গর্তে গর্তে ঝাঁকি, সুস্থ যাত্রীও হয়ে পড়েন অসুস্থ
Published: 17th, February 2025 GMT
বাগেরহাট সদর উপজেলার কাড়াপাড়ায় বাড়ি ষাটোর্ধ্ব ফরিদ উদ্দীনের। নানা প্রয়োজনে অবসরপ্রাপ্ত এই সরকারি কর্মকর্তাকে চার কিলোমিটার দূরে জেলা শহরে আসতে হয়।
এ জন্য দশানী-রামপাল-মোংলা আঞ্চলিক মহাসড়কের বিকল্প কোনো পথ নেই। ভাঙাচোরা এই সড়কের ক্রমাগত ঝাঁকিতে সুস্থ অবস্থায় সকালে বেরিয়ে বিকেলে ফিরতে ফিরেত অসুস্থ হয়ে পড়েন ফরিদ উদ্দীন।
গত শুক্রবার কথা হয় ফরিদ উদ্দীনের সঙ্গে। তিনি বলেন, রাস্তাটি ঠিক হওয়ার বদলে দিন দিন আরও খারাপ হচ্ছে। ঠিকাদার বা সড়ক বিভাগের কোনো কর্মকর্তার যেন এ নিয়ে মাথাব্যথা নেই। জেলার কোথাও এমন ভয়াবহ খারাপ রাস্তা তাঁর চোখে পড়েনি।
জেলা সড়ক বিভাগ সূত্রে জানা যায়, বাগেরহাটের দশানী-রামপাল-মোংলা আঞ্চলিক মহাসড়কের ৩৩ দশমিক ৮৭ কিলোমিটার অংশ সম্প্রসারণ ও সংস্কারে ২০২২ সালের আগস্ট মাসে তিন ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে কার্যাদেশ দেওয়া হয়। এর মধ্যে প্রায় ৭ মাস ধরে কাজ বন্ধ রেখেছে মাহাবুব ব্রাদার্স নামের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। আগেও দুই দফা সময় বাড়িয়ে তারা ১০ কিলোমিটার সড়কের মাত্র ৩০ শতাংশ কাজ সম্পন্ন করতে পেরেছে। যে কারণে সড়কের এখানে-ওখানে খানাখন্দ ও ভাঙাচোরা। পাশাপাশি হঠাৎ মোড়ের কারণে সড়কটিতে প্রতিদিনই ঘটছে দুর্ঘটনা। গর্ত বাঁচিয়ে নানা কসরত করে যানবাহন নিয়ে যেতে হয় চালকদের। চারদিকে যেন ধুলার রাজত্ব। যে কারণে পথচারীদের চলাচলও কঠিন হয়ে পড়ছে দিন দিন।
শুক্রবার সকালে দশানী থেকে ডেমা এলাকা পর্যন্ত ৫ কিলোমিটার সড়কের পুরোটি ভাঙাচোরা দেখা যায়। ছোট-বড় গর্তের সংখ্যা গণে শেষ করা কঠিন। এমন অবস্থার মধ্যেই যাত্রীবাহী রিকশা, ইজিবাইক, ট্রাক, প্রাইভেটকার, মোটরসাইকেলসহ নানা যানবাহন চলছে। প্রায়ই এই সড়কে আটকে যায় ভারী ট্রাক, কখনও ভেঙেও পড়ে। তখন চরম যানজট দেখা দেয়।
নিয়মিত এই সড়কে যাত্রী পরিবহন করেন ইজিবাইক চালক রাসেল শেখ। তিনি বলেন, ‘রাস্তায় নামলে মনে হয় আজাবের মধ্যে এসে পড়লাম। গর্তে পড়ে গাড়ি বিকল হয়ে যায়। ঝাঁকিতে যাত্রীরা অসুস্থ হয়ে পড়ে। এটিকে এখন রোগী বানানোর সড়ক বলা যায়।’
মুসা মিয়া নামের আরেকজন ইজিবাইক চালক বলেন, ‘গর্তে গাড়ি পড়লেই এক সাইডে এমনভাবে বেঁকে যায়– মনে হয় যেন, উল্টে পড়ে গেলাম। রোগী থাকলে তাদের অবস্থা আরও নাজুক হয়ে যায়।’
এই সড়ক ধরেই বাগেরহাটের সরকারি প্রফুল্ল চন্দ্র কলেজে যেতে হয় ডেমা এলাকার বাসিন্দা রাকিবুল হাসানকে। ভাঙা সড়কের জন্য তাঁকে গুনতে হয় বাড়তি ভাড়া। এ ছাড়া দ্বিগুণ সময় লাগে জানিয়ে রাকিবুল বলেন, ঝাঁকুনি ও কষ্ট যে কী পরিমাণ হয়, তা বলে বোঝানো কঠিন।
মির্জাপুর এলাকার ষাটোর্ধ্ব রিনা বেগম বলেন, ‘রাস্তায় চলাচল করতে প্রচণ্ড কষ্ট হয়। কোমরে-পায়ে ব্যথা পাই। বেঁচে থাকতে কি এই রাস্তা নির্মাণ শেষ হবে না?’
ধুলাবালির কারণে দোকান খোলা রাখতে মুশকিলে পড়তে হয় ব্যবসায়ীদের। এ তথ্য জানিয়ে কাড়াপাড়া বাজারের ব্যবসায়ী রানা আকুঞ্জি বলেন, ‘ক্রেতারা আসতে চায় না। বছরের পর বছর এমন দুর্ভোগে আছি আমরা।’ তিনি আরও বলেন, রাস্তার সব জায়গায় ছোট ছোট পাথর ফেলা
হয়েছে। সড়কের পাশে একাধিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান রয়েছে। দিন দশেক আগে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের
দুই শিক্ষার্থী রাস্তার পাশ দিয়ে যাচ্ছিল। এ সময় কোনো যানবাহনের চাকা থেকে ছিটকে আসা
পাথর ছিটকে তাদের মাথায় লাগে। পরে শিশু দুটিকে হাসপাতালে নিতে হয়।
একই এলাকার মিলু আকুঞ্জি বলেন, রাস্তা খারাপ হওয়ায় কেউ অসুস্থ হলে হাসপাতালে নিতে অনেক সময় লেগে যায়। এতে রোগীর অবস্থা আরও খারাপ হয়। তাঁর কথার সত্যতা মেলে জেলা হাসপাতালের সরকারি অ্যাম্বুলেন্সের চালক মো.
যেতে এমন হয়েছে, রাস্তার ঝাঁকিতে গাড়িতে অন্তঃসত্ত্বা নারীর বাচ্চা প্রসব হয়ে গেছে।
অনেক সময় রোগীর মৃত্যু হয়েছে। গাড়ি চালানোই যায় না এখান দিয়ে।
সড়কের কাজ ফেলে রাখার বিষয়ে জানতে মাহাবুব ব্রাদার্সের স্থানীয় কার্যালয়ে গিয়ে দায়িত্বশীল কাউকে পাওয়া যায়নি। বাগেরহাট সড়ক ও জনপথ (সওজ) বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. আশরাফুল ইসলাম এ বিষয়ে বলেন, ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে চিঠি দেওয়া হচ্ছে। যদি তারা এখনও কাজ না করে ফেলে রাখে, তাহলে চুক্তিপত্র বাতিল করবেন। পরবর্তী সময়ে অন্য ঠিকাদারের মাধ্যমে কাজটি সম্পন্ন করার চেষ্টা করবেন।
উৎস: Samakal
এছাড়াও পড়ুন:
সংস্কার ও নির্বাচন দুটোই হতে হবে
এখন কোনো কোনো রাজনৈতিক দল নির্বাচন চায়, সংস্কার চায় না। তাদের মনে রাখা উচিত, জুলাই গণঅভ্যুত্থান কেবল ক্ষমতার পালাবদলের জন্য হয়নি। এই গণঅভ্যুত্থানের আকাঙ্ক্ষা হলো সংস্কার এবং নির্বাচন দুটিই হতে হবে। স্বাধীনতার ৫৩ বছরে রাজনৈতিক দলগুলো কেবল ক্ষমতা পাকাপোক্ত করতে নিজেদের স্বার্থে রাজনীতি করেছে। জনগণকে দেওয়া প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করেছে। এ ধারার আমূল পরিবর্তন করতে হবে।
রাজধানীর ব্র্যাক সেন্টার ইনে গতকাল শনিবার বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) সম্মেলনের দ্বিতীয় দিনে ‘অভ্যুত্থান-পরবর্তী বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক রাজনীতি’ শীর্ষক একটি অধিবেশনে এসব কথা বলেন বক্তারা। গবেষণা সংস্থা সিপিডির সম্মাননীয় ফেলো অধ্যাপক রওনক জাহানের সভাপতিত্বে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন গবেষণা প্রতিষ্ঠান বিআইজিডির সিনিয়র রিসার্চ ফেলো ড. মির্জা এম হাসান।
আলোচনায় অংশ নিয়ে সংবিধান সংস্কারে গঠিত কমিশনের প্রধান অধ্যাপক আলী রীয়াজ বলেন, বর্তমান সংবিধানে প্রধানমন্ত্রীকে তাঁর কাজের জন্য জবাবদিহির আওতায় আনার কোনো ব্যবস্থা নেই। এতে প্রধানমন্ত্রীর স্বেচ্ছাচারী হয়ে ওঠার যথেষ্ট সুযোগ আছে। সংবিধান সংস্কারের প্রস্তাবে প্রধানমন্ত্রীর জবাবদিহি নিশ্চিতের প্রবিধান সংযুক্ত করা হবে।
আলী রীয়াজ বলেন, সংবিধান সংস্কারের ক্ষেত্রে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে প্রতিষ্ঠান শক্তিশালী করে তোলার ওপর। বিগত সরকারের সময়ে দেশের গণতান্ত্রিক ও রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে চরমভাবে দুর্বল করে ফেলা হয়, যা প্রধানমন্ত্রীকে কর্তৃত্ববাদী হওয়ার পথ প্রশস্ত করে। ভবিষ্যতে যাতে এমন ধারার পুনরাবৃত্তি না হয়, সেজন্য সংবিধানে বিশেষ অনুচ্ছেদ যুক্ত করার প্রস্তাব করা হয়েছে।
আলী রীয়াজ আরও বলেন, জুলাই-আগস্ট গণঅভ্যুত্থাকে কেউ কেউ ‘বিপ্লব’ বলেন। আদতে এটা বিপ্লব ছিল না। বিপ্লব হলে বিভিন্ন কমিশন গঠন করার দরকার হতো না। তিনি উল্লেখ করেন, সংবিধান সংস্কার কমিশন তাদের প্রস্তাব দিয়েছে। এখন রাজনৈতিক দলগুলোর ওপর নির্ভর করবে তারা কতটুকু গ্রহণ করবে।
সিপিডির চেয়ারম্যান অধ্যাপক রেহমান সোবহান বলেন, অতীতের ক্ষমতার চর্চা ছিল অর্থের ও ক্ষমতা কুক্ষিগত করে রাখার জন্য। আদর্শের চর্চার প্রভাব খুব একটা ছিল না। জাতীয় সংসদের প্রধান থেকে শুরু করে ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য পর্যন্ত সবাইকে এ ধারায় চলতে দেখা গেছে। আওয়ামী লীগ চলে গেলেও সেই টাকার প্রভাবের শূন্যতা পূরণ হয়ে যাচ্ছে।
তিনি বলেন, দাবি আদায় করতে লোক জড়ো করা এবং সহিংসতা রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এখান থেকে বের হওয়ার রাস্তা খুঁজতে হবে।
অধ্যাপক রওনক জাহান বলেন, সবাই সংস্কার চান। তবে কী সংস্কার চান, তা সুস্পষ্ট করা উচিত। সংস্কার কেবল আইনের পরিবর্তনের মধ্যে আটকে থাকলে হবে না। আইন অনেক আছে। সমস্যা রাজনৈতিক চর্চার। বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার রাষ্ট্র ব্যবস্থায় অনেকগুলো সংস্কারের জন্য কাজ করছে। এরই মধ্যে অনেক সংস্কার প্রস্তাবও এসেছে। তবে সংস্কার প্রস্তাবের অনেকগুলো আইন পরিবর্তনের জন্য। সত্যিকার অর্থে, গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে চাইলে জনগণকে সিদ্ধান্ত গ্রহণের মূল ভূমিকা রাখতে হবে।
তিনি বলেন, রাজনৈতিক চর্চার পরিবর্তনের জন্য অন্তর্বর্তী নির্দলীয় সরকার ব্যবস্থা চালু করা হয়েছিল। কিন্তু সেই সরকার ব্যবস্থাকেও রাজনীতিকীকরণ করা হয়েছিল। রাষ্ট্রক্ষমতাকে ব্যবহার করে ক্ষমতা ধরে রাখার চর্চাও দেখা গেছে। প্রতিবছর সম্পদের হিসাব প্রকাশ করবে– ‘দিন বদলের’ কথা বলে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় এসে সে প্রতিশ্রুতি রাখেনি। কীভাবে মানুষ এটা বিশ্বাস করবে, রাজনৈতিক দলগুলো যে প্রতিশ্রুতি দিয়ে ক্ষমতায় আসছে, সেই প্রতিশ্রুতি রাখবে।
সিনিয়র আইনজীবী ব্যারিস্টার সারা হোসেন বলেন, বিগত সরকারের সময়ও অনেক কথা বলা হয়েছে। কিন্তু ওই কথা শোনার বা শুনে তা আমলে নিয়ে কাজ করা হয়নি। সংবিধান সংশোধনের কথা হচ্ছে। এটা করতে হলে তা কীভাবে যুগোপযোগী হয়, তা নিয়ে ভাবতে হবে।
৫৩ বছরে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়ন হয়নি এবং এ কারণে নব্বই বা চব্বিশে গণঅভ্যুত্থান হয়েছে বলে মত দেন সিপিবির সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স। তিনি বলেন, সমাজ ও রাষ্ট্র ব্যবস্থার গভীরে বৈষম্য রয়ে গেছে। মানুষ শান্তি চায়, ভয়ের পরিবেশে বাঁচতে চায় না। তারা চায় সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে তাদের কথা শোনা হোক। স্থানীয় সরকার ব্যবস্থাকে জবাবদিহি করার ব্যবস্থার মধ্য দিয়ে জনগণের মতকে প্রতিষ্ঠা করার পথে এগোনো সহজ হতে পারে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজের অধ্যাপক ড. আসিফ শাহান বলেন, অর্গানাইজেশন এবং ইনস্টিটিউশনের মধ্যকার পার্থক্য করতে হবে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কার্যক্রমকে জবাবদিহির আওতায় আনতে হবে কঠোরভাবে।
জাতীয় নাগরিক কমিটির সহআহ্বায়ক সারোয়ার তুষার বলেন, অতীতের সরকার ব্যবস্থায় মানুষের কথা শোনার কোনো ব্যবস্থা ছিল না। প্রধান রাজনৈতিক দলগুলো যে প্রতিশ্রুতি দিয়ে ক্ষমতায় এসেছিল, তারা সে প্রতিশ্রুতি রাখেনি।
তিনি বলেন, জুলাই গণঅভ্যুত্থানের আগে সুষ্ঠু নির্বাচনই ছিল মানুষের প্রধান আকাঙ্ক্ষা। কিন্তু গণঅভ্যুত্থানের পর মানুষের আকাঙ্ক্ষা কেবল নির্বাচনে আটকে নেই। অতীতের সরকার ব্যবস্থাগুলোতে দেখা গেছে, সর্বোচ্চ ৪০ শতাংশ মানুষের ভোট নিয়ে সংসদে দুই-তৃতীয়াংশের বেশি আসন পেয়েছিল এবং তারা সংবিধান বদলের অধিকার পেয়ে ইচ্ছামতো পরিবর্তন করেছে। নতুন বাংলাদেশের মানুষ এর বদল চান। কেবল ক্ষমতার পালাবদল করে দিতে এ গণঅভ্যুত্থান হয়নি।
বিএনপিসহ প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর দ্রুত নির্বাচন আয়োজনের দাবি বিষয়ে সারোয়ার তুষার বলেন, তারা হয়তো সংস্কার চায় না। তিনি উল্লেখ করেন, জনগণের মতামতকে গুরুত্ব দিতে হলে স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করতে হবে। এখন স্থানীয় সরকার ব্যবস্থার নামে আছে স্থানীয় প্রশাসন ব্যবস্থা। এর বদল করতে হবে।
বক্তারা আরও বলেন, নিজেদের পক্ষে কথা বলার জন্য রাষ্ট্র ব্যবস্থায় প্রতিনিধি পাঠানোর পর যদি জনগণ দেখেন তাদের পক্ষে ওই প্রতিনিধি কথা বলছেন না, তাহলে তাকে ফেরত নেওয়ার ব্যবস্থাও থাকা উচিত। রাজনৈতিকগুলো গণতন্ত্রের কথা বললেও নিজেরা গণতন্ত্রের চর্চা করে না। মুখে জনগণই সব ক্ষমতা উৎস– এমনটা বললেও সংসদে নিজ দলের বিরুদ্ধেই কথা বলতে পারে না।