ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক বরাবরই আবেগের। তবে এই মাত্রা অতিদূর পর্যন্ত চলে গিয়েছিল, বিশেষত আওয়ামী লীগের আমলে। আওয়ামী লীগ সরকার গৃহীত নীতি সব দিক থেকে প্রতিবেশী দেশটির স্বার্থের অনুকূলে কাজ করেছে। এতে বাংলাদেশের মানুষের অধিকার চরমভাবে ক্ষুণ্ন হয়েছে। এ কারণে সাম্প্রতিক সময়ে দেশে ভারত বিরোধিতা চরম পর্যায়ে পৌঁছেছে। জুলাই গণঅভ্যুত্থানের পর রাজনৈতিক পরিস্থিতি বদলে গেছে বটে, কিন্তু ভারতের ব্যাপারে মূলধারার অন্যান্য রাজনৈতিক দলের অবস্থান কী– তা গভীর মনোযোগ দিয়ে বিচার করার দাবি রাখে। 

খেয়াল করা দরকার, ভারতের ব্যাপারে জুলাই-আগস্ট অভ্যুত্থানের পরও একই সুর শোনা যাচ্ছে। নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্তের ডাক উঠেছে। অভ্যুত্থানে শত শত শিক্ষার্থী শহীদ হয়েছে, কিন্তু দেশটির সঙ্গে রাষ্ট্রনীতি এখনও জনগণবিরোধী পথে হাঁটার আশঙ্কা বেড়ে গেছে। সাম্প্রতিক বিতর্কে সে রকমই বার্তা পাওয়া যাচ্ছে। আগামী দিনের শাসক মহলের কথাবার্তায় ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক শাসন ও শোষণের মধ্যেই আবদ্ধ থাকছে। 

অভ্যুত্থানের পর ভারতের মিডিয়া ও সরকার যে পথে হেঁটেছিল, তা অনেকটা কমে এসেছে। বর্তমানে তারা বাংলাদেশের রাজনীতিতে নতুন ফর্মুলা আনার চেষ্টা চালাচ্ছে, যাতে বিএনপি কিংবা জামায়াত আওয়ামী লীগের ব্যাপারে নমনীয় হয়। বাংলাদেশের রাজনীতিতে আওয়ামী লীগের প্রভাব প্রায় শূন্যে নেমে আসার পর ভারত সেই বাস্তবতা মেনে নিয়ে বিএনপি বা জামায়াতের সঙ্গে ভিন্ন বন্দোবস্ত কায়েমে তৎপর। কিন্তু মূল উদ্দেশ্য দল দুটির মাধ্যমে রাজনৈতিকভাবে আওয়ামী লীগের অবস্থান পাকাপোক্ত করা। অর্থাৎ বিএনপি বা জামায়াত যারাই আগামীতে ক্ষমতায় আসবে, তারা যেন আওয়ামী লীগকে ‘রাজনৈতিক ভ্রাতা’ হিসেবে গ্রহণ করে নেয়।  

এই নতুন কৌশলে বিএনপি বা জামায়াতের মধ্যে যে দলটি আওয়ামী লীগকে যত বেশি ছাড় দেবে, দেশটি সে দলের পক্ষে কাজ করবে। এই প্রক্রিয়ায় এগোলে ভারতের ব্যাপারে আওয়ামী লীগেরই অবস্থান আবার ভিন্ন নামে ফিরে আসার আশঙ্কা রয়েছে। যদি বিএনপি বা জামায়াত আওয়ামী লীগকে ছাড় দেওয়ার নীতি গ্রহণ করে, তাহলে আগামী নির্বাচনে জয়যুক্ত দলটি একই পথে হাঁটতে বাধ্য। আওয়ামী লীগ যেভাবে ভারতনীতি গ্রহণ করেছিল, সেভাবে বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক নির্ধারিত হবে। বিএনপি কিংবা জামায়াতের পক্ষে ভিন্ন পথে হাঁটার সুযোগই থাকবে না। প্রকৃতপক্ষে দল দুটি ভিন্ন নীতি গ্রহণের রাস্তা কী হতে পারে, তা নিয়ে ভাবছে বলে মনে হয় না। কারণ আওয়ামী লীগের মতো দল দুটিও ভারত ‘বিগ ব্রাদার’– এই নীতিতে বিশ্বাস করে এবং সেভাবেই হাঁটতে চায়। 

এ ধরনের নীতি ও মানসিকতা বাংলাদেশের জাতীয় স্বার্থ ক্ষুণ্ন করতে পারে। দেখা যায়, ভারতের জাতীয় স্বার্থ ও আঞ্চলিক নিরাপত্তা সুরক্ষায় বিজেপি, কংগ্রেস বা তৃণমূল কংগ্রেস জাতীয় ঐক্যে পৌঁছাতে পারে। বাংলাদেশকে কী দেবে কিংবা কতটুকু দেবে– এ ব্যাপারে তারা একজোট। গণঅভ্যুত্থানের পরও বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সে রকম কোনো ঐক্য গড়ে ওঠেনি। ভারতকে আমরা কতুটুকু ছাড় দেব, কতটুকু দেব না কিংবা বিনিময়ে আমাদের প্রাপ্তি কী– এসব ব্যাপারে বিএনপি-জামায়াতের মধ্যে কোনো রকম জাতীয় ঐক্য দেখা যাচ্ছে না। এ সুযোগকে ভারত কাজে লাগাতে চায়।   
প্রশ্ন হচ্ছে, এ পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের মূলধারার রাজনৈতিক দলগুলোর কী করণীয়? নিশ্চয় ভারতের প্রাসঙ্গিকতা উড়িয়ে দেওয়া নয়; বরং বাংলাদেশে আওয়ামী লীগের মধ্য দিয়ে ভারতের যে আধিপত্যবাদী নীতি পোক্ত হয়েছে, সেই ভিত্তি ভেঙে দিতে কর্মসূচি হাতে নেওয়া। দুর্ভাগ্যবশত, বিএনপি কিংবা জামায়াতের এ ব্যাপারে উল্লেখযোগ্য কোনো তৎপরতা নেই। 
আমরা জানি, ভারতকে ট্রানজিট দেওয়া, বিভিন্ন শিল্পে ভারতীয় নাগরিকদের অবাধ কর্মসংস্থান, ভারতীয় টেলিভিশন চ্যানেল বাংলাদেশে একতরফা ও অবাধে চলতে দেওয়া ইত্যাদির মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ হয়ে উঠেছিল ভারতের জন্য অন্যতম রেমিট্যান্স প্রেরণকারী দেশ। এসব ব্যাপারে বিএনপি-জামায়াতের এখনও জোরালো কোনো অবস্থান আমাদের চোখে পড়েনি। যেমন– বাংলাদেশের পাঠ্যপুস্তক মুদ্রিত হয় ভারতে; বাংলাদেশের কর্মকর্তারা ভারতে গিয়ে প্রশিক্ষণ নেন; দেশের দুর্বল চিকিৎসা ব্যবস্থার কারণে প্রতিবছর হাজার হাজার মানুষ ভারতে গিয়ে চিকিৎসা নেন। এ পরিস্থিতি বাংলাদেশের ওপর ভারতের নিয়ন্ত্রণমূলক নীতি গ্রহণে সহায়ক। এসব বিষয়ে আগামীতে বিএনপি বা জামায়াত কী অবস্থান নিতে চায়– কোনো সুস্পষ্ট ঘোষণা এখন পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে না। 

আক্ষরিক অর্থেই ভারত গত দুই দশক বা তার আগে থেকেই বাংলাদেশকে আঞ্চলিক শক্তি ও অর্থনৈতিক ‘উপনিবেশ’ হিসেবে ব্যবহার করেছে। এই ক্ষেত্র প্রস্তুতে নিঃসন্দেহে সবচেয়ে বেশি ভূমিকা রেখেছে আওয়ামী লীগ। একই সঙ্গে বিএনপি বা জামায়াতের মতো রাজনৈতিক দলগুলোর ভূমিকা কী? সেই সুবিধা অব্যাহত রাখতে ভারত বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলোর দিকে তাকিয়ে আছে। 
সন্দেহ নেই, ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশের পাশে দাঁড়িয়েছিল ভারত। কিন্তু সেই সম্পর্কের ভিত্তি যতটা মানবিক ও যৌক্তিক; স্বাধীনতার পাঁচ দশক পরও এ দেশের মানুষকে সে জন্য যে প্রতিদান দিতে হচ্ছে, সেটা অযৌক্তিক ও অমানবিক। ফলে নিছক বিরোধিতা নয়, বরং ভারতের সঙ্গে এ দেশের সম্পর্ক আরও যৌক্তিক ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত করা জরুরি। স্বার্থ শতভাগ নিশ্চিত না হলেও অন্তত বাংলাদেশ যেন শতভাগ ঠকে না যায়। সে জন্য রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ভারত প্রশ্নে অভিন্ন অবস্থান প্রয়োজন। রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে এই ঐক্য গড়ে না উঠলে বাংলাদেশের স্বার্থ কখনও সুরক্ষিত হবে না।  

নিয়ামত আলী: গ্র্যাজুয়েট টিচিং অ্যাসিস্ট্যান্ট; ফ্লোরিডা আটলান্টিক ইউনিভার্সিটি, যুক্তরাষ্ট্র 

.

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: ল দ শ র র জন ত র র জন ত ক অবস থ ন ব এনপ গ রহণ আওয় ম

এছাড়াও পড়ুন:

বাংলাদেশ হউক বহুপক্ষীয়

বায়ান্নর একুশে ফেব্রুয়ারি কেবল বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষা নহে; জাতিসত্তা রক্ষার আন্দোলনেও অমর দিবসরূপে দেদীপ্যমান। মাতৃভাষার মর্যাদা রক্ষায় বুকের তাজা রক্ত ঢালিয়া দিয়া ভাষাশহীদগণ কেবল দেশপ্রেমের অনন্য উদাহরণই সৃষ্টি করেন নাই; দিবসটি বাংলা ছাপাইয়া সকল ভাষার মর্যাদার স্মারক হইয়া উঠিয়াছে। একুশের চেতনা দেশ-কাল-পাত্রভেদে অধিকার আদায়ে প্রেরণার উৎসরূপে ক্রিয়াশীল। আমরা দেখিয়াছি, অধিকার আদায়ে বাঙালি ভাষা আন্দোলনের যেই সংগ্রাম রচনা করিয়াছিল, সেই পথপরিক্রমায়ই সূচিত হয় একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ। অকুতোভয় বাঙালি জনগোষ্ঠী এই ভূখণ্ডের অপরাপর জাতিগোষ্ঠীকে লইয়া দীর্ঘ ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে অর্জন করে স্বাধীনতা। স্বাধীনতার পরও যুগ যুগ ধরিয়া আন্দোলনের প্রেরণা হইয়া রহিয়াছে ভাষা আন্দোলন। এমনকি চব্বিশের গণঅভ্যুত্থানও উহার বাহিরে নহে। বায়ান্নতে ছাত্র-জনতা মুখের ভাষা রক্ষায় সোচ্চার হইয়া আন্দোলনে ঝাঁপাইয়া পড়িয়াছিল। চব্বিশের গণঅভ্যুত্থানেও তাহারা প্রেরণা হইয়া উঠিয়াছিল। জুলাই-আগস্টের আন্দোলনে দেয়ালে দেয়ালে মায়ের ভাষায় লিখিত গ্রাফিতি মানুষকে উজ্জীবিত করিয়াছিল। মাতৃভাষায় উচ্চারিত স্লোগান যে কতটা শক্তিশালী হইয়া উঠিতে পারে; যুগে যুগ দাবি আদায়ের আন্দোলনে উহা প্রমাণিত। যেই কারণে ঐতিহাসিক দিবসটি সাত দশক অতিক্রম করিলেও উহার চেতনা চিরঅমলিন।

আমাদের রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের প্রধান দুইটি দাবি ছিল– রাষ্ট্রভাষা বাংলা এবং সর্বস্তরে বাংলা ভাষার প্রচলন। ১৯৫৪ সালেই আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় তৎকালীন পাকিস্তান গণপরিষদে বাংলা রাষ্ট্রভাষারূপে স্বীকৃতির মাধ্যমে প্রথম দাবি পূরণ হইলেও দ্বিতীয় দাবিটি এখনও প্রত্যাশিত মাত্রায় পূরণ হয় নাই। সর্বত্র বাংলা প্রচলনের প্রশ্নটা আমরা ফি বৎসরই করিয়া আসিতেছি। কিন্তু রাষ্ট্রের প্রতিটা পর্যায়ে, প্রতিটা ক্ষেত্রে আমাদের মাতৃভাষার প্রচলন কতটা হইয়াছে? যেই জাতির মানুষ ভাষার তরে জীবন দিয়াছে, সেই জাতির কোটি কোটি মানুষের পড়িতে ও লিখিতে না পারিবার বিষয় বেদনাদায়কই বটে। একই সঙ্গে মাতৃভাষা এখনও আমাদের সর্বত্র শিক্ষার বাহন হইয়া উঠিতে পারে নাই। উচ্চশিক্ষার পুস্তকসহ অনেক বিষয় আমরা এখনও বাংলায় করিতে পারি নাই। মাতৃভাষারূপে বাংলার দাপ্তরিক ব্যবহার বৃদ্ধি পাইয়াছে সত্য, কিন্তু আদালতের কর্মকাণ্ড এখনও ইংরাজিনির্ভর। 

তবে ১৯৯৯ সালে জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতিবিষয়ক সংস্থা ইউনেস্কোর একুশে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের ঘোষণায় বাঙালি জাতি ও বাংলা ভাষার ভাবমূর্তিই কেবল উজ্জ্বল হয়নি, একই সঙ্গে বিশ্বের সব মাতৃভাষাই বিশেষ মর্যাদা ও মনোযোগ লাভ করিয়াছে। জাতিসংঘের অন্যতম দাপ্তরিক ভাষারূপে বাংলাও আবির্ভূত হউক। আমরা বিশ্বাস করি, সকলের মাতৃভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠিত করিবার বিষয়ও একুশে ফেব্রুয়ারির চেতনা। অমর একুশে আমাদের জাতিসত্তা রক্ষার আন্দোলনরূপেও দেখিয়া আসিয়াছি। আমাদের সামাজিক, রাজনৈতিক ও রাষ্ট্রীয় জীবনে ইহা প্রেরণার বাতিঘরস্বরূপ ক্রিয়াশীল। তজ্জন্য দেশের চলমান রাজনৈতিক সংকটেও পথ দেখাইতে পারে একুশের চেতনা।
আমরা জানি, গণঅভ্যুত্থান-পরবর্তী সময়ে আমাদের চ্যালেঞ্জ দেশের গণতান্ত্রিক উত্তরণ। তজ্জন্য অবাধ-সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন গুরুত্বপূর্ণ। ইতোমধ্যে প্রধান উপদেষ্টা নির্বাচনের সম্ভাব্য তারিখ ঘোষণা করিয়াছেন। এখন প্রয়োজন নির্বাচন ও অন্যান্য সংস্কার বিষয়ে জাতীয় ঐকমত্য। বিশেষত রাজনৈতিক দলগুলির মধ্যে ঐকমত্য জরুরি।
আমরা প্রত্যাশা করিব, ঐকমত্য প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে দেশবাসী বায়ান্ন সালের ন্যায় দল-মত নির্বিশেষে ঐক্যবদ্ধ হইবে। আমরা জানি, একুশে ফেব্রুয়ারি মানে বহুপাক্ষিকতা ও সকলের যথাযোগ্য মর্যাদার প্রশ্ন। গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়া গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার যেই পথ আমাদের সম্মুখে উন্মুক্ত, উহা সকলের জন্য অবারিত হউক। 

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • গবেষণা ও অনুবাদে অনেকটাই পিছিয়ে
  • সুরক্ষিত বন্দরের পথে এখনও চার বাধা
  • ‘রক্তাক্ত কুয়েট’ হামলাকারিরা চিহ্নিত!
  • আমরা কারও দাবার ঘুঁটি হব না: জামায়াত আমির
  • গ্রামে ঋণ পেতে ব্যাংকের চেয়ে এনজিওতে ভরসা
  • বাংলাদেশ হউক বহুপক্ষীয়
  • অস্ত্রধারীরা প্রকাশ্যে, পিটুনির শিকার দুই কিশোর এখনও প্রিজন সেলে
  • তিন মাসের সুমাইয়ার পৃথিবীজুড়ে শূন্যতা
  • দ্বন্দ্ব, বিবাদে এখনও উত্তপ্ত রাজনগর বিএনপি