কম্বল ছাড়িতে চাহিলেও কম্বল কি ছাড়িবে?
Published: 17th, February 2025 GMT
রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ হইতে নিষ্কৃতি চাহিয়া বিভাগীয় কমিশনার ও জেলা প্রশাসকগণ প্রধান উপদেষ্টার নিকট যেই আবেদন জানাইয়াছেন, উহাকে স্বাগত জানানোই সংগত ছিল। রবিবার হইতে প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ে তিন দিনের সম্মেলনের প্রথম দিনেই প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সহিত মুক্ত আলোচনায় জেলা প্রশাসকগণের উক্ত আবেদন সমর্থন না করিবার কী কারণ থাকিতে পারে? এই জন্য সুনির্দিষ্ট নীতিমালা প্রণয়ন ও সংস্কার তাহারা চাহিয়াছেন। কিন্তু প্রশ্ন হইতেছে, রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ কি যাচিয়া আসিয়াছিল? নাকি জেলা প্রশাসকগণই ক্রমান্বয়ে এইরূপ হস্তক্ষেপ অনিবার্য করিয়া তুলিয়াছিলেন? বাংলা প্রবাদ মানিয়া এক্ষণে কম্বল ছাড়িতে চাহিলেই কি কম্বল সহজে ছাড়িয়া যাইতে পারে?
বস্তুত জনপ্রশাসনে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ নূতন নহে। স্বাধীনতার পর গত ৫৩ বৎসরে যেই দলই ক্ষমতাসীন হইয়াছে, সেই দলই প্রশাসনের সর্বস্তরে পদায়নের ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তার দলীয় আনুগত্যকে প্রাধান্য দিয়াছে। বিষয়টি বিপরীত দিক হইতে দেখিলে, নূতন সরকার ক্ষমতাসীন হইবার অব্যবহিত পরই আমলাদিগের একটি অংশ দলীয় আনুগত্য প্রকাশ ও যথাস্থানে সেই বার্তা পৌঁছাইয়া দিতে অতিউৎসাহী হইয়াছে। পারস্পরিক এই প্রবণতার বলি হইয়াছে প্রধানত সুশাসন এবং কর্মকর্তাদের কর্মদক্ষতা ও সেবা প্রদানের মানসিকতা। বিশেষত গত দেড় দশকে শীর্ষ হইতে মাঠ পর্যায়ে প্রশাসনের উক্ত চর্চা অতীতের সকল রেকর্ড অতিক্রম করিয়াছিল। উল্লিখিত সরকারের আমলে একদিকে বালুমহাল, হাটবাজার ইজারা, সরকারি সম্পত্তি দখলসহ বিবিধ খাতে টাকার অবৈধ লেনদেন মহামারির রূপ ধারণ করে। অপরদিকে প্রশাসন হয় তাহা উপেক্ষা করে নতুবা উহাতে যোগসাজশে লিপ্ত হয়। বল্গাহীন এই দলীয়করণের ফসলরূপেই আমরা তখন স্থানীয় ও জাতীয় নির্বাচনসহ সর্বক্ষেত্রে জাল-জালিয়াতির প্রশ্নে সরকারি কর্মকর্তা ও রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দকে একাকার হইতে দেখি। গত বৎসরের জুলাই-আগস্ট আন্দোলনের ধাক্কায় সেই সরকারটির তাসের ঘরের ন্যায় ভাঙিয়া পড়িবার পশ্চাতেও যে জনপ্রশাসনের সেই অভ্যন্তরীণ শৃঙ্খলা ও পেশাদারিত্বহীনতার বড় ভূমিকা ছিল– ইহা অস্বীকার করা যায় না। ঐ তিক্ত অভিজ্ঞতার পুনরাবৃত্তি রোধেই সম্ভবত জেলা প্রশাসকগণ আলোচ্য আবেদনটি রাখিয়াছেন।
দুর্ভাগ্যবশত, জনপ্রশাসনে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ বর্তমানেও অব্যাহত। অন্তত জেলা প্রশাসক সম্মেলনে অংশগ্রহণকারীদের বক্তব্য সেই কথাই তুলিয়া ধরিতেছে। প্রতিবেদনমতে, প্রায় সকল বিভাগীয় কমিশনার বলিয়াছেন, ৫ আগস্টের পর মাঠ প্রশাসন পারস্পরিক সমন্বয়ের মাধ্যমে কার্য করিলেও রাজনৈতিক শক্তির কারণে মাঠে কার্যের গতি ধীর। সম্মেলনে এই বক্তব্যও আসিয়াছে, বিগত সরকারের পতনের পর লুক্কায়িত প্রভাবশালী আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দের নামে ইজারাকৃত বালুমহাল হস্তগত করিয়াছেন বিএনপি নেতৃবৃন্দ। রাজনৈতিক চাপের কারণে প্রশাসন এই ক্ষেত্রে যথাযথ ভূমিকা রাখিতে পারিতেছেন না। শুধু উহাই নহে, বিভিন্ন নামে বিচ্ছৃঙ্খল জনতা রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে একাদিক্রমে অঘটন ঘটাইয়া চলিতেছে। এই সকল বিশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে পুলিশ ও প্রশাসন ব্যর্থতার পরিচয় দিয়াছে। প্রধান উপদেষ্টাসহ উপদেষ্টামণ্ডলীর একাধিক সদস্যের হুঁশিয়ারি এবং বিশিষ্ট নাগরিকবৃন্দের বিবৃতি প্রদানের পরও পরিস্থিতির ইতরবিশেষ হইতেছে না।
জেলা প্রশাসকগণের ন্যায় আমরাও মনে করি, শিক্ষার্থী-জনতার বহু ত্যাগ-তিতিক্ষার ফসল বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারকে সফল হইতে হইলে জনপ্রশাসনে রাজনৈতিক শক্তির চাপ দ্রুত হ্রাস করিতে হইবে। উপরন্তু, সংস্কারের মাধ্যমে তাহাদের এমন ব্যবস্থা রাখিয়া যাইতে হইবে যাহাতে মাঠ প্রশাসনের কর্মকর্তাবৃন্দ স্বাধীনভাবে কার্য চালাইতে পারেন। স্মরণে রাখিতে হইবে, পেশাদারিত্ব বজায় রাখিয়া প্রশাসনের কর্মকর্তাবৃন্দ স্বাধীনভাবে কার্য করিতে না পারিলে রাষ্ট্রের অগ্রগতিই শুধু ব্যাহত হইবে না, ব্যর্থতার কলঙ্কতিলকও ইহাকে পরিতে হইতে পারে। প্রশ্ন হইতেছে, জেলা প্রশাসকগণ রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ হইতে মুক্তি চাহিলেও রাজনীতি তাহাদের মুক্তি দিতে কতখানি প্রস্তুত?
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: সরক র
এছাড়াও পড়ুন:
৫ দফা দাবিতে রংপুরের মেডিকেল শিক্ষার্থীদের ‘কমপ্লিট শাটডাউন’, সড়ক অবরোধ
এমবিবিএস ও বিডিএস ছাড়া চিকিৎসকের স্বীকৃতি দেওয়া বন্ধসহ ৫ দফা দাবিতে রংপুরে ক্লাস-পরীক্ষা বর্জনের পাশাপাশি সড়ক অবরোধ করে ‘কমপ্লিট শাটডাউন’ কর্মসূচি পালন করেছেন সরকারি ও বেসরকারি মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থীরা। এতে রংপুর-দিনাজপুর মহাসড়কে যানবাহন চলাচল বন্ধ হয়ে তাৎক্ষণিকভাবে ভোগান্তিতে পড়েন যাত্রী, চালক ও সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। একই দাবিতে ইন্টার্ন চিকিৎসকেরাও কর্মবিরতিতে আছেন।
আজ শনিবার বেলা সাড়ে ১১টার দিকে রংপুর মেডিকেল কলেজ গেট থেকে বিক্ষোভ মিছিল নিয়ে শহীদ মুখতার ইলাহী চত্বরে (মেডিকেল মোড়) সড়ক অবরোধ করেন শিক্ষার্থীরা। এ কর্মসূচিতে রংপুর মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থীরা ছাড়াও রংপুর কমিউনিটি মেডিকেল কলেজ, প্রাইম মেডিকেল কলেজ, রংপুর আর্মি মেডিকেল কলেজের কয়েক শ শিক্ষার্থী অংশ নেন। এক ঘণ্টার সড়ক অবরোধ শেষে দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে তাঁরা রংপুর মেডিকেল কলেজের ভেতর পথসভা করেন। পরে মহাসড়কটিতে যান চলাচল স্বাভাবিক হতে শুরু করে।
আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা জানান, একই দাবিতে ১৭, ১৮ ও ১৯ ফেব্রুয়ারি এই তিন দিন ধারাবাহিক বিক্ষোভ মিছিল ও পথসভা করেছেন তাঁরা। ২০ ফেব্রুয়ারি থেকে ইন্টার্ন চিকিৎসকদের কর্মবিরতি ও শিক্ষার্থীরা ক্লাস ও পরীক্ষা বর্জন করছেন। এসব দাবি মেনে না নেওয়া পর্যন্ত কর্মসূচি অব্যাহত থাকবে।
রংপুর মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থী আবু রায়হান প্রথম আলোকে জানান, ৫ দফা দাবিতে তাঁরা ‘কমপ্লিট শাটডাউন’ কর্মসূচি পালন করেছেন। তাঁরা আন্দোলন করছেন যাতে মানুষের সঙ্গে স্বাস্থ্য নিয়ে প্রতারণা করা না হয়। দেড় বছর বা ৬ মাসের একটি প্রশিক্ষণ নিয়ে কেউ চিকিৎসক লিখে মানুষের সঙ্গে যাতে প্রতারণা করতে না পারে।
শিক্ষার্থীদের পাঁচ দফা দাবি হলো,
১. এমবিবিএস/বিডিএস ব্যতীত কেউ চিকিৎসক লিখতে পারবে না। বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিলের (বিএমডিসি) বিরুদ্ধে করা রিট ৭২ ঘণ্টার মধ্যে প্রত্যাহার করতে হবে। বিএমডিসি নিবন্ধন শুধু এমবিবিএস/বিডিএস ডিগ্রিধারীদের দিতে হবে। ২০১০ সাল থেকে হাসিনা সরকার ম্যাটসদের (মেডিকেল অ্যাসিস্ট্যান্ট ট্রেনিং স্কুল) বিএমডিসি থেকে নিবন্ধন দেওয়া শুরু করেছে। এই ম্যাটসদের বিএমডিসি থেকে নিবন্ধন দেওয়া অবিলম্বে বন্ধ করতে হবে।
২. উন্নত বিশ্বের চিকিৎসাব্যবস্থার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ ওভার দ্য কাউন্টার বা ওটিসি ড্রাগ লিস্ট আপডেট করতে হবে। এমবিবিএস বা বিডিএস ছাড়া অন্য কেউ ওটিসি লিস্টের বাইরের ওষুধ প্রেসক্রাইব করতে পারবে না। রেজিস্টার্ড চিকিৎসকের প্রেসক্রিপশন ছাড়া ফার্মেসিগুলো ওটিসি লিস্টের বাইরের কোনো ওষুধ বিক্রি করতে পারবে না।
৩. স্বাস্থ্য খাতে চিকিৎসকের সংকট নিরসনে দ্রুত ১০ হাজার চিকিৎসক নিয়োগ দিয়ে সব শূন্য পদ পূরণ করতে হবে। আলাদা স্বাস্থ্য কমিশন গঠন করে আগের মতো সপ্তম গ্রেডে নিয়োগ দিতে হবে। প্রতিবছর ৪-৫ হাজার চিকিৎসক নিয়োগ দিয়ে স্বাস্থ্য খাতের ভারসাম্য বজায় রাখতে হবে। চিকিৎসকদের বিসিএসে বয়সসীমা ৩৪ বছর করতে হবে।
৪. সব মেডিকেল অ্যাসিস্ট্যান্ট স্কুল (ম্যাটস) ও মানহীন সরকারি ও বেসরকারি মেডিকেল কলেজগুলো বন্ধ করতে হবে। ইতিমধ্যে পাস করা ম্যাটস শিক্ষার্থীদের উপসহকারী কমিউনিটি মেডিকেল অফিসার (স্যাকমো) পদবি রহিত করে মেডিকেল অ্যাসিস্ট্যান্ট হিসেবে নিয়োগের ব্যবস্থা করতে হবে।
৫. চিকিৎসক সুরক্ষা আইন বাস্তবায়ন করতে হবে।