ব্যাংকিং সুবিধা না পাওয়া মানুষের ভাগ্য বদলাবে কি
Published: 17th, February 2025 GMT
দেশে জনসংখ্যার একটি উল্লেখযোগ্য অংশ এখনো আনুষ্ঠানিক ব্যাংকিং ব্যবস্থার বাইরে রয়ে গেছে। এ অবস্থায় আর্থিক অন্তর্ভুক্তি সমাজের বা রাষ্ট্রের সামগ্রিক উন্নয়নের জন্য অপরিহার্য।
কারণ, আর্থিক অন্তর্ভুক্তি হলো কোনো ব্যক্তি এবং ব্যবসার নির্দিষ্ট পরিচয়, আয়ের স্তর বা ভৌগোলিক অবস্থান নির্বিশেষে একটি কার্যকর, সহজলভ্য ও সাশ্রয়ী মূল্যে আর্থিক সেবা এবং পরিষেবাগুলোতে সবার অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার একটি সুচিন্তিত প্রক্রিয়া।
জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে বিগত সরকারের দীর্ঘ শাসনের অবসানের পরপরই দেশের সামগ্রিক খাতে পরিবর্তনের দাবি ওঠে। বিশেষ করে ব্যাংকিং ও আর্থিক খাতের ব্যাপক সংস্কার এবং পরিবর্তনের দাবি ছিল সবার ওপরে।
পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে দেশের অর্থনীতিকে টিকিয়ে রাখতে বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে নেতৃত্বের পরিবর্তনসহ অর্থ পাচার রোধে বেশ কিছু ত্বরিত পদক্ষেপ হাতে নেয়।
এখনো বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিশাল পরিবর্তনের আশা করা হচ্ছে, যেখানে আর্থিক অন্তর্ভুক্তি কার্যক্রমের গুরুত্ব বেশ জোরালো হয়ে উঠেছে।
বিষয়টি নিয়ে এখনো যথেষ্ট মাত্রায় জনসচেতনতামূলক কার্যক্রমের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে।
আরও পড়ুনব্যাংকিং খাত ঘুরে দাঁড়াতে পারে কী করে১৮ ডিসেম্বর ২০২৪ক্ষুদ্রঋণ প্রকল্পের মাধ্যমে দেশের দারিদ্র্য হ্রাসের মতো একটি বিরাট ক্ষেত্রে বাংলাদেশ অভাবনীয় সাফল্য পেয়েছে।
তা সত্ত্বেও বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার মধ্যে এখনো তিন কোটি মানুষ আর্থিক ব্যবস্থা থেকে বাদ পড়ে আছে।
আর বিশ্বের মোট ব্যাংকিং সুবিধাবঞ্চিত মানুষের সংখ্যা প্রায় ১৪০ কোটি। বাংলাদেশের ব্যাংকিং সুবিধাবঞ্চিত মানুষ, বিশেষ করে যাঁরা গ্রামীণ এলাকায় থাকেন, তাঁরা এখনো তাঁদের সঞ্চয় অ্যাকাউন্ট, ঋণ, বিমা সুবিধা ও আর্থিক লেনদেন ব্যবস্থার মতো মৌলিক আর্থিক পরিষেবাগুলো গ্রহণ করার ক্ষেত্রে নানাবিধ প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হচ্ছেন।
বিশ্বব্যাংকের মতে, বাংলাদেশের প্রায় ৪৫ শতাংশ প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তি এখনো ব্যাংকিং সুবিধাবঞ্চিত।
এই বিশাল জনসংখ্যাকে প্রায়ই অনানুষ্ঠানিক আর্থিক চ্যানেলের ওপর নির্ভর করতে হয়, যা অনেকটা অবিশ্বাস্য, অনিরাপদ ও ব্যয়বহুলও বটে।
সুতরাং আর্থিক অন্তর্ভুক্তি দেশের মানুষের জীবন-জীবিকার মান উন্নয়ন, অর্থনৈতিক উন্নয়ন তথা দারিদ্র্য দূরীকরণের জন্য একটি অপরিহার্য হাতিয়ার।
এটি অসংখ্য মানুষের, বিশেষ করে নারীর ক্ষমতায়ন ও ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা তৈরির ব্যাপক সম্ভাবনা রাখে।
কিন্তু এখনো বিভিন্ন সীমাবদ্ধতার কারণে ব্যাংকিং সুবিধাবঞ্চিত জনগোষ্ঠীকে আনুষ্ঠানিক আর্থিক পরিষেবার আওতায় আনা সম্ভব হচ্ছে না।
আরও পড়ুনবাংলাদেশ ব্যাংককে কথা নয় কাজ দেখাতে হবে২৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার ৬৮ দশমিক৩৪ শতাংশের বেশি মানুষ প্রত্যন্ত অঞ্চলে বসবাস করেন।
এ অঞ্চলগুলোতে ব্যাংকের শাখা, উপশাখা ও এজেন্ট আউটলেটের অভাবের কারণে অনেক মানুষ ব্যাংকিং পরিষেবা গ্রহণ করতে পারেন না।
অনেক সময় নিরবচ্ছিন্ন ইন্টারনেট সংযোগ ও যোগাযোগব্যবস্থার অভাবে তাঁদের সমস্যাটিকে আরও বাড়িয়ে তোলে।
বর্তমানে বাংলাদেশের আর্থিক সাক্ষরতার হার মাত্র ২৮ শতাংশ, তার মানে প্রায় ৭২ শতাংশ মানুষ এখনো ব্যাংক, ব্যাংকিং প্রোডাক্ট বা সেগুলো কীভাবে ব্যবহার করতে হয়, এ সম্পর্কে পরিচিত নন।
আর্থিক সাক্ষরতার এই জ্ঞানের অভাব আনুষ্ঠানিক আর্থিক পরিষেবাগুলোকে ব্যবহারের ক্ষেত্রে অনেককে অবিশ্বাস্য ও অনিশ্চয়তার লেনদেনের দিকে নিয়ে যায়। এর মাধ্যমে কারও জীবনকে আর্থিক ভয় ও উদ্বেগের দিকে ধাবিত করতে পারে।
এ ছাড়া দেশের প্রচলিত সামাজিক প্রথা ও লৈঙ্গিক বৈষম্যের কারণে বিশেষ করে গ্রামীণ এলাকার নারীদের জন্য সংস্কৃতিগতভাবে সীমাবদ্ধতা, চলাফেরায় ধীরস্থিরতা এবং আর্থিক অক্ষমতার কারণে তাঁরা আনুষ্ঠানিক আর্থিক পরিষেবাগুলোকে গ্রহণ করতে পারেন না।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে মোবাইল ব্যাংকিং ও ডিজিটাল আর্থিক পরিষেবার উত্থান বাংলাদেশে আর্থিক অন্তর্ভুক্তি প্রচেষ্টায় বিপ্লব এনেছে।
দেশে মোবাইল ফোনের প্রবেশাধিকার বৃদ্ধি, ডিজিটাল পেমেন্টের উদ্ভাবনের সঙ্গে মিলিত হয়ে গ্রামীণ এবং সুবিধাবঞ্চিত এলাকার মানুষদের জন্য ব্যাংক শাখার প্রয়োজন ছাড়াই আর্থিক পরিষেবা গ্রহণে করতে সক্ষম হচ্ছেন।
আরও পড়ুনআলোচিত ব্যাংকগুলোর ভবিষ্যৎ কী১৬ সেপ্টেম্বর ২০২৪ডিজিটাল আর্থিক পরিষেবার প্রসারের কথা বলতে গেলে প্রথমে আসে বিকাশ, যা প্রায় ২ কোটি ১২ লাখ গ্রাহক ব্যবহার করেন এবং নগদ, যা প্রায় ৪৫ লাখ গ্রাহক ব্যবহার করেন।
উভয় প্ল্যাটফর্ম দুটি প্রমাণ করেছে, প্রযুক্তি কীভাবে ব্যাংকিং সুবিধাবঞ্চিত জনগোষ্ঠীকে আর্থিক সেবা প্রদানের জন্য ব্যবহার করা যেতে পারে।
এ প্ল্যাটফর্মগুলোর মাধ্যমে গ্রাহক মোবাইল ফোন ব্যবহার করে খুব সহজে অর্থ প্রেরণ, অর্থ গ্রহণ, বিল পরিশোধ, সঞ্চয় ও ডিজিটাল ঋণ গ্রহণের সুযোগ পাচ্ছেন।
বাংলাদেশ সরকার তার জাতীয় উন্নয়ন কর্মসূচিতে আর্থিক অন্তর্ভুক্তির গুরুত্ব স্বীকার করেছে।
দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক বাংলাদেশ ব্যাংক আর্থিক অন্তর্ভুক্তিমূলক জাতীয় লক্ষ্য অর্জনে অবদান রাখার প্রয়াসে আর্থিক নেটওয়ার্ক শক্তিশালী করার জন্য সুবিধাবঞ্চিত অঞ্চল ও ব্যাংকিং সুবিধাবঞ্চিত জনগোষ্ঠীর কাছে পৌঁছানোর জন্য, আর্থিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখার জন্য, পূর্বের সুবিধাবঞ্চিতদের ক্ষেত্রে সুযোগ উন্মুক্ত করার জন্য, আর্থিক প্রোডাক্টের জন্য গ্রাহকের ভিত্তি সম্প্রসারণ করার জন্য, দেশের একটি প্রাণবন্ত এবং স্থিতিশীল আর্থিক খাত গঠনে অবদান রাখার জন্য বেশ কয়েকটি উদ্যোগ চালু করেছে।
এসব উদ্যোগের মধ্যে রয়েছে মোবাইল ব্যাংকিং, এজেন্ট ব্যাংকিং, উপশাখা ও ক্ষুদ্রঋণ খোলার জন্য নিয়মকানুন তৈরি করা, সেই সঙ্গে আর্থিক সাক্ষরতা কর্মসূচি এবং স্কুল ব্যাংকিং ও কৃষি ব্যাংকিং উদ্যোগসহ নো-ফ্রিল অ্যাকাউন্ট খোলার কর্মসূচি চালু করা ইত্যাদি।
পাশাপাশি সরকার দেশের বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে আর্থিক অন্তর্ভুক্তিতে জড়িত হওয়ার জন্য উৎসাহিত করে থাকে, যাতে ব্যাংকগুলো সুবিধাবঞ্চিত জনগোষ্ঠীকে সেবা প্রদানের জন্য সরকারঘোষিত ভর্তুকি এবং প্রণোদনা প্রদানের কাজ চালিয়ে যায়।
অধিকন্তু সরকার আমাদের দেশে বৈদেশিক মুদ্রার প্রধান উৎস অর্থাৎ অভিবাসীদের আনুষ্ঠানিক ব্যাংকিং চ্যানেল ব্যবহার করার জন্য বিভিন্ন প্রণোদনা প্রদান করছে।
মোদ্দাকথা সরকার আর্থিক অন্তর্ভুক্তির জন্য যথেষ্ট আন্তরিক, তবে লক্ষ্যে পৌঁছাতে হলে এখনো বহু পথ পাড়ি দিতে হবে।
বাংলাদেশে আর্থিক অন্তর্ভুক্তিতে ক্ষুদ্রঋণ অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অবদানকারী। গ্রামীণ ব্যাংক ও ব্র্যাকের মতো প্রতিষ্ঠানগুলো ক্ষুদ্রঋণ কর্মসূচিতে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছে।
এর ফলে লাখ লাখ মানুষ, বিশেষ করে নারীরা নিজ উদ্যোগে ছোট ছোট ব্যবসা শুরু করতে বা তাঁদের জীবিকা উন্নত করতে এবং দারিদ্র্যের চক্র থেকে মুক্তি পেতে সক্ষম হয়েছেন।
আরও পড়ুনব্যাংকিং খাতের যেসব সমস্যার জরুরি সমাধান প্রয়োজন০২ সেপ্টেম্বর ২০২৪২০২৩ সালের ৩০ জুনের প্রতিবেদন অনুসারে, বাংলাদেশে প্রায় ৪ কোটি ৮৬ লাখ মানুষ ক্ষুদ্রঋণ প্রতিষ্ঠানের সদস্য ছিলেন, যাঁর মধ্যে ৩ কোটি ১৫ লাখই ক্ষুদ্রঋণগ্রহীতা।
তবু ক্ষুদ্রঋণের সুদের হার ও ঋণচক্রের জন্যও কারও কারও দ্বারা সমালোচিত হয়েছে।
তবে বাংলাদেশের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হলো কিছু সমালোচনাকে উপেক্ষা করে বা আমলে নিয়ে আরও উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণের মাধ্যমে সারা দেশে আর্থিক অন্তর্ভুক্তির জন্য ক্ষুদ্রঋণ আরও টেকসই এবং সহায়ক হাতিয়ার হিসেবে জায়গা করে নিয়েছে, তা নিশ্চিত করা।
দেশের প্রতিটি কোণে আর্থিক অন্তর্ভুক্তির সুবিধা পৌঁছানোর জন্য ডিজিটাল অবকাঠামোতে আরও বিনিয়োগ করা প্রয়োজন।
প্রত্যন্ত অঞ্চলে নিরবচ্ছিন্ন ইন্টারনেট সংযোগ ও মোবাইলের নেটওয়ার্ক কাভারেজের সম্প্রসারণ ডিজিটাল আর্থিক পরিষেবাগুলোকে সহজতর করতে এবং সব মানুষের কাছে তার গ্রহণযোগ্যতা নিশ্চিত করতে সহায়তা করবে।
ডিজিটালাইজেশনের বাইরেও আর্থিক অন্তর্ভুক্তির সাফল্যের জন্য আর্থিক সাক্ষরতা বৃদ্ধি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, বিশেষ করে গ্রামীণ এলাকায় যেখানকার মোট জনসংখ্যার প্রায় ৬৮ শতাংশ নারী।
এ ছাড়া নারী-পুরুষের আর্থিক বৈষম্য দূর করতে হলে সমগ্র দেশে নারীদের উদ্বুদ্ধ করতে হবে, যাঁরা মোট জনসংখ্যার প্রায় ৫০ দশমিক ৮০ শতাংশ।
দেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ জনশক্তি তরুণ-তরুণীদের সম্পৃক্ত করতে হবে, যাঁরা মোট জনসংখ্যার প্রায় ৩৪ শতাংশ এবং বর্তমানে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীর সংখ্যা প্রায় ২৭ লাখ ৫০ হাজার, যাঁদেরকেও আর্থিক সাক্ষরতা কর্মসূচির মাধ্যমে আনুষ্ঠানিক আর্থিক ব্যবস্থায় যুক্ত হতে উৎসাহিত করতে হবে।
ইতিমধ্যে ডিজিটাল আর্থিক পরিষেবা, মোবাইল ব্যাংকিং ও ক্ষুদ্রঋণ আর্থিক বৈষম্য দূর করার ক্ষেত্রে শক্তিশালী হাতিয়ার হিসেবে প্রমাণিত হয়েছে। বাংলাদেশের সার্বিক উন্নয়নের জন্য তথা ব্যাংকিং সুবিধাবঞ্চিত জনগোষ্ঠীর জন্য আর্থিক অন্তর্ভুক্তি একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, যেটি বলার অপেক্ষা রাখে না। এ ক্ষেত্রে সরকার, আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও প্রযুক্তি উদ্যোক্তাদের সমন্বিত প্রচেষ্টার মাধ্যমে বাংলাদেশের ব্যাংকিং সুবিধাবঞ্চিত জনগোষ্ঠীর সংখ্যা উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস করা যেতে পারে।একই সঙ্গে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে এমন সব প্রোডাক্ট উদ্ভাবন করতে হবে, যা ব্যাংকিং সুবিধার বাইরে থাকা জনগোষ্ঠীর চাহিদা পূরণে সহায়ক হয়।
নিম্ন আয়ের ব্যক্তিদের জন্য তৈরি আকর্ষণীয় সুবিধার সঞ্চয় অ্যাকাউন্ট, ক্ষুদ্রঋণ সুবিধা এবং বিমা পণ্যগুলোর জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি দেশজুড়ে আর্থিক অন্তর্ভুক্তি বৃদ্ধিকে অনেক এগিয়ে নিয়ে যাবে।
অন্যদিকে আর্থিক ব্যবস্থায় জেন্ডার সংবেদনশীল নীতি ও উদ্যোগগুলোকে যথাযথভাবে প্রচার করাটাও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
অর্থনীতিতে নারীর অংশগ্রহণ নিশ্চিত হলে আর্থিক অন্তর্ভুক্তি খাত আরও টেকসই ও সুনিয়ন্ত্রিত হবে।
ইতিমধ্যে ডিজিটাল আর্থিক পরিষেবা, মোবাইল ব্যাংকিং ও ক্ষুদ্রঋণ আর্থিক বৈষম্য দূর করার ক্ষেত্রে শক্তিশালী হাতিয়ার হিসেবে প্রমাণিত হয়েছে।
বাংলাদেশের সার্বিক উন্নয়নের জন্য তথা ব্যাংকিং সুবিধাবঞ্চিত জনগোষ্ঠীর জন্য আর্থিক অন্তর্ভুক্তি একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, যেটি বলার অপেক্ষা রাখে না।
এ ক্ষেত্রে সরকার, আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও প্রযুক্তি উদ্যোক্তাদের সমন্বিত প্রচেষ্টার মাধ্যমে বাংলাদেশের ব্যাংকিং সুবিধাবঞ্চিত জনগোষ্ঠীর সংখ্যা উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস করা যেতে পারে।
সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টায় আর্থিক অন্তর্ভুক্তির বাধাগুলো মোকাবিলা করে বাংলাদেশ আরও অন্তর্ভুক্তিমূলক আর্থিক ব্যবস্থা তৈরি করতে পারে, যা সব নাগরিককে ক্ষমতায়ন করে এবং টেকসই অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিকে ত্বরান্বিত করবে।
এম এম মাহবুব হাসান, বাংকার ও উন্নয়ন গবেষক
ই-মেইল: [email protected]
উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: ন ষ ঠ ন ক আর থ ক আর থ ক ব যবস থ ম ট জনস খ য র আর থ ক প র ন র জন য র র জন য ও আর থ ক র জন য ব ব শ ষ কর য দ র কর গ র হক সরক র গ রহণ ত করত র করত
এছাড়াও পড়ুন:
যক্ষ্মার নতুন ঝুঁকিতে দেশ
যক্ষ্মা নির্মূলে গত দুই দশক ধরে অন্যান্য দাতা সংস্থার মতো বাংলাদেশকে আর্থিক সহায়তা করেছে মার্কিন সহায়তা সংস্থা ইউএসএইড। গত জানুয়ারিতে যুক্তরাষ্ট্রে নতুন সরকার ক্ষমতায় আসার পর অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও বন্ধ হয়ে গেছে ইউএসএইডের অর্থায়ন। ফলে যক্ষ্মা রোগ নির্ণয়, প্রতিরোধ এবং চিকিৎসায় প্রভাব পড়েছে। বন্ধ হয়ে গেছে বেসরকারিভাবে পরিচালিত রোগ শনাক্তকরণ, গবেষণা ও সচেতনতামূলক কর্মকাণ্ড। হাসপাতালে মিলছে না ওষুধ প্রতিরোধী যক্ষ্মার সেবা। এতে যক্ষ্মার নতুন ঝুঁকিতে পড়তে যাচ্ছে বাংলাদেশ।
স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশে এখনও শনাক্তের বাইরে ১৭ শতাংশ যক্ষ্মা রোগী। এ রোগীরা অজান্তেই যক্ষ্মার জীবাণু দ্রুত ছড়াতে সহায়তা করবে এবং যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচি বন্ধের কারণে নতুন রোগী শনাক্ত কার্যক্রম ব্যাহত হবে। এতে যক্ষ্মা নিয়ে নতুন করে সংকটে পড়তে পারে দেশ। এ জন্য এখনই স্থগিত কার্যক্রম সচল করতে সরকারের উদ্যোগ নেওয়া জরুরি। অন্য উৎস থেকে সহায়তা পেতে নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে কাজ করতে হবে।
এমন পরিস্থিতিতে আজ সোমবার অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও নানা আয়োজনে পালিত হচ্ছে বিশ্ব যক্ষ্মা দিবস। রোগটির ক্ষতিকর দিক, বিশেষ করে স্বাস্থ্য, সামাজিক ও অর্থনৈতিক পরিণতি সম্পর্কে সচেতনতা বাড়াতে প্রতিবছর দিবসটি পালিত হয়। দিনটির এবারের প্রতিপাদ্য– ‘প্রতিশ্রুতি, বিনিয়োগ ও সেবাদান দ্বারা সম্ভব হবে যক্ষ্মামুক্ত বাংলাদেশ গড়া’।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য বলছে, গত বছর বিশ্বে যক্ষ্মা রোগী শনাক্ত হয়েছে ৩ লাখ ১৬ হাজার ৩৭৪ জন। এর মধ্যে ১০ শতাংশই শিশু। ২০২৩ সালে যক্ষ্মায় বিশ্বের ৪৪ হাজার মানুষ মারা গেছে। এখনও ১৭ শতাংশ রোগী শনাক্তের বাইরে। ২০৩৫ সালের মধ্যে যক্ষ্মা নির্মূলের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে হলে শনাক্তের বাইরে থাকা রোগীদের চিহ্নিত করে চিকিৎসার আওতায় আনতে হবে।
ওষুধ প্রতিরোধী যক্ষ্মা নির্মূল কার্যক্রম স্থগিত
যক্ষ্মা আক্রান্ত রোগীকে চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী ছয় মাস নিয়মিত ওষুধ সেবন করতে হয়। নির্দিষ্ট মাত্রায় নিয়মিত এবং পূর্ণ মেয়াদে ওষুধ না খেলে যক্ষ্মার জীবাণু ওই ওষুধের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলে। বাংলাদেশে যক্ষ্মায় আক্রান্ত রোগীদের অবহেলা ও অসচেতনতায় এই ওষুধ প্রতিরোধী যক্ষ্মা বা এমডিআর টিবি বাড়ছে। যাদের একটা বড় অংশই মারা যান। ওষুধ প্রতিরোধী যক্ষ্মা রোগী কমাতে রাজধানীসহ দেশে সাত বক্ষব্যাধি হাসপাতালে আলাদা চিকিৎসকের মাধ্যমে সেবা দেওয়া হতো। এই প্রকল্পটিও বাস্তবায়ন হতো ইউএসএইডের অর্থায়নে।
২০২১ সালে ইউএসএইডের সহায়তায় রাজধানীর শ্যামলীতে দেশের প্রথম ওয়ানস্টপ যক্ষ্মা (টিবি) নামে এই সেবা কেন্দ্রের উদ্বোধন করা হয়। একজন চিকিৎসক দিয়ে এ সেবা নিশ্চিত করা হতো। গত জানুয়ারিতে ইউএসএইডের অর্থায়ন বন্ধ হয়ে গেলে ওই চিকিৎসককে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে বলে জানান শ্যামলী টিবি হাসপাতালের উপপরিচালক ডা. আয়েশা আক্তার। তিনি বলেন, আমাদের হাসপাতালে ওয়ানস্টপ টিবি সার্ভিস সেন্টার যক্ষ্মা রোগীদের জন্য সেবা চলমান আছে। রোগীদের সেবা চলমান রাখতে আমাদের চিকিৎসকদের প্রশিক্ষণ দিয়ে দক্ষ করে গড়ে তোলা হয়েছে। তারাই সার্বিক চিকিৎসা দিচ্ছেন। বর্তমানে হাসপাতালে ২১ জন রোগী ভর্তি আছেন। এর মধ্যে ৫ জন ওষুধ প্রতিরোধী যক্ষ্মায় (এমডিআর টিবি) আক্রান্ত।
‘জানাও’ অ্যাপ বন্ধ
যক্ষ্মা প্রতিরোধে ইউএসএইডের সহায়তায় ২০১৮ সালে ‘জানাও’ নামে একটি অ্যাপ প্রস্তুত করা হয়। সারাদেশে ৫০০ চিকিৎসক নিয়ে পাইলট আকারে অ্যাপটির ব্যবহার শুরু হয়েছিল। সাফল্য দেখে এক পর্যায়ে এটি উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়। অ্যাপে নিবন্ধিত যে কোনো চিকিৎসক যক্ষ্মা রোগীর সন্ধান পেলে তাঁকে এ অ্যাপে নিবন্ধন করে দিতেন। এ পর্যন্ত অ্যাপের মাধ্যমে চিকিৎসা সেবা নিয়ে অন্তত ৭ হাজার রোগী যক্ষ্মা মুক্ত হয়েছেন। ইউএসএইডের অর্থায়ন বন্ধ হওয়ায় বর্তমানে অ্যাপটি বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে বলে জানা গেছে। ছাঁটাই করা হয়েছে এতে নিয়োজিত কর্মীদেরও।
আইসিডিডিআর,বির সাত প্রকল্প স্থগিত
নাম প্রকাশ না করার শর্তে আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশের (আইসিডিডিআর,বি) এক বিজ্ঞানী জানান, ইউএসএইডের অর্থায়নে আইসিডিডিআর,বিতে সাত প্রকল্প চলমান ছিল। এগুলো সব বন্ধ হয়ে গেছে। চাকরিচ্যুত করা হয়েছে এসব কাজে জড়িত প্রায় এক হাজার কর্মীকে। এসব প্রকল্পের মাধ্যমে যক্ষ্মার সক্রিয় রোগী সন্ধান, স্ক্রিনিং ও সংস্পর্শে আসা ব্যক্তিদের শনাক্ত করা হতো। যেহেতু এসব কার্যক্রম বন্ধ হয়ে গেছে, তাই আগামী বছর যক্ষ্মার নতুন ঝুঁকিতে পড়বে বাংলাদেশ। বর্তমানে ১৭ শতাংশ রোগী শনাক্তের বাইরে রয়েছে। নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম না থাকায় দ্রুতগতিতে যক্ষ্মা ছড়িয়ে পড়ার শঙ্কা তৈরি হবে।
ওই বিজ্ঞানী আরও জানান, আইসিডিডিআর,বিতে একই সঙ্গে বেশ কিছু গবেষণা প্রকল্প চলমান ছিল ইউএসএইডের সহায়তায়। এগুলো স্থগিত হওয়ায় নতুন চিকিৎসা ও প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থার উন্নয়ন থমকে গেছে। সংকট কাটিয়ে উঠতে এসব প্রকল্প চলমান রাখতে হবে। এ ক্ষেত্রে সরকারকে এগিয়ে আসতে হবে বা অন্য কোনো দাতা সংস্থাকে যুক্ত করতে হবে নতুন করে। বিষয়গুলো নিয়ে আমরা সরকারের সঙ্গে আলোচনা করেছি। তবে গত ৯ মাস স্বাস্থ্যের কোনো অপারেশন প্ল্যান নেই। ফলে ব্যাহত হচ্ছে স্বাস্থ্য খাতের বিভিন্ন সেবা। অপারেশন প্ল্যানের মাধ্যমে যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচিও ছিল। যদি অপারেশন প্ল্যান চালু থাকত, তাহলে এখান থেকে কিছু আর্থিক সহায়তা নেওয়া সম্ভব হতো। সে পথও বন্ধ।
ব্র্যাকের গবেষণা স্থগিত
ইউএসএইডের সহায়তায় বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ব্র্যাকেও যক্ষ্মা নিয়ে গবেষণা প্রকল্প ছিল। গত জানুয়ারিতে সেটি বন্ধ হয়ে গেছে। সংস্থাটির যক্ষ্মা কর্মসূচির লিড টেকনিক্যাল পারসন ডা. ফারহানা নিশাত সেহেলী বলেন, গত জানুয়ারি থেকে ইউএসএইডের অর্থায়নে চলমান গবেষণা প্রকল্প বন্ধ রয়েছে। তবে দুই মাসে তেমন কোনো প্রভাব লক্ষ্য করা যায়নি। এসব কর্মকাণ্ড দীর্ঘমেয়াদে বন্ধ থাকলে প্রভাব পড়বেই।
যক্ষ্মা সম্পর্কে সচেতনতারও অভাব
দেশে যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণে জাতীয় যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির সঙ্গে দীর্ঘদিন কাজ করছে আইসিডিডিআর,বি। প্রতিষ্ঠানটির সিনিয়র সায়েন্টিস্ট সায়েরা বানু বলেন, ‘যক্ষ্মার চিকিৎসা বিনামূল্যে পাওয়া যায় এটা অনেকেই জানে না। মানুষের মধ্যে যক্ষ্মা সম্পর্কে সচেতনতারও অভাব রয়েছে। যক্ষ্মা মোকাবিলায় শুধু সরকার বা যক্ষ্মা নিয়ে কাজ করে এমন সংস্থার উদ্যোগ যথেষ্ট নয়। এর মধ্যে হঠাৎ করে ইউএসএইডের সহায়তা বন্ধে নতুন সংকট তৈরি করেছে। এই সংকট নিরসনে সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি দেশি-বিদেশি দাতা সংস্থার এগিয়ে আসতে হবে। যক্ষ্মা নির্মূলের লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের জন্য নিশ্চিত করতে হবে সেবা জনগণের দোরগোড়ায় পৌঁছানো।
যা বলছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর
জাতীয় যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির (এনটিপি) প্রোগ্রাম ম্যানেজার ডা. জাহাঙ্গীর কবির বলেন, আমরা যক্ষ্মা রোগ নির্ণয়ে অনেক সাফল্য অর্জন করেছি। এনটিপি মূলত চলে গ্লোবাল ফান্ডে। তাই ইউএসএইডের অর্থায়ন বন্ধে সরকারি কোনো প্রকল্পে প্রভাব পড়বে না। তবে এ জনস্বাস্থ্যবিষয়ক সমস্যা পুরোপুরি কাটিয়ে উঠতে সরকার ও বেসরকারি খাতকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে।