‘কারও গাছ থেকে সুপারি পেড়ে আনতে হবে, ডাক পড়ত রুপনার। নারকেল পাড়তেও রুপনা। নানিয়ারচরের মেয়েটি যেন সারাক্ষণ গাছে গাছে ঘুরত। পাশে আমার এক আত্মীয়ের বাড়ি। তিনি আমাকে ফোন করে বললেন, মেয়েটাকে নিয়ে গিয়ে যাতে ক্যাম্পে রাখি। ফুটবলটা সে ভালো খেলে।’

নারী ফুটবল দলের গোলরক্ষক রুপনা চাকমাকে ফুটবলে নিয়ে আসার বর্ণনা এভাবেই দিলেন তাঁর প্রথম কোচ বীর সেন চাকমা। বীর সেন প্রাথমিক বিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক। বাংলাদেশ জাতীয় নারী ফুটবল দলে পাহাড়ের যে এতগুলো মেয়ে খেলছেন, এর পেছনে বড় অবদান তাঁর।

গত রোববার রাঙামাটির কাউখালীর ঘাগড়া চেলাছড়া এলাকায় তাঁর খামারের পাশে একটি দোকানে কথা হয় বীর সেন চাকমার সঙ্গে। সেখানে বসেই তিনি সময়ের চাকায় ভর করে ফিরে গেলেন অনেক বছর পেছনে। স্মৃতি থেকে তুলে এনে কথা বললেন শিষ্যদের গড়ে তোলা নিয়ে। একই সঙ্গে নারী ফুটবলের বর্তমান পরিস্থিতি নিয়েও জানালেন নিজের ভাবনার কথা।  

বীর সেনের হাত ধরে এ পর্যন্ত অন্তত ছয়–সাতজন পাহাড়ি মেয়ে জাতীয় দলে জায়গা করে নিয়েছেন। বর্তমানে জাতীয় দলে খেলছেন তিনজন। তাঁদের অন্যতম গোলরক্ষক রুপনা। অপর দুজন হলেন ঋতুপর্ণা চাকমা ও মনিকা চাকমা।

কোচ পিটার বাটলারের বিরুদ্ধে বেশ কয়েকজন ফুটবলারের বিদ্রোহে বাংলাদেশের নারী ফুটবলে দেখা দিয়েছে অন্য রকম এক সংকট। বিদ্রোহীদের মধ্যে বীর সেনের তিন শিষ্যও আছেন। তবে বিদ্রোহীদের যে কজনকে ছাড় দেওয়ার কথা বলেছেন কোচ বাটলার, এর মধ্যে বীর সেনের শিষ্যও আছেন। ঋতুপর্ণা–রুপনার সম্ভাবনার প্রশ্নে বাটলার যেমন আশাবাদী, তেমনি তাঁদের ছোটবেলার কোচ বীর সেনও।

বীর সেন বললেন, ‘সাফ চ্যাম্পিয়নশিপের পর ওদের সঙ্গে কথা হয়েছে। এই ঝামেলা কেন শুরু হলো, জানি না। এরপর ওদের ফোনে পাচ্ছি না। দু–একবার সামান্য কথা হয়েছিল। ওদের বলেছি, মন দিয়ে অনুশীলন করতে। তাদের এখনো দেশকে আরও অনেক কিছু দেওয়ার বাকি আছে।’

চায়ের দোকানে বসে সকাল ১০টার দিকে কথাগুলো বলছিলেন বীর সেন। কথা বলতে বলতে প্রতিবেদকের সামনেই ঋতুপর্ণাকে ফোন করে বসলেন বীর সেন। ওপারে ফোন ধরলেন না ঋতুপর্ণা। পরে মারিয়া মান্দাকে ফোন করলেন বীর সেন। মারিয়া ফোনে জানালেন ঋতুপর্ণা ঘুমাচ্ছেন। পরে ঋতু–রুপনাদের সঙ্গে যোগাযোগ করিয়ে দিতে বললেন মারিয়াকে।

নারী ফুটবলের বর্তমান পরিস্থিতি তাঁকে মানসিকভাবে খুব কষ্ট দিচ্ছে। বীর সেন বললেন, ‘২০১১ থেকে ২০১৪-১৫ সাল পর্যন্ত অনেক মেয়েকে আমরা তুলে এনেছিলাম প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে। অর্ধাহার, অনাহারের কষ্ট ভুলে তারা জাতীয় দলে প্রতিনিধিত্ব করছে। এটা আমার কাছে অনেক গর্বের। আমি মনে করি ঋতু, রুপনা ও মনিকারা এখনো তরুণ। তাদের আরও অনেক সম্ভাবনাময় জীবন পড়ে আছে। এই ঝামেলাটা দ্রুত মেটানোর উদ্যোগ নেওয়া সব পক্ষের দায়িত্ব।’

তিন পার্বত্য জেলা থেকে ধরে ধরে নারী ফুটবলারদের ঘাগড়া বহুমুখী উচ্চবিদ্যালয়ের ক্যাম্পে নিয়ে আসার গল্পে ফিরে গেলেন বীর সেন। কিছুটা স্মৃতিকাতরও হলেন তিনি। নিজে কখনো ফুটবল খেলেননি। তারপরও ফুটবলের প্রতি তাঁর ভক্তি কোথা থেকে এল, তা নিজেও বলতে পারছেন না বীর সেন, ‘আমি তখন মগাছড়ি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক। কিশোরীদের দল করতে বলা হলো। দল গঠন করলাম। তারপর থানা পর্যায়ে, জেলা পর্যায়ে খেলায় যারা অংশ নিয়েছে; তাদের মধ্যে কয়েকজনকে পাখির চোখ করলাম। ভালো খেলোয়াড়দের নিয়ে ভর্তি করলাম নিজের স্কুলে। ঘাগড়া স্কুল মাঠের পাশে একটা পরিত্যক্ত কক্ষে তাদের থাকার ব্যবস্থা করলাম। খাওয়াদাওয়া থেকে সবকিছু ওখানেই।’  

তখন তাঁর সঙ্গী ছিলেন কোচ শান্তিমণি চাকমা ও ম্যানেজার ধারসমণি চাকমা। তিনজন মিলে তিন পার্বত্য জেলায় অনেক ঘুরেছেন প্রতিভা অন্বেষণের জন্য। এভাবেই পেয়ে যান আজকের রুপনা, ঋতুপর্ণা, মনিকা কিংবা আনাই চিন মগিনিদের। ২০১১ সালেই পেয়ে যান সাফল্য। জাতীয় পর্যায়ে চ্যাম্পিয়ন হয় মগাছড়ি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়।

তবে এতটা সহজ ছিল না পথটা। নানাজনের কাছ থেকে মেয়েদের জন্য সাহায্য–সহযোগিতা নিতে হয়েছে। নিজের উপার্জিত অর্থের বেশির ভাগও ব্যয় হয় এই ফুটবল ক্যাম্পের পেছনে। বীর সেন বলে চলেন, ‘লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য ছিল শীর্ষে যাব। তাই চ্যাম্পিয়ন হয়েছি। এরপর এই দল থেকে আস্তে আস্তে অনূর্ধ্ব-১৪ হয়ে জাতীয় দলে জায়গা করে নেয় আমার মেয়েরা।’

ঋতুপর্ণা যখন ক্যাম্পে আসেন, তখন তিনি তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ে। ২০১২ সালের কথা। বেশি ছোট বলে তাঁকে বীর সেনের আত্মীয় অর্জুনমণির ঘরে থাকতে দেওয়া হয়। পরে আস্তে আস্তে ক্যাম্পে নিয়ে যাওয়া হয়। এভাবে চলে বীর সেনের সংগ্রাম। বীর সেন বললেন, ‘ঋতু খুব ছোট ছিল। কিন্তু খেলত দুর্দান্ত। রুপনা তো গাছে গাছে ঘুরত। তার বাবা–মা কোনোভাবে দেবে না। প্রথমবার ফিরে আসি। কিন্তু তার খেলা মনে গেঁথে ছিল। সে ছিল অলরাউন্ডার। সব পজিশনে খেলতে পারে। পরে একটা মাইক্রো নিয়ে গিয়ে বাবা–মাকে মানিয়ে রুপনাকে নিয়ে আসি।’

কথা হচ্ছিল চেলাছড়া এলাকার একটা ছোট চায়ের দোকানে বসে। এই দোকানের মালিক বাচিধন চাকমা। তিনি ২০১১ সালে মগাছড়ি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের দলকে নেতৃত্ব দেওয়া তৃষা চাকমার বাবা। অনুশীলনে চোটের কারণে তৃষা আর বেশি দূর এগোতে পারেননি। তবে তৃষার জন্য এই দুয়ার, ওই দুয়ারে চাকরির চেষ্টা করে যাচ্ছেন তাঁর ফুটবলগুরু বীর সেন। ২০১৫ সাল থেকে এই প্রক্রিয়া থেকে দূরে সরে গেলেও এখনো তৃষা, ঋতু, রুপনাদের সব খবর তিনি রাখছেন যত্নের সঙ্গে।

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: ব র স ন বল জ ত য় দল ফ টবল র বলল ন করল ম

এছাড়াও পড়ুন:

জাতীয় স্মৃতিসৌধে ‘জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধ’ স্লোগান, আটক ৩

স্বাধীনতা দিবসে সাভারে জাতীয় স্মৃতিসৌধে ‘জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধ’ স্লোগান দিয়ে ‘পরিস্থিতি অস্থিতিশীল করার চেষ্টার’ অভিযোগে তিনজনকে আটক করেছে আশুলিয়া থানা পুলিশ। আজ বুধবার সকাল ১১টার দিকে সাভার জাতীয় স্মৃতিসৌধ কমপ্লেক্সের ভেতর থেকে তাদের আটক করা হয়।

আটকরা হলেন- মুক্তিযোদ্ধা সংসদ সন্তান কমান্ড কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক ও মুক্তিযুদ্ধ প্রজন্ম লীগের মহাসচিব সিরাজগঞ্জ জেলার সেলিম রেজা (৪৭), মুক্তিযোদ্ধা সংসদ সন্তান কমান্ড কেন্দ্রীয় কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক শহিদুল ইসলাম (৫০) ও আশুলিয়ার দক্ষিণ গাজীরচট সোহেল পারভেজ (৪১)।

জানা গেছে, সকাল সাড়ে ১১টার দিকে জাতীয় স্মৃতিসৌধের শহীদ বেদিতে ফুলেল শ্রদ্ধা জানান কয়েকজন। এ সময় তারা হাতে লাল পতাকা নিয়ে বিভিন্ন স্লোগান দেন। পরে উপস্থিত জনতা তাদের ধাওয়া দিয়ে কয়েকজনকে মারধর করে। এ সময় পুলিশ ঘটনাস্থল থেকে আওয়ামী লীগ সন্দেহে ওই তিনজনকে আটক করে। 

ঢাকা জেলা অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (সাভার সার্কেল) শাহিনুর কবির বলেন, উস্কানিমূলক স্লোগান দিয়ে মহান স্বাধীনতা দিবসে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টির চেষ্টা করছিল কয়েকজন। এ সময় তিনজনকে আটক করে আশুলিয়া থানায় নিয়ে আসা হয়েছে। তারা সবাই আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত।

সম্পর্কিত নিবন্ধ