সম্প্রতি আলুসহ সবজির দাম বেশি কমে যাওয়ায় ভোক্তা লাভবান হয়েছেন, কিন্তু কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। কারণ কৃষি সামগ্রীর দাম বেশি হওয়ায় উৎপাদন খরচ অনেক বেড়েছে। কৃষক হাড়ভাঙা পরিশ্রম করে জমিতে ফসল ফলান। সেই ফসল সারাদেশের মানুষের খাদ্য চাহিদা পূরণ করে। কোনো কোনো ফসল দেশের চাহিদা পূরণের পর বিদেশে রপ্তানি করে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করা হয়। তাই অর্থনৈতিক উন্নয়নে কৃষির অবদান অনস্বীকার্য। 

বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে যে কয়টি সেক্টর কাজ করছে তার মধ্যে কৃষি সেক্টর অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে চলেছে। আমাদের জাতীয় অর্থনীতির চালিকাশক্তি হচ্ছে কৃষি। খাদ্য সরবরাহ, আমিষের ঘাটতি পূরণ ও পুষ্টি চাহিদার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ দিক হচ্ছে কৃষক ও কৃষি সম্পদ। আমাদের কৃষকরা মাথার ঘাম পায়ে ফেলে কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে দেশের খাদ্য ঘাটতি পূরণে কাজ করে যাচ্ছেন। কিন্তু এ খাতে পর্যাপ্ত বাজেট না থাকার কারণে কৃষকরা ফসল উৎপাদনে প্রতিনিয়ত হিমশিম খাচ্ছেন। এমতাবস্থায় কৃষি খাতে সরকারের আরও উদার দৃষ্টিভঙ্গি ও সহযোগিতার হাত বাড়ানো জরুরি। 

দেশের অনেক যুবক এখন কৃষি ক্ষেত্রে নিজেদের কর্মসংস্থানের সুযোগ গ্রহণ করছেন। বাংলাদেশে সম্ভবত একমাত্র কৃষি ক্ষেত্রেই অপেক্ষাকৃত কম পুঁজিতে বড় উদ্যোক্তা হওয়ার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। ফলে শিক্ষিত যুবকদের মধ্যে অনেকেই চাকরির চিন্তা না করে কৃষি কাজের মাধ্যমে স্বনির্ভর হওয়ার চেষ্টায় নিমজ্জিত। 

বাংলাদেশের কৃষিভিত্তিক শিল্পের মধ্যে রয়েছে পোলট্রি ফার্ম, ডেইরি ফার্ম, খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ শিল্প, মৎস্য হিমায়িতকরণ ও প্রক্রিয়াকরণ শিল্প। কৃষিজ শিল্প খাতের মধ্যে খাদ্য ও কাঁচামাল সংরক্ষণের প্রক্রিয়াজাত শিল্প অন্যতম। আমরা জানি, প্রকৃতিগতভাবেই আমাদের খাদ্য প্রক্রিয়াজাত শিল্প বহুমুখী একটি ক্ষেত্র। দেশে প্রায় আটশত প্রক্রিয়াকরণ খাদ্য প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এ সংখ্যা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। সময়ের পরিবর্তন ও জাগতিক উন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে কৃষির উন্নয়নেও এক অভূতপূর্ব অগ্রগতি সাধিত হয়েছে। বর্তমানে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে কৃষির আনুপাতিক অবদান কমলেও জনসংখ্যা বৃদ্ধির দ্রুতগতির সঙ্গে সীমিত ও সংকুচিত হয়ে আসা জমি নিয়েও মোট কৃষি উৎপাদন বাড়ছে। কৃষিতে উন্নত প্রযুক্তি, বীজ, সার ও আধুনিক যন্ত্রের ব্যবহার উৎপাদন বৃদ্ধির পেছনে অন্যতম কারণ। এর অসাধারণ অবদান রয়েছে আমাদের দেশের গবেষক ও কৃষিবিজ্ঞানীদের। যাদের অক্লান্ত পরিশ্রম আর নিষ্ঠার সঙ্গে গবেষণার কারণে উচ্চফলনশীল ফসল অথচ অতি স্বল্পতম সময়ে ঘরে তোলা যায় এমন জাত ও পরিবেশ সহিষ্ণু নতুন জাতের ফসল উদ্ভাবন করেছেন।
ধান-পাটের পাশাপাশি খাদ্যশস্য, রবিশস্য, শাকসবজিসহ নানা রকমের ফল, সমুদ্র ও মিঠাপানির মাছ, গবাদি পশু, পোলট্রি, মাংস ও ডিম, উন্নত জাতের হাঁস-মুরগি, দুগ্ধ উৎপাদন আগের তুলনায় অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে। অনেক ক্ষেত্রে বিশ্ব উৎপাদন তালিকায় শীর্ষস্থান দখলের জন্য যুদ্ধ করছে বাংলাদেশের কৃষি সেক্টর। কাজেই ৭০ ভাগ মানুষ কৃষির ওপর নির্ভরতার প্রতীক কৃষিক্ষেত্র এখন সামগ্রিক অগ্রগতির অনবদ্য দৃষ্টান্ত। বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার ৭০ শতাংশ এবং শ্রমশক্তির প্রায় ৬০ শতাংশ সরাসরি কৃষিকাজে নিয়োজিত থেকে কৃষির উন্নয়নে অবদানে রেখে কাজ করে যাচ্ছেন।

বাংলাদেশে প্রতি বছর প্রাকৃতিক দুর্যোগে কৃষকদের বড় ধরনের ক্ষতি হচ্ছে। তার পরও কৃষকরা এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছেন। ২০২৪ সালের বন্যা ও প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ফসল ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। কৃষকরা ব্যাপক ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছেন। কোনো প্রকার প্রাকৃতিক দুর্যোগ না হলে আরও উন্নতমানের ধান চাষের মাধ্যমে বাংলাদেশ চাল রপ্তানিকারক দেশ হিসেবে বিশ্বে সুখ্যাতি পাবে বলে আমার ধারণা। সাম্প্রতিক সময়ে দেশের প্রায় ৫৮ শতাংশ চাল আসে বোরো ধান থেকে। বোরো ফসলের উৎপাদন বেড়েছে প্রায় পাঁচ গুণ। স্বাধীনতার ৫৪ বছরে প্রায় ২০ শতাংশ চাষের জমি কমলেও চাল উৎপাদন বেড়েছে মাত্র চার থেকে পাঁচ গুণ। আমাদের দেশের বহু কৃষিজ ফসল ও পণ্য বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ব্যাপকভাবে সমাদৃত।

অন্যদিকে ইরি চাষের সময় যে ফসল কৃষকরা ঘরে তোলে তাতে খাদ্য চাহিদা মেটানোর পর অতিরিক্ত ফসল বিক্রি করে কৃষকরা আর্থিকভাবে লাভবান হওয়ার সুযোগ পান। ধান কাটার পর বিচুলি বিক্রি করে আমাদের দেশের কৃষকরা প্রতি সিজনে বিঘাপ্রতি প্রায় ১০ হাজার টাকা আয় করে থাকেন। আমাদের দেশের নাগামরিচ, হবিগঞ্জের লেবু, কচুরলতি, উত্তরবঙ্গের শজিনার ডাঁটা উৎপাদন কৃষিক্ষেত্রে বিশেষ অবদান রাখছে। এসব কৃষিদ্রব্য বিদেশে ব্যাপক জনপ্রিয়। তাছাড়া খুলনা ও সাতক্ষীরা অঞ্চলে ঘেরের মাধ্যমে চিংড়ি মাছ ও কাঁকড়ার চাষ করে কৃষকরা বিদেশে রপ্তানি করে প্রচুর বৈদেশিক অর্থ উপার্জন করছেন। কিন্তু স্বল্প পুঁজির কৃষকরা কৃষি উৎপাদনের দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির কারণে পদে পদে বিপদের সম্মুখীন হচ্ছেন। অর্থের অভাবে খরা মৌসুমে সময় মতো জমিতে পানি সেচের ব্যবস্থা করতে না পারা এবং যথাসময়ে সার ও কীটনাশক দিতে না পারার কারণে উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে এবং কৃষির মাধমে অর্থনৈতিক উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। ফলে দেশের সামগ্রিক অর্থনীতিতে মারাত্মক নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। এ ছাড়া কৃষিসামগ্রীর দাম দিন দিন বৃদ্ধির কারণে কৃষকরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। 

এমতাবস্থায় সরকারকে কৃষি সরঞ্জামের মূল্য কমানো, শস্য উৎপাদনে কৃষকদের উৎসাহ প্রদান ও কৃষি খামার প্রতিষ্ঠা এবং পরিচালনার জন্য কৃষকদের বিনা সুদে কৃষিঋণের ব্যবস্থা করলে কৃষকরা যেমন উপকৃত হবেন, তেমনি কৃষির মাধ্যমে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে বৈপ্লবিক পরিবর্তন সাধনে কৃষকরা অসামান্য অবদান রাখতে সক্ষম হবেন।

ড.

বি এম শহীদুল ইসলাম : শিক্ষাবিদ ও গবেষক 

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: আম দ র দ শ র অবদ ন র ক ষকর

এছাড়াও পড়ুন:

প্রাথমিক স্তরে শেখার সক্ষমতা নিশ্চিত করতে হবে

ড. মনজুর আহমদ অন্তর্বর্তী সরকারের প্রাথমিক ও উপানুষ্ঠানিক শিক্ষার মানোন্নয়নে গঠিত কনসালটেশন কমিটির প্রধান। গণসাক্ষরতা অভিযানের (ক্যাম্প) উপদেষ্টা এবং বাংলাদেশ প্রান্তিক শিশু বিকাশ নেটওয়ার্কের সভাপতির দায়িত্ব পালন করছেন তিনি। দুই দশকেরও বেশি ইউনিসেফে কাজ করেছেন। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সমকালের জ্যেষ্ঠ সহসম্পাদক মাহফুজুর রহমান মানিক।

সমকাল: প্রাথমিক ও উপানুষ্ঠানিক শিক্ষার মানোন্নয়নে ‘কনসালটেশন কমিটি’ সরকারের বড় পদক্ষেপ, যেখানে আপনি নেতৃত্ব দিয়েছেন। আপনাদের সুপারিশের প্রধান বার্তা কী?

মনজুর আহমদ: গত বছরের অক্টোবরে প্রাথমিক ও উপানুষ্ঠানিক শিক্ষার মানোন্নয়নে প্রয়োজনীয় সুপারিশ দিতে শিক্ষাবিদ, বিশেষজ্ঞ এবং প্রাথমিক শিক্ষাসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সমন্বয়ে ৯ সদস্যের একটি ‘কনসালটেশন কমিটি’ গঠন করে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়। আমি সেখানে নেতৃত্ব দিয়েছি এবং আমরা সম্প্রতি প্রধান উপদেষ্টার কাছে এর প্রতিবেদন জমা দিয়েছি। সেখানে বিভিন্ন বিষয়ে শতাধিক সুপারিশ করা হয়েছে। আমাদের মূল কথা হলো, প্রাথমিক স্তরে ভাষা ও গণিতের ভিত্তিমূলক দক্ষতা, অর্থাৎ শেখার সক্ষমতা অর্জন করতে হবে প্রতিটি শিশুকে। এর সঙ্গে শিশুর নিরাপত্তা, শারীরিক ও মানসিক ব্যবস্থা এবং দায়িত্বশীল সামাজিক আচরণেও দৃষ্টি দিতে হবে। এই কাজগুলো হচ্ছে না, অর্ধেকের বেশি শিশু পঞ্চম শ্রেণি সমাপ্ত করেও পড়তে, লিখতে বা অঙ্কের চার নিয়ম ব্যবহার করতে পারে না। গত দুই দশকে পরপর বিভিন্ন প্রাথমিক শিক্ষা উন্নয়ন কার্যক্রম চালানোর পরও এ ক্ষেত্রে বিশেষ পরিবর্তন হয়নি। এই স্থবিরতা মাথায় রেখে বিভিন্ন করণীয় প্রস্তাব করা হয়েছে।

সমকাল: আপনারা কি কোনো দেশের প্রাথমিক শিক্ষাকে মানদণ্ড হিসেবে ধরেছেন? তা অর্জন করতে কত বছর লাগবে বলে মনে করেন? 

মনজুর আহমদ: আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত প্রাথমিক শিক্ষার মানদণ্ড হচ্ছে– সকল শিশুর জন্য মানসম্মত, সমতাভিত্তিক ও অন্তর্ভুক্তিমূলক শিক্ষার অধিকার নিশ্চিত করা। ২০৩০ সালের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যেও এই সুযোগ সর্বজনীন করার অঙ্গীকার করা হয়েছে। শ্রীলঙ্কা ছাড়া দক্ষিণ এশিয়ার সব দেশ এ ক্ষেত্রে পিছিয়ে আছে। মধ্যম আয়ের দেশের লক্ষ্যে পৌঁছাতে হলে বাংলাদেশকে এ বিষয়ে অগ্রাধিকার দিতে হবে। সময়াবদ্ধ পরিকল্পনা করে এগোতে হবে।

সমকাল: বাংলাদেশ প্রাথমিক শিক্ষার মূল প্রশাসনিক ক্ষেত্র যেমন পিটিআই (প্রাইমারি ট্রেনিং ইনস্টিটিউট), প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর ইত্যাদি জায়গায় শিক্ষায় ডিগ্রি থাকা বাধ্যতামূলক করা প্রয়োজন। আপনারা কি এ বিষয়ে কোনো সুপারিশ করেছেন?

মনজুর আহমদ: শিক্ষার মান উন্নয়ন ও সংস্কারের ভূমিকা সবার আগে। কিন্তু শিক্ষকের পেশা গ্রহণে যোগ্য ও মেধাবী তরুণরা আগ্রহী নন। প্রাথমিক শিক্ষক ট্রেনিং ইনস্টিটিউটে নিয়োগ পেতে শিক্ষা বিজ্ঞানে ডিগ্রি থাকা এখন আবশ্যক। শিক্ষক বা শিক্ষা কর্মকর্তা হিসেবে নিয়োগের জন্য এ রকম বাধ্যবাধকতা নেই। অর্থাৎ এসব পদের জন্য বিশেষায়িত জ্ঞান বা দক্ষতার প্রয়োজন নেই। শিক্ষার মান বৃদ্ধি ও শিক্ষকের পেশাগত মর্যাদা প্রতিষ্ঠার জন্য বিশেষ পেশাগত প্রস্তুতি আবশ্যকীয় করা প্রয়োজন। সংস্কার কমিটি এ সুপারিশ করেছে।

সমকাল: মেধাবী শিক্ষার্থীদের প্রাথমিক শিক্ষায় শিক্ষক হিসেবে নিয়ে আসার জন্য কোনো কার্যকর পরিকল্পনা আছে কি? নবম গ্রেড থেকে যোগ্যতার ভিত্তিতে বেতন কাঠামো নির্ধারণের বিষয়ে আপনার মত কী? 

মনজুর আহমদ: কমিটির মতে, প্রাথমিক, মাধ্যমিকসহ বিদ্যালয়ের স্বতন্ত্র পেশাগত মর্যাদা ঊর্ধ্বতন বেতন কাঠামো ও পেশাগত অগ্রগতির ব্যবস্থা করা দরকার। এই ধরনের কাঠামোগত পরিবর্তন সময়সাপেক্ষ। অন্তর্বর্তী পদক্ষেপ হিসেবে প্রাথমিক স্তরে বর্তমান ১৩তম গ্রেড থেকে ১২তম গ্রেডে শুরু এবং ১১তম গ্রেডে পদোন্নতি সুপারিশ করা হয়েছে। পেশাগত অগ্রগতির উদ্দেশ্যে শিক্ষক, সিনিয়র শিক্ষক ও প্রধান শিক্ষক– এই তিন ধাপ সৃষ্টির প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে।

সমকাল: আমাদের জনগোষ্ঠীর এখনও বড় একটা অংশ অক্ষরজ্ঞানহীন। তাদের সাক্ষরতার বিষয়টি কি আপনারা চিন্তা করেছেন?

মনজুর আহমদ: সাক্ষরতা শুধু অক্ষরজ্ঞান এবং নাম স্বাক্ষরে সীমাবদ্ধ রাখলে চলবে না। অতীতে এই ধরনের কর্মসূচিতে ভালো ফল পাওয়া যায়নি। জীবনব্যাপী শিক্ষার ধারণার আলোকে জীবিকা ও জীবনের প্রয়োজনে বিদ্যালয়বহির্ভূত কিশোর-তরুণদের শিক্ষা ও বিভিন্ন ধরনের প্রশিক্ষণের সুযোগ সৃষ্টির জন্য কমিউনিটি শিক্ষাকেন্দ্রের নেটওয়ার্ক তৈরির সুপারিশ করা হয়েছে। দক্ষ ও অভিজ্ঞ এনজিওগুলোর সঙ্গে অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যুরোকে এই কার্যক্রমের পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের উদ্যোগ নিতে হবে।

সমকাল:  শিক্ষা খাতে বাজেট বরাদ্দ ও ব্যয় ব্যবস্থাপনা নিয়ে কোনো সুপারিশ করা হয়েছে কি? এটি মূল বাজেটের কত শতাংশ হলে ভালো হয়?

মনজুর আহমদ: শিক্ষার মান বৃদ্ধি এবং এটিকে ফলপ্রসূ করতে হলে রাষ্ট্রের বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। পাঠের উপকরণ, বই ইত্যাদি ছাড়াও অবকাঠামো এবং শিক্ষকের সংখ্যা ও দক্ষতা বাড়াতে ব্যয় বাড়াতে হবে। প্রযুক্তির যথার্থ ব্যবহারের ব্যবস্থা বাড়াতে হবে। দরিদ্র পরিবারের জন্য শিক্ষার ব্যয় লাঘবের কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। জাতীয় আয় বা বাজেটের নির্দিষ্ট অনুপাতের কথা বলা হয়নি। তবে ক্রমাগত বিনিয়োগের পরিমাণ বাড়ানো এবং এর যথার্থ ব্যবহারের জন্য ব্যবস্থাপনাগত ও জবাবদিহির পদক্ষেপের কথা বলা হয়েছে।

সমকাল: শিশুদের মূল্যায়নের বিষয়টিকে আপনারা স্কুলের প্রধান শিক্ষক ও শিক্ষক দল এবং উপজেলা কর্মকর্তাদের সমন্বিত কাজ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন…।

মনজুর আহমদ: শিশুর শেখা বা দক্ষতা অর্জন সমগ্র শিক্ষা আয়োজনের সাফল্যের মাপকাঠি। এ জন্য প্রতিটি শিশুর শিক্ষার অগ্রগতির মূল্যায়ন এবং প্রতিটি বিদ্যালয় ও বিদ্যালয় ব্যবস্থার কার্যকারিতার মূল্যায়ন প্রয়োজন। শ্রেণিকক্ষে ও বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীর ধারাবাহিক এবং বর্ষ বা স্তর শেষে মূল্যায়ন থাকবে। একই সঙ্গে শিক্ষার্থীর দক্ষতা জরিপের মাধ্যমে বিদ্যালয়েও মূল্যায়ন হবে।  মূল্যায়নের ভিত্তিতে প্রতি বিদ্যালয়কে শিক্ষার্থীর অগ্রগতির নিরিখে ‘লাল’, ‘হলুদ’ ও ‘সবুজ’ হিসেবে চিহ্নিত করা হতে পারে। বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক, শিক্ষক দল ও উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তার সম্মিলিত দায়িত্ব হবে প্রতি বিদ্যালয়কে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে ‘সবুজে’ রূপান্তরিত করা।

সমকাল: আপনারা এনজিও সংযুক্তির সুপারিশ করেছেন। এনজিও সাধারণত নির্দিষ্ট লক্ষ্যে ও নির্দিষ্ট এলাকায় কাজ করে। প্রাথমিক শিক্ষায় বিভিন্ন ধারা যেমন– সরকারি, বেসরকারি, ইবতেদায়ি, মাদ্রাসা ও কমিউনিটি স্কুল রয়েছে। এটি কীভাবে সমন্বয় করা হবে? 

মনজুর আহমদ:  এ ক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের দায়িত্ব হবে প্রধান। বিভিন্ন অরাষ্ট্রীয় শিক্ষাসেবা আছে ও থাকবে। সব সেবাদানকারীকে নিয়ে সমন্বিত সামগ্রিক এলাকাভিত্তিক পরিকল্পনা করতে হবে। সে জন্য নীতি কাঠামো ও সহযোগিতার পদ্ধতি ও মডেল তৈরি করতে হবে। শিক্ষা শাসন ও ব্যবস্থাপনার প্রকৃত বিকেন্দ্রীকরণের জন্য ২০ উপজেলায় পাইলট প্রকল্পের সুপারিশ করা হয়েছে।

সমকাল:  শিক্ষকতা পেশাকে পেশাদারিত্বের আওতায় আনতে টিচিং লাইসেন্স বাধ্যতামূলক করার বিষয়ে আপনার মত কী? উন্নত বিশ্বে এটি দীর্ঘদিন ধরে একটি গুরুত্বপূর্ণ মানদণ্ড হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। 
মনজুর আহমদ: আগেই বলা হয়েছে, শিক্ষক ও শিক্ষক কর্মীদের শিক্ষাবিজ্ঞানে শিক্ষা, প্রশিক্ষণ ও নির্ধারিত যোগ্যতা অর্জন ক্রমে বাধ্যতামূলক হওয়া উচিত। এ জন্য যথার্থ কর্মপরিকল্পনা তৈরি ও বাস্তবায়নের উদ্যোগ নিতে হবে।

সমকাল: প্রাথমিক বিদ্যালয়ে অভিগম্যতা ও শিশুদের মধ্যকার বৈষম্য নিরসন বিষয়ে আপনার বক্তব্য কী?

মনজুর আহমদ: অর্থনৈতিক, সামাজিক, ভৌগোলিক, ভাষাগত কারণে এবং বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুদের ক্ষেত্রে শিক্ষায় অভিগম্যতা ও অংশগ্রহণে ব্যাপক বৈষম্য বিদ্যমান। বৈষম্যের প্রকৃতি ও পরিমাণ সব জায়গায় এক নয়। এ জন্য বিশেষ লক্ষ্য, কৌশল ও পরিকল্পনা এবং অতিরিক্ত বিনিয়োগে অগ্রাধিকার দিতে হবে। এ বিষয়ে কমিটি কিছু আশু এবং মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি সুপারিশ করেছে।

সমকাল: আপনাদের শিক্ষা পরামর্শক পরিষদ (এডুকেশন কনসালটেটিভ কাউন্সিল) গঠনের সুপারিশ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। স্থায়ী শিক্ষা কমিশন গঠনের বিষয়টি কি কম গুরুত্ব পেয়েছে?

মনজুর আহমদ: শিক্ষার মতো জটিল ও বহুমাত্রিক বিষয়ে একটি কমিটি সুপারিশ প্রদানেই সব সমস্যার সমাধান হবে বলে মনে করা সংগত নয়। যেসব সুপারিশ করা হলো, সেগুলো সম্পর্কে যথার্থ বিবেচনা, সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও বাস্তবায়নের পথে কীভাবে এগোনো হচ্ছে, তা শিক্ষাসমাজ ও সচেতন নাগরিকের নজরদারিতে থাকতে হবে। এ জন্য স্থায়ী উচ্চক্ষমতার শিক্ষা কমিশন প্রতিষ্ঠার কথা বলা হয়েছে। এটির আইনি কাঠামো, সাংগঠনিক স্বরূপ, কার্যধারা ইত্যাদি বিষয়ে সিদ্ধান্ত সময়সাপেক্ষ এবং এ জন্য রাজনৈতিক ঐকমত্যও প্রয়োজন। ইতোমধ্যে অন্তর্বর্তী পদক্ষেপ হিসেবে শিক্ষা খাতের জন্য একটি শিক্ষা পরামর্শ পরিষদের সুপারিশ করা হয়েছে। এই পরিষদ বিভিন্ন জটিল ও সংবেদনশীল বিষয় বিবেচনা এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণে সরকারের জন্য সহায়ক হতে পারে। তাৎক্ষণিকভাবে বিচ্ছিন্নভাবে ও চাপের মুখে সিদ্ধান্ত গ্রহণ পরিহারের জন্য এ পদক্ষেপ প্রয়োজন। 

সমকাল: আপনাদের সুপারিশমালার বাস্তবায়ন সম্পর্কে আপনি কতখানি আশাবাদী?

মনজুর আহমদ: প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস জাতির উদ্দেশে তাঁর প্রথম ভাষণে (২৫ আগস্ট) বলেছিলেন, শিক্ষায় যে নৈরাজ্য সৃষ্টি হয়েছে, তা দূর করা হবে তাঁর সরকারের অন্যতম অগ্রাধিকার। কমিটির সুবিবেচিত প্রস্তাব বাস্তবায়নযোগ্য বলে আমি মনে করি। এ সম্পর্কে অনেক আশু ও মধ্যমেয়াদি পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারে বর্তমানে প্রস্তুতাধীন পঞ্চম প্রাথমিক শিক্ষা উন্নয়ন কার্যক্রমের (পিইডিপি ৫) আওতায় এবং সরকারের শিক্ষা বাজেট প্রস্তাবে। আগামী ২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেটে এর নিদর্শন দেখব বলে আমি আশা করি।
সমকাল: সময় দেওয়ার জন্য ধন্যবাদ।

মনজুর আহমদ: আপনাকেও ধন্যবাদ। 

সমকালের জন্য শুভকামনা।

সম্পর্কিত নিবন্ধ