গ্রামে নিষিদ্ধ বাদ্যযন্ত্র, তৃতীয় লিঙ্গের মানুষদের ঢুকতে মানা
Published: 18th, February 2025 GMT
ঝিনাইদহের হরিণাকুণ্ডু উপজেলার ফলসী ইউনিয়নের একটি গ্রাম শড়াতলা। এক সপ্তাহ ধরে গ্রামের দেয়ালে দেয়ালে একটি নোটিশ দেখা যাচ্ছে। এতে লেখা, শড়াতলা গ্রামে সব ধরনের বাদ্যযন্ত্র ও হকার নিষিদ্ধ। তৃতীয় লিঙ্গের মানুষও গ্রামটিতে ঢুকতে পারবেন না। এই নিয়ম অমান্য করলে গুনতে হবে জরিমানা। সমাজপতিদের এই সিদ্ধান্তে ক্ষুব্ধ জেলা-উপজেলার সংস্কৃতিপ্রেমী মানুষ। তারা বলছেন, এটা বেআইনি। তবে এটিকে ‘সামাজিক অবক্ষয় রোধে ইতিবাচক পদক্ষেপ’ হিসেবে দেখছেন কেউ কেউ।
গতকাল সোমবার সরেজমিন দেখা যায়, শড়াতলা গ্রামের বিভিন্ন বাড়ি ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের দেয়ালে ১০০ টাকা মূল্যের নন-জুডিশিয়াল স্ট্যাম্পের ফটোকপি সাঁটানো। স্ট্যাম্পের ওপর অংশে বড় করে লেখা, ‘সকল প্রকার বাদ্যযন্ত্র ও হকার নিষিদ্ধকরণের নোটিশ’। ভেতরে লেখা রয়েছে, ‘গ্রামবাসীর পক্ষ থেকে জানানো যাচ্ছে, সকল প্রকার বাদ্যযন্ত্র নিষিদ্ধ করা হলো। যারা বাদ্যযন্ত্র বাজাবে, তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে। সেই সাথে তাদেরকে চার হাজার টাকা জরিমানা করা হবে এবং তাদের পিতামাতার বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’ হকার ও তৃতীয় লিঙ্গের মানুষদেরও গ্রামে প্রবেশ নিষিদ্ধ করা হয়েছে।
নোটিশে উল্লেখ রয়েছে, ‘যেহেতু আমাদের গ্রামের ৯৫% মানুষ শিক্ষিত ও ২০ জনের মতো সরকারি কর্মকর্তা বা কর্মচারী আছে। নতুন প্রজন্মের ভবিষ্যৎ বিবেচনা করে গ্রামবাসী এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছে।’
নোটিশের শেষ অংশে ‘গ্রামবাসীর পক্ষে’ ১৮ জন সই করেছেন। তাদের মধ্যে রয়েছেন জনপ্রতিনিধি, বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সভাপতি, শিক্ষক, ইমাম ও সমাজসেবক।
বাদ্যযন্ত্র নিষিদ্ধ করে নোটিশ সাঁটানোর বিষয়টি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে। অনেকে এ নিয়ে সমালোচনা করছেন। গতকাল একজন নিজের ফেসবুক আইডিতে এ বিষয়ে পোস্ট করেন। সেখানে মন্তব্যের ঘরে একজন লিখেছেন, ‘প্রতিটি গ্রামে-শহরে মানুষের ব্যক্তি স্বাধীনতা রয়েছে। গুটিকয়েক মানুষ আইনবহির্ভূত কাজ করবে, এটা হতে পারে না।’ আরেকজন মন্তব্য করেছেন, ‘হকার ও তৃতীয় লিঙ্গের মানুষরা আসুক, তবে বাদ্যযন্ত্র না বাজিয়ে তাদের কাজ সেরে চলে যাক।’
নোটিশে সই করা শড়াতলা গ্রামের পশ্চিমপাড়া জামে মসজিদ কমিটির সভাপতি এনামুল হক বলেন, আগে গ্রামে উচ্চ স্বরে বাদ্যযন্ত্র বাজানো হতো। এতে অসুস্থ মানুষ, শিক্ষার্থী, নারী, শিশুসহ অনেকের সমস্যা হতো। এ ছাড়া তৃতীয় লিঙ্গের মানুষ বিভিন্ন সময়ে উচ্চ স্বরে বাদ্যযন্ত্র বাজিয়ে নাচ-গান করে। এতে মানুষের সমস্যা হয়। তারা ও হকাররা নানা সময়ে মানুষের কাছ থেকে অতিরিক্ত টাকা-পয়সা হাতিয়ে নেয়। তাই এমন সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
১ নম্বর ওয়ার্ডের মেম্বার তৌহিদুর রহমান বলেন, বাদ্যযন্ত্র ব্যবহারের কারণে ছেলেমেয়েদের লেখাপড়ার ক্ষতি হয়। তাই তাদের সুবিধার জন্য গ্রামের সবার মতামতের ভিত্তিতেই এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ফলসী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান বজলুর রহমান বলেন, আমি অসুস্থ। ঢাকায় চিকিৎসাধীন আছি। এ বিষয়ে আমার কিছু জানা নেই।
ঝিনাইদহের বিহঙ্গ সাংস্কৃতিক চর্চা কেন্দ্রের সাধারণ সম্পাদক শাহীনূর আলম লিটন বলেন, নব্বইয়ে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে আমরা পথনাটক এবং গান-বাজনার মাধ্যমে মানুষকে সম্পৃক্ত করেছিলাম। চব্বিশের ছাত্র-জনতার আন্দোলনেও সাংস্কৃতিক অঙ্গনের মানুষের ভূমিকা রয়েছে। আমি মনে করি, একটি গোষ্ঠী আমাদের সমাজকে পিছিয়ে দেওয়ার জন্য ধর্মকে মানুষের ওপর চাপিয়ে দিচ্ছে। অথচ সৌদি আরবসহ অনেক মুসলিম দেশেও সাংস্কৃতিক চর্চা হচ্ছে।
তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, একটা এলাকা থেকে কেউ বাদ্যযন্ত্র নিষিদ্ধ করতে পারে না। এটা বেআইনি। এর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে প্রশাসনের প্রতি দাবি জানাই।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) বি এম তারিক-উজ-জামান বলেন, বিষয়টি আমি শুনেছি। এটি আইনবিরোধী। এভাবে কেউ নিয়ম তৈরি করতে পারে না। ইতোমধ্যে আমি এর সঙ্গে জড়িতদের খুঁজে বের করতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে জানিয়েছি। জড়িতদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
.
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: ব দ যযন ত র ঝ ন ইদহ ন ষ দ ধ কর ব যবস থ ন বল ন
এছাড়াও পড়ুন:
হোটেল-রেস্তোরাঁয় শ্রমিকের ন্যূনতম মজুরি ১৩০৫০ টাকা
হোটেল ও রেস্তোরাঁ খাতে শ্রমিক-কর্মচারীদের মাসিক নিম্নতম মজুরি হারের খসড়া গেজেট আকারে প্রকাশ করেছে নিম্নতম মজুরি বোর্ড। এতে শ্রমিক-কর্মচারীদের জন্য ১৩ হাজার ৫০ টাকা ন্যূনতম মজুরি নির্ধারণের সুপারিশ করা হয়েছে। প্রতিবছর শ্রমিক-কর্মচারীদের মূল মজুরি ৫ শতাংশ হারে বাড়ানোরও সুপারিশ করেছে নিম্নতম মজুরি বোর্ড। গত ২৯ জানুয়ারি এ গেজেট প্রকাশ করে এ বিষয়ে অংশীজনের কোনো মতামত, পরামর্শ বা আপত্তি থাকলে তা জানাতে বলা হয়।
গত বছরের ১৫ জানুয়ারি নিম্নতম মজুরি বোর্ডে হোটেল ও রেস্তোরাঁ শিল্প খাতে মালিক ও শ্রমিকদের প্রতিনিধিত্বকারী সদস্য নিয়োগ করা হয়। পরে এ খাতের শ্রমিক-কর্মচারীদের নিম্নতম মজুরি নির্ধারণের কার্যক্রম গ্রহণের জন্য বোর্ডের চেয়ারম্যানকে অনুরোধ জানানো হয়। এরপর নিম্নতম মজুরি হারের সুপারিশ প্রণয়নের জন্য বোর্ডের একাধিক সভা অনুষ্ঠিত হয়। বোর্ডের চেয়ারম্যান ও সদস্যরা ঢাকার কাজী আলাউদ্দিন রোড ও চকবাজার এলাকায় হোটেল-রেস্তোরাঁ শিল্পের তিনটি এবং টাঙ্গাইল সদরের চারটি প্রতিষ্ঠান ও কারখানায় গিয়ে বিভিন্ন কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ করেন। সেখানে সংশ্লিষ্ট মালিক ও শ্রমিক নেতাদের সঙ্গে মতবিনিময় সভা করে তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করেন তারা।
বোর্ডের সভায় সংশ্লিষ্ট শিল্পের মালিক ও শ্রমিক প্রতিনিধি এবং শ্রমিক সংগঠনের পক্ষ থেকে দেওয়া স্মারকলিপি, মজুরি প্রস্তাব ও পরিদর্শন প্রতিবেদনসহ শ্রম আইন অনুসারে শ্রমিকদের জীবনযাপন ব্যয়, জীবনযাপনের মান, উৎপাদন খরচ, উৎপাদনশীলতা, উৎপাদিত দ্রব্যের দাম, মূল্যস্ফীতি, কাজের ধরন, ঝুঁকি ও মান, ব্যবসায়িক সামর্থ্য, দেশের ও সংশ্লিষ্ট এলাকার আর্থসামাজিক অবস্থা এবং অন্যান্য প্রাসঙ্গিক বিষয় পর্যালোচনা করা হয়। সার্বিক অবস্থা বিবেচনা করে সরকারের কাছে নিম্নতম মজুরির হার নির্ধারণ সম্পর্কিত সুপারিশ করা হয়েছে।
হোটেলের নিম্নতম মজুরি: নিম্নতম মজুরি বোর্ডের সুপারিশে বলা হয়, এক তারকা হোটেলগুলোর ডিসওয়াশ বয়, ডোরম্যানসহ গ্রেড-৩ এর শ্রমিকরা সর্বনিম্ন মজুরি পাবেন প্রতি মাসে ১৩ হাজার ৫০ টাকা। এর মধ্যে মূল মজুরি ৭ হাজার ৫শ টাকা, বাড়ি ভাড়া ৩ হাজার ৭৫০ টাকা, চিকিৎসা ভাতা ১ হাজার টাকা ও যাতায়াত ভাতা ৮০০ টাকা। দুই তারকা হোটেলগুলোর গ্রেড-৩ এ থাকা জুনিয়র ওয়েটারসহ শ্রমিকরা প্রতি মাসে ন্যূনতম ১৩ হাজার ৬৫০ টাকা ন্যূনতম মজুরি পাবেন। এই গ্রেডে থাকা তিন তারকা হোটেলের শ্রমিকরা পাবেন মাসিক ন্যূনতম ১৪ হাজার ৭শ টাকা। একই গ্রেডের মাসিক সর্বনিম্ন মজুরি চার তারকার ক্ষেত্রে ১৫ হাজার ৭৫০ টাকা এবং পাঁচ তারকার ক্ষেত্রে ১৬ হাজার ৮শ টাকা।
এতে গ্রেড-২-এর শ্রমিকদের ক্ষেত্রে সর্বনিম্ন মাসিক মজুরির যে সুপারিশ করা হয়েছে তা হচ্ছে এক তারকা হোটেলে ১৮ হাজার ৪৫০ টাকা, দুই তারকা হোটেলে ২০ হাজার ২৫০ টাকা, তিন তারকা হোটেলে ২২ হাজার ৫০ টাকা, চার তারকা হোটেলে ২৩ হাজার ৮৫০ টাকা ও পাঁচ তারকা হোটেলে ২৫ হাজার ৬৫০ টাকা।
নিম্নতম মজুরি বোর্ডের সুপারিশে বলা হয়, শ্রমিকদের গ্রেড-১ এর ক্ষেত্রে নিম্নতম মাসিক মজুরি হবে এক তারকা হোটেলের ক্ষেত্রে ৩১ হাজার ৮শ টাকা, দুই তারকা হোটেলে ৩৩ হাজার ৩শ টাকা, তিন তারকা হোটেলে ৩৪ হাজার ৮শ টাকা, চার তারকা হোটেলে ৩৭ হাজার ৮শ টাকা এবং পাঁচ তারকা হোটেলে ৪০ হাজার ৮শ টাকা।
হোটেলগুলোর কর্মচারীদের জন্য নিম্নতম মজুরি কাঠামোর সুপারিশে বলা হয়, গ্রেড-৩ এর কর্মচারীরা সর্বনিম্ন মাসিক মজুরি পাবেন এক তারকা হোটেলে ১৩ হাজার ৫০ টাকা, দুই তারকা হোটেলে ১৩ হাজার ৬৫০ টাকা, তিন তারকা হোটেলে ১৪ হাজার ৭শ টাকা, চার তারকা হোটেলে ১৫ হাজার ৭৫০ টাকা এবং পাঁচ তারকা হোটেলে ১৬ হাজার ৬৫০ টাকা। গ্রেড-২ এর কর্মচারীরা পাবেন এক তারকায় ১৮ হাজার
৪৫০ টাকা, দুই তারকায় ২০ হাজার ২৫০ টাকা, তিন তারকায় ২২ হাজার ৫০ টাকা, চার তারকায় ২৩ হাজার ৮৫০ টাকা এবং পাঁচ তারকায় ২৫ হাজার ৬৫০ টাকা। গ্রেড-১ এর কর্মচারীরা পাবেন এক তারকায় ২৭ হাজার ৩শ, দুই তারকায় ২৯ হাজার ১শ, তিন তারকায় ৩০ হাজার ৯শ, চার তারকায় ৩২ হাজার ৭শ এবং পাঁচ তারকায় ৩৪ হাজার ৫শ টাকা।
রেস্তোরাঁয় নিম্নতম মজুরি: নিম্নতম মজুরি বোর্ডের সুপারিশে বলা হয়েছে, গ্রেড-৪ এর শ্রমিকদের ন্যূনতম মাসিক মজুরি হবে ডি শ্রেণির রেস্তোরাঁয় ১৩ হাজার ৫০ টাকা, সি শ্রেণির রেস্তোরাঁয় ১৩ হাজার ৬৫০ টাকা, বি শ্রেণির রেস্তোরাঁয় ১৪ হাজার ৭শ টাকা এবং এ শ্রেণির রেস্তোরাঁয় ১৫ হাজার ৭৫০ টাকা। গ্রেড-৩ এর ক্ষেত্রে ডি, সি, বি এবং এ শ্রেণিতে এটি নির্ধারণ করা হয়েছে যথাক্রমে ১৫ হাজার ৭৫০ টাকা, ১৩ হাজার ৬৫০ টাকা, ১৪ হাজার ৭শ এবং ১৬ হাজার ৬৫০ টাকা।
গ্রেড-২ এর ক্ষেত্রে এটি যথাক্রমে ১৬ হাজার ৬৫০, ১৮ হাজার ৪৫০, ২০ হাজার ২৫০ ও ২২ হাজার ৫০ টাকা। গ্রেড-১ এর এটি যথাক্রমে ৩০ হাজার ৩শ, ৩১ হাজার ৮শ, ৩৩ হাজার ৩শ ও ৩৪ হাজার ৮শ টাকা।
রেস্তোরাঁয় কর্মচারীদের জন্য যে সুপারিশ করা হয়েছে তাতেও সর্বনিম্ন মজুরি ধরা হয়েছে ১৩ হাজার ৫০ টাকা। সবচেয়ে বেশি পাবেন এ শ্রেণির রেস্তোরাঁয় গ্রেড-১ এর কর্মচারীরা। তাদের ক্ষেত্রে ন্যূনতম মাসিক মজুরি ধরা হয়েছে ২২ হাজার ৫০ টাকা। এ ছাড়া সব ধরনের হোটেল-রেস্তোরাঁয় শিক্ষানবিশ শ্রমিকরা মাসে ৯ হাজার ৩শ টাকা পাবেন।