গত ছয় মাসে বাংলাদেশে অনেক উৎসব, আয়োজন, মেলা, অনুষ্ঠান হুমকি দিয়ে বা হামলা-ভাঙচুরের মাধ্যমে বন্ধ করা হয়েছে। বিশেষ করে গত এক সপ্তাহে প্রায় প্রতিদিন বিভিন্ন কারণ দেখিয়ে মব তৈরি করে কোনো না কোনো অনুষ্ঠান, উৎসব বন্ধ করা হয়েছে। 

উৎসব এবং নানা আয়োজনের মধ্য দিয়ে ঋতুরাজ বসন্তকে বরণ করা এ অঞ্চলের দীর্ঘদিনের রীতি। গাছে গাছে গজিয়ে ওঠা নতুন পাতা ও ফুলে রাঙিয়ে দেওয়া প্রকৃতিকে স্বাগত জানানো হয়। কিন্তু এবার বসন্ত উৎসব আগের মতো উদযাপন করা যায়নি। কেন যায়নি, তা বুঝতে কিছু ঘটনার উল্লেখ প্রাসঙ্গিক হতে পারে।
ঢাকায় জাতীয় বসন্ত উৎসব উদযাপন পরিষদ এবার তিনটি স্থানে ‘বসন্ত উৎসব’ পালনের কর্মসূচি নিয়েছিল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বকুলতলা ও পুরান ঢাকার বাহাদুর শাহ পার্কের আয়োজন ঠিকঠাক করা গেলেও, উত্তরার অনুষ্ঠানটি হতে পারেনি; আয়োজকদের ভাষায়– কিছু লোকের হুমকির কারণে। চট্টগ্রামে রেলওয়ের মালিকানাধীন সিআরবি শিরীষতলায় কর্তৃপক্ষের অনুমতি নিয়ে আবৃত্তি সংগঠন প্রমার বসন্ত উৎসব মাঝপথেই বন্ধ হয়ে যায় রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ ‘অনিবার্য কারণবশত’ মাঠ ব্যবহারের অনুমতি বাতিল করলে। একই দিনে টাঙ্গাইলের ভূঞাপুরে ফুলের দোকান ভাঙচুর করা হয়েছে; জেলার গোপালপুর উপজেলায় নির্ধারিত ঘুড়ি উৎসব বাতিল হয়েছে উৎসববিরোধী লিফলেট বিতরণের পর। 

১৫ ফেব্রুয়ারি বন্ধ করা হয়েছে ‘ঢাকা মহানগর নাট্য উৎসব’। হুমকিতে বন্ধ করা হয়েছে নারায়ণগঞ্জ সদর উপজেলার কাশীপুরের মধ্য নরসিংহপুর গ্রামের সাধুসঙ্গ ও লালন মেলা। টাঙ্গাইলের সখীপুরে ফাইলা পাগলার (ফালুচান শাহ) মেলা বন্ধ করেছে যৌথ বাহিনী। এর আগে বন্ধ করা হয় বছরের পর বছর ধরে হয়ে আসা মাদারীপুরের কালকিনির কুণ্ডুবাড়ির কালীপূজা মেলা। 
অমর একুশে বইমেলাতেও ঘটেছে নানা ঘটনা। নারীবাদী লেখিকা তসলিমা নাসরীনের বই প্রকাশ ও বিক্রি করায় আক্রমণ হয়েছে ‘সব্যসাচী’ প্রকাশনা স্টলের ওপর। পরে স্টলটি বন্ধ করে প্রকাশককে নেওয়া হয়েছে জেলে। গ্রেপ্তার করা হয়েছে কবি সোহেল হাসান গালিবকে। তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ, বইমেলায় প্রকাশিত একটি বইয়ে অন্তর্ভুক্ত কবিতায় ‘মহানবীকে কটাক্ষ’ করা হয়েছে। আরেকটি ঘটনায় মবের হুমকির মুখে বইমেলা থেকে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে নারীদের স্বাস্থ্য সুরক্ষা পণ্য স্যানিটারি ন্যাপকিনের স্টল। তবে সামাজিক মাধ্যমে এ নিয়ে ব্যাপক প্রতিবাদ হলে কর্তৃপক্ষ নিজেই সেই পণ্য সরবরাহের প্রতিশ্রুতি দেয়। 

খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ে ঘটেছে আরও অদ্ভুত ঘটনা। সিন্ডিকেট সভায় সেখানকার হলসহ ১৯টি স্থাপনার নাম পরিবর্তন করা হয়, যেখানে মাত্র দুটোর নামের সঙ্গে ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সম্পর্ক ছিল। কিন্তু বাকিগুলো ছিল বিশ্ববিখ্যাত বিজ্ঞানী ড.

সত্যেন্দ্রনাথ বসু, আচার্য জগদীশচন্দ্র বসু, কবি জীবনানন্দ দাশ, লালন সাঁই, আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায় এবং বিভিন্ন শহীদ বুদ্ধিজীবীর নামে। কী কারণে ওই স্থাপনাগুলো থেকে জাতির এ শ্রেষ্ঠ সন্তানদের নাম কাটা গেল? শিক্ষার্থীরা নাকি পুরোনো নামগুলোর ব্যাপারে ‘আপত্তি’ জানিয়েছিল। কোন শিক্ষার্থী; তারা মোট শিক্ষার্থীর কত ভাগ– জানানো হয়নি। 
ঘটনাগুলো বিশ্লেষণ করলে আমরা যে চিত্র পাই তাকে এক ধরনের কালচারাল জেনোসাইড বলা যায়। আমাদের এই ভূখণ্ড সাংস্কৃতিকভাবে অত্যন্ত শক্তিশালী ও বৈচিত্র্যময়। পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে অনেক স্কলার ছুটে এসেছেন এই বৈচিত্র্য নিয়ে গবেষণা করতে। অনেকেই স্থায়ীভাবে এ দেশে বসবাসের সিদ্ধান্তও নিয়েছেন। কিন্তু এই শক্তি ও সৌন্দর্যকেই হামলার লক্ষ্যবস্তু করা হচ্ছে; মুছে দেওয়ার চেষ্টা চলছে। 

প্রশ্ন হতে পারে, অন্তর্ভুক্তিমূলক রাষ্ট্র ও সমাজ গঠনের প্রতিশ্রুতি দিয়ে ক্ষমতাসীন হওয়া সরকার তাহলে কী করছে? এর সহজ উত্তর হতে পারে, সরকার হিরো-ডেভিল গেম খেলছে। সরকারের প্রশংসা করলে হিরো; তা না হলেই ফ্যাসিস্টের দোসর অথবা ডেভিল। প্রধান উপদেষ্টা বাংলা একাডেমির ঘটনায় দুঃখ প্রকাশ করেছেন বটে, কিন্তু সংস্কৃতি উপদেষ্টা ‘সমঝোতা’ পলিসি নিয়ে দু-একটি জায়গায় ক্ষত মেরামতের প্রচেষ্টায় আছেন। এমনকি কারা বিরোধিতা করছে, কেন বিরোধিতা করছে, সেটি না খুঁজে অনুষ্ঠান বন্ধ বা পণ্ড হওয়ার পুরো দায় চাপানোর চেষ্টা করছেন আয়োজকদের ওপর। বলছেন, হুমকিদাতারা আয়োজকদের পছন্দ করছেন না; তাই আপত্তি তুলছেন। 

অধিকাংশ ঘটনায় হুমকিদাতা বা হামলাকারীরা আগেই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিষয়টি জানান দিয়েছেন। কিন্তু এক প্রকার ফৌজদারি অপরাধ হলেও, তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না। ঘটনা ঘটার পর নিন্দা এবং দুঃখ প্রকাশ করা হচ্ছে। তাতেই যেন সরকারের কাজ শেষ!

অনেকেই সামাজিক মাধ্যমে মন্তব্য করছেন, সরকারের নিয়ন্ত্রণে অনেক কিছুই নেই। আবার কেউ কেউ বলছেন, একটি ছায়া সরকার সব পরিচালনা করছে। এগুলো সরকারকে আলোচনা থেকে সরিয়ে রাখার কৌশল। সরকার যদি এগুলোর বিহিত করতে না পারে, তা সরাসরি বললেই তো হয়। এতে অন্তত সরকারের এক প্রকার জবাবদিহি হবে; জনগণও নিজ করণীয় ঠিক করতে পারবে। 
আমি দৃঢ়ভাবে মনে করি, এ সরকার কোনোভাবেই অরাজনৈতিক নয়; সম্পূর্ণ রাজনৈতিক সরকার। হয়তো নির্দিষ্ট কোনো রাজনৈতিক দলের সরকার নয়। কিন্তু হিড়িক তুলে উৎসব-অনুষ্ঠান বন্ধ করা নিঃসন্দেহে অরাজনৈতিক বিষয় নয়। এসব নিয়ে রাষ্ট্রীয় বক্তব্য যে নেই, এটিও রাজনীতির অংশ। সরকার কোন জায়গায় কথা বলছে, কোন জায়গায় কথা বলছে না; কাদের বিরুদ্ধে কথা বলছে, কাদের বিরুদ্ধে কথা বলছে না; নিশ্চিতভাবে তা সরকারের রাজনৈতিক আদর্শের পরিচায়ক।
এখানে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হলো, কোনো গোষ্ঠীর পছন্দ-অপছন্দ কি সংস্কৃতির গতিপথ নির্ধারণ করে? এ বিষয়ে সনদ বিতরণ করার দায়িত্ব কি সরকার ওই গোষ্ঠীর হাতে ছেড়ে দিয়েছে? হিরো-ডেভিল সনদও কি তবে এই প্রক্রিয়ার অংশ? কোনো দেশের সরকার কি তার নাগরিকদের ইচ্ছামতো তকমা দিতে পারে? কিংবা অন্যরা তকমা দিয়ে কারও আনুষ্ঠান বন্ধ করলে তাদের পক্ষে কি সরকার সাফাই গাইতে পারে? এ দেশে কি ‘সমঝোতা’র নাগরদোলাতেই চলতে থাকবে উৎসব-অনুষ্ঠানের চরকি?

মব আসলে কোনো হুজুগে বিষয় নয়। কারা মব করছে, কেন করছে– এটি বোঝা দুরূহ নয়। সরকার জানছে না, বুঝছে না– বিষয়টি কিন্তু এমন নয়। মব বর্তমানে একটি গোষ্ঠীর আদর্শিক ব্যানার থেকেই হচ্ছে এবং রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা পাচ্ছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে আন্দোলন ঠেকাতে সরকার নিজেও মবকে উৎসাহিত করছে। 
আমরা আপাতত এটুকু বলতে পারি, জনগণ সবই দেখছে ও বুঝতে পারছে। এই দেখা ও বোঝার ফল শেষমেশ কী দাঁড়ায়– ইতিহাসে তার নজিরও তো কম নেই। 

জোবাইদা নাসরীন: শিক্ষক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় 
zobaidanasreen@gmail.com

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: বসন ত উৎসব র জন ত ক অন ষ ঠ ন সরক র র

এছাড়াও পড়ুন:

গুলশান সোসাইটির আয়োজনে দুদিনের ভাষা উৎসব শুরু কাল

আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উপলক্ষে গুলশান সোসাইটি লিটফেস্টের আদলে আয়োজন করেছে ‘গুলশান সোসাইটি ভাষা উৎসব ২০২৫’। দুই দিনব্যাপী এ উৎসব গুলশান লেকপার্কে শুরু হবে আগামীকাল ২১ ফেব্রুয়ারি।

ভাষাগত বৈচিত্র্যকে সম্মান জানাতে আয়োজিত এই উৎসবে থাকবে প্যানেল আলোচনা, সাংস্কৃতিক পরিবেশনা এবং বিভিন্ন ভাষায় অধিবেশন, যেখানে বাংলা, ইংরেজি এবং বাংলাদেশের অন্যান্য ভাষার গুরুত্ব ও বৈচিত্র্য তুলে ধরা হবে। দুই দিনের এই আয়োজনে ১৫টির বেশি সুপরিকল্পিত অধিবেশনে অংশ নেবেন খ্যাতিমান সাহিত্যিক, সাংবাদিক, শিক্ষাবিদ, চিন্তক এবং সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বরা। প্রতিদিন সকাল সাড়ে ১০টা থেকে সন্ধ্যা সাড়ে ৭টা পর্যন্ত অনুষ্ঠান চলবে।

লিটফেস্টের আদলে সাজানো এ আয়োজনে শিমুল মুস্তাফা ও ডালিয়া আহমেদের আবৃত্তি, সায়ানের গান, মো. নাজিম উদ্দিনের ‘দ্য ভিঞ্চি ক্লাব’ নিয়ে বুক টক, তাসনীম খলিলের সঙ্গে আনফিল্টার্ড কথোপকথন, ওয়ার্দা ও এফ মাইনরের নানাভাষী গান, চন্দ্রশেখর সাহার জামদানির ভাষা নিয়ে আলোচনা, জয়িতার পাঠগীতি এবং আরও অনেক আড্ডা-গান চলবে দুদিন।

উৎসবের অন্যতম আকর্ষণ হিসেবে থাকবে একটি স্বল্প পরিসরের বইমেলা, যেখানে সমৃদ্ধ সাহিত্যকর্মের সমাহার থাকবে। একটি ফুডকোর্টে থাকবে নানা রকম মুখরোচক খাবার; এবং অংশগ্রহণমূলক বিভিন্ন সৃজনশীল কার্যক্রম। গুলশান সোসাইটি শহীদ দিবস উপলক্ষে পার্কের ভেতরে একটি অস্থায়ী শহীদ মিনার স্থাপন করেছে, যেখানে নাগরিকেরা এবং বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ভাষাশহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে পারবেন।

এই ভাষা উৎসবটি ভাষার সৌন্দর্যকে উদ্‌যাপনের পাশাপাশি বাংলাদেশি ঐতিহ্য ও বহুভাষিকতার গুরুত্বকে আরও গভীরভাবে উপলব্ধি করার এক অনন্য সুযোগ তৈরি করবে বলে মনে করেন আয়োজকেরা।

এই আয়োজনে সহযোগী হিসেবে আছে প্রধান পৃষ্ঠপোষক: ইস্টার্ণ ব্যাংক লিমিটেড; চিকিৎসা সহায়তা: অ্যাসেন্ট হেলথ; ইন্টারনেট পার্টনার: রেড ডাটা; ফুডকোর্ট পার্টনার: পাঠাও ফুডস; স্ট্রিট আর্ট পার্টনার: অ্যাকোয়া পেইন্টস/এলিট স্টিল; এবং ইভেন্ট পার্টনার: যাত্রিক প্রোডাকশনস।

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • কক্সবাজার সৈকতে কাল শুরু হচ্ছে ২১ জাতিগোষ্ঠীর উৎসব
  • শুরু হলো সিনে ক্যারাভান চলচ্চিত্র উৎসব
  • গুলশান সোসাইটির আয়োজনে দুদিনের ভাষা উৎসব শুরু কাল
  • শেকৃবিতে শিবিরের প্রকাশনা উৎসব বন্ধের নির্দেশ
  • তারুণ্যের উৎসব ম্যারাথনে দ্বিতীয় হাবিপ্রবির শিক্ষার্থী
  • মেহজাবীনের সিনেমা দিয়ে পর্দা নামছে আমার ভাষার চলচ্চিত্র উৎসবের 
  • এবার হোঁচট খেলে আর উঠে দাঁড়াতে পারব না: মাহফুজ আলম
  • পলো হাতে মাছ ধরতে দলে দলে শৌখিন শিকারিরা গোমতীতে, মাছ পেলেই হইহুল্লোড়
  • এবার হোঁচট খেলে আর উঠে দাঁড়াতে পারব না: উপদেষ্টা মাহফুজ