ঘুরে দাঁড়ানো অর্থনীতি পিছিয়েও পড়তে পারে
Published: 18th, February 2025 GMT
অর্থ মন্ত্রণালয় ‘বাংলাদেশের অর্থনীতি: সাম্প্রতিক চ্যালেঞ্জ ও ভবিষ্যৎ করণীয়’ নিয়ে একটি প্রতিবেদন তৈরি করেছে। প্রতিবেদনটি নিয়ে উপদেষ্টা পরিষদ একটি সভা করেছে ৯ ফেব্রুয়ারি। সভা শেষে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম সাংবাদিকদের বলেছেন, ‘বাংলাদেশের অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়িয়েছে, খুব ভালোভাবেই ঘুরে দাঁড়িয়েছে।’
সবচেয়ে ভালো দিক হচ্ছে অর্থ মন্ত্রণালয়ের তৈরি করা এই রিপোর্ট গোপন করা হয়নি। এখানে অর্থনীতির ঝুঁকিগুলোর কথা ভালোভাবেই বলা হয়েছে। তারপরও কিছু কথা থেকে যায়। কেননা, অর্থনীতির ঘুরে দাঁড়ানোর পরিসংখ্যান আর বাস্তবতার মধ্যে কিছু ফারাক আছে।
কেন মূল্যস্ফীতি কমছে নাসাধারণ মানুষের দৈনন্দিন জীবনযাপনের দৃষ্টিকোণ থেকে এ মুহূর্তে অর্থনীতির সবচেয়ে বড় সংকটের নাম মূল্যস্ফীতি। এটাও ঠিক, উচ্চ মূল্যস্ফীতি বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার উত্তরাধিকারসূত্রে পেয়েছে।
বিগত আওয়ামী লীগ সরকার মুখে মুখে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকারের কথা বলত বটে, কিন্তু কাজে দেখা যায়নি। তাদের পদক্ষেপগুলো ছিল ভুলে ভরা, উদ্দেশ্যমূলক ও খামখেয়ালিপূর্ণ। তাতে মূল্যস্ফীতি কমেনি। মানুষেরও কোনো আস্থা ছিল না। সেদিক থেকে কৃতিত্ব পাবেন বর্তমান গভর্নর আহসান এইচ মনসুর। তিনি অন্তত মৌলিক অর্থনীতির রীতিনীতি অনুসরণ করে নীতি সুদহার একটানা বাড়িয়ে গেছেন। যতক্ষণ মূল্যস্ফীতি মাথা না নোয়ায়, ততক্ষণ পর্যন্ত এ কাজ করে বিশ্বের অন্যান্য দেশ সফল হয়েছে।
প্রশ্ন হচ্ছে, বাংলাদেশে প্রভাবটা এখনো তত জোরালো নয় কেন? একটা উত্তর অর্থ মন্ত্রণালয়ের প্রতিবেদনেই আছে। যেমন ‘মূলত সরবরাহ চেইনের দুর্বলতার কারণে খাদ্য মূল্যস্ফীতি উচ্চ পর্যায়ে রয়েছে।’ এই সরবরাহব্যবস্থা ঠিক করতে কত দিন লাগবে, সেটাই এখন বড় বিষয়।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের প্রতিবেদনেই বলা আছে, আগামী জুন নাগাদ মূল্যস্ফীতি ৮ শতাংশে নামতে পারে। সুতরাং আপাতত স্বস্তির খবর নেই।
আরও পড়ুনঅর্থনীতিতে মনোযোগের সংকট সরকারের২২ অক্টোবর ২০২৪অর্থনীতির যত ঝুঁকিঅর্থ মন্ত্রণালয়ের প্রতিবেদন অনুযায়ী, আগে ঝুঁকি বা সংকটের কথা তুলে ধরি। যেমন দুই দফা বন্যার কারণে আউশ ও আমন উৎপাদন কম হয়েছে যথাক্রমে ৯ লাখ ৫৫ হাজার টন ও ৩ লাখ ৫৮ হাজার টন। সরকারের কাছে খাদ্যশস্য মজুতও আছে ধারণক্ষমতার তুলনায় ২৩ দশমিক ৬ শতাংশ বা ৮ লাখ টন কম।
আরেকটা সমস্যা হচ্ছে সরকার বিদ্যুৎ ও সারে ভর্তুকি কমাতে পারছে না। কারণ, উচ্চ মূল্যস্ফীতি। পরিকল্পনা হচ্ছে মূল্যস্ফীতি সাড়ে ৬ শতাংশে নেমে এলে সরকার বিদ্যুৎ ও সারের দাম বাড়াবে। আবার কর-জিডিপি অনুপাত আরও কমছে। রাজস্ব আদায়ের ঘাটতি এর প্রধান কারণ। আর্থিক খাত ঝুঁকির মধ্যে আছে, প্রকৃত খেলাপি ঋণ এখনো বাড়ছে এবং আগের সরকারের আর্থিক অব্যবস্থার কারণে ১০টি ব্যাংক তীব্র ঝুঁকির মুখে রয়েছে। চলতি (২০২৪-২৫) অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে বৈদেশিক বিনিয়োগ কমেছে ৭১ দশমিক ৩৭ শতাংশ।
শিল্প খাতের চ্যালেঞ্জ প্রসঙ্গে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বেক্সিমকো গ্রুপের প্রায় ৪০ হাজার কর্মচারীর সহিংস আন্দোলনে রাস্তা অবরোধসহ আশপাশের অন্যান্য শিল্পকারখানায় ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করায় সেগুলো ঝুঁকির মুখে রয়েছে। যেসব কারখানামালিক পলাতক, তাঁদের মালিকানাধীন কারখানাগুলোয় নিয়মিত বেতন-ভাতা দিতে না পারায় শ্রমিক অসন্তোষের সৃষ্টি হচ্ছে এবং স্বার্থান্বেষী মহলের প্ররোচনায় শিল্পাঞ্চলে শ্রমিক অসন্তোষ ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছাত্র আন্দোলনের মতো ঘটনায় আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ও জনদুর্ভোগ সৃষ্টি হচ্ছে।
তাহলে কী করণীয়? প্রতিবেদন অনুযায়ী, অন্তর্বর্তী সরকারের জন্য আর্থিক খাতের দুর্বলতা এবং শ্রমিক অসন্তোষ স্বল্প মেয়াদে অন্যতম ঝুঁকির উৎস। আর মূল্যস্ফীতির পাশাপাশি আর্থিক খাতের শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা এবং ঘনীভূত হওয়ার আগেই শ্রমিক অসন্তোষ প্রশমিত করা অন্তর্বর্তী সরকারের সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার।
সুতরাং দেখা যাচ্ছে, অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়ানোর কথা বলা হলেও অনেকগুলো ঝুঁকি এখনো রয়ে গেছে। এসব ঝুঁকি কমাতে না পারলে ঘুরে দাঁড়ানো অর্থনীতি সামনে আর এগোতে পারবে না।
ভালোর পেছনেও প্রশ্ন আছেসুখবর আছে রপ্তানি ও প্রবাসী আয়ে। এই দুইয়ের কল্যাণে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের পতনও ঠেকানো গেছে। কৃতিত্ব প্রবাসীদের, তাঁরা ব্যাংকিং চ্যানেলে আয় পাঠাচ্ছেন। তাঁদের অবদান স্বীকার করতেই হয়। তারপরও নিশ্চয়ই মনে আছে, ২০২০-২১ অর্থবছরে দেশে প্রবাসী আয়ে প্রবৃদ্ধি ছিল ৩৬ শতাংশের বেশি। একই অর্থবছরে প্রায় ২১ হাজার কোটি কালোটাকা সাদা হয়েছিল। এক বছরে এত কালোটাকা সাদা হওয়াও ছিল এখন পর্যন্ত দেশের রেকর্ড। সেই সময় ছিল কোভিড মহামারির বছর। বিদেশ ভ্রমণ বন্ধ। টাকা পাচার করার উপায়ও ছিল না। ফলে হুন্ডির কোনো চাহিদা ছিল না। সুতরাং কালোটাকা দেশের মধ্যেই সাদা হয়েছে, হুন্ডির চাহিদা না থাকায় প্রবাসী আয়ও এসেছে বৈধ পথে।
দেশে এখনো হুন্ডির চাহিদা তুলনামূলক কম। আওয়ামী লীগ সরকারের প্রভাবশালীরা আগেই অর্থ পাচার করে রেখেছেন। আর যাঁদের অর্থ দেশে ছিল, তাঁদের বড় অংশ পালিয়ে গেলেও সব অর্থ নিয়ে যাওয়ার সময় ও সুযোগ পাননি। ওই সুযোগ তৈরি করতে না দেওয়াটাই সরকারের বড় কাজ। একই সঙ্গে ভবিষ্যতেও হুন্ডির চাহিদা কমিয়ে রাখতে হবে।
এ জন্য এখন থেকেই দুর্নীতির বিরুদ্ধে জোরালো ব্যবস্থা নিতে হবে। নিয়ন্ত্রণ করতে হবে কালোটাকা উপার্জনের পথ। বন্ধ করতে হবে কর ফাঁকি, ঘুষ, চোরাচালানি, অস্ত্র ও মাদক ব্যবসার উৎস। এটা সম্ভব না হলে আবারও বেড়ে যাবে অর্থ পাচার, কমবে প্রবাসী আয়। সুশাসন প্রতিষ্ঠা করতে পারলেই কেবল তা সম্ভব।
প্রতিবেদনে যা নেইঅর্থ মন্ত্রণালয়ের প্রতিবেদনে অভ্যন্তরীণ বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থানের কথাটির সরাসরি কোনো উল্লেখ নেই। আছে কেবল বিদেশি বিনিয়োগের কথা। আমরা সবাই জানি, অভ্যন্তরীণ বিনিয়োগ না বাড়লে কখনোই বিদেশি বিনিয়োগ বাড়ে না। সংকট এখানেই। দেশীয় বিনিয়োগসংশ্লিষ্ট প্রতিটি সূচকই নিম্নগামী। যেমন বেসরকারি খাতে ব্যাংকঋণ, মূলধনি যন্ত্রপাতি, শিল্প উৎপাদন সূচক ইত্যাদি।
প্রতিবেদনটিতে কেবল শিল্প খাতের চ্যালেঞ্জের কথা আছে, তবে তা শ্রমিক অসন্তোষ নিয়ে। শ্রমিক অসন্তোষ অবশ্যই বিনিয়োগের বড় অন্তরায়। পাশাপাশি ব্যাংকঋণের সুদহারও বাড়ছে। যদিও বাংলাদেশে কখনোই সুদহারের ওপর বিনিয়োগ নির্ভরশীল ছিল না। বরং একশ্রেণির ব্যবসায়ী সস্তায় অর্থ পেয়ে ব্যাংকঋণের নয়–ছয় করেছেন। সরকারই তাঁদের জন্য সুদহারে ‘নয়-ছয়’-এর ব্যবস্থা করে দিয়েছিল। এরই পরিণতি উচ্চ খেলাপি ঋণ।
এমনিতেই বিনিয়োগের অনেকগুলো বাধা আছে। বাংলাদেশে বিনিয়োগ পরিবেশ কখনোই উন্নত ছিল না। বরং ক্রমে খারাপ হয়েছে। এমনকি বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের সময়ে উন্নতি হয়নি, বরং অনেক ক্ষেত্রেই খারাপ হয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বড় সমস্যার নাম অনিশ্চয়তা ও আইনশৃঙ্খলার অবনতি। এর সুরাহা না হলে বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান বাড়বে না, সমাজে অস্থিরতাও কমবে না।
বড় সমস্যা যেখানেবললে ভুল হবে না যে আইনশৃঙ্খলার গুরুতর অবনতি ঘটেছে। চুরি, ডাকাতি, ছিনতাইয়ের কারণে ব্যক্তি নিরাপত্তা যেমন বিপন্ন, তেমনি উসকানি দিয়ে স্থাপনা বা সম্পত্তিতে দলবদ্ধ হামলা বন্ধে সরকারের উদ্যোগের অভাব আস্থার সংকট তৈরি করছে। আস্থাহীন থাকলে বিনিয়োগকারীরা এগিয়ে আসবে না, সরবরাহ চেইন ঠিক হবে না, শিল্প খাতে অসন্তোষ কমবে না, অর্থনীতিও ঘুরে দাঁড়াতে পারবে না। বরং পিছিয়ে পড়বে।
এটা ঠিক যে সরকার ছয়টি কমিশন গঠন করে সংস্কারের উদ্যোগ নিয়েছে। গঠন করা হয়েছে বিষয়ভিত্তিক একাধিক টাস্কফোর্স ও কমিটি। অনেকগুলোর রিপোর্ট জমাও পড়েছে। বাস্তবায়ন হলে অদূর ভবিষ্যতে এর সুফলও পাওয়া যাবে। সবগুলোই সঠিক কাজ। তবে এসব সংস্কারের প্রতি সমর্থন পেতে অবশ্যই বিদ্যমান অর্থনৈতিক ও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি করতে হবে।
মার্কিন অর্থনীতিবিদ ডেভিড লিপটন একসময় আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) উপব্যবস্থাপনা পরিচালক ছিলেন। পরে মার্কিন অর্থ মন্ত্রণালয়েও কাজ করেছেন। ২০১৯ সালে তিনি আইএমএফের হয়ে এক গবেষণামূলক লেখায় শেষটা করেছিলেন এভাবে, ‘সুশাসন প্রতিষ্ঠা করা, অর্থাৎ শাসনব্যবস্থা পরিচালনার উন্নতি খুব সহজ কাজ নয়। এ জন্য দীর্ঘ সময় ধরে টেকসই প্রচেষ্টা চালিয়ে যেতে হয়। তবে এ জন্য কেবল সঠিক কাজ করাটাই পর্যাপ্ত নয়। বরং এ থেকে সাধারণ মানুষ কী উপকার পাচ্ছে, তা দৃশ্যমান হতে হয়।’
অন্তর্বর্তী সরকারের চ্যালেঞ্জ এটাই, উপকার দৃশ্যমান করা।
● শওকত হোসেন প্রথম আলোর হেড অব অনলাইন
[email protected]
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: সরক র র ব যবস থ আর থ ক
এছাড়াও পড়ুন:
পুলিশের জনসম্পৃক্ত কর্মকাণ্ডে ভাটা
গত বছর ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর ভেঙে পড়েছিল পুলিশি ব্যবস্থা। নাজুক আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি সামাল দিতে সরকারকে পড়তে হয় নানা প্রতিবন্ধকতার মুখে। এখনও পুরো স্বাভাবিক হয়ে উঠতে পারেনি পুলিশ। আইন প্রয়োগ করতে গিয়ে বাধার মুখে পড়তে হচ্ছে বাহিনীটিকে। এমন পরিস্থিতিতেও বন্ধ আছে কমিউনিটি পুলিশিং কার্যক্রম। ওপেন হাউস ডে ও উঠান বৈঠকের মতো কার্যক্রম সেভাবে দৃশ্যমান নয়। ফলে পুলিশের সঙ্গে জনগণের দূরত্ব বেড়েছে। জনগণ-পুলিশ ইতিবাচক সম্পৃক্ততার কর্মকাণ্ডে ভাটা দেখা দিয়েছে।
আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে জনগণের সঙ্গে পুলিশের মাঠ পর্যায়ের সদস্যদের সম্পর্ক আরও সহযোগিতামূলক ও বন্ধুত্বপূর্ণ করার প্রয়োজনীয়তার ওপর গুরুত্ব দিচ্ছেন বিশিষ্টজন। তারা বিস্তৃত পরিসরে জনসম্পৃক্ত কর্মসূচি চালু করার কথা বলছেন। জনতার সঙ্গে পুলিশের ভঙ্গুর সম্পর্ক পুনঃস্থাপনে এসব কার্যক্রম ভালো ফল আনতে পারে বলে মনে করছেন তারা। পুলিশ সংস্কার কমিশনের সুপারিশেও জনমুখী ও জবাবদিহিমূলক পুলিশ বাহিনী গড়ে তুলতে কমিউনিটি পুলিশিংয়ের ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। এটিকে প্রাতিষ্ঠানিকীকরণে আইনি কাঠামোর কথাও বলা হয়েছে।
সাবেক পুলিশ মহাপরিদর্শক মোহাম্মদ নুরুল হুদা বলেন, বর্তমান পরিস্থিতির কারণেই হয়তো কমিউনিটি পুলিশিং কমিটিগুলো স্তিমিত হয়ে আছে। এগুলো পুনরুজ্জীবিত করতে হবে। এখন রাজনৈতিক নেতারা আগের মতো তৎপর নেই; ওয়ার্ড পর্যায়ে সরকারের প্রতিনিধি নেই। তাই সামাজিক নেতাদের সঙ্গে কথা বলতে হবে। সমাজে যাদের মতামতের গুরুত্ব আছে, তাদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতে হবে। এটি শুধু এখনকার জন্য নয়, সব সময়ের জন্যই দরকার। আস্থা ফিরিয়ে আনার জন্য এবং আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে কাজ করার জন্য এটি জরুরি।
সমাজ ও অপরাধ বিশেষজ্ঞ এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক ড. তৌহিদুল হক বলেন, বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের সঙ্গে পুলিশের সংযোগ স্থাপনের মধ্য দিয়ে আস্থার সম্পর্ক গড়ে তুলতে কমিউনিটি পুলিশিং, বিট পুলিশিং ও ওপেন হাউস ডে চালু করা হয়। পুলিশ এখন নৈতিক ও মনোবল সংকটের মধ্যে আছে, আইন প্রয়োগ করতে গিয়ে বিভিন্ন বাধা ও প্রশ্নের মুখে পড়ছে, শারীরিক ও মানসিক আক্রমণের শিকার হচ্ছে। এ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে পুলিশের কমিউনিটিভিত্তিক কার্যক্রম যত বাড়ানো যাবে, মানুষের সঙ্গে সংযোগ বা সম্পর্কের জায়গাটা তত বেশি আস্থা-বিশ্বাসের হবে। এলাকাভিত্তিক অপরাধীরা কোণঠাসা থাকবে। পুলিশ সম্পর্কে মানুষের যে ভুল ধারণা, তা দূর হবে।
পুলিশ সদরদপ্তরের গণমাধ্যম ও জনসংযোগ বিভাগের সহকারী মহাপরিদর্শক ইনামুল হক সাগর সমকালকে বলেন, কমিউনিটি পুলিশিং ফোরামের আগের যে কমিটিগুলো ছিল, সেগুলো এখন নেই। তবে জনগণকে সঙ্গে নিয়ে পুলিশের বিভিন্ন কার্যক্রম চলমান। পুলিশ সদস্যরা ওপেন হাউস ডে, উঠান বৈঠক, গাড়িচালক ও হেলপারদের নিয়ে বিভিন্ন সচেতনতামূলক কার্যক্রম অব্যাহত রেখেছেন। ভবিষ্যতে জনগণকে সঙ্গে নিয়ে আরও সংগঠিতভাবে পুলিশিংয়ের প্রচেষ্টা অব্যাহত থাকবে।
সম্প্রতি রাজধানীর বিভিন্ন শপিংমলসহ আবাসিক এলাকার নিরাপত্তায় পুলিশ ও অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বাইরে বেসরকারি কর্মীদের ‘অক্সিলারি ফোর্স’ হিসেবে নিয়োগের কথা জানায় ডিএমপি। তবে এই সিদ্ধান্ত খুব বেশি সাড়া ফেলেনি। আবার কিছুদিন ধরে সিটিজেন ফোরামের মাধ্যমে স্থানীয় বাসিন্দাদের সঙ্গে সম্পর্কের ভিত তৈরির চেষ্টা করছে পুলিশ।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পুলিশের সমাজভিত্তিক কার্যক্রম বাড়ানো প্রয়োজন। স্থানীয় গণ্যমান্য ব্যক্তিদের সঙ্গে পুলিশের সম্পর্ক ভালো হলে কোনো বেআইনি কর্মকাণ্ডে জনগণই বাধা হয়ে দাঁড়াবে।
জনমুখী ও জবাবদিহিমূলক পুলিশ বাহিনী গড়ে তুলতে পুলিশ সংস্কার কমিশনের প্রস্তাবেও বেশ কিছু বিষয় গুরুত্ব পেয়েছে। এতে কমিউনিটি পুলিশিংয়ের ধরন ও বিস্তৃতি কেমন হতে পারে, সে ব্যাপারে আছে কিছু পরামর্শ। বলা হয়েছে, জনবান্ধব পুলিশিং নিশ্চিত করতে কমিউনিটি পুলিশিংয়ের পরিসর বাড়ানো প্রয়োজন। একে কার্যকর করে ‘চেক অ্যান্ড ব্যালান্স’ ব্যবস্থা করে জবাবদিহি বাড়ানোর কৌশল হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা জরুরি। পুলিশ ও জনগণের মধ্যে সম্পর্কে যে ক্ষত সৃষ্টি হয়েছে, তা সারিয়ে তুলতে কমিউনিটি পুলিশিং টেকসই ব্যবস্থা হিসেবে কাজ করতে পারে। সমাজের সৎ ও সবার কাছে গ্রহণযোগ্য ব্যক্তিদের এ ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার দিতে হবে।
বিগত সরকারের দমনপীড়নের হাতিয়ার হয়ে ওঠায় তাদের প্রতি ক্ষোভ রয়েছে মানুষের। এ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে কমিউনিটিভিত্তিক বা জনসম্পৃক্ত কর্মসূচি ভূমিকা রাখতে পারে বলে মনে করেন বিশিষ্টজন। বর্তমানে সীমিত মাত্রায় ওপেন হাউস ডে ও উঠান বৈঠকের মতো কর্মসূচি চলমান থাকার কথা বলা হলেও সেগুলোর কার্যকারিতা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। ঢাকা মহানগরেই এসব কর্মকাণ্ড তেমন দৃশ্যমান নয়। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কমিউনিটি পুলিশিংয়ের মতো কর্মসূচি আবার চালু করলে পুলিশের সঙ্গে সাধারণ মানুষের সেতুবন্ধন দৃঢ় হবে। এলাকাভিত্তিক অপরাধীদের বিষয়ে তথ্য পাওয়া সহজ হবে। আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে আরও স্বচ্ছন্দ হতে পারবে পুলিশ। তবে এটি করতে গিয়ে অতীতের মতো ঢালাওভাবে কারও ওপর দায়িত্ব ছেড়ে দিলে তৃতীয় পক্ষ সুযোগ নেবে। কাউকে অভিযুক্ত করার ভয় দেখিয়ে সুবিধা আদায় বা কোনো কিছু করতে বাধ্য করার ঘটনা অতীতে ঘটেছে। এ কারণে এই ব্যবস্থাকে যথাযথ নজরদারির আওতায় রাখতে হবে।
সংশ্লিষ্টরা জানান, ক্ষমতার পালাবদলের পর আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি সামাল দিতেই পুলিশের হিমশিম অবস্থা। তাই কমিউনিটি পুলিশিং কমিটি পুনর্গঠন বা সক্রিয় করার দিকে মনোযোগ দেওয়া যায়নি। আগের কমিটিগুলো এখন কার্যকর নেই। নতুন করে কমিটি গঠনের বিষয়ে কোনো নির্দেশনা আসেনি। শোনা যাচ্ছে, আগের মতো না হয়ে কিছুটা নতুন আঙ্গিকে কমিটি হতে পারে। এখন সারাদেশে নাগরিক কমিটি গঠন করা হয়েছে। তাদের সঙ্গে পুলিশের নিয়মিত যোগাযোগ রয়েছে। আগামী পুলিশ সপ্তাহে নাগরিকদের নিয়ে একটি আয়োজন রাখার পরিকল্পনা করা হচ্ছে।
জনসম্পৃক্ত পুলিশ গড়তে ১৯৯৩ সালে ময়মনসিংহে এবং পরের বছর ঢাকার দুটি থানায় কমিউনিটি পুলিশিং চালু হয়। ২০০৫ সালে জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচির (ইউএনডিপি) সহায়তায় পুলিশ সংস্কার কর্মসূচির আওতায় সারাদেশে এই কার্যক্রম ছড়িয়ে দেওয়া হয়। এই কার্যক্রমকে আরও গতিশীল করতে বিভিন্ন এলাকাকে ‘বিট’ হিসেবে ভাগ করে চালু হয় বিট পুলিশিং। প্রতিটি বিটের দায়িত্বপ্রাপ্ত পুলিশ কর্মকর্তা সংশ্লিষ্ট এলাকার আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে স্থানীয়দের সঙ্গে সুসম্পর্ক রাখতেন। জনসচেতনতা বাড়াতে উঠান বৈঠকের মতো কর্মসূচি নিতেন। তাদের তদারক করতেন থানার জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তারা।
কমিউনিটি পুলিশিং কমিটির বড় কর্মপরিধি ছিল ঢাকা মহানগরে। ৫০টি থানার পুলিশকে সহায়তা করতেন কমিউনিটি পুলিশিং সদস্যরা। এখন তাদের কার্যক্রম নেই। তবে ঢাকাসহ সারাদেশেই নাগরিক কমিটি গঠন করা হয়েছে। ঢাকা মহানগর পুলিশের গণমাধ্যম ও জনসংযোগ বিভাগের উপকমিশনার মুহাম্মদ তালেবুর রহমান সমকালকে বলেন, ঢাকায় আমরা সিটিজেন ফোরাম বা নাগরিক কমিটি গঠন করেছি। তারা আমাদের নানা পরামর্শ ও তথ্য দিয়ে সহায়তা করেন। সংশ্লিষ্ট থানার কর্মকর্তারা কমিটিগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ রাখছেন। এ ছাড়া সহায়ক পুলিশরাও অপরাধ দমনে ভূমিকা রাখবেন।
পুলিশ সংস্কার কমিশনের প্রস্তাবে বলা হয়, কমিউনিটি পুলিশিংকে আগে কেবল অপরাধ দমনের কৌশল হিসেবে সীমাবদ্ধ রাখা হতো। তবে সুনির্দিষ্টভাবে ছাত্রদের সমন্বয়ে এ ব্যবস্থা চালু করা যেতে পারে। যুক্তরাজ্য, ভারতসহ অনেক দেশে ছাত্রদের মাধ্যমে কমিউনিটি পুলিশিং পদ্ধতি চালু আছে। এ ছাড়া দেশে বিভিন্ন অফিস ও বাড়িতে বেসরকারি নিরাপত্তারক্ষী আছেন। তাদের পদ্ধতিগত কাঠামোর মাধ্যমে জনসম্পৃক্ত কাজে যুক্ত করলে নিরাপত্তা সুসংহত হবে। দেশে গ্রাম আদালত ও চৌকিদারি ব্যবস্থা বিদ্যমান। স্থানীয় ব্যবস্থাকে যথাযথভাবে কাজে লাগিয়ে অপরাধ দমন ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব। কমিউনিটি পুলিশ ব্যবস্থার জন্য বাজেট বরাদ্দেরও পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।
সংশ্লিষ্ট একাধিক কর্মকর্তা বলেছেন, বর্তমানে পুলিশের প্রায় সব গুরুত্বপূর্ণ পদে আছেন নতুন মুখ। অনেক এলাকায় অপরাধের তথ্য পুলিশ সময়মতো পায় না। কমিউনিটি পুলিশ ব্যবস্থা কার্যকর হলে দ্রুত নাগরিকদের কাছ থেকে অপরাধের তথ্য পাওয়া যাবে। আবার অনেক জায়গায় অপরাধীকে ধরতে গিয়ে ‘মব ভায়োলেন্সের’ মুখোমুখি হচ্ছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। স্থানীয় গণমান্য ব্যক্তিদের সঙ্গে পুলিশের সম্পৃক্ততা আরও জোরদার হলে বেআইনি কর্মকাণ্ডে জনগণই বাধা হয়ে দাঁড়াবে। কমিউনিটি পুলিশিংয়ের কমিটিতে যাতে মাদক কারবারিসহ বিতর্কিত লোকজন যুক্ত না হতে পারে, সেটি নিশ্চিত করতে হবে। তা না হলো সমাজে ভুল বার্তা যাবে।
সরেজমিন যা দেখা গেল
রাজধানীর কয়েকটি থানা ঘুরে কমিউনিটি পুলিশিং, ওপেন হাউস ডে ও উঠান বৈঠক নামে কোনো কার্যক্রম চলমান থাকার তথ্য মেলেনি। কিছু ক্ষেত্রে নতুন করে গঠিত হয়েছে সিটিজেন ফোরাম বা নাগরিক কমিটি। এর মাধ্যমে জনসম্পৃক্ততা বাড়ানোর চেষ্টা করছে পুলিশ। তাদের নিয়ে মতবিনিময় সভা হচ্ছে। সেই সঙ্গে থানা এলাকার বিভিন্ন বিটে আলাদাভাবে বৈঠকের আয়োজন করা হচ্ছে। এর বাইরে মসজিদে গিয়ে, বিভিন্ন সামাজিক-সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে গিয়ে পুলিশ কর্মকর্তারা জনগণের সঙ্গে কথা বলছেন, সহযোগিতা চাচ্ছেন।
সম্প্রতি হাতিরঝিল থানায় গিয়ে দেখা যায়, ডিউটি অফিসারের কক্ষের সামনে কয়েকজন নারী দাঁড়িয়ে কথা বলছেন। তারা বিরোধ-সংক্রান্ত একটি সমস্যা সমাধানে পুলিশের সহায়তা চাইতে এসেছেন। তারা জানান, পুলিশের সেবায় পরিবর্তন এসেছে। কেউ থানায় এলে পুলিশ তাঁর বক্তব্য মনোযোগ দিয়ে শুনছে; দ্রুত সাড়া দেওয়ার চেষ্টা করছে।
হাতিরঝিল থানার ওসি মোহাম্মদ রাজু বলেন, মানুষের মনে আস্থা ফিরিয়ে আনতে নানারকম উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এলাকার নানা শ্রেণি-পেশার মানুষকে নিয়ে সিটিজেন ফোরাম গঠন করা হয়েছে। তাদের নিয়ে দুই মাস আগে একটি মতবিনিময় সভার আয়োজন করা হয়। এতে উপস্থিত প্রায় ৫০০ জনের মধ্যে ফুটপাতের ব্যবসায়ী, রিকশাচালকসহ সমাজের বিভিন্ন পর্যায়ের মানুষ ছিলেন। তাদের অভিযোগ, তাদের চাওয়া, তাদের সমস্যা আমরা গুরুত্বসহকারে শুনেছি এবং সে অনুযায়ী সেবা দেওয়ার চেষ্টা করছি।