অধ্যাপক ড. তুহিন ওয়াদুদ বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক। নদী রক্ষাবিষয়ক সংগঠন রিভারাইন পিপলের প্রতিষ্ঠাকালীন সিনেটর এবং বর্তমানে পরিচালক। প্রায় ১৫ বছর ধরে তিস্তাসহ দেশের সব নদী নিয়ে মাঠ পর্যায়ে কাজ করেন। নদী বিষয়ে নিয়মিত কলাম লিখছেন ১৫ বছর ধরে। নদীবিষয়ক তাঁর দুটি বই ‘নদী সুরক্ষায় দায়িত্বশীলতা’, ‘রংপুর অঞ্চলের নদনদী’। তাঁর নেতৃত্বে গড়ে ওঠা আন্দোলনে কয়েকটি নদী অবৈধ দখলদারদের হাত থেকে মুক্ত হয়েছে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সমকালের জ্যেষ্ঠ সহসম্পাদক মাহফুজুর রহমান মানিক।

সমকাল: সম্প্রতি আপনি লিখেছেন, ‘তিস্তা মহাপরিকল্পনার নামে ছেলে ভোলানোর গল্প আর কত দিন?’ এর পর সেখানে সরকারের দু’জন উপদেষ্টা সফর করে এ ব্যাপারে যে আশ্বাস দিয়েছেন, তাতে কতটা আশাবাদী হওয়া যায়?

তুহিন ওয়াদুদ: দেখুন, তিস্তা নিয়ে যে কোনো প্রতিশ্রুতির ওপর তিস্তাপারের মানুষের তেমন আস্থা নেই। আমরা যখন তিস্তাপারে মানুষের দুঃখ-কষ্টের আলাপ করতে যাই, তারা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেন– ‘তিস্তা নদীর কাম কি হইবে বাহে? মনে হয় হবার নয়।’ সে কারণে আমি লিখেছি– ‘তিস্তা মহাপরিকল্পনার নামে ছেলে ভোলানোর গল্প আর কত দিন?’ অন্তর্বর্তী সরকারের পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান এবং স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া তিস্তাপারের গণশুনানি সমাবেশে এসেছিলেন। ওই দিন একজন কৃষক দুই উপদেষ্টার উদ্দেশে বলেন– ‘এবার হামাক ঠকান না বাহে!’ এ কথাটি বেশ সাড়া ফেলেছে। এটিই তিস্তাপারের মানুষের মনের কথা। ফলে দু’জন উপদেষ্টা সুনির্দিষ্ট কার্যপরিকল্পনার প্রতিশ্রুতি দিলেও সাধারণ মানুষের মধ্যে দীর্ঘদিনে তৈরি হওয়া অবিশ্বাস আর অনাস্থা দূর হয়নি। তবে সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান ভাঙন বন্ধে কাজ শুরুর নির্দেশ জারি করার কথা বলেছেন।

সমকাল: তিস্তা মহাপরিকল্পনা এতদিন ঝুলে থাকার কারণ কী বলে মনে হয় আপনার?

তুহিন ওয়াদুদ: তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়িত না হওয়ার দুটি প্রধান কারণ– প্রথমত, সদিচ্ছার অভাব। দ্বিতীয়ত, রংপুর অঞ্চলের প্রতি চরম বৈষম্যমূলক আচরণ। ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকার সারাদেশে ৩ লাখ কোটি টাকার মেগা প্রকল্প যখন হাতে নিয়েছিল, তখন রংপুর বিভাগের জন্য কোনো মেগা প্রকল্প গ্রহণ করেনি। তিস্তা মহাপরিকল্পনা হতে পারত এ অঞ্চলের মেগা প্রকল্প। তিস্তা নদীতে প্রতিবছর ভাঙন ও বন্যার ক্ষতি অর্থমূল্যে পরিমাপ করা অসম্ভব। তারপরও বছরে আর্থিক ক্ষতি প্রায় ১ লাখ কোটি টাকা। অথচ তিন বছর মেয়াদি মহাপরিকল্পনা গ্রহণ করলে বছরে ৩ হাজার কোটি টাকা, অর্থাৎ মোট ৯ হাজার কোটি টাকায় তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা সম্ভব হতো। মাত্র ৯ হাজার কোটি টাকা যে লাখ লাখ কোটি টাকার সুরক্ষা দিতে পারত, এটি সরকার একবারও ভাবার প্রয়োজন মনে করেনি। ৩ লাখ কোটি টাকার মেগা প্রকল্পে দেশের যে আর্থিক লাভ হবে, এক তিস্তা মহাপরিকল্পনায় তার চেয়ে বেশি আর্থিক লাভ করা সম্ভব। আসলে কোনো সময়ই কোনো সরকার রংপুর অঞ্চলের সমস্যা দূরীকরণে সদিচ্ছা পোষণ করেনি।

সমকাল: ভারতের একতরফা পানি প্রত্যাহারের কারণে শুষ্ক মৌসুমে তিস্তায় পানি না থাকায় উত্তরাঞ্চল মরুভূমি হয়ে যাচ্ছে। বর্ষায়ও সংকট তৈরি হচ্ছে। ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকার তিস্তা মহাপরিকল্পনা ভারতের সঙ্গে করতে চাইলেও তা বাস্তবায়ন হয়নি। এ ক্ষেত্রে ভারতের ভূমিকা কীভাবে দেখেন?

তুহিন ওয়াদুদ: ভারতের একতরফা পানি প্রত্যাহারে নেতিবাচক প্রভাব কেবল শুষ্ক মৌসুমে নয়, বর্ষা মৌসুমেও পড়ছে। এটি যথার্থই বলেছেন। কিন্তু আওয়ামী লীগ সরকার আন্তরিকভাবে তিস্তা মহাপরিকল্পনা করতে চেয়েছে– এটি কখনোই মনে হয়নি। ভারতও ১৯৯৭ সালের আন্তর্জাতিক পানিপ্রবাহ কনভেনশন লঙ্ঘন করে একতরফা তিস্তার পানি প্রত্যাহার করে গেছে। এটি মানবতারও লঙ্ঘন। শুধু নদীর প্রশ্নে নয়; তিস্তার পানি প্রত্যাহার করার কারণে বাংলাদেশ পরিবেশ-প্রতিবেশসহ আর্থিকভাবে ভীষণ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। বাংলাদেশের এত বড় ক্ষতি ভারত করতে পারে না।

সমকাল: ২০১১ সালে তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তি হওয়ার কথা ছিল। এখন পর্যন্ত হচ্ছে না কেন?

তুহিন ওয়াদুদ: তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তি ভারতও যেমন করতে চায়নি, তেমনি বাংলাদেশের পক্ষেও জোরালোভাবে এ দাবি উত্থাপন করা হয়নি। ২০১১ সালের সেপ্টেম্বর মাসের প্রথমার্ধে তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তি চূড়ান্ত হওয়ার কথা ছিল। সে সময়ে ভারতের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং বাংলাদেশে এসেছিলেন। একই সময়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়েরও আসার কথা ছিল। মনমোহন সিং বললেন, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় না আসায় তিস্তা চুক্তি হলো না। এটি আসলে চুক্তি না করার অভিনব কৌশল। ভারতের প্রধানমন্ত্রীও তিস্তা পানি বণ্টন চুক্তি চাননি। এর একটি প্রমাণ উল্লেখ করা যায়, যে বছর তিস্তা পানি বণ্টন চুক্তি হয়নি, ঠিক সেই বছরে কেন্দ্রীয় সরকারপ্রধান মনমোহন সিং পশ্চিমবঙ্গ সরকারকে তাদের তিস্তায় সেচ প্রকল্পের আওতা বৃদ্ধির জন্য প্রচুর টাকা বরাদ্দ দিয়েছিল। এতে বোঝা যায়, ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার তাদের তিস্তা সেচ প্রকল্পের আওতা বৃদ্ধি করতে আগ্রহী, চুক্তি করতে নয়। পশ্চিমবঙ্গ এবং কেন্দ্রের মধ্যে সাজানো খেলার অংশ হিসেবে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তখন বাংলাদেশে আসেননি।

সমকাল: তিস্তাসহ অন্যান্য নদীর ক্ষেত্রে ভারতের অন্যায্য ভূমিকায় বাংলাদেশের করণীয় কী?

তুহিন ওয়াদুদ: নদী প্রসঙ্গে ভারতের অন্যায্য ভূমিকার বিরুদ্ধে বাংলাদেশের শক্ত ও সরব অবস্থান গ্রহণ জরুরি। শুধু তিস্তা নয়; ভারত আরও অনেক নদীতে অশুভ দৃষ্টি ফেলেছে। বাংলাদেশে যে ধরলা নদী, ভারতে এর নাম জলঢাকা। ভারত এ নদীর পানি খাল খনন করে তিস্তায় নেওয়ার কাজ শুরু করেছে। ভারত ধরলা নদীর পানি প্রত্যাহার শুরু করলে তিস্তা ও ধরলার মধ্যবর্তী সানিয়াজান, রত্নাই, সিংগিমারীসহ কয়েকটি আন্তঃসীমান্ত নদীর পানি হারাবে বাংলাদেশ। ফলে সব আন্তঃসীমান্ত নদীর ক্ষেত্রে বাংলাদেশের করণীয় ঠিক করতে হবে। ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের ৫৪টি আন্তঃসীমান্ত নদী আছে, বলা হয়। এটি ঠিক নয়। রিভারাইন পিপল থেকে গবেষণায় আমরা দেখিয়েছি, বাংলাদেশ-ভারত আন্তঃসীমান্ত নদীর সংখ্যা অন্তত ১২৩। এগুলো চিহ্নিত করে যৌথ নদী রক্ষা কমিশন থেকে স্বীকৃত হতে হবে। একই সময়ে ভারতের একতরফা পানি প্রত্যাহার বিষয়ে আপত্তি জানাতে হবে। বিষয়টি নিয়ে জাতিসংঘে প্রতিকার চাওয়া ও আন্তর্জাতিক আদালতে যেতে হবে। এতে ভারতের পানিবিষয়ক আগ্রাসন দুনিয়াবাসী জানবে। সামাজিক একটি চাপ সৃষ্টি হবে। বিশ্ববাসীর কাছে ভারতের পানিশোষক চরিত্র ব্যাপকভাবে তুলে ধরা প্রয়োজন।

সমকাল: ভারতের এক ধরনের অসহযোগিতায় অন্তর্বর্তী সরকার চীনের সঙ্গে তিস্তা মহাপরিকল্পনা নিয়ে যেভাবে এগোচ্ছে, তা আপনি কীভাবে দেখছেন? 

তুহিন ওয়াদুদ: দেখুন, দীর্ঘদিন তিস্তা নদীর সংকট দূরীকরণে আন্দোলন করে আসছি। ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক এতটাই উচ্চ-নিম্ন পর্যায়ের ছিল যে, বাংলাদেশ কখনও ভারতের পানি শোষণ প্রশ্নে ‘টুঁ’ শব্দটি করেনি। ২০১৪ সাল থেকে একতরফা পানি প্রত্যাহার শুরু করে ভারত। ওই বছর তিস্তা সেচ প্রকল্প এলাকায় পানির অভাবে জমি ফেটে চৌচির হয়েছিল। কৃষকের কান্নায় জনপদের আকাশ-বাতাস ভারি হয়ে উঠেছিল। প্রায় প্রতিবছর ভারত হঠাৎ গজলডোবা ব্যারাজের সব গেট অসময়ে খুলে দেয়। তখন বাংলাদেশ অংশে ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হয়। কখনও তার প্রতিবাদ জানায়নি বাংলাদেশ। ভারত এতটাই নির্মম যে, পানি ছাড়ার সময়ে বলার ন্যূনতম প্রয়োজন মনে করে না। ফলে ভারতের কাছে সহযোগিতা আশা করা কঠিন। ভারত যদি সহযোগিতা না করে তাহলে বাংলাদেশের তো বসে থাকার সুযোগ নেই। সে ক্ষেত্রে চীনের কাছে একমাত্র সহযোগিতা নিতে হবে, এমনটাও মনে করার কারণ নেই। অন্তর্বর্তী সরকার যদি ভারত-চীন ভিন্ন অন্য কোথাও থেকে সমাধান খুঁজত, তাহলে বেশি ভালো হতো। ভারতের অসহযোগিতায় চীনকে একমাত্র ভরসা হিসেবে দেখলে তারও পরিণতি খারাপ হতে পারে।

সমকাল: তিস্তা মহাপরিকল্পনা নিয়ে বহুপক্ষীয় সমাধানের কথা যে উঠছে, তা কতটা যুক্তিসংগত বলে আপনি মনে করেন?

তুহিন ওয়াদুদ: বহুপক্ষীয় সমাধানের যে ধারণা হাজির করা হয়েছে, তা সম্ভব হলে সবচেয়ে ভালো হতো। কিন্তু বর্তমান বাস্তবতায় ভারতের সঙ্গে সম্পর্কের যে ধরন, তাতে বহুপক্ষীয়দের মধ্যে সমন্বয় করাই কঠিন। সমন্বয়ের চিন্তার বাইরে চীন, ভারত উভয় দেশকে বাদ দিয়ে অন্য ব্যবস্থা করা গেলেও ভালো। বাংলাদেশ যদি নিজস্ব অর্থায়নে কাজ শুরু করে, সেটি উত্তম। তবে জানিয়ে রাখি, যেহেতু তিস্তা বাংলাদেশ-ভারত মিলে আন্তঃসীমান্ত নদী, তাই প্রধানত এ দু্ই দেশসহ বহুপক্ষীয় সমাধান করলে তা বেশি ফলপ্রসূ হবে।

সমকাল: আপনারা রিভারাইন পিপলের মাধ্যমে ২০১০ সাল থেকে তিস্তা সুরক্ষার যে আন্দোলন করছেন, আপনাদের সুনির্দিষ্ট কোনো প্রস্তাব আছে?

তুহিন ওয়াদুদ: ২০১০ সাল থেকে আমরা বলে আসছি, জীবনরেখা নামে পরিচিত উত্তরের আশীর্বাদ তিস্তা নদী বর্তমানে অভিশাপে পরিণত হয়েছে। এ নদীকে আবারও আশীর্বাদে পরিণত করতে হবে। এ জন্য নিজ দেশীয় এবং দ্বিদেশীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। নায্য হিস্যার ভিত্তিতে পানি পেতে হবে, আবার নিজ দেশীয় পরিচর্যাও অব্যাহত রাখতে হবে। তিস্তা নদী তথা কৃষি, কৃষক, জীববৈচিত্র্য সর্বোপরি পরিবেশ-প্রকৃতি সুরক্ষা সাপেক্ষে এর পরিচর্যা জরুরি। তিস্তার শাখা এবং উপনদীগুলোকে বাঁচাতে হবে। বিজ্ঞানসম্মত খনন করতে হবে। আন্তর্জাতিক পানিপ্রবাহ কনভেনশন অনুযায়ী উজানের দেশের কারণে ভাটির দেশে কোনো ক্ষতি হলে তার ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। বাংলাদেশের পক্ষ থেকে ক্ষতির পরিমাণ উল্লেখ করে সেই ক্ষতিপূরণ চাওয়া প্রয়োজন। বাংলাদেশের উজানে যেসব জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপন করা হয়েছে, সেগুলোতেও আমাদের অধিকার আছে– এ কথাও ভারতকে স্মরণ করিয়ে দিতে হবে। 
তিস্তা নদী ঘিরে যতদিন মহাপরিকল্পনার কাজ শুরু না হবে ততদিন এর দুই পারে যেসব ভাঙনদুর্গত এলাকা রয়েছে, সেখানে ভাঙনরোধী কাজ করতে হবে। ২০১১ সালে যখন তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তি চূড়ান্ত হয়েছিল, তখন আমরা তিস্তা ব্যারাজ-সংলগ্ন নদীতে নৌ মিছিল করেছিলাম। তখনও আমাদের দাবি ছিল তিস্তা নদীর জন্য প্রাকৃতিক প্রবাহ সচল রাখতে ২০ শতাংশ পানি রেখে বাংলাদেশ ৪০ শতাংশ এবং ভারত ৪০ শতাংশ পাবে। তিস্তা নিয়ে রিভারাইন পিপলের দাবি– বিজ্ঞানসম্মতভাবে নদীবান্ধব-জনবান্ধব-দেশবান্ধব পরিচর্যামূলক প্রকল্প গ্রহণ করতে হবে।

সমকাল: তিস্তার ভাঙন প্রতিরোধে আপনাদের যে দাবি, মহাপরিকল্পনা ছাড়া অ্যাডহক ভিত্তিতে প্রকল্প গ্রহণের মাধ্যমে কি এর সমাধান সম্ভব?

তুহিন ওয়াদুদ: ‘তিস্তা মহাপরিকল্পনা’ নামে হোক কিংবা অন্য যে কোনো নামে; একটি সামগ্রিক ব্যবস্থাপনা জরুরি। এ ছাড়া শুধু তিস্তার ভাঙন রোধে কাজ করতে হবে। এই ভাঙন রোধের কাজ সাময়িক সমাধান। সে জন্য স্থায়ী সমাধানে কাজ শুরু করতে হবে। কেবল অ্যাডহক ভিত্তিতে প্রকল্পে সমাধান হবে না।

সমকাল: ‘তিস্তা নদী রক্ষা আন্দোলন’-এর ব্যানারে ১৭ ও ১৮ ফেব্রুয়ারি দুই দিনব্যাপী বৃহৎ কর্মসূচির কথা আমরা জানি। এর মূল বার্তা কী?

তুহিন ওয়াদুদ: তিস্তা আন্দোলন নিয়ে অনেক সংগঠন গড়ে উঠেছে। সর্বশেষ ‘তিস্তা নদী রক্ষা আন্দোলন’ কাজ করছে। বিএনপি নেতা আসাদুল হাবীব দুলু এ আন্দোলনের উদ্যোক্তা এবং প্রধান সমন্বয়ক। তাঁর এই আন্দোলনও নদীপারে বেশ সাড়া ফেলেছে। বিএনপির কেন্দ্রীয় প্রথম সারির সব নেতাই আসছেন। কেউ অনলাইনে বক্তব্য দিচ্ছেন। এর ভেতর দিয়ে বিএনপির রাজনৈতিক দায়বদ্ধতাও সৃষ্টি হচ্ছে। নাগরিক ঐক্য, গণসংহতি আন্দোলনের নেতারাও আসছেন। এ আন্দোলনেরও উদ্দেশ্য তিস্তা সুরক্ষা তথা তিস্তাপারের মানুষের জীবনের দুঃখ-কষ্ট লাঘব করা। একই সঙ্গে তিস্তার পানির ন্যায্য হিস্যা আদায় করা। তিস্তা নদীর ভাঙন রোধে এবং পানির ন্যায্য হিস্যা আদায়ে এটি অনন্য আন্দোলন হিসেবে থাকবে। 

তুহিন ওয়াদুদ: তিস্তাপারের মানুষের সঙ্গে দীর্ঘদিনের কাজের অভিজ্ঞতা থেকে তাদের কেমন দুর্দশা দেখেছেন?

সমকাল: এ প্রশ্নের উত্তর ঠিকঠাক দেওয়ার মতো ভাষা আমার জানা নেই। তিস্তা নদীর ভাঙনে প্রতিবছর হাজার হাজার মানুষ গৃহহীন হয়। অঢেল সম্পত্তির মালিক ভাঙনে সবকিছু হারিয়ে কপর্দকশূন্য হয়ে পড়েন। কয়েক দিন আগে এক ব্যক্তির সঙ্গে কথা হলো, যাঁর অনেক বড় বাড়ি ছিল। তিনি এখন অন্যের বাড়িতে আশ্রিত। একটি ঘরে ছেলে-ছেলেবউসহ থাকতে হচ্ছে। রাতে মাঝখানে একটি কাপড় আড়াআড়ি টেনে পার্টিশন দেওয়া। একটি ঘরেই রান্না এবং থাকা। একেকজনের বাড়ি ১৫ বার পর্যন্ত ভাঙার রেকর্ড আছে। এসব দেখলে, শুনলে মন যে পরিমাণ খারাপ হয়, তা ভাষায় প্রকাশ করা যায় না। এতটাই দুর্দশা ভাঙনকবলিত মানুষের। সম্প্রতি আমি বাংলাদেশ অংশে তিস্তা নদীর ১১৫ কিলোমিটার নৌপথে সরেজমিন দেখে এসেছি। কয়েক দিনের মধ্যে ভাঙন বন্ধে ব্যবস্থা নেওয়া না হলে এ বছরও হাজার হাজার বাড়ি নদীতে বিলীন হবে।

সমকাল: রংপুরের অন্যান্য নদী নিয়েও আপনার কাজ আছে। সেসব নদীর অবস্থা কেমন দেখছেন? সেগুলোর সংকট কি তিস্তা সমস্যাকে আরও বাড়িয়ে তুলছে?

তুহিন ওয়াদুদ: রংপুর অঞ্চলের একটি নদীও নেই, যাকে স্বাস্থ্যকর বলা যায়। এ অঞ্চলের সব নদী যে তিস্তার সংকট বাড়িয়ে তুলেছে, তা নয়। তবে প্রায় ১৫টি শাখা-প্রশাখা-উপশাখাকে তিস্তা থেকে বিচ্ছিন্ন করা হয়েছে। এর মাধ্যমে তিস্তা নদীর সংকট বৃদ্ধি পেয়েছে। এই নদীগুলোর সঙ্গে তিস্তার সংযোগ আগের মতো করতে হবে।

সমকাল: অন্তর্বর্তী সরকারের তিস্তা মহাপরিকল্পনার ভবিষ্যৎ কী?

তুহিন ওয়াদুদ: অন্তর্বর্তী সরকারের ছয় মাস পেরিয়ে গেছে। আর যদি ছয় মাসও দায়িত্বে থাকে, এতেই তিস্তা মহাপরিকল্পনার কাজ শুরু করা সম্ভব। সে জন্য জোর তাগিদ অনুভব করতে হবে। অন্তর্বর্তী সরকার যদি এটি শুরু করে, তবে তা ঐতিহাসিক কাজ হবে। দেশ স্বাধীন হওয়ার অর্ধশত বছর পেরিয়ে গেলেও কোনো সরকার যা পারেনি, অন্তর্বর্তী সরকার তা করে দেখাতে পারে। উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান এ বছরের ডিসেম্বরের মধ্যে মহাপরিকল্পনার কাজ চূড়ান্ত করার ঘোষণা দিয়েছেন। এ মুহূর্তে বাংলাদেশে তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নের চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ আর কোনো কাজ থাকতে পারে না। তিস্তার ওপর প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে নির্ভরশীল দুই কোটি মানুষ তীর্থের কাকের মতো চেয়ে আছে তিস্তা সংকট দূর হওয়ার আশায়। তারা চায় তিস্তা নদীর স্থায়ী সমাধানের কার্যক্রম শুরু হোক।

সমকাল: সময় দেওয়ার জন্য ধন্যবাদ।

তুহিন ওয়াদুদ: সমকালকেও ধন্যবাদ।
 

.

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: উপদ ষ ট প রকল প সরক র র ব যবস থ আর থ ক র জন য ক জ কর র করণ সমক ল হওয় র

এছাড়াও পড়ুন:

আজও গোবিন্দগঞ্জে যানবাহনের ধীরগতি

ঢাকা-রংপুর মহাসড়কের গোবিন্দগঞ্জের চার রাস্তা মোড়ে শনিবার দিনভরই থেমে থেমে যানজট ও  ধীরগতি দেখা গেছে। সওজের সাসেক প্রকল্পের নির্মাণ কাজের পাশাপাশি ঢাকা-উত্তরাঞ্চলগামী দূর ও স্বল্পপাল্লার বাস থেকে যাত্রী যত্রতত্র উঠা-নামায় এ অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে। যদিও সেনাবাহিনী, ট্র্যাফিক ও হাইওয়ে পুলিশসহ আনসার সদস্যরা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে চেষ্টা করছেন। তবে পরিবহন চালকরা নিয়ম না মেনে যাত্রী উঠা-নামা করায় কৃত্রিম যানজট ও ধীরগতির সৃষ্টি হচ্ছে। 

গোবিন্দগঞ্জ চার রাস্তা মোড়ে পুলিশ বক্সে দায়িত্বরত ইন্সপেক্টর ওসমান আলী জানান, সওজের কাজের কারণে রাস্তায় এমনিতেই সরু। তার ওপর যত্রতত্র যানবাহন থেকে যাত্রী উঠা-নামায় অল্প সময়ের জন্য যানবাহনের ধীরগতি হলেও শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা তা কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করছেন। দীর্ঘ সময়ের জন্য কোনো ধরনের যানজট ধীরগতি সৃষ্টি করতে দেওয়া হচ্ছে না।

টাঙ্গাইলের এলেঙ্গা থেকে সিরাজগঞ্জ, বগুড়া হয়ে রংপুর পর্যন্ত ১৯০ কিলোমিটার মহাসড়কে গত সাড়ে আট বছর থেকে সওজের সাউথ এশিয়ান ইকোনমিক কো-অপারেশন (সাসেক-২) প্রকল্পের কাজ চলছে। ভূমি অধিগ্রহণ জটিলতায় গাইবান্ধার পলাশবাড়ি ও গোবিন্দগঞ্জ মোড়ে এখনও কাজ পুরোপুরি শেষ হয়নি। এতে ঈদের আগে এই দুই স্থানেই বেশি জটলা বাঁধছে। 

সওজের সাউথ এশিয়ান ইকোনমিক কো-অপারেশন (সাসেক-২) প্রকল্পের পরিচালক (পিডি) ড. ওয়ালিউর রহমান বলেন, সাড়ে আট বছর আগে কাজ শুরু হলেও মূলত জোরেশোরে শুরু হয় করোনা শেষে। আমরা আপ্রাণ চেষ্টা করছি। ভূমি অধিগ্রহণ কাজের জটিলতার জন্য গোবিন্দগঞ্জ ও পলাশবাড়ীতে কাজ শুরু করতে দীর্ঘ সময় লেগে যায়। আশা করছি, আগামী ডিসেম্বরের মধ্যেই ইনশাল্লাহ পুরো কাজ হবে। আগামী বছর থেকে চার রাস্তা সম্প্রসারণ সুফল উত্তরাঞ্চলবাসীর পুরোপুরি ভোগ করতে পারবে।

গাইবান্ধা সড়ক ও জনপথ বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী পিয়াস কুমার সেন বলেন, হাইওয়ের কাজ করছে সাসেক-২ প্রকল্প। তাদের কাজ এখনও চলমান। আমাদের কাছে সড়ক বুঝিয়ে দেওয়ার পর রাস্তার পাশের অবৈধ স্থাপনাসহ সড়কের সার্বিক দেখভাল করবে গাইবান্ধা সড়ক বিভাগ। 

বগুড়া রিজিয়ন হাইওয়ে পুলিশের এসপি (অতিরিক্ত ডিআইজি পদোন্নতিপ্রাপ্ত) মো. শহীদুল্লাহ বলেন, ঢাকা রংপুর মহাসড়কের সিরাজগঞ্জ-বগুড়া অংশে শনিবার দুপুর পর্যন্ত যানজট হয়নি। বরং ঢাকা-উত্তরাঞ্চলগামী যানবাহন দুই লেন দিয়েই স্বাভাবিকভাবে চলছে।

সম্পর্কিত নিবন্ধ