ছাত্র সংসদ নির্বাচন ছাত্রদলে ‘আটকা’
Published: 18th, February 2025 GMT
গণঅভ্যুত্থানের পর পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের বৈধ নেতৃত্বদানের প্ল্যাটফর্ম ছাত্র সংসদ নির্বাচনের দাবি জোরালো হয়। তবে সময় গড়ানোর সঙ্গে তা স্তিমিত হয়েছে। রাজনৈতিক দলগুলোর গ্রিন সিগন্যাল না থাকায় ছাত্র সংগঠন এখনই নির্বাচন চাচ্ছে না। সাধারণ শিক্ষার্থীরা সংসদের আগে ছাত্র সংসদ নির্বাচন চাইলেও প্রশাসন নির্বিকার।
বিএনপি দ্রুত জাতীয় নির্বাচনের দাবিতে সোচ্চার। তাদের সংগঠন ছাত্রদলের ভাষ্য, গত বছর ৫ আগস্ট গণঅভ্যুত্থানে শেখ হাসিনার পতন হলেও বিশ্ববিদ্যালয়ে ফ্যাসিবাদী কাঠামো রয়ে গেছে। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক-কর্মকর্তারাও ছাত্রদলের প্রতি পক্ষপাতমূলক আচরণ করছে। ফলে সংস্কার ছাড়া তাদের পক্ষে নিরপেক্ষ নির্বাচন করা সম্ভব নয়। ছাত্র সংসদ নির্বাচন করার আগে শিক্ষার্থীদের ওপর হামলায় জড়িত ছাত্রলীগের বিচার, প্রশাসন থেকে আওয়ামীপন্থিদের অপসারণ ও গঠনতন্ত্র সংস্কার করতে হবে।
গণঅভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেওয়া বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন শুরুতে এ নির্বাচনের ব্যাপারে সরব হলেও এখন নীরব। এর পেছনে ওপর মহলের ইশারা, সঙ্গে রয়েছে নতুন রাজনৈতিক দল গঠনের ব্যস্ততা। একই অবস্থা ছাত্রশিবিরের; মুখে নির্বাচন চাইলেও অদৃশ্য কারণে পিছু হটেছে। এ ইস্যুতে ক্যাম্পাসে তৎপরতা নেই বাম সংগঠনগুলোরও।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ছাত্র সংসদ নির্বাচনের সুদূরপ্রসারী প্রভাব বিশ্ববিদ্যালয়ের গণ্ডি পেরিয়ে জাতীয় নির্বাচনেও পড়ে। এ জন্য সংসদের আগে নির্বাচন না করার ব্যাপারে রাজনৈতিক দল থেকেই চাপ রয়েছে।
জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক আইনুল ইসলাম সমকালকে বলেন, ‘জাতীয় নির্বাচনের সঙ্গে ছাত্র সংসদ নির্বাচন অনুঘটক হিসেবে কাজ করে। ছাত্র সংসদে পরাজয় জাতীয় নির্বাচনে প্রভাব ফেলে। জাতীয় নির্বাচন চলতি বছরের মধ্যে হলে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ছাত্র সংসদ নির্বাচনের গ্রিন সিগন্যাল পাবে না। নির্বাচন দেরিতে হলে ভিন্ন হিসাব আসবে।’ তিনি বলেন, ‘ছাত্র সংসদ বড় কর্মযজ্ঞ। একটিতে শুরু হলে অন্যদের ওপর চাপ বাড়ে। আমার মনে হয়, বিশ্ববিদ্যালয়গুলো অপেক্ষা করছে জাতীয় নির্বাচনের রূপরেখার জন্য। সরকার সেটি দিলে ছাত্র সংসদ নির্বাচনও একটি পথ পাবে।’
ডাকসু নিয়ে তথৈবচ প্রশাসন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) আচরণবিধি, গঠনতন্ত্র সংস্কার ও ক্যাম্পাসে ছাত্র রাজনীতি নিয়ে তিনটি কমিটি হয়েছে। প্রক্টর সাইফুদ্দীন আহমেদ ফেব্রুয়ারির শুরুতে রূপরেখার প্রতিশ্রুতি দিলেও এখনও পারেননি। এ নিয়ে ক্ষুব্ধ সাধারণ শিক্ষার্থীরা। ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের ছাত্র হাফিজুর রহমান বলেন, ‘সংস্কার ও নির্বাচন– দুটির অগ্রগতি আমরা চাই। কিন্তু প্রশাসন কিছুই করছে না। ডাকসু হলে ছাত্রলীগের বিচার প্রক্রিয়া আরও ত্বরান্বিত হতো।’
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক আব্দুল কাদের বলেন, ‘প্রশাসন কিছু সংস্কার কাজ করছে। দ্রুত সংস্কার কাজ শেষে তারা নির্বাচন দেবে– এটাই প্রত্যাশা।’
এ ব্যাপারে ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক নাছির উদ্দীন নাছির বলেন, ‘দেশের সব খাত সংস্কার হলে বিশ্ববিদ্যালয়ে কেন ফ্যাসিবাদী কাঠামো থাকবে?
সংস্কার প্রক্রিয়া শেষ করে আমরাও দ্রুত ডাকসু নির্বাচন চাই। কিন্তু প্রশাসনের সংস্কার প্রক্রিয়া দৃশ্যমান না হলে আমরা কোনো টাইমফ্রেম বলব না।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক নিয়াজ আহমেদ খান বলেন, ‘ডাকসু আমাদের অন্যতম প্রতিশ্রুতি। প্রতিনিয়ত এ নিয়ে কাজ হচ্ছে। আমরা চাই, ডাকসু নিয়ে পুরোপুরি ঐক্য না হলেও, যেন বৃহত্তর ঐক্য হয়।’
রাকসু ঝুলে আছে ‘পক্ষপাতিত্বে’
রাবি প্রতিনিধি অর্পণ ধর জানিয়েছেন, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদ (রাকসু) নির্বাচনের পক্ষে শিক্ষার্থীরা। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন, শিবিরসহ বামপন্থি ছাত্র সংগঠনও নির্বাচন চায়। তবে প্রশাসনের প্রতি পক্ষপাতিত্বের অভিযোগ এনেছে ছাত্রদল। তাদের ভাষ্য, প্রশাসন জামায়াত-শিবিরঘেঁষা, তাদের পক্ষে নিরপেক্ষ নির্বাচন করা সম্ভব নয়। আবার ছাত্রলীগের কারণে দীর্ঘদিন তারা শিক্ষার্থী-ঘনিষ্ঠ কার্যক্রম করতে পারেননি। ফলে এখনই নির্বাচন চাচ্ছেন না তারা।
গত বছর ২৯ সেপ্টেম্বর রাকসুর কোষাধ্যক্ষ হিসেবে আরবি বিভাগের অধ্যাপক সেতাউর রহমানকে নিয়োগ দেয় কর্তৃপক্ষ। এর পর আর কোনো তৎপরতা দেখা যায়নি। যদিও প্রশাসন বলছে, ঈদের পর নির্বাচন হতে পারে।
রাবি ছাত্রদলের আহ্বায়ক সুলতান আহমেদ রাহীর প্রশ্ন– প্রশাসন একটি নির্দিষ্ট রাজনৈতিক দলের এজেন্ডা বাস্তবায়ন করছে। এ অবস্থায় কীভাবে নিরপেক্ষ নির্বাচন সম্ভব? সব সংগঠনের সহাবস্থান ও গঠনতন্ত্র সংস্কারের দাবি জানান তিনি।
শাখা ছাত্রশিবিরের সভাপতি মোস্তাকুর রহমান জাহিদ বলেন, ‘ক্যাম্পাসের অবস্থা এখন ভালো। সংসদের আগে রাকসু নির্বাচন হলে ভালো হবে।’ বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক গোলাম কিবরিয়া মোহাম্মদ মেশকাতও একই দাবি জানান।
বামপন্থি ছাত্র সংগঠনের মোর্চা গণতান্ত্রিক ছাত্রজোট নিজেদের গোছাতে আরেকটু সময় চায়। জোটের সদস্য বিপ্লবী ছাত্রমৈত্রী রাবি শাখার সভাপতি শাকিল হোসেন বলেন, ‘রাকসু নির্বাচনে প্রস্তুতির জন্য অবশ্যই সময় দরকার আছে।’
উপাচার্য অধ্যাপক সালেহ্ হাসান নকীব জানান, রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে তারা আলোচনা করেছেন। মোটা দাগে সবাই নির্বাচনের পক্ষে। কেউ দ্রুত, কেউ দেরিতে। প্রশাসনও ঈদের পরে নির্বাচন দিতে চায়।
অনিশ্চিত গন্তব্যে জাকসু
জাবি প্রতিনিধি তারেক হোসেন জানিয়েছেন, আন্দোলনের মুখে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদ (জাকসু) নির্বাচনের রূপরেখা ঘোষণা দিয়ে সাড়া ফেলে কর্তৃপক্ষ। তবে ছাত্র সংগঠনগুলোর দুই মেরুতে অবস্থান, পাল্টাপাল্টি কর্মসূচি, প্রশাসনকে অসহযোগিতা ও নির্বাচন-সংক্রান্ত সভা বর্জনের পর ঝুলে গেছে জাকসুর ভাগ্য।
নির্বাচনের আগে গঠনতন্ত্র সংস্কারসহ তাদের দাবিগুলোর বাস্তবায়ন চায় ছাত্রদল। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও ছাত্রশিবির বিপরীতে অবস্থান নিয়েছে। তারা মনে করে, সংস্কার নির্বাচিত প্রতিনিধির হাতে ছেড়ে দেওয়া উচিত। যদিও এপ্রিলের শেষ সপ্তাহে তপশিল এবং ২১ মের মধ্যে নির্বাচনের আশ্বাস দিয়েছে প্রশাসন।
ছাত্রদল, ছাত্র ইউনিয়ন (অমর্ত্য-ঋদ্ধ), ছাত্র ফ্রন্ট (মার্ক্সবাদী) এবং সাংস্কৃতিক জোটভুক্ত ৯ সংগঠনের দাবি, গঠনতন্ত্র সংস্কার, জুলাইয়ে শিক্ষার্থীদের ওপর হামলার বিচার, সিনেট-সিন্ডিকেট ও প্রশাসন থেকে আওয়ামীপন্থি শিক্ষকদের অপসারণের পর নির্বাচন হতে হবে। জাবি ছাত্রদলের আহ্বায়ক জহির উদ্দিন বাবর বলেন, ‘নির্বাচনের আগে অবশ্যই প্রশাসনকে আমাদের দাবির বিষয়ে দৃশ্যমান পদক্ষেপ নিতে হবে।’
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের জাবি শাখার সদস্য সচিব তৌহিদ মোহাম্মদ সিয়াম বলেন, ‘জাকসুর গঠনতন্ত্রে ন্যূনতম সংস্কার হওয়া উচিত। তবে সংস্কারের কথা বলে নির্বাচন পেছানো ঠিক হবে না।’ শাখা ছাত্রশিবিরের সভাপতি মুহিবুর রহমান বলেন, ‘সঠিক পথ হচ্ছে, নির্বাচনের পর নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মাধ্যমে সংস্কার করা।’ ছাত্র ইউনিয়নের জাবি সংসদের সভাপতি অমর্ত্য রায় বলেন, ‘সংস্কার ও নির্বাচন একই সময়ে চলতে পারে।’
উপাচার্য অধ্যাপক মোহাম্মদ কামরুল আহসান বলেন, ‘মতবিরোধ থাকলে কোনো কিছু শুরু করা যায় না। আশা করি, যেসব বিষয়ে মতভিন্নতা রয়েছে, তা দূর করে দ্রুত আমরা সমাধানে পৌঁছাতে পারব।’
সংসদের পরে চাকসু নির্বাচন চায় ছাত্রদল
চবি প্রতিনিধি মারজান আক্তার জানিয়েছেন, শিক্ষার্থীদের দাবির মুখে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (চাকসু) নির্বাচন জুনে হতে পারে বলে জানায় প্রশাসন। তবে ছাত্রদল সভাপতি আলাউদ্দিন মহসিন বলেছেন, জাতীয় নির্বাচনের পরে হলেই কেবল তারা চাকসু নির্বাচনে সম্মতি দেবেন। তিনি আরও বলেন, এখন পর্যন্ত চবি প্রশাসন চাকসু নিয়ে আমাদের সঙ্গে কোনো আলোচনা করেনি।
ছাত্রশিবিরের সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ আলী বলেন, ‘ছাত্র রাজনীতি নিয়ে শিক্ষার্থীদের মধ্যে নেতিবাচক মনোভাব তৈরি হয়েছে। সেটি দূর করতে দ্রুত চাকসু নির্বাচন দরকার।’ চবি ছাত্র ফেডারেশনের আহ্বায়ক আজাদ হোসেন বলেন, ‘প্রশাসন মে বা জুনে নির্বাচন দিতে পারে। আমরা সেভাবেই প্রস্তুতি নিচ্ছি।’
উপ-উপাচার্য ও চাকসু নীতিমালা প্রণয়ন কমিটির আহ্বায়ক অধ্যাপক কামাল উদ্দিন সমকালকে বলেন, ‘এপ্রিলে সমাবর্তন। সমাবর্তন ও চাকসুর কাজ একসঙ্গে চলছে। নীতিমালা কমিটির কাজ শেষে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে বসা হবে। ঐকমত্য হলে মে বা জুনে নির্বাচন হতে পারে।’
রাজনীতি নিষিদ্ধ শাকসু নিয়ে নেই তোড়জোড়
শাবি প্রতিনিধি রাজীব হোসেন জানিয়েছেন, সিলেট শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ শিক্ষার্থীরা শাকসু সচলের পক্ষে। তবে প্রশাসনের এ নিয়ে তেমন মাথাব্যথা নেই। ক্যাম্পাসে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড নিষিদ্ধ থাকায় ছাত্র সংগঠনগুলো কোনো কর্মসূচি করে না।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক আসাদুল্লাহ আল গালিব বলেন, ‘আমরা প্রশাসনের সঙ্গে কথা বলেছি। আবারও বসব। সংসদ নির্বাচনের আগেই ছাত্র সংসদ নির্বাচন চাই।’ ছাত্রশিবিরের সভাপতি তারেক মনোয়ার বলেন, ‘দলীয় ব্যানারে রাজনীতি নিষিদ্ধ থাকায় আমরা দাবি তুলতে পারছি না। তবে আমরা দ্রুত নির্বাচনের পক্ষে।
শাবিতে ছাত্রদলের সক্রিয় কমিটি নেই। ২০১৬ সালের কমিটির দপ্তর সম্পাদক মনির হোসেন ক্যাম্পাসে সক্রিয়। তিনি সমকালকে বলেন, ‘প্রশাসন উদ্যোগ নিলে আমরা সহায়তা করব। তবে আমরা মনে করি, জাতীয় নির্বাচনের আগে ছাত্র সংসদ নির্বাচন করা ঠিক হবে না।’
উপাচার্য অধ্যাপক এ এম সরোয়ার উদ্দিন চৌধুরী বলেন, ‘সামনে আমাদের ভর্তি পরীক্ষা। এটি শেষে শাকসুসহ অন্য বিষয়গুলো দেখা হবে।’
.
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: র জন ত গঠনতন ত র স স ক র ছ ত র স গঠন ছ ত রদল র র রহম ন র বল ন স ন বল আম দ র ন বল ন ন র পর অবস থ গঠন র
এছাড়াও পড়ুন:
রমনা বটমূলে বোমা হামলা: ২৪ বছরেও হয়নি বিস্ফোরক মামলার রায়
রাজধানীর রমনা বটমূলে বর্ষবরণের অনুষ্ঠানে বোমা হামলার পর দুই যুগ পার হয়েছে। এ ঘটনায় বিস্ফোরক দ্রব্য আইনে দায়ের করা মামলার বিচার এখনো শেষ হয়নি। কবে রায় হবে, নির্দিষ্ট করে বলতে পারছেন না সংশ্লিষ্টরা।
২০০১ সালে রমনা বটমূলে বোমা হামলা হয়। এতে ১০ জন প্রাণ হারান। ওই ঘটনায় দায়ের করা হত্যা মামলার বিচার শেষ হয়েছে ১৩ বছর আগে। তবে, ২৪ বছরেও শেষ হয়নি বিস্ফোরক মামলার বিচারকাজ।
তিন বছর আগে মামলাটি ঢাকার দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল-১ এ যুক্তি-তর্ক উপস্থাপনের পর্যায়ে ছিল। ২০২২ সালের ২৮ জুলাই মামলাটি বদলি করে ঢাকা মহানগর বিশেষ ট্রাইব্যুনাল-১ এ পাঠানো হয়। সেখান থেকে ২০২৩ সালের ৩ জানুয়ারি পাঠানো হয় মহানগর বিশেষ ট্রাইব্যুনাল-১৫ তে।
মামলাটি এখন আসামিদের আত্মপক্ষ শুনানির পর্যায়ে আছে। সর্বশেষ গত ২৪ ফেব্রুয়ারি আসামিদের আত্মপক্ষ শুনানির তারিখ ধার্য ছিল। কিন্তু, মামলার তিন আসামি সিলেটের এক মামলায় সেখানে থাকায় তাদের আদালতে হাজির করা হয়নি। এদিকে, এক আসামির পক্ষে মামলার তদন্ত কর্মকর্তাকে পুনরায় জেরার আবেদন করা হয়েছে। বিচারক সাইফুর রহমান মজুমদার আগামী ২০ এপ্রিল শুনানির তারিখ ধার্য করেছেন।
সংশ্লিষ্ট আদালতের অ্যাডিশনাল পাবলিক প্রসিকিউটর মাহফুজ হাসান বলেছেন, “গত অক্টোবরে আমরা নিয়োগ পেয়েছি। ডিসেম্বরে ছিল শীতকালীন অবকাশ। আমরা খুব বেশি সুযোগ পাইনি। রাষ্ট্রীয় দিকনির্দেশনার দিকে তাকিয়ে আছি। আমাদের পিপি স্যার আছেন। তাকে সব সময় ইনফর্ম করি। পিপি স্যার যে দিকনির্দেশনা দেবেন, সে অনুযায়ী কাজ করব। আসামিরা অন্য মামলায় গ্রেপ্তার হওয়ায় তাদের এ মামলায় হাজির করা যাচ্ছে না। এজন্য একটু সময় লাগছে।”
ঢাকা মহানগর পাবলিক প্রসিকিউটর ওমর ফারুকের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, “এ মামলা সম্পর্কে আমার জানা নাই। খোঁজ নিয়ে দেখব।”
বিস্ফোরক দ্রব্য আইনে দায়ের করা মামলার আসামিরা হলেন—আরিফ হাসান ওরফে সুমন ওরফে আবদুর রাজ্জাক, মাওলানা আকবর হোসাইন ওরফে হেলাল উদ্দিন, শাহাদাতউল্লাহ ওরফে জুয়েল, হাফেজ মাওলানা আবু তাহের, মাওলানা মো. তাজউদ্দিন, মাওলানা সাব্বির ওরফে আবদুল হান্নান সাব্বির, মাওলানা শওকত ওসমান ওরফে শেখ ফরিদ, হাফেজ জাহাঙ্গীর আলম বদর, মাওলানা আবু বকর ওরফে হাফেজ সেলিম হাওলাদার, মুফতি শফিকুর রহমান ও মুফতি আব্দুল হাই। তাদের মধ্যে মাওলানা মো. তাজউদ্দিন, হাফেজ জাহাঙ্গীর আলম বদর ও মুফতি আব্দুল হাই পলাতক এবং অপর আট আসামি কারাগারে আছেন।
আসামি আরিফ হাসানের আইনজীবী মিজানুর রহমান বলেছেন, আগের সরকার ইচ্ছে করে এ মামলার বিচার শেষ করেনি। আসামিদের আটকে রেখে দিয়েছে। কারণ, তারা জানত, আসামিরা রমনায় বোমা হামলা ও ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা করেনি। উচ্চ আদালতে তারা খালাস পাবেন। এ কারণে মামলা শেষ না করে ঝুলিয়ে রেখে আসামিদের আটকে রেখেছে। আমরা চাই, মামলার বিচার শেষ হোক। রমনা বটমূলে ঘটনা ঘটেছে, মানুষও মারা গেছে। দোষীদের বিচার আমরাও চাই। মামলার বিচার শেষ হলর কেউ দোষী হলে সাজা পাবে আর দোষ না করলে খালাস পাবে।
২০০১ সালের পহেলা বৈশাখ ভোরে রমনা বটমূলে ছায়ানটের বর্ষবরণ অনুষ্ঠানস্থলে দুটি বোমার বিস্ফোরণ ঘটানো হয়। সকাল ৮টা ৫ মিনিটে একটি এবং এর পরপরই আরেকটি বোমা বিস্ফোরিত হয়। বিস্ফোরণে ঘটনাস্থলেই সাত ব্যক্তি প্রাণ হারান এবং ২০-২৫ জন আহত হন। পরে আহত ব্যক্তিদের মধ্যে তিন জন চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান। ওই ঘটনায় নীলক্ষেত পুলিশ ফাঁড়ির সার্জেন্ট অমল চন্দ্র চন্দ ওই দিনই রমনা থানায় হত্যা ও বিস্ফোরক আইনে দুটি মামলা করেন। এতে ১৪ জনকে আসামি করে অভিযোগপত্র দাখিল করেন পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) পরিদর্শক আবু হেনা মো. ইউসুফ।
দুটি মামলার মধ্যে প্রায় ১৩ বছর পর হত্যা মামলার রায় হয় ২০১৪ সালের ২৩ জুন। রায়ে নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন হরকাতুল জিহাদ বাংলাদেশের শীর্ষ নেতা মুফতি আব্দুল হান্নানসহ আট জনকে মৃত্যুদণ্ড ও ছয় জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেন আদালত।
মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্তরা হলেন—মুফতি আব্দুল হান্নান মুন্সী ওরফে আবুল কালাম ওরফে আব্দুল মান্নান, আরিফ হাসান সুমন, মাওলানা আকবর হোসাইন ওরফে হেলালউদ্দিন, মো. তাজউদ্দিন, আলহাজ মাওলানা হাফেজ জাহাঙ্গীর আলম বদর, মাওলানা আবু বকর ওরফে হাফেজ সেলিম হাওলাদার, মুফতি শফিকুর রহমান ও মুফতি আব্দুল হাই।
যাবজ্জীবন কারাদণ্ডপ্রাপ্তরা হলেন—শাহাদত উল্লাহ ওরফে জুয়েল, হাফেজ মাওলানা আবু তাহের, মাওলানা আব্দুর রউফ, মাওলানা সাব্বির ওরফে আব্দুল হান্নান সাব্বির, মাওলানা শওকত ওসমান ওরফে শেখ ফরিদ ও হাফেজ মাওলানা ইয়াহিয়া।
তাদের মধ্যে মাওলানা তাজউদ্দিনসহ তিন আসামি এখনো পলাতক। শীর্ষ জঙ্গি নেতা মুফতি আব্দুল হান্নান মুন্সী ওরফে আবুল কালাম ওরফে আব্দুল মান্নানের অপর এক মামলায় ফাঁসি কার্যকর হয়েছে। এজন্য বিস্ফোরক মামলা থেকে তাকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে।
গত ১৮ ফেব্রুয়ারি হত্যা মামলার মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামিদের ডেথ রেফারেন্স ও জেল আপিলের ওপর আসামিপক্ষ ও রাষ্ট্রপক্ষের শুনানি শেষ হয়। শুনানি শেষে গত ১৮ ফেব্রুয়ারি বিচারপতি মোস্তফা জামান ইসলাম ও বিচারপতি নাসরিন আক্তারের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ রায় ঘোষণার জন্য অপেক্ষমাণ রাখেন।
এর আগে ২০১৭ সালের ৮ জানুয়ারি বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম ও বিচারপতি সহিদুল করিমের হাইকোর্ট বেঞ্চে মামলার ডেথ রেফারেন্স ও আপিলের শুনানি শুরু হয়। এরপর ওই বছরের ১৪ মার্চ চূড়ান্ত যুক্তি-তর্ক উপস্থাপনের তারিখ ঠিক করা হয়। পরে আদালত মামলাটি কার্যতালিকা থেকে বাদ দেন। এরপর মামলাটি যায় বিচারপতি মো. রুহুল কুদ্দুস ও বিচারপতি এ এসএম আব্দুল মোবিনের হাইকোর্ট বেঞ্চে। সেখানে দীর্ঘদিন থাকার পরও মামলাটির শুনানি হয়নি।
হত্যা মামলা সম্পর্কে ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল সুলতানা আক্তার রুবি বলেছেন, ডেথ রেফারেন্স ও জেল আপিলের ওপর শুনানি শেষ হয়েছে। শুনানিতে আমরা বিচারিক আদালতের দেওয়া সাজার যৌক্তিকতা তুলে ধরেছি। প্রত্যাশা করছি, সর্বোচ্চ সাজা রায়ে বহাল থাকবে।
ছায়ানটের বর্ষবরণ অনুষ্ঠান বোমা হামলায় নিহতরা হলেন—চট্টগ্রাম জেলার সন্দ্বীপ থানার দুবলা গ্রামের মৃত সিরাজুল ইসলামের ছেলে আবুল কালাম আজাদ (৩৫), বরগুনা জেলার বামনা থানার বাইজোরা গ্রামের আবুল হোসেন ওরফে এনায়েত হোসেনের ছেলে জসিম (২৩), কুমিল্লা জেলার দাউদকান্দি থানার বিরামকান্দি গ্রামের আবুল কাশেমের ছেলে এমরান (৩২), পটুয়াখালীর সদর থানার ছোট বিমাই গ্রামের মৃত অনবী ভূষণ সরকারের ছেলে অসীম চন্দ্র সরকার (২৫), পটুয়াখালী জেলার বাউফল থানার কাজীপাড়া গ্রামের আবুল কাশেম গাজীর ছেলে মামুন (২৫), একই গ্রামের সামছুল হক কাজীর ছেলে রিয়াজ (২৫), একই এলাকার আবুল হাশেম গাজীর মেয়ে শিল্পী (২০), নোয়াখালী জেলার বেগমগঞ্জ থানার রথি রুহিত রামপুর গ্রামের আবুল কালামের ছেলে ইসমাইল হোসেন স্বপন (২৭), ঢাকার দোহার থানার চরনটসোলা গ্রামের মৃত আয়নাল খাঁর ছেলে আফসার (৩৫) ও অপর এক জন অজ্ঞাত পুরুষ।
ঢাকা/মামুন/রফিক