আইএমএফের ঋণের চতুর্থ কিস্তি পেতে দেরি হবে
Published: 18th, February 2025 GMT
আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) সঙ্গে বাংলাদেশের ৪৭০ কোটি মার্কিন ডলারের ঋণ কর্মসূচি শুরু হওয়ার পর এবার কিস্তি পেতে দেরি হচ্ছে। আগের তিন কিস্তি ইতিমধ্যে পেয়েছে বাংলাদেশ। চতুর্থ কিস্তির অর্থ পাওয়ার কথা ছিল গত ডিসেম্বরে। এখন পর্যন্ত সেই অর্থ পাওয়া যায়নি।
অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ গতকাল সোমবার ঢাকার ওসমানী মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত জেলা প্রশাসক (ডিসি) সম্মেলনের দ্বিতীয় দিনে অর্থ মন্ত্রণালয়-সংক্রান্ত অধিবেশন শেষে আইএমএফের ঋণের কিস্তি নিয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন। তিনি বলেন, ‘আমরা বলেছি যে আমাদের কিছু কাজ আছে। তাই আমরা অত তাড়া করছি না। আপনারা ভাবছেন ভিক্ষা করে টাকাপয়সা নিয়ে আসি। আসলে অনেক শর্ত মেনে এবং আমাদের নিজস্ব তাগিদে অর্থ আনতে হয়।’
আইএমএফের চতুর্থ কিস্তি প্রসঙ্গে অর্থ উপদেষ্টা বলেন, ‘কিছু শর্ত আছে তা (আইএমএফ) বললেই আমরা পূরণ করব না। এখন আমাদের সামষ্টিক অর্থনীতি ভালো। চলতি হিসাব, আর্থিক হিসাব ও প্রবাসী আয় ইতিবাচক। তাই আমরা মরিয়া হয়ে উঠছি না।’
পরের কিস্তির প্রস্তাব আগামী মাসে কি ওয়াশিংটনে আইএমএফের নির্বাহী পর্ষদে উঠছে, এমন প্রশ্নের জবাবে অর্থ উপদেষ্টা বলেন,
‘মার্চে নয়। বলেছি যে একটু অপেক্ষা করব। আগামী জুনে দুই কিস্তির (চতুর্থ ও পঞ্চম) প্রস্তাব একসঙ্গে উঠুক।’ মার্চ থেকে পিছিয়ে জুনে চলে যাওয়ার বিষয়টি আইএমএফের পাশাপাশি সরকারও চেয়েছে বলে জানান সালেহউদ্দিন আহমেদ।
তিনি বলেন, ‘তারা পরামর্শ দিয়েছে। আমরাও বলেছি কিছু বিষয় আছে, যা আমরা দ্রুত করতে পারব না।’
৪ ফেব্রুয়ারি প্রথম আলোকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুরও বলেছিলেন, ‘আইএমএফ যদি এখন কিছু না-ও দেয়, তাতেও কিছু যায় আসে না। কারণ, চলতি হিসাব, আর্থিক হিসাব এবং প্রবাসী আয়ের প্রবাহ এখন ভালো।’
যা বলা হচ্ছে, তার সঙ্গে বাস্তবতার মিল নেই। মনে হচ্ছে কোথাও একটা গিট্টু লেগে গেছে। এ কারণে অর্থ উপদেষ্টা হয়তো পরিষ্কার করে কিছু বলছেন না বা পাশ কাটিয়ে যাচ্ছেন। জাহিদ হোসেন, সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ, ঢাকা কার্যালয়, বিশ্বব্যাংকচতুর্থ কিস্তিতে পাওয়ার কথা ৬৪ কোটি ৫০ লাখ ডলার। আইএমএফের সঙ্গে ঋণ কর্মসূচি শুরু হয় ২০২৩ সালের ৩০ জানুয়ারি। ২০২৩ সালের ২ ফেব্রুয়ারি প্রথম কিস্তির ৪৭ কোটি ৬৩ লাখ ডলার পায় বাংলাদেশ। একই বছরের ডিসেম্বরে পাওয়া গেছে দ্বিতীয় কিস্তির ৬৮ কোটি ১০ লাখ ডলার। ২০২৪ সালের জুনে পাওয়া গেছে তৃতীয় কিস্তির ১১৫ কোটি ডলার। অর্থাৎ তিন কিস্তিতে আইএমএফ থেকে ২৩১ কোটি ডলার পেয়েছে বাংলাদেশ। বাকি আছে ঋণের ২৩৯ কোটি ডলার।
প্রতিবার কিস্তি পাওয়ার আগে আইএমএফের নির্বাহী পর্ষদের অনুমোদন লাগে। এর আগে ঋণের শর্ত পূরণের অগ্রগতি পর্যালোচনার জন্য ঢাকায় আসে আইএমএফের দল। চতুর্থ কিস্তির অর্থ ছাড়ের লক্ষ্যে আইএমএফের দল ঢাকায় আসে গত ডিসেম্বরে। তবে কিস্তি ছাড়ের বিষয়টি এবার পিছিয়ে গেছে।
কেন এমন পরিস্থিতি হলো—জানতে চাইলে মোটাদাগে আইএমএফের কাঠামোগত মানদণ্ডের শর্ত পূরণ করতে না পারার কথা জানিয়েছেন অর্থ বিভাগের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। তাঁরা বলেন, আগের অনেক শর্ত পূরণ হয়নি। নতুন করে পূরণ না হওয়া শর্ত বেড়েছে। এবার কিস্তির শর্তগুলোর বেশির ভাগ জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)–সংক্রান্ত। এর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে রাজস্ব প্রশাসন ও রাজস্ব নীতি আলাদা করা, যা নিয়ে সরকারের পক্ষ থেকে বিশ্বাসযোগ্য অগ্রগতি নেই। ব্যক্তিগত আয়কর থেকে রাজস্ব আদায় বৃদ্ধি, করপোরেট কর যৌক্তিক করা, মূল্য সংযোজন করের হার ঠিক করা এবং করছাড় কমিয়ে আনার লক্ষ্যমাত্রাও রয়েছে।
এ ছাড়া রয়েছে আর্থিক খাতের জন্য গুরুত্বপূর্ণ আইন প্রণয়ন ও পুরোনো আইনের সংশোধন, সরকারি ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ১০ শতাংশের নিচে নামিয়ে আনা, বিনিময় হার নির্ধারণের কাজটি ধীরে ধীরে বাজারের ওপর ছেড়ে দেওয়া।
অর্থ উপদেষ্টার দেওয়া বক্তব্যের বিষয়ে জানতে চাইলে বিশ্বব্যাংক ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, যা বলা হচ্ছে, তার সঙ্গে বাস্তবতার মিল নেই। মনে হচ্ছে কোথাও একটা গিট্টু লেগে গেছে। এ কারণে অর্থ উপদেষ্টা হয়তো পরিষ্কার করে কিছু বলছেন না বা পাশ কাটিয়ে যাচ্ছেন।
জাহিদ হোসেন বলেন, ‘ঋণ কর্মসূচিটি কি আমরা চলমান রাখতে চাচ্ছি না? যদি চাই, তাহলে শর্তগুলো পূরণ করতে হবে। করা যে যাবে না, তা নয়। কেন করা হচ্ছে না, আমারও প্রশ্ন। তবে কিস্তি না পাওয়ার নেতিবাচক প্রভাব রয়েছে।’ তিনি বলেন, আইএমএফের কিস্তি আটকে গেলে বিশ্বব্যাংকের বাজেট সহায়তাও আটকে যেতে পারে, এটাও বিবেচনায় রাখা জরুরি।
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: আইএমএফ র
এছাড়াও পড়ুন:
কিস্তি ছাড়ের সমঝোতা এখনো হয়নি, তবে আলোচনা চলবে: আইএমএফ
আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) সঙ্গে এ দফার পর্যালোচনা বৈঠক শেষে সমঝোতা হয়নি বাংলাদেশের। ফলে চলমান ৪৭০ কোটি মার্কিন ডলারের ঋণ কর্মসূচি থেকে চতুর্থ ও পঞ্চম কিস্তির অর্থ পাওয়ার বিষয়ে চূড়ান্ত মতামত জানায়নি সফররত আইএমএফ প্রতিনিধিদল। আইএমএফ বলেছে, এ বিষয়ে আলোচনা আরও চলবে এবং সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে দুই কিস্তির অর্থ পাওয়া যেতে পারে আগামী জুনের শেষ দিকে।
দুই সপ্তাহের পর্যালোচনার পর আজ বৃহস্পতিবার আইএমএফ আনুষ্ঠানিক ব্রিফিংয়ে এ কথা বলেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকে অনুষ্ঠিত এ ব্রিফিংয়ে আইএমএফের গবেষণা বিভাগের উন্নয়ন সামষ্টিক অর্থনীতি শাখার প্রধান (তিনি মিশনপ্রধান) ক্রিস পাপাজর্জিওসহ অন্য ৯ সদস্য উপস্থিত ছিলেন।
মিশনপ্রধান ক্রিস পাপাজর্জিও বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের রাজধানী ওয়াশিংটনে অনুষ্ঠেয় আইএমএফ-বিশ্বব্যাংকের বসন্তকালীন বৈঠকে এ বিষয়ে আরও আলোচনা হবে। এ বৈঠক হবে ২১ থেকে ২৬ এপ্রিল।
পাপাজর্জিও মনে করেন, বাংলাদেশের রিজার্ভের পাশাপাশি বিনিময় হারও স্থিতিশীল। রিজার্ভের পরিমাণ এমনকি তাদের প্রত্যাশার চেয়ে বেশি। বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হার আরও নমনীয় হলে অর্থনীতির স্থিতিশীলতা বাড়বে।
করব্যবস্থার সংস্কারের বিষয়ে গুরুত্ব দিয়ে আইএমএফ বলেছে, করনীতি ও প্রশাসনের মধ্যে পরিষ্কার পার্থক্য থাকা উচিত। এ ছাড়া করছাড় কমাতে হবে, করনীতিকে সহজ করতে হবে এবং রাজস্ব বৃদ্ধির টেকসই পথ খুঁজে বের করতে হবে।
ব্যাংক খাতের স্বাস্থ্য ফিরিয়ে আনতে আইনগত সংস্কার ও কার্যকর সম্পদ মান যাচাই এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের স্বাধীনতা ও সুশাসন জোরদারের প্রতিও গুরুত্বারোপ করে আইএমএফ। সংস্থাটি বলেছে, অর্থ পাচার ও সন্ত্রাসে অর্থায়ন মোকাবিলায় বাংলাদেশ সরকারের ভূমিকার জোরালো অগ্রগতি দরকার।
মিশনটি ৬ এপ্রিল থেকে গতকাল বুধবার পর্যন্ত বাংলাদেশ ব্যাংক ও অর্থ বিভাগের পাশাপাশি জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর), আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ, বিদ্যুৎ বিভাগ, বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড, বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি), জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগ ইত্যাদি দপ্তরের সঙ্গে বৈঠক করেছে। ৬ ও ১৬ এপ্রিল এ মিশন বৈঠক করেছে অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদের সঙ্গেও।
এর আগেও কিস্তি ছাড়ের বিষয়ে আইএমএফ মিশন এসেছিল। মিশন শেষে উভয় পক্ষের মধ্যে একটি ‘স্টাফ লেবেল’ চুক্তি হয়েছিল। এটি আসলে কিস্তি ছাড়ের বিষয়ে প্রাথমিক ইতিবাচক মনোভাবের প্রকাশ। এবার এ ধরনের স্টাফ লেবেল চুক্তি হয়নি বলে জানা গেছে।
আইএমএফের সঙ্গে ঋণ কর্মসূচি শুরু হয় ২০২৩ সালের ৩০ জানুয়ারি। ২০২৩ সালের ২ ফেব্রুয়ারি প্রথম কিস্তির ৪৭ কোটি ৬৩ লাখ ডলার পায় বাংলাদেশ। একই বছরের ডিসেম্বরে পাওয়া গেছে দ্বিতীয় কিস্তির ৬৮ কোটি ১০ লাখ ডলার।
২০২৪ সালের জুনে পাওয়া গেছে তৃতীয় কিস্তির ১১৫ কোটি ডলার। অর্থাৎ তিন কিস্তিতে আইএমএফ থেকে ২৩১ কোটি ডলার পেয়েছে বাংলাদেশ। বাকি আছে ঋণের ২৩৯ কোটি ডলার। বিপত্তি দেখা দেয় চতুর্থ কিস্তির অর্থছাড়ের বেলায়। অন্তর্বর্তী সরকারের আশা চতুর্থ ও পঞ্চম কিস্তির অর্থ একসঙ্গে পাওয়া যাবে আগামী জুনে।