Prothomalo:
2025-04-18@12:04:40 GMT

শহীদ জোহার আত্মত্যাগের স্মরণে

Published: 18th, February 2025 GMT

ফাগুন আসে পলাশের আগুন হয়ে; কৃষ্ণচূড়ার লালে মিশে যায়, প্রেম আর দ্রোহের ছোঁয়া। কিন্তু এক ফাল্গুনে, ১৯৬৯ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে কৃষ্ণচূড়ার রং মলিন হয়ে গিয়েছিল এক মহান শিক্ষকের রক্তে; সেই সঙ্গে চক্র ক্রমিক হারে বসন্ত ছাপিয়ে দরজায় কড়া নেড়েছিল অবহেলা! ঠিক যেন কবি দর্পণ কবিরের স্বরচিত কবিতার মতো; মধ্য দুপুরের তির্যক রোদের মতো; অনেকটা নির্লজ্জভাবে আলিঙ্গন করে নিয়েছিল অনাকাঙ্ক্ষিত অবহেলা!  ড.

সৈয়দ মুহাম্মদ শামসুজ্জোহা—বাংলাদেশের অন্যতম শহীদ বুদ্ধিজীবী, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের এক সাহসী শিক্ষক; যিনি প্রমাণ করে গেছেন—শিক্ষকের কলম যেমন শক্তিশালী, তেমনি তাঁদের আত্মদানের দৃঢ়তাও এক অবিনশ্বর চেতনা।

উনসত্তরের সেই অগ্নিঝরা দিনগুলোতে বাঙালি আত্মত্যাগের মন্ত্রে নিজেদের উৎসর্গ করার দীক্ষা নিচ্ছিল। উত্তাল বিক্ষোভের মধ্যে ২০ জানুয়ারি পাকিস্তানি পুলিশের গুলিতে শহীদ হন আমানুল্লাহ মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান, শহীদ আসাদ নামে তিনি ইতিহাসে খ্যাত। এরই ধারাবাহিকতায় ফেব্রুয়ারির ১৫ তারিখে ঢাকা সেনানিবাসে হত্যা করা হয় সার্জেন্ট জহুরুল হককে।

ফলে দেশের মানুষের মধ্যে আন্দোলনের আগুন দাবানলের রূপ নেয়। প্রতিবাদস্বরূপ ১৮ ফেব্রুয়ারি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সহস্র ছাত্র–ছাত্রী ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে মিছিল নিয়ে ক্যাম্পাস থেকে শহরে যাওয়ার চেষ্টা করেন। কাজলা গেটে পাকিস্তান সেনাবাহিনী সে মিছিলে গুলি করার প্রস্তুতি নেয়।

‘ডোন্ট ফায়ার, আই সেইড—ডোন্ট ফায়ার; কোনো ছাত্রের গায়ে গুলি লাগার আগে যেন আমার বুকে গুলি লাগে’—নিজেকে প্রক্টর পরিচয় দিয়ে বলিষ্ঠ কণ্ঠে চিৎকার দিয়ে ওঠেন ড. জোহা। তর্কযুদ্ধের একপর্যায়ে সেনাসদস্যরা তাঁকে লক্ষ্য করে গুলি ছুড়েই ক্ষান্ত হয়নি, বেয়নেট দিয়ে নৃশংসভাবে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা করে।

‘ঝিনুক নীরবে সহো, ঝিনুক নীরবে সহে যাও/ ভিতরে বিষের বালি, মুখ বুজে মুক্তা ফলাও!’ প্রারম্ভ থেকেই এ দেশের শিক্ষকেরা অসহায় শিক্ষাব্যবস্থার কাছে, নানা বাহিনীর কাছে, ছাত্র নামের দুর্বৃত্তদের কাছে! শিক্ষক সম্পর্কে মানুষের মনে যে বিষয়টি গেঁথে গেছে, তারা খুব সাধারণ মানের জীবনযাপন করবে এবং সেই সাদামাটা জীবনের জন্য সমাজ তাদের ধন্য ধন্য করবে। অর্থাৎ বাংলা সিনেমায় দেখানো শিক্ষকদের সেলুলয়েড ও জেরক্স ভার্সন! অথচ শিক্ষকদের তাঁরা মানুষ গড়ার কারিগর হিসেবেও গণ্য করেন।
আজকের শিক্ষাব্যবস্থা চরম সংকটে। শিক্ষার পবিত্র অঙ্গনেও ব্যবসার ছায়া, উচ্চশিক্ষার নামে বিদেশে মেধা পাচারের কালো হাতছানি। শিক্ষকদের বেতন, পারিতোষিক, সামাজিক নিরাপত্তা, কর্মপরিবেশ—সবকিছুতেই ঘাটতি। আদর্শচর্চা ও নৈতিক শিক্ষার স্থান দখল করেছে গ্রেডভিত্তিক শিক্ষা। একসময় যাদের সামনে জাতি মাথা নত করত; আজ তাঁরা অবহেলিত। শিক্ষকের হাত থেকে কেড়ে নেওয়া হয়েছে ন্যায় ও নীতির স্বাধীনতা।

জীবন ঠুনকো, জীবন সংকটময়। তবে রক্ত যখন অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী হয়ে ওঠে, তখন তা ইতিহাস গড়ে। শহীদ জোহার আত্মত্যাগ তেমন ইতিহাসই তৈরি করেছে। শহীদ ড. শামসুজ্জোহার মৃত্যুর ৩৯ বছর পর ২০০৮ সালে এই রাষ্ট্র তাঁকে স্বাধীনতা পুরস্কারে ভূষিত করেছে এবং তাঁর নামে চার টাকা মূল্যের স্মারক ডাকটিকিট চালু করা হয়েছে। রাবি ক্যাম্পাসে একটি ছাত্র হলের নামকরণ করা হয় তাঁর নামে। বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল ফটক দিয়ে প্রবেশ করলে প্রশাসন ভবনের সামনে নজরে পড়বে শহীদ জোহার সমাধিক্ষেত্র।

কয়েক বছর ধরে জোহা দিবস পালনে যোগ দিয়েছে সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়। একুশে পদকও দেওয়া হয়নি ড. জোহাকে। এ জন্য রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় পরিবার আবেদন জানিয়ে আসছে দীর্ঘদিন ধরে। প্রতিবছর রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে সকালে সূর্যোদয়ের সঙ্গে কালো পতাকা উত্তোলন, ড. জোহার সমাধি ও স্মৃতিফলকে পুষ্পস্তবক অর্পণ করা হয়। পাশাপাশি জোহা স্মারক বক্তৃতা ও আলোচনাসভা, রচনা প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়। তবে ‘সংসারের জন্য যে নিজেকে প্রতিনিয়ত ক্ষয় করিলো, তাহাকে সকলে মাথায় করিয়া দায়মুক্তি পাইলো;  কিন্তু তাহাতে তাহার ক্ষয় পূরণ হইল কি?’
যে জাতি জোহার মতো বীরের স্বীকৃতি জানাতে কুণ্ঠাবোধ করে, সেই জাতির চেতনা কীভাবে বিকশিত হবে?

আজ যখন অন্যায় সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে প্রবাহিত, যখন সত্য বলতে ভয় পায় মানুষ, যখন ন্যায়বিচার অবরুদ্ধ—তখন আমাদের প্রয়োজন শামসুজ্জোহার মতো সাহসী শিক্ষকদের, যাঁরা জ্ঞানের আলোয় পথ দেখাবেন, যাঁরা আবারও বুক পেতে দেবেন সত্যের জন্য; কিন্তু একফালি ছেঁড়া চাঁদ আঁকড়ে পুরো পূর্ণিমা উপভোগের আকাঙ্ক্ষা করাটা বাড়াবাড়ি! হৃদয় স্পর্শ করলে দেখা যাবে, সেখানে একটা মাংসপিণ্ড ব্যতীত কোনো অনুভব নেই।

উনসত্তরের রক্তস্নাত কৃষ্ণচূড়া প্রকৃতি থেকে হৃদয়ে বিশালতা জাগ্রত করে। সেই ফাগুনের বাতাসের কিংশুকের দোলায় আমাদের প্রত্যাশা এক মহান শিক্ষকের যথাযথ মর্যাদা। ১৮ ফেব্রুয়ারিকে ‘জাতীয় শিক্ষক  দিবস' হিসেবে স্বীকৃতিদান এখন সময়ের দাবি।

তাই সময়ের উজান-স্রোতে গা ভাসানো এই প্রজন্মকে রক্ষা করতে হলে শিক্ষকের যথাযথ মর্যাদা ফিরিয়ে দিতে হবে, তাঁদের স্বাধীনভাবে কাজ করার সুযোগ দিতে হবে। সময়ের প্রভাবমুক্ত, মুক্তচিন্তার একটি শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে। শিক্ষকদের আবার শ্রদ্ধার আসনে বসাতে হবে, যেন তাঁরা জাতি গঠনে চেতনাস্রষ্টা হয়ে উঠতে পারেন।

শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করছি, শহীদ সৈয়দ ড.শামসুজ্জোহার প্রতি;সেই সব শিক্ষককের প্রতি, যাঁরা এখনো আলোর মশাল হাতে দাঁড়িয়ে আছেন অন্ধকারের বিরুদ্ধে, সত্যের পক্ষে, শিক্ষার মর্যাদা রক্ষার জন্য!
নীরবতা কখনো মুক্তির পথ হতে পারে না। পরিশেষে ‘আলো হাতে চলিতেছে আঁধারের যাত্রী’—আমরা যেন সেই যাত্রী হই; যারা সত্য, ন্যায় ও জ্ঞানের আলো বহন করে এগিয়ে যায়।

দীপা সাহা
শিক্ষার্থী, আইন ও ভূমি প্রশাসন বিভাগ
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: শ ক ষকদ র র জন য ব যবস

এছাড়াও পড়ুন:

ইয়েমেনে যুক্তরাষ্ট্রের ভয়াবহ বিমান হামলা, নিহত ৫৮

ইয়েমেনের রাস ইসা বন্দরে মার্কিন ভয়াবহ বিমান হামলা চালিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। এতে অন্তত ৫৮ জন নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন ১২৬ জন। সাম্প্রতিক সময়ে দেশটিতে যুক্তরাষ্ট্রের চালানো ভয়াবহ হামলাগুলোর মধ্যে এটি একটি। খবর আল জাজিরার।

মার্কিন সেনাবাহিনী জানিয়েছে, হুথি যোদ্ধাদের জ্বালানির উৎস বন্ধ করার জন্যই এই হামলা চালানো হচ্ছে।

ওয়াশিংটন জানিয়েছে, ইয়েমেনের হুথিদের অবস্থানগুলোতে তারা হামলা চালিয়ে যাবে যতক্ষণ না লোহিত সাগরে জাহাজ চলাচলের ওপর এই গোষ্ঠীর আক্রমণ বন্ধ হয়।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে করা এক পোস্টে মার্কিন সেন্ট্রাল কমান্ড জানিয়েছে, এই হামলার উদ্দেশ্য ছিল হুথিদের অর্থনৈতিক শক্তির উৎস কমানো।

অন্যদিকে গাজায় প্রাণঘাতী হামলা অব্যাহত রেখেছে ইসরায়েল। এতে বৃহস্পতিবার ৩২ ফিলিস্তিনি প্রাণ হারিয়েছেন। তবে শুক্রবার সকালে চালানো হামলায় অবরুদ্ধ উপত্যকাটির খান ইউনিসে এক পরিবারের ১৩ জন নিহত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে।

ত্রাণ সংস্থাগুলো জানিয়েছে, গাজা আমাদের প্রজন্মের সবচেয়ে খারাপ মানবিক ব্যর্থতাগুলোর মধ্যে একটি।

গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, ইসরায়েলি হামলায় এখন পর্যন্ত মোট ৫১ হাজার ৬৫ জনের মৃত্যু হয়েছে। আহত হয়েছেন এক লাখ ১৬ হাজার ৫০৫ জন।

যদিও গাজার সরকারি মিডিয়া অফিস জানিয়েছে, নিহতের সংখ্যা ৬১ হাজার ৭০০। কারণ ধ্বংসস্তূপের নিচে যারা চাপা পড়েছে তাদেরও নিহতের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।

সম্পর্কিত নিবন্ধ