যে কারণে আয়নাঘরগুলো জাদুঘর হিসেবে সংরক্ষণ জরুরি
Published: 18th, February 2025 GMT
আর্জেন্টিনার রাজধানী বুয়েন্স আয়ারসের ইএসএমএ জাদুঘরের কক্ষ সংখ্যা ১৭; সব কক্ষ ঘুরে দেখতে মোটামুটি ৯০ মিনিট লাগে। কক্ষগুলোতে রয়েছে সত্তরের দশকে আর্জেন্টিনার সামরিক জান্তার গুমের শিকার ব্যক্তিদের সাক্ষ্য, দেয়াল লিখন, নির্যাতনের হাতিয়ার, জাতীয় গুম কমিশনের ঐতিহাসিক দলিলপত্র, সামরিক জান্তার বিচারবিষয়ক নথি, গুম বিষয়ে রাষ্ট্রীয় গোপন দলিল ইত্যাদি। জাদুঘরটি একসময় ছিল আর্জেন্টিনার নেভি স্কুল অব মেকানিক্সের (ইএসএমএ) অফিসার্স কোয়ার্টার, যা জান্তার গোপন বন্দিশালা হিসেবে ব্যবহৃত হতো।
১৯৭৬ থেকে ১৯৮৩ সালের সামরিক স্বৈরশাসনকালে বিরোধীদের অপহরণের পর এই ভবনে বন্দি করে নির্যাতন চালানো হতো; অনেককে হত্যাও করা হতো। সে সময় গুমের শিকার ৩০ হাজারের মধ্যে অন্তত ৫ হাজার মানুষকে গুমের কাজে ভবনটি ব্যবহৃত হয়। এটিই ছিল আর্জেন্টিনার বড় গোপন বন্দিশালা।
সামরিক জান্তার পতনের পর বেশ কয়েক বছরের অনিশ্চয়তা ও সিদ্ধান্তহীনতার পর বন্দিশালাটি জাদুঘরে রূপান্তর করা হয়। বিশ্বজুড়ে গুম প্রতিরোধ ও মানবাধিকার রক্ষায় গুমের স্মৃতি ধরে রাখার গুরুত্ব বিবেচনায় ইউনেস্কো ২০২৩ সালে এটিকে বিশ্বঐতিহ্য হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। লক্ষণীয়, কুখ্যাত বন্দিশালাটির বিশ্বঐতিহ্য হিসেবে স্বীকৃতি আর্জেন্টিনা ইতিবাচক হিসেবেই গ্রহণ করে। তৎকালীন প্রেসিডেন্ট আলবার্তো ফার্নান্দেজ স্বীকৃতিকে ‘গণতন্ত্রের বিজয়’ হিসেবে উদযাপন করেন। দেশটির মানবাধিকারবিষয়ক সেক্রেটারি হোরাশিও কোর্তি বলেছিলেন, ‘এই আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি বিগত সামরিক-বেসামরিক স্বৈরশাসন আমলের রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস ও অপরাধকে অস্বীকার বা লঘু করার তৎপরতার বিরুদ্ধে শক্ত জবাব।’ বলাই বাহুল্য, এতে কথিত ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হওয়ার বদলে মানবাধিকার রক্ষায় আর্জেন্টিনার অঙ্গীকারই প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
ইউনেস্কো বলছে, জাদুঘরের ভবনটি মানবতাবিরোধী অপরাধের জুডিশিয়াল এভিডেন্স বা বিচারিক প্রমাণ হিসেবে সংরক্ষণ করা হচ্ছে। এই ভবনের অবকাঠামোর কোনো ধরনের পরিবর্তন করা নিষিদ্ধ। ভবনটি সংরক্ষণ ও পুনর্বাসনের জন্য ন্যূনতম যে কাজগুলো করা প্রয়োজন, সেগুলো বিজ্ঞানসম্মত উপায়ে এমনভাবে সম্পন্ন করা হয় যেন ভবনটির বিচারিক প্রামাণ্যতা কোনোভাবে ক্ষতিগ্রস্ত না হয়। এ কারণেই ইএসএমএ বন্দিশালার দেয়ালের দাগ, লেখা ও আঁকিবুঁকি অক্ষত রেখে দেওয়া হয়েছে। গুম ও বন্দিত্বের শিকার ব্যক্তিরা তাদের নাম, ফোন নম্বর, স্বাক্ষর, দলীয় পরিচয়, তারিখ ইত্যাদি লিখে বা খোদাই করে রেখেছিলেন। বর্তমানে দেয়াল লিখনগুলো নিয়ে প্রত্নতাত্ত্বিক গবেষণা চালানো হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে বিভিন্ন উৎস থেকে পাওয়া আলোকচিত্র, স্কেচ, বন্দিদের সাক্ষ্য, রাষ্ট্রীয় গোপন নথি ইত্যাদি কাজে লাগানো হচ্ছে। আর্জেন্টিনার মানবাধিকারবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের ন্যাশনাল ডিরেকশন অব সাইটস অব মেমোরির মাধ্যমে এ কাজগুলো করা হচ্ছে।
আর্জেন্টিনার মতো ঐতিহাসিক ও আইনগত উভয় বিচারে বাংলাদেশে ‘আয়নাঘর’ নামে পরিচিত গোপন বন্দিশালাগুলোকে যথাযথ সংরক্ষণ ও জাদুঘর হিসেবে উন্মুক্ত করা দরকার। আফসোস, আর্জেন্টিনায় সামরিক জান্তার পতনের ৪০ বছর পর সেই বন্দিশালাগুলো অক্ষত থাকলেও বাংলাদেশের ক্ষেত্রে শেখ হাসিনার পতনের পরপরই আয়নাঘরগুলোতে নানা পরিবর্তনের মাধ্যমে সাক্ষ্য-প্রমাণ ও ঐতিহাসিক গুরুত্ব খর্বের চেষ্টা করা হয়েছে।
গুমের ঘটনা তদন্তে গঠিত কমিশন গত অক্টোবরে এক সংবাদ সম্মেলনে গোপন বন্দিশালায় আলামত নষ্টের প্রমাণ পাওয়ার কথা জানিয়েছিল। বিশেষত দেয়ালে গুমের শিকার ব্যক্তিদের লেখাগুলো রং করে মুছে ফেলার কথা জানিয়েছিল। শুধু তাই নয়, গুমে জড়িত আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ‘আন্তর্জাতিক ভাবমূর্তি রক্ষায়’ বন্দিশালাগুলো পুরোপুরি অপসারণ করতে চাওয়ার কথাও সংবাদমাধ্যমে এসেছে (‘আয়নাঘরে’ সাজ বদল, নষ্ট গুমের আলামত, সমকাল, ৪ অক্টোবর ২০২৪)।
সম্প্রতি কয়েকজন গুমের শিকার ব্যক্তি, সংবাদকর্মী, উপদেষ্টাসহ অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার আয়নাঘর পরিদর্শনের সময়ও বিষয়টি উঠে আসে। তারা রাজধানীর কচুক্ষেত, আগারগাঁও, উত্তরায় অবস্থিত ডিজিএফআই ও র্যাব পরিচালিত তিনটি গোপন বন্দিশালা পরিদর্শন করেন। কচুক্ষেতে ডিজিএফআই পরিচালিত বন্দিশালা পরিদর্শনের সময় তথ্য ও সম্প্রচার উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম একটি কক্ষ শনাক্ত করেন, যেখানে জুলাই আন্দোলনকালে তাঁকে আটকে রাখা হয়েছিল। সেই কক্ষের এক পাশে টয়লেট হিসেবে বেসিনের মতো কাঠামো ছিল। ৫ আগস্টের পর সেলগুলোর মাঝের দেয়াল ভেঙে ফেলা হয় ও দেয়াল রং করা হয়। স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়াও বলেছেন, তাঁকে আটকে রাখা কক্ষের দেয়ালের ওপরের অংশের খোপগুলোতে এগজস্ট ফ্যান ছিল, যা এখন নেই। তিনিও মাঝের দেয়াল ভেঙে কক্ষ বড় করে ফেলার কথা বলেছেন (আয়নাঘরেই আটকে রাখা হয়েছিল, চিনতে পারলেন নাহিদ ও আসিফ, ডেইলি স্টার বাংলা, ১২ ফেব্রুয়ারি ২০২৫)।
গোপন বন্দিশালাগুলোর আলামত যদি এভাবে নষ্ট করা হয়, তাহলে একদিকে গুরুত্বপূর্ণ বিচারিক উপাদান হাতছাড়া হবে, অন্যদিকে গুমের ঘটনার ঐতিহাসিক সত্যতা নিয়ে প্রশ্ন তোলার সুযোগ তৈরি হবে। গোপন বন্দিশালাগুলোর যথাযথ সংরক্ষণ এবং ঢাকঢাক গুড়গুড় বন্ধ না হলে পতিত স্বৈরাচারের দোসররা এগুলোকে বিতর্কিত করার চেষ্টা করবে। অথচ গুম ছিল বিরোধী দল ও ভিন্নমত দমনে ক্ষমতাচ্যুত স্বৈরাচারী সরকারের বহুল ব্যবহৃত হাতিয়ার।
গুম-সংক্রান্ত তদন্ত কমিশনের অন্তর্বর্তী প্রতিবেদন অনুসারে, তাদের কাছে ১ হাজার ৬৭৬টি গুমের অভিযোগ এসেছে। এর মধ্যে ৭৫৮টি অভিযোগের পর্যালোচনা থেকে দেখা গেছে, ৭৩ শতাংশ ভুক্তভোগী ফিরে এলেও বাকি ২৭ শতাংশ (অন্তত ২০৪ জন) এখনও নিখোঁজ। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর মধ্যে র্যাব, পুলিশ, ডিবি, সিটিটিসি, ডিজিএফআই ও এনএসআই গুমের ঘটনাগুলোর সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিল। সংস্থাগুলো সাধারণত সাদা পোশাকে ভুক্তভোগীদের তুলে নিত এবং পরিচয় গোপন করার জন্য আরেক সংস্থার নাম ব্যবহার করত। গুমের শিকার ব্যক্তিদের কাউকে কাউকে ভারতীয় সংস্থার সঙ্গে বিনিময়ের তথ্যও পেয়েছে তদন্ত কমিশন। আটকের পর ভুক্তভোগীদের সাধারণত গোপন অন্ধকার কক্ষে রাখা হতো এবং সেখানেই অমানুষিক নির্যাতন চলত। অনেক ক্ষেত্রে মাথায় গুলির পর লাশের সঙ্গে সিমেন্টভর্তি ব্যাগ বেঁধে ফেলে দেওয়া হতো নদীতে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে হত্যাকাণ্ডকে ‘দুর্ঘটনা’ হিসেবে দেখাতে রেললাইনে লাশ ফেলে রাখা হতো।
তদন্ত কমিশন এসব গুমের ঘটনায় নির্দেশদাতা হিসেবে ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সম্পৃক্ততার প্রমাণ পাওয়ার কথা জানালেও গুমের সঙ্গে সরাসরি জড়িতদের শনাক্ত ও বিচারকাজ এখনও বাকি। অথচ তার আগেই বন্দিশালাগুলোতে কাঠামোগত নানা পরিবর্তন ঘটিয়ে গুমের আলামত ধ্বংস করা হয়েছে।
শুধু আইনগত কারণেই নয়; ভবিষ্যতে বাংলাদেশে গুমের পুনরাবৃত্তি রোধেও গুমের ইতিহাস ধরে রাখতে হবে। গুমের ইতিহাস সংরক্ষণের গুরুত্ব বিষয়ে আর্জেন্টিনার সাবেক প্রেসিডেন্ট আলবার্তো ফার্নান্দেজ বলেছিলেন, ‘যৌথ স্মৃতির মাধ্যমেই মানুষ ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি করা থেকে বিরত থাকে এবং শ্রেয়তর ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে যায়।’
এ কারণে শুধু আর্জেন্টিনা নয়; রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস ও গুমের অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যাওয়া আরও অনেক দেশ সেই ইতিহাস সংরক্ষণে নানা পদক্ষেপ নিয়েছে। যেমন চিলির কুখ্যাত ডিআইএনএর গোপন বন্দিশালাগুলোর একটি ‘লন্ড্রেস ৩৮’ একেবারে পূর্বাবস্থায় সংরক্ষণ করা হচ্ছে। জেনারেল পিনোশের স্বৈরশাসনের সময় গুম ও নির্যাতনে ব্যবহৃত দেশটির এ রকম আরও অনেক বন্দিশালাকে স্মৃতিস্থান হিসেবে সংরক্ষণ এবং সেখানে নানা ধরনের সাংস্কৃতিক ও শিক্ষামূলক কার্যক্রম, গাইডেড ট্যুর, প্রদর্শনী, সেমিনারের আয়োজন হচ্ছে।
বাংলাদেশে গুম-সংক্রান্ত বহু প্রশ্নের উত্তর এখনও অজানা। গণঅভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পরপর গুমের শিকার কয়েকজন ফিরে এলেও এখনও অনেকে নিখোঁজ। অনেকেই জানেন না, তাদের স্বজনের ভাগ্যে কী ঘটেছে। এমনকি যারা ফিরে এসেছেন, তাদের কোথায় আটকে রেখেছিল, সুস্পষ্ট জানা যায়নি। গুমে ব্যবহৃত গোপন বন্দিশালার সঠিক সংখ্যা ও অবস্থান এখনও অজানা। গুমের ঘটনায় কারা, কীভাবে যুক্ত, তা নিয়েও রয়েছে অনেক প্রশ্ন। গুমের জন্য দায়ী ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানগুলোর বিচার ও সংস্কার বাকি। কাজগুলো সঠিকভাবে করতে হলে গুম-সংশ্লিষ্ট সব তথ্যপ্রমাণ, নথি যথাযথ সংরক্ষণ জরুরি। গোপন বন্দিশালাগুলোকে যথাযথ সংরক্ষণ এবং স্বৈরশাসনের দুঃসহ স্মৃতি হিসেবে জনগণের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হবে গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ।
কল্লোল মোস্তফা: প্রকৌশলী; উন্নয়ন
অর্থনীতিবিষয়ক লেখক
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: গণঅভ য ত থ ন আর জ ন ট ন র গ ম র ঘটন ব যবহ ত র পতন র উপদ ষ ট র জন য ন র পর ক ত কর জ দ ঘর ব ষয়ক সরক র তদন ত
এছাড়াও পড়ুন:
এখনও পুরনো যেসব রীতিতে চৈত্রসংক্রান্তি পালন করেন রংপুরের মানুষ
রংপুরের গ্রামাঞ্চলের মানুষ পহেলা বৈশাখে এখনও পুরনো দিনের রীতি অনুসরণ করে চলেন। দেশের সব জায়গায় আধুনিকতার ছোঁয়া লাগলেও পুরনো সেই রেওয়াজ তারা এখনও লালন করেন। বাংলা বছরের শেষ দিনটিকে বলা হয় চৈত্রসংক্রান্তি। শাস্ত্র অনুসারে এই দিনে স্নান, দান, ব্রত, উপবাস প্রভৃতিকে পূণ্যকর্ম বলে মনে করা হয়।
গৃহস্থের মঙ্গল কামনায় নেচে নেচে গান: চৈত্রসংক্রান্তিকে ঘিরে সন্ন্যাসীরা বাদ্যের তালে তালে নেচে নেচে দেবদেবীর প্রতিকৃতি (পাট) মাথায় নিয়ে ঘুরে বেড়ান। তাঁরা যে বাড়িতে যান, সেই বাড়ির গৃহিণী পরিষ্কার পিঁড়ি বা জলচৌকি পেতে দেন। এরপর তাঁরা ওই পিঁড়ি বা জলচৌকির ওপর পাট নামান। এই সময় গৃহস্থের মঙ্গল কামনায় নেচে নেচে গান পরিবেশন করেন সন্ন্যাসীরা। গান শেষে সন্ন্যাসীদের চাল, সবজি কিংবা টাকা উপঢৌকন দেন গৃহিণীরা। সংগৃহীত অর্থে, বাংলার সংস্কৃতি নতুন প্রজন্মের কাছে ছড়িয়ে দিতে চৈত্রসংক্রান্তি উৎসব ও চড়ক মেলার আয়োজন করা হয়।
চৈত্রসংক্রান্তির সকালে তিতা জাতীয় খাবার: পুরনো রীতি অনুয়ায়ী; রংপুরের গ্রামাঞ্চলের লোকজন চৈত্রসংক্রান্তির সকালে তিতা জাতীয় (ভাটির পাতার রস, জাত নিমের পাতার রস, নীলতাতের রস) খাবার খান। তাদের বিশ্বাস, এতে সারাবছর শরীরে কোনো রোগ-বালাই হবে না। এছাড়া মূলত খেসারি, মসুর, ছোলা জাতীয় কলাই ভেজে চিবিয়ে খাওয়া হয়। বিষয়টি মূলত দাঁতকে শক্তিশালী করার জন্য।
সামাজিক সম্প্রীতি সৃষ্টিতে ইতিবাচক ভূমিকা রাখে গ্রামীণ মেলা: চৈত্রসংক্রান্তি ও পহেলা বৈশাখে রংপুরের বিভিন্ন এলাকায় মেলার আয়োজন অনেক পুরনো রীতি। বাংলার ঐতিহ্যবাহী লোকসংস্কৃতির অন্যতম উপাদান হলো মেলা। গ্রামীণ সমাজ জীবনের পারস্পরিক যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে মেলার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল একসময়। মেলাকে কেন্দ্র করে উৎসবমুখর পরিবেশ সৃষ্টি হয়। আশপাশের কয়েক গ্রামের মানুষ আসে মেলায়। সামাজিক সম্প্রীতি সৃষ্টির ক্ষেত্রে এই পারস্পরিক যোগাযোগ ইতিবাচক ভূমিকা রাখে। স্থানীয় কারুশিল্পীদের উৎপাদিত পণ্য এবং কৃষিপণ্যই থাকে গ্রামীণ মেলার মূল বেচাকেনার জিনিস। বাঁশ, বেত, পাট, শোলা, ধাতব, মৃৎ, চামড়া, তন্তুজাত হরেক রকমের কারুপণ্য ও বাচ্চাদের খেলনার বিপুল সমাবেশ গ্রামীণ মেলাকে বর্ণাঢ্য করে তোলে। এর পাশাপাশি থাকে খাজা, গজা, মওয়া এসব খাদ্যসামগ্রীর সমাবেশ। থাকে নাগরদোলা, পুতুলনাচ, গাজির গান, যাত্রাপালা, সার্কাস, লাঠিখেলাসহ হরেক রকমের আয়োজন।
হালখাতায় মন্ডা-মিঠাইসহ হরেক খাবারের আয়োজন: নবাব মুর্শিদ কুলি খান পয়লা বৈশাখে ‘পুণ্যাহ’ উৎসব চালু করেন। তখন কিছুটা জাতীয় পুঁজির বিকাশ ঘটায় ব্যবসা-বাণিজ্যের একটি উন্নত অবস্থা সৃষ্টি হচ্ছিল। এই ব্যবসায়ীরাই পুণ্যাহর আনুষঙ্গিক অনুষ্ঠান হিসেবে ‘হালখাতা’ উৎসব চালু করেন। বাংলার অর্থনীতি ছিল কৃষিনির্ভর। ফলে কৃষকের হাতে নগদ অর্থের জোগান শুধু ফসল কাটার সময়েই আসত। তাই বাধ্য হয়ে তাঁরা দৈনন্দিন প্রয়োজনীয় জিনিস ব্যবসায়ী বা দোকানিদের কাছ থেকে বাকিতে কিনতে বাধ্য হতেন। নতুন বছরের প্রথম দিনে হালখাতা উৎসবে বকেয়া অর্থের পুরোটা বা আংশিক পরিশোধ করে হালখাতা বা নতুন খাতায় নাম লেখা হতো। তার মধ্যে অবশ্য আনন্দের উপকরণও ছিল। হালখাতা উপলক্ষে খাওয়া-দাওয়া বিশেষ করে মিষ্টান্ন বিতরণের রেওয়াজ ছিল। সেই রীতি অনুসরণ করে রংপুর অঞ্চলের ব্যবসায়ীরা পহেলা বৈশাখে বাড়ি কিংবা ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে হালখাতার আয়োজন করেন। অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিতদের আপ্যায়নে বাড়িতে তৈরি করা হয় মন্ডা-মিঠাইসহ হরেক রকম খাবারের জিনিস।
ঝগড়াঝাটি বা কারও সঙ্গে লেনদেন না করার প্রথা: আর পহেলা বৈশাখে ভালো খাবার, ভালো কাপড় পরিধান, ঝগড়াঝাটি না করা, কারও সঙ্গে লেনদেন না করাসহ বিভিন্ন নিয়ম মেনে চলার প্রস্তুতিও নেওয়া হয়েছে। এতে করে আগামী বছরজুড়ে ভালো থাকা যাবে-এই বিশ্বাস থেকেই পহেলা বৈশাখে রংপুর অঞ্চলের মানুষজন এসব পুরনো রীতিনীতি মেনে চলেন।
বর্ষবরণে চলছে প্রস্তুতি: রংপুরের বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা যায়, পহেলা বৈশাখ বাংলা বর্ষবরণে চলছে প্রস্তুতি। এতে থাকছে বৈশাখী শোভাযাত্রা, বিভিন্ন প্রতিযোগিতা, গ্রাম বাংলার ঐতিহ্যবাহী সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান।