মণিপুরি ভাষা শেখাতে বৃন্দা রানীর যত উদ্যোগ
Published: 18th, February 2025 GMT
মাতৃভাষা আছে, সেই ভাষার বর্ণলিপি আছে। ঘরোয়া আলাপে, উৎসব-পার্বণে, নিজেদের মধ্যে বৈঠক-আড্ডায়, পথে-মাঠে পরস্পরের মধ্যে এই মাতৃভাষাতে কথাবার্তাও হয়। কিন্তু মাতৃভাষাতে পড়তে ও লিখতে গেলেই যত বিপত্তি। চোখের সামনে মাতৃভাষার লিপিগুলো নিছক কিছু রেখা ছাড়া আর কিছু মনে হয় না। অনেকেই তা পড়তে ও লিখতে পারেন না। চর্চার সুযোগ না থাকায় মণিপুরিদের মাতৃভাষা নিয়ে এই বিপত্তি তৈরি হয়েছে।
এই বিপত্তি কাটিয়ে উঠতে মণিপুরি ভাষার চর্চা ও সম্প্রসারণের উদ্যোগ নিয়েছেন শিক্ষক ও কবি বৃন্দা রানী সিনহা। নিজ বাড়ির একটি ঘরের বারান্দাতেই খুলেছেন মণিপুরি ভাষা বা মীতৈলোন চর্চার প্রতিষ্ঠান মণিপুরি ভাষা প্রশিক্ষণকেন্দ্র বা মীতৈ ময়েক তম্বিবগী স্কুল। মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জ উপজেলার আদমপুর ইউনিয়নের হকতিয়ারখোলায় তাঁর বাড়ি। সপ্তাহের প্রতি শুক্রবার সকালে এই কেন্দ্রে শিশুদের এবং মাসে এক-দুই শুক্রবার বিকেলে গৃহিণীদের মণিপুরি ভাষার বর্ণ, শব্দ ও বাক্যগঠন শেখানো হচ্ছে। এখানে পাঠ নিয়ে এখন অনেকেই মাতৃভাষায় পড়তে ও লিখতে পারেন।
স্থানীয় ব্যক্তিরা বলেন, হকতিয়ারখোলায় বৃন্দা রানী সিনহার বাড়িতে অনেক শিশু মাতৃভাষায় পড়তে আসে। ঘরের একটি বারান্দার মধ্যে প্লাস্টিকের পাটিতে বসে শিশুশিক্ষার্থীরা পাঠ নিয়ে থাকে। বৃন্দা রানী সিনহা একদম পাঠশালার মতো করে ব্ল্যাকবোর্ডে হাতে-কলমে মণিপুরি অক্ষর, শব্দ, বাক্যগঠন ও উচ্চারণ শেখান। একসঙ্গে ২৫-৩০ জন শিশু প্রতি শুক্রবার সকালে এই কেন্দ্রে পড়তে আসে। এ ছাড়া মাসে এক থেকে দুই শুক্রবার বিকেলে গৃহিণীদের সুযোগমতো একই কেন্দ্রে মণিপুরি ভাষা শেখানো হয়। সুন্দর একটি পাঠশালার পরিবেশ তৈরি হয়েছে বাড়িটিতে। গত শুক্রবার এ রকমই স্কুলের মতো ঘরের বারান্দাতে শিশু ও গৃহিণীদের পাঠ নিতে দেখা গেছে।
কবি-সংগঠক সনাতন হামোম প্রথম আলোকে বলেন, মণিপুরিদের মাতৃভাষা হচ্ছে মণিপুরি ভাষা বা মীতৈলোন। মণিপুরি ভাষা ভারতের মণিপুরের রাজ্যভাষা। এই মণিপুর রাজ্যের মণিপুরিরা ৩৫০ থেকে ৪০০ বছর আগে কমলগঞ্জ এলাকায় এসে বসবাস শুরু করেন। জনসংখ্যা ২৪ থেকে ২৫ হাজার। এ দেশের মণিপুরিরা নিজঘরে মাতৃভাষা, অর্থাৎ মণিপুরি বা মীতৈলোন ভাষাতেই কথা বলেন। ঘরের বাইরে কথা বলেন বাংলায়। যাঁরা চাকরি বা অন্য কোনো পেশায় বাইরে থাকেন, তাঁরা মাতৃভাষার চেয়ে বাংলা ভাষায় সহজে কথা বলতে পারেন। তাঁদের কেউ কেউ গ্রামের বাড়িতে এলে পরিবারের অন্য সদস্যদের সঙ্গেও বাংলাতেই কথা বলেন। ফলে নিজ মাতৃভাষা মণিপুরি বৃহৎ ভাষার মূলধারায় বিলুপ্তির পথে। সচেতন মণিপুরিরা মাতৃভাষাকে রক্ষার জন্য নানা উদ্যোগ নিয়েছেন। সেমিনারসহ অন্যান্য অনুষ্ঠানের মাধ্যমে ভাষা নিয়ে গণজাগরণ তৈরির চেষ্টা করেন।
সনাতন হামোম বলেন, ‘এসব উদ্যোগে সরকারি সহযোগিতা না থাকায় অল্প দিনেই তা মুখথুবড়ে পড়ে। প্রাথমিক শিক্ষা পর্যায়ে পাঁচটি জাতিগোষ্ঠীর ভাষা নিয়ে লেখাপড়ার সুযোগ–সুবিধা দেওয়া হলেও মণিপুরিরা এখনো বঞ্চিত। অথচ মণিপুরি ভাষার সাহিত্য-সংস্কৃতি খুবই উন্নত। মণিপুরি ভাষার নিজস্ব বর্ণমালা রয়েছে।’
স্থানীয় মণিপুরিরা বলেন, মণিপুরি ভাষার এই দুর্দিন কাটিয়ে উঠতে ব্যক্তিগত উদ্যোগে মণিপুরি ভাষা প্রশিক্ষণকেন্দ্র গড়ে তুলেছেন প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক বৃন্দা রানী সিনহা। ২০২৩ সালের জুলাইয়ে তিনি চাকরি থেকে অবসরে গেছেন। বাড়ির একটি ঘরের বারান্দাকেই বানিয়ে নিয়েছেন পাঠশালা। ওই বারান্দাতে ৩০-৩২ জন একসঙ্গে বসতে পারে। ২০১৯ সালে শুরু হয় তাঁর এই কেন্দ্র।
এমন উদ্যোগের ব্যাপারে বৃন্দা রানী সিনহা বলেন, ‘ভাষাটা বিলুপ্তির পথে। মণিপুরি ভাষা শেখার কোনো সুযোগ নেই। চিন্তা করলাম, ভাষার জন্য কিছু করতে পারি কি না। অন্তত ভাষাটা বেঁচে থাকুক, সম্প্রসারিত হোক। ভাষার লিপি আছে। কিন্তু কেউ পড়তে–লিখতে পারে না। ছোট বাচ্চা দিয়ে শুরু করলাম। এদের অনেকে এখন মেডিকেলে, ভার্সিটিতে পড়ছে। পরে গৃহিণীদের নিয়ে শুরু করি।’
বৃন্দা রানী সিনহা বলেন, তিনি কেন্দ্রটি শুরুর আগে গ্রামের অভিভাবকদের নিয়ে সভা করেন। পরিবারের সদস্যদের অনুমতি নেন। সবাই তাঁকে অনুপ্রাণিত করেন, সহযোগিতা করেন। প্রতি সপ্তাহে শুক্রবার সকাল ১০টা থেকে বেলা সাড়ে ১১টা পর্যন্ত পাঠ নেন শিশুদের। করোনার সময়টিতেও পাঠদান বন্ধ হয়নি। তখন প্রশিক্ষণার্থীদের সংখ্যা অর্ধেক করে, দূরত্ব বাড়িয়ে পাঠ দেওয়া হয়েছে। ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে শুরু করেন গৃহিণীদের পাঠদান। মাসে এক-দুই শুক্রবারে বিকেলে মণিপুরি ভাষা শেখেন গৃহিণীরা। গৃহিণীরা দিনের কাজ শেষ করে কেন্দ্রে পাঠ নিতে আসেন। গৃহিণীদের ব্যস্ততার কারণে মাঝেমধ্যে কিছুটা অনিয়মিত হয়ে যায় তাঁদের পাঠ গ্রহণ।
২০১৯ সালে যখন শুরু করেন কেন্দ্র, তখন বৃন্দা রানী সিনহার কাছে মণিপুরি ভাষার একটিমাত্র বই ছিল। এই সময় কবি এ কে শেরাম ১৫টি বই দেন। বৃন্দার স্বামী সুখময় সিংহ ব্ল্যাকবোর্ড, ডাস্টার কিনে দেন। অনেকের অনুদানে কেনা হয় একটি সাউন্ড বক্স। পরবর্তী সময়ে এথনিক কমিউনিটি ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশনের (একডো) কর্মকর্তা লক্ষ্মীকান্ত সিংহ এগিয়ে আসেন। শুরু থেকে তিনি বইসহ বিভিন্ন শিক্ষা উপকরণ দিয়ে সহযোগিতা করেন। বৃন্দা নিজে থেকেও শিক্ষার্থীদের জন্য খাতা-কলম মজুত রাখেন। প্রতিবছর ২৫ ডিসেম্বর নেওয়া হয় মূল্যায়ন পরীক্ষা। এ সময় ভালো ফলের জন্য দেওয়া হয় পুরস্কার। এই কেন্দ্রে এলাকার কেওয়ালিঘাট, কাটাবিল ও হকতিয়ারখোলা গ্রামের শতাধিক মেইতেই (মণিপুরি) ও পাঙাল (মুসলিম মণিপুরি) শিক্ষার্থী এরই মধ্যে মণিপুরি ভাষা পড়তে, লিখতে শিখেছে। শুরুর দিকে নিয়মিত টিফিন দিতেন, এখন কিছুটা অনিয়মিত হয়ে গেছে।
হকতিয়ারখোলার গৃহিণী বিমলা সিনহা বলেন, ‘আমরা এখন মায়ের ভাষাটা শিখতে পাররাম। আগে জানতাম না, পড়তাম পারতাম না। এখন মণিপুরি ভাষার বই পড়তাম পারছি। আমরার ছেলেমেয়ে শিখছে। এতে ভাষা টিকতে পারব।’
বৃন্দার এক ছেলে ও এক মেয়ে চিকিৎসক, এক ছেলে ব্যাংকার। তাঁর নিজের দুটি কবিতার বই প্রকাশিত হয়েছে। একটি মণিপুরি ভাষায় ঐগী খোঙচাৎ (আমার পদচারণা) এবং অপরটি অবিশ্রান্ত পৃথিবী। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘কেন্দ্রে যারা আসে; তারা পড়তে, লিখতে পারে। যত দিন শারীরিকভাবে সক্ষম আছি, তত দিন ভাষা প্রশিক্ষণকেন্দ্র চালিয়ে যাব।’
পাঙাল রিসার্চ অ্যান্ড পাবলিকেশন অর্গানাইজেশনের সভাপতি, শিক্ষক-কবি সাজ্জাদুল হক বলেন, ‘ভাষা প্রশিক্ষণকেন্দ্রের মাধ্যমে মেইতেই ও পাঙাল শিক্ষার্থীরা তাদের নিজ মাতৃভাষা ও বর্ণমালা চর্চার সুযোগ পাচ্ছে। রাষ্ট্রীয়ভাবে প্রাতিষ্ঠানিক ভাষাচর্চার সুযোগ না থাকায় ভাষা প্রশিক্ষণকেন্দ্রের কোনো বিকল্প নেই।’
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: এই ক ন দ র ঘর র ব র জন য র একট
এছাড়াও পড়ুন:
পল্লী দারিদ্র্য বিমোচন ফাউন্ডেশনে বড় নিয়োগ, আবেদন করেছেন কি, পদ ৩৩৫
স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় বিভাগের অধিভুক্ত পল্লী দারিদ্র্য বিমোচন ফাউন্ডেশন (পিডিবিএফ) জনবল নিয়োগে আবারও বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করেছে। এই ফাউন্ডেশনে ১১তম গ্রেডে ৩৩৫ জনকে নিয়োগ দেওয়া হবে। এর আগে ২৪ মার্চ ২ ক্যাটাগরির পদে ১ হাজার ৩৩০ জনকে নিয়োগের জন্য বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে প্রতিষ্ঠানটি। আগ্রহী প্রার্থীদের অনলাইনে আবেদন করতে হবে।
পদের নাম: সহকারী হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা
পদসংখ্যা: ৩৩৫
আরও পড়ুনপুলিশে ২০০০ কনস্টেবল নিয়োগ: লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষার প্রস্তুতিতে যা করণীয় ২ ঘণ্টা আগেআবেদনের যোগ্যতা: স্বীকৃত কলেজ/বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কমপক্ষে দ্বিতীয় শ্রেণি/সমমানের সিজিপিএসহ বাণিজ্যে স্নাতক/সমমান ডিগ্রি থাকতে হবে। শিক্ষাজীবনে কোনো ক্ষেত্রে তৃতীয় বিভাগ/শ্রেণি/সমমানের সিজিপিএ গ্রহণযোগ্য হবে না। হিসাব ব্যবস্থাপনায় পারদর্শী হতে হবে।
আবেদনের বয়স: ৩১ মার্চ ২০২৫ তারিখে ১৮ থেকে ৩২ বছর।
বেতন স্কেল: ১২,৫০০-৩০,২৩০ টাকা (গ্রেড-১১)
আরও পড়ুনপানি উন্নয়ন বোর্ডে আবেদনের সময় বৃদ্ধি, পদ ২৭৭১১ এপ্রিল ২০২৫আবেদন যেভাবেআগ্রহী প্রার্থীদের এই ওয়েবসাইটে ফরম পূরণের মাধ্যমে আবেদন করতে হবে। নিয়োগসংক্রান্ত বিস্তারিত তথ্য এই লিংকে জানা যাবে। অনলাইনে আবেদন করতে কোনো সমস্যা হলে টেলিটক নম্বর থেকে ১২১ বা অন্য অপারেটর থেকে ০১৫০০১২১১২১-৯ পর্যন্ত কল অথবা [email protected] ঠিকানায় ই-মেইলে যোগাযোগ করা যাবে। এ ছাড়া টেলিটকের জব পোর্টালের ফেসবুক পেজে মেসেজের মাধ্যমে যোগাযোগ করা যাবে। মেইল/মেসেজের সাবজেক্টে প্রতিষ্ঠান ও পদের নাম এবং ইউজার আইডি ও যোগাযোগের নম্বর অবশ্যই উল্লেখ করতে হবে।
আরও পড়ুনবিটিসিএলে নবম–দশম গ্রেডে নিয়োগ, ১৩১ পদের পুনরায় বিজ্ঞপ্তি১০ এপ্রিল ২০২৫আবেদন ফিঅনলাইনে ফরম পূরণের অনধিক ৭২ ঘণ্টার মধ্যে আবেদন ফি বাবদ ১৬৮ টাকা টেলিটক প্রিপেইড মুঠোফোন নম্বর থেকে এসএমএসের মাধ্যমে জমা দিতে হবে।
আবেদনের শেষ সময়: ১৬ এপ্রিল ২০২৫, বিকেল ৫টা পর্যন্ত।