রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ হইতে নিষ্কৃতি চাহিয়া বিভাগীয় কমিশনার ও জেলা প্রশাসকগণ প্রধান উপদেষ্টার নিকট যেই আবেদন জানাইয়াছেন, উহাকে স্বাগত জানানোই সংগত ছিল। রবিবার হইতে প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ে তিন দিনের সম্মেলনের প্রথম দিনেই প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সহিত মুক্ত আলোচনায় জেলা প্রশাসকগণের উক্ত আবেদন সমর্থন না করিবার কী কারণ থাকিতে পারে? এই জন্য সুনির্দিষ্ট নীতিমালা প্রণয়ন ও সংস্কার তাহারা চাহিয়াছেন। কিন্তু প্রশ্ন হইতেছে, রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ কি যাচিয়া আসিয়াছিল? নাকি জেলা প্রশাসকগণই ক্রমান্বয়ে এইরূপ হস্তক্ষেপ অনিবার্য করিয়া তুলিয়াছিলেন? বাংলা প্রবাদ মানিয়া এক্ষণে কম্বল ছাড়িতে চাহিলেই কি কম্বল সহজে ছাড়িয়া যাইতে পারে? 

বস্তুত জনপ্রশাসনে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ নূতন নহে। স্বাধীনতার পর গত ৫৩ বৎসরে যেই দলই ক্ষমতাসীন হইয়াছে, সেই দলই প্রশাসনের সর্বস্তরে পদায়নের ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তার দলীয় আনুগত্যকে প্রাধান্য দিয়াছে। বিষয়টি বিপরীত দিক হইতে দেখিলে, নূতন সরকার ক্ষমতাসীন হইবার অব্যবহিত পরই আমলাদিগের একটি অংশ দলীয় আনুগত্য প্রকাশ ও যথাস্থানে সেই বার্তা পৌঁছাইয়া দিতে অতিউৎসাহী হইয়াছে। পারস্পরিক এই প্রবণতার বলি হইয়াছে প্রধানত সুশাসন এবং কর্মকর্তাদের কর্মদক্ষতা ও সেবা প্রদানের মানসিকতা। বিশেষত গত দেড় দশকে শীর্ষ হইতে মাঠ পর্যায়ে প্রশাসনের উক্ত চর্চা অতীতের সকল রেকর্ড অতিক্রম করিয়াছিল। উল্লিখিত সরকারের আমলে একদিকে বালুমহাল, হাটবাজার ইজারা, সরকারি সম্পত্তি দখলসহ বিবিধ খাতে টাকার অবৈধ লেনদেন মহামারির রূপ ধারণ করে। অপরদিকে প্রশাসন হয় তাহা উপেক্ষা করে নতুবা উহাতে যোগসাজশে লিপ্ত হয়। বল্গাহীন এই দলীয়করণের ফসলরূপেই আমরা তখন স্থানীয় ও জাতীয় নির্বাচনসহ সর্বক্ষেত্রে জাল-জালিয়াতির প্রশ্নে সরকারি কর্মকর্তা ও রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দকে একাকার হইতে দেখি। গত বৎসরের জুলাই-আগস্ট আন্দোলনের ধাক্কায় সেই সরকারটির তাসের ঘরের ন্যায় ভাঙিয়া পড়িবার পশ্চাতেও যে জনপ্রশাসনের সেই অভ্যন্তরীণ শৃঙ্খলা ও পেশাদারিত্বহীনতার বড় ভূমিকা ছিল– ইহা অস্বীকার করা যায় না। ঐ তিক্ত অভিজ্ঞতার পুনরাবৃত্তি রোধেই সম্ভবত জেলা প্রশাসকগণ আলোচ্য আবেদনটি রাখিয়াছেন।

দুর্ভাগ্যবশত, জনপ্রশাসনে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ বর্তমানেও অব্যাহত। অন্তত জেলা প্রশাসক সম্মেলনে অংশগ্রহণকারীদের বক্তব্য সেই কথাই তুলিয়া ধরিতেছে। প্রতিবেদনমতে, প্রায় সকল বিভাগীয় কমিশনার বলিয়াছেন, ৫ আগস্টের পর মাঠ প্রশাসন পারস্পরিক সমন্বয়ের মাধ্যমে কার্য করিলেও রাজনৈতিক শক্তির কারণে মাঠে কার্যের গতি ধীর। সম্মেলনে এই বক্তব্যও আসিয়াছে, বিগত সরকারের পতনের পর লুক্কায়িত প্রভাবশালী আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দের নামে ইজারাকৃত বালুমহাল হস্তগত করিয়াছেন বিএনপি নেতৃবৃন্দ। রাজনৈতিক চাপের কারণে প্রশাসন এই ক্ষেত্রে যথাযথ ভূমিকা রাখিতে পারিতেছেন না। শুধু উহাই নহে, বিভিন্ন নামে বিচ্ছৃঙ্খল জনতা রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে একাদিক্রমে অঘটন ঘটাইয়া চলিতেছে। এই সকল বিশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে পুলিশ ও প্রশাসন ব্যর্থতার পরিচয় দিয়াছে। প্রধান উপদেষ্টাসহ উপদেষ্টামণ্ডলীর একাধিক সদস্যের হুঁশিয়ারি এবং বিশিষ্ট নাগরিকবৃন্দের বিবৃতি প্রদানের পরও পরিস্থিতির ইতরবিশেষ হইতেছে না।
জেলা প্রশাসকগণের ন্যায় আমরাও মনে করি, শিক্ষার্থী-জনতার বহু ত্যাগ-তিতিক্ষার ফসল বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারকে সফল হইতে হইলে জনপ্রশাসনে রাজনৈতিক শক্তির চাপ দ্রুত হ্রাস করিতে হইবে। উপরন্তু, সংস্কারের মাধ্যমে তাহাদের এমন ব্যবস্থা রাখিয়া যাইতে হইবে যাহাতে মাঠ প্রশাসনের কর্মকর্তাবৃন্দ স্বাধীনভাবে কার্য চালাইতে পারেন। স্মরণে রাখিতে হইবে, পেশাদারিত্ব বজায় রাখিয়া প্রশাসনের কর্মকর্তাবৃন্দ স্বাধীনভাবে কার্য করিতে না পারিলে রাষ্ট্রের অগ্রগতিই শুধু ব্যাহত হইবে না, ব্যর্থতার কলঙ্কতিলকও ইহাকে পরিতে হইতে পারে। প্রশ্ন হইতেছে, জেলা প্রশাসকগণ রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ হইতে মুক্তি চাহিলেও রাজনীতি তাহাদের মুক্তি দিতে কতখানি প্রস্তুত?

.

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: সরক র

এছাড়াও পড়ুন:

জনগণের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হউক

আজ আমাদের ৫৫তম স্বাধীনতা দিবস। পাকিস্তানি প্রায়-ঔপনিবেশিক শাসন-শোষণবিরোধী ২৩ বৎসরের সংগ্রামের ধারাবাহিকতায়, বিশেষত ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ নিরীহ বাঙালির উপর পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী পরিচালিত বর্বর হত্যাযজ্ঞের প্রেক্ষাপটে, একই বৎসরের এই দিনে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করা হয়। ইহার ধারাবাহিকতায় প্রায় ৯ মাসব্যাপী সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে ৩০ লক্ষ মানুষের শহীদি আত্মদান এবং দুই লক্ষাধিক নারীর অপরিসীম নির্যাতন ভোগের বিনিময়ে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্ররূপে বাংলাদেশ উচ্চ শিরে আপন অস্তিত্ব ঘোষণা করে বিশ্ব-মানচিত্রে। এই দিনে আমরা গভীর শ্রদ্ধার সহিত স্মরণ করি মুক্তিযুদ্ধের সকল শহীদ, যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা, সম্ভ্রমহারা মাতা-ভগিনি এবং স্বজন হারানো পরিবারসমূহকে। মুক্তিযুদ্ধের অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক জাতীয় নেতৃবৃন্দ, সকল সেক্টর কমান্ডারসহ রণাঙ্গনের মুক্তিযোদ্ধাদের। তাহাদের ঋণ আমরা কোনোদিন ভুলিতে পারিব না। 

ইহা অনস্বীকার্য, বিশেষ কিছু মহল ব্যতীত জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে এই ভূখণ্ডের সকলেই ঐ যুদ্ধে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে অংশগ্রহণ করিয়াছিলেন। মুক্তিযুদ্ধে আমাদের প্রধান লক্ষ্য ছিল, এই দেশের ভালো-মন্দের সিদ্ধান্ত আমরা নিজেরাই গ্রহণ করিব। আমাদের ভাগ্য আমরাই গড়িব। পাশাপাশি আমাদের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে উল্লিখিত সকলের জন্য সাম্য, সামাজিক ন্যায়বিচার ও মানবিক মর্যাদা নিশ্চিতকরণের প্রতিশ্রুতিও বিস্মৃত হইলে চলিবে না। তদনুযায়ী আমাদের স্বাধীনতার ৫৪তম এই বার্ষিকীতে সকল স্বপ্ন ও বাস্তবতার সংগতি-অসংগতি লইয়া আলোচনাও গুরুত্বপূর্ণ।

ইহা সত্য, গত ৫৪ বৎসরে বিভিন্ন সরকারের প্রচেষ্টায় বাংলাদেশ দারিদ্র্যমুক্তিতে উল্লেখযোগ্য সাফল্য অর্জন করিয়াছে। জাতিসংঘ স্বীকৃত নানা মানবউন্নয়ন সূচকেও অনুরূপ সাফল্যের প্রকাশ স্পষ্ট। উহারই প্রমাণস্বরূপ, আমরা ইতোমধ্যে জাতিসংঘ স্বীকৃত উন্নয়নশীল দেশের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হইয়াছি, যাহা আগামী বৎসরই স্থায়ী রূপ পাইবে বলিয়া আমরা সকলে জ্ঞাত। তবে ইহাও সত্য, উক্ত সময়ে বিশেষত ধনী-দরিদ্রের বৈষম্য উদ্বেগজনকরূপে প্রকট। দ্রুত কার্যকর ব্যবস্থা না গৃহীত হইলে তাহা রাষ্ট্র ও সমাজকে দীর্ঘ মেয়াদে অনাকাঙ্ক্ষিত অস্থিরতায় নিমজ্জিত করিতে পারে। বিশেষত বিগত সরকারের সময়ে বিপুল অঙ্কের অর্থ পাচার, খেলাপি ঋণসহ ব্যাংক খাতে যেই অরাজকতা চলিয়াছে, উহার ক্ষত এখনও শুকায় নাই। ঊচ্চহারের মূল্যস্ফীতি, বিনিয়োগ প্রবাহে ভাটা, বেকারত্ব ইত্যাদি এই সময়ের বিশেষ শঙ্কার বিষয়। শত শত প্রাণের বিনিময়ে সংঘটিত গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে আমরা বিগত সরকারের কবল হইতে মুক্ত হইয়াছি বটে, কিন্তু জানমালের নিরাপত্তার প্রশ্নটি অদ্যাবধি জনপরিসরে বৃহৎ উদ্বেগ ছড়াইয়া চলিয়াছে। আমাদের রাজনীতি যেই দোষারোপ ও সংঘর্ষের বৃত্তে আটকা পড়িয়াছিল, উহা হইতেও মুক্তি মিলিয়াছে, বলা যায় না। আমরা দেখিয়াছি, ঐ রাজনীতির ফলস্বরূপ গণতন্ত্র সংহত হইবার পরিবর্তে বিগত দিনগুলিতে ক্রমশ সংকুচিত হইয়াছে। বাক-ব্যক্তি স্বাধীনতা এবং সংবিধান স্বীকৃত অন্যান্য নাগরিক অধিকারের পরিসর ক্রমশ সংকীর্ণ হইয়াছে। রাজনীতি ও সমাজে সাম্প্রদায়িকতা বেশ জাঁকিয়া বসিয়াছিল। এই সকল কিছুই সাম্য, সামাজিক ন্যায়বিচার ও মানবিক মর্যাদাবিরোধী। তাই গণঅভ্যুত্থান-পরবর্তী সময়ে রাষ্ট্র সংস্কারের বিষয় বেশ প্রাধান্য পাইয়াছে।

তবে ইহাও স্বীকার্য, দেশে একটি কার্যকর নির্বাচন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করিতে না পারা বিগত ৫৪ বৎসরে অন্যতম বৃহৎ ব্যর্থতা। জনগণের শাসন নিশ্চিতকরণের ক্ষেত্রে একমাত্র ব্যবস্থা হইল নিয়মিত বিরতিতে অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠান। ইতিহাস সাক্ষী– কেবল নির্বাচিত সরকারের সময়েই এই দেশে সার্বিক উন্নয়ন ঘটিয়াছে। বিগত সরকার জবরদস্তিমূলক ক্ষমতা ধরিয়া রাখিতে গিয়া দেশে নির্বাচন ব্যবস্থাকে যেইভাবে ধ্বংস করিয়া দিয়াছে, উহা নজিরবিহীন। আমরা মনে করি, ঐ বিধ্বংসী ধারা হইতে দেশকে বাহির করিয়া আনা বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের অন্যতম প্রধান দায়িত্ব। রাষ্ট্রের উপর সর্বার্থে জনগণের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার স্বার্থে একটা কার্যকর নির্বাচন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা সময়ের দাবি। অদ্যকার স্বাধীনতা দিবসে সরকার উক্ত বিষয়কে প্রাধান্য দিয়া সকল কর্মসূচির বিন্যাস করিবে– ইহাই আমাদের প্রত্যাশা।

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • জনগণের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হউক