতিসংঘের অন্যতম দাপ্তরিক ভাষারূপে বাংলাও আবির্ভূত হউক। আমরা বিশ্বাস করি, সকলের মাতৃভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠিত করিবার বিষয়ও একুশে ফেব্রুয়ারির চেতনা। অমর একুশে আমাদের জাতিসত্তা রক্ষার আন্দোলনরূপেও দেখিয়া আসিয়াছি। আমাদের সামাজিক, রাজনৈতিক ও রাষ্ট্রীয় জীবনে ইহা প্রেরণার বাতিঘরস্বরূপ ক্রিয়াশীল। তজ্জন্য দেশের চলমান রাজনৈতিক সংকটেও পথ দেখাইতে পারে একুশের চেতনা।
আমরা জানি, গণঅভ্যুত্থান-পরবর্তী সময়ে আমাদের চ্যালেঞ্জ দেশের গণতান্ত্রিক উত্তরণ। তজ্জন্য অবাধ-সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন গুরুত্বপূর্ণ। ইতোমধ্যে প্রধান উপদেষ্টা নির্বাচনের সম্ভাব্য তারিখ ঘোষণা করিয়াছেন। এখন প্রয়োজন নির্বাচন ও অন্যান্য সংস্কার বিষয়ে জাতীয় ঐকমত্য। বিশেষত রাজনৈতিক দলগুলির মধ্যে ঐকমত্য জরুরি।
আমরা প্রত্যাশা করিব, ঐকমত্য প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে দেশবাসী বায়ান্ন সালের ন্যায় দল-মত নির্বিশেষে ঐক্যবদ্ধ হইবে। আমরা জানি, একুশে ফেব্রুয়ারি মানে বহুপাক্ষিকতা ও সকলের যথাযোগ্য মর্যাদার প্রশ্ন। গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়া গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার যেই পথ আমাদের সম্মুখে উন্মুক্ত, উহা সকলের জন্য অবারিত হউক। 

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • বাংলাদেশ হউক বহুপক্ষীয়
  • অস্ত্রধারীরা প্রকাশ্যে, পিটুনির শিকার দুই কিশোর এখনও প্রিজন সেলে
  • তিন মাসের সুমাইয়ার পৃথিবীজুড়ে শূন্যতা
  • দ্বন্দ্ব, বিবাদে এখনও উত্তপ্ত রাজনগর বিএনপি
  • আমাদের দর্শকের সঙ্গে প্রতারণা করা হচ্ছে: তটিনী
  • যে কারণে আয়নাঘরগুলো জাদুঘর হিসেবে সংরক্ষণ জরুরি
  • স্বৈরাচারমুক্ত দেশে জামায়াত এখনও বৈষম্যের শিকার: গোলাম পরওয়ার