মহাশূন্য থেকে পৃথিবীর ছবি দেখে বিস্ময়, ভালোবাসায় স্তব্ধ হয়ে ওঠেনি, এমন মানুষ কম। সুনীলে সবুজে মাখামাখি স্বপ্নের ভেজা আবরণে ঘূর্ণায়মান যেন এক স্বপ্নচারী অতিকায় লাটিম আমাদের এই ধরিত্রী, বসুধা, বসুমতী, সর্বংসহা। প্রকৃতিবিজ্ঞানী জেমস লাভলকের ভাষায় ‘গায়া’। গ্রহমণ্ডলের মধ্যে একমাত্র পৃথিবীকে পশ্চিমারা নামকরণ করেনি গ্রিক দেবদেবীর নামে, যেভাবে করেছে অন্য গ্রহকে– ইউরেনাস, নেপচুন কিংবা সেটার্ন। পৃথিবীকে বলেছে আর্থ, আরবি ভাষায় আর্ধ, হিব্রুতে এরেৎজ। মানে ভূমি। মহাশূন্য থেকে দেখলে সত্যিকার রূপে দেখা যায় তার সুনীল জলজ মায়াময় ছবি।
এই জলজ রূপের এক সংস্করণ আমাদের জলাভূমি নদী-নালা, হাওর-বাঁওড়। আমাদের হৃদয় যুগ যুগ ধরে সিক্ত করেছে জন্মভূমির এই জলজ রূপ। আর আমরাই আজ ধ্বংস করতে ব্যস্ত এই জলাভূমি। পৃথিবীতে গঠিত যে জীবন আমাদের রক্ত, ঘাম ও অশ্রুতে; এ যেন জলজ পৃথিবীর আরেক রূপ। যে সালোকসংশ্লেষণ আমাদের খাদ্য জোগায়, তার অন্যতম প্রধান উপাদান পানি। বর্ষণে সিক্ত ভূমিতে জন্মায় ধান। বারিহীন মরুভূমি শস্যহীন– এ নেহাত শিশুও জানে।
বাংলার পলিমাটি জলের ফেলে যাওয়া সঞ্চয় হয়ে ওঠে আমাদের শস্যময় মাতৃভূমি। সিলেট-ময়মনসিংহের হাওরাঞ্চল, হাকালুকি, কাউয়াদীঘি কিংবা হাইল হাওর– আমাদের জন্মভূমির আবশ্যিক অঙ্গ। যেমন মানবদেহে থাকে কিডনি, ফুসফুস; থাকে দু’ফোঁটা অশ্রু, তেমনি জননী বসুমতীর আছে জলজ অঙ্গ। সৃষ্টির শুরু থেকে এমনিভাবে নির্মিত হয়েছে জীবন ও পৃথিবী। প্রথমে রসায়নের সমীকরণে, তারপর ঋতুর গোলক আবর্তনে, মানুষের অনুভবে ও বেঁচে থাকার ক্রমাগত আয়োজনে জল ও স্থলের মাত্রা আমাদের দিয়েছে যাপিত জীবন। বসুধা কখনও ভাবেনি, তার সন্তানেরা একদিন জলের এই অঙ্গীকারকে পৃথিবীর শরীর থেকে চিরতরে ছিনিয়ে নেবে। কলিকালে আসবে এমন একদিন, যেদিন এক দল অর্থগৃধ্নু পঙ্গপাল ক্ষুদ্র অর্থ ও স্বার্থের লোভে মাতা ধরিত্রীকে জলহারা করবে।
আমরা এই আত্মহননকারী মহাকালের দ্বারপ্রান্তে। একদার বিশালায়তন নদীগুলো এখন বাঁধের পরে বাঁধের পরিক্রমে অবলুপ্ত। পরাক্রমশালী গঙ্গা-পদ্মা ফারাক্কার আক্রমণে অপসৃয়মাণ, তিস্তা নিয়ে চলছে স্বার্থময় জলকেলী, আর মহাসড়কের করাল গ্রাসে অন্তর্হিতপ্রায় হাওরগুলো। ভূমিদস্যুর কবলে আস্তাকুঁড়ে আমাদের নদীগুলো। বজ্রের পূতিগন্ধময় বিভীষিকায় বীভৎস হয়ে উঠছে প্রতিটি শহরতলির জলাধার। ভাবতে অবাক লাগে, একদা এক প্রাচীনতম সময়ে পৃথিবীর দেখভাল করার জন্য পৃথিবীতে ঈশ্বর প্রতিনিধি পাঠিয়েছিলেন!
পরাক্রমের এই অর্থলিপ্সু সময়ে, হে জলাভূমির পৃথিবী, তোমাকে তাহলে কী বলি? যুদ্ধক্লান্ত ভগ্নদূতের মতন শব্দের বরং বর্ণনা করি এই ধ্বংসের কাহিনি।
ঢাকা-সিলেট মহাসড়ক ধরে এগোলে প্রথমে চোখে পড়ে এই প্রকৃতিবিনাশী আয়োজন। হবিগঞ্জের হাওরকে ধ্বংস করে হয়েছে বিশাল হাইওয়ে।
আমার নানাবাড়ির হাওরগুলো আজ বিলুপ্ত। ভবিষ্যতের গবেষক অন্তত লিখে রাখুক সেই তস্করদের নাম, যারা একদা আমাদের জলাভূমি ধ্বংস করেছিল। মাধবপুর এলাকায় দেখা যায় শস্যভূমি গ্রাস করে নির্মিত হয়েছে বিবিধ কারখানা। এলাকার মানুষ প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ করেছে, কিন্তু রাষ্ট্র তার পুলিশ বাহিনী নিয়ে দাঁড়িয়েছে ভূমিদস্যু ও জলজ জীবহন্তাদের পক্ষে। রাষ্ট্রের প্ররোচনা ও মদদ না থাকলে প্রকৃতিকে এভাবে ধ্বংস করা অসম্ভব। একদিন যেদিন আমাদের খাবার অন্ন ফুরিয়ে যাবে, সেদিন যেন প্রকৃতি আমাদের মেঝের টাইল্স, ঘরের ইট কিংবা রপ্তানিযোগ্য মালপত্র খেয়ে উদর পূর্তি করার সক্ষমতা দান করে। সুজলা যে ভূমিকে আমরা জলহারা করেছি, সে কুকর্মের প্রতিদানে ইতিহাস একদিন আমাদের উত্তরপুরুষদের মুখোমুখি। আমাদের সন্তান-স্বজনদের ধিক্কার নিশ্চিত সেদিন আমাদের দিকে বর্ষিত হবে। অথচ পরিবেশ রক্ষা করার জন্য আমাদের রয়েছে মন্ত্রণালয়। মন্ত্রী ও পারিষদের রয়েছে কৃষ্ণবর্ণ জমকালো গাড়ি; তাতে শোভা পায় রাষ্ট্রের পতাকা। পরিবেশ, ভূমি, কৃষি, মৎস্য– এ সম্পদগুলো দেখভাল করার জন্য সমাজ ও রাষ্ট্র তাদের বিপুলভাবে অর্থায়ন করে। ট্যাক্সের ভারে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের বাক্স খালি। অথচ ভূমি, পরিবেশ, কৃষি লুটেরাদের অভয়ারণ্য।
রাষ্ট্র ও সমাজের ব্যর্থতার চিহ্ন আমাদের জলাধারগুলোর গায়ে শ্যাওলার আস্তরণে লেখা। লেখা জলাভূমির জেলেদের গায়ে; জলাভূমি গ্রাস করা দস্যুদের অন্যায় সম্পদে; হাজার হাজার আইনি দলিলে, যাকে কেন্দ্র করে দেশের এই জলজ অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের জন্য চলছে আইনি লড়াই। তবু মানুষ রুখে দাঁড়াচ্ছে। হাকালুকি, কাউয়াদীঘিতে চলছে জমায়েত সংগ্রাম। এ সংগ্রামে শামিল আমি নিজেও শুধু এই কারণে, এ দেশের জলাভূমি আমার আশৈশব আশ্রয় ছিল। সরকারের বাজার থেকে নৌকায় চেপে হবিগঞ্জের বড় হাওর পেরিয়ে একদা যেতাম লুগাও, হোসেনপুর কিংবা সদরঘাট। উজ্জীবিত হয়েছি মাঝিমাল্লার গানে, কবাইয়ার হাওরের কৃষক সংগ্রামের কাহিনিতে। সেসব কথা আজ নেহাত অতীত। ধনতন্ত্রের নিষ্পেষণে আজ নিঃসহায় শোষিত মানুষ। একদার সর্বংসহা পৃথিবীও এখন শেষ দিন গুনছে। পৃথিবীব্যাপী বেজে উঠেছে উষ্ণায়নের পাগলা ঘণ্টা। এই অতি-উষ্ণ ক্ষয়িত প্রান্তরে তবু আমরা আমাদের জলজ ভূমি উদ্ধারের স্বপ্ন দেখি। আমি এই স্বপ্নের অনুচর হয়ে একটা খোলা জিপে চেপে কাউয়াদীঘি দেখে এলাম। আষাঢ়ের বর্ষণ ও প্লাবনের পর নৌকায় চেপে আবার যাব। কী ছিল আর কী হারিয়েছি, তা দেখা ও পরিমাপের কোনো বিকল্প নেই।
পৃথিবী, পরিবেশ, প্রকৃতি, জলাভূমির পক্ষে দাঁড়াবে আগামীর মানুষ। শেষ হয়ে যাওয়ার করুণ বিলাপ ত্যাগ করে আবারও পথে নামবে মানুষ। পৃথিবী ধুঁকছে; তেতে উঠছে রাগে ক্ষোভে; অনল বর্ষণ করছে মাতা ধরিত্রী। তার এই পুড়ে খাক হয়ে যাওয়া ঠেকাতে আমাদের পথে নামতে হবে। এই শেষ সংগ্রামের কোনো বিকল্প নেই।
ড.
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: ধ ব স কর ন আম দ র পর ব শ র জন য একদ ন
এছাড়াও পড়ুন:
বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন আয়োজিত উন্মুক্ত কনসার্ট স্থগিত
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ব্যানারে হতে যাওয়া ‘রিবিল্ডিং দ্য নেশন’ কনসার্টটি হঠাৎ স্থগিত করা হয়েছে। বৃহস্পতিবার রাতে স্থগিতের বিষয়টি আয়োজকরা নিশ্চিত করেছেন।
তবে হঠাৎ করেই একদিন আগে কেন আলোচিত এ কনসার্টটি স্থগিত করা হলো সে বিষয়টি দায়িত্বশীল কারও বক্তব্য পাওয়া যায়নি। তবে আয়োজকদের একজন জানিয়েছেন নিরাপত্তা ইস্যুতে আপাতত স্থগিত করা হয়েছে। পরে বিস্তারিত জানানো হবে।
আগামী ২২ ফেব্রুয়ারি রাজধানীর পুরোনো বাণিজ্য মেলা মাঠ, আগারগাঁওয়ে অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা ছিল। আয়োজকরা জানান, নিরাপত্তার কারণে কনসার্টটি স্থগিত করা হয়েছে। তবে কখন কনসার্টটি হবে তা নিয়ে বিস্তারিত জানা যায়নি।
আয়োজকদের পক্ষ থেকে এর আগে বলা হয়, ‘এটি বাংলাদেশের ইতিহাসে অন্যতম বৃহৎ উন্মুক্ত কনসার্ট হতে যাচ্ছে। কনসার্ট ভেন্যুতে কয়েক লাখ মানুষ একসঙ্গে নিরাপদে গান শুনতে পারবে।
‘তাদের সামনে দেশের বিভিন্ন ব্যান্ড গান পরিবেশন করবে। আমরা দেশীয় শিল্পীদের নিয়ে কনসার্টের লাইনআপ সাজিয়েছি; যারা আন্দোলনের সময় নিজেদের ক্যারিয়ারের চিন্তা না করে আন্দোলনের পক্ষে অবস্থান নিয়েছিলেন।’
প্রসঙ্গত, এই কনসার্টে প্রধান আকর্ষণ হিসেবে গান গাওয়ার কথা ছিল নগর বাউল জেমস। আরও গান শোনানোর কথা ছিল ব্যান্ড চিরকুট, আর্টসেল, সোনার বাংলা সার্কাস, বেঙ্গল সিম্ফনি, বাংলা ফাইভ, ক্রিপটিক ফেইট, কুঁড়েঘর, কাকতাল, সংগীতশিল্পী ফারজানা ওয়াহিদ সায়ানসহ অনেকে।