জেলা শিল্পকলা একাডেমির ভাড়া কমলো, খুশি সংস্কৃতিকর্মীরা
Published: 17th, February 2025 GMT
সারাদেশের জেলা শিল্পকলা একাডেমির হলের ভাড়া কমলো। বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির ১২৫তম পরিষদ সভায় জেলা শিল্পকলা একাডেমির মিলনায়তনসমূহের ভাড়া পুনঃনির্ধারণ করা হয়েছে। গতকাল এ তথ্য জানিয়েছে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি।
জানা গেছে, ঢাকার শিল্পকলা একাডেমির জাতীয় নাট্যশালায় ৭৫০ আসনের প্রধান মিলনায়তন সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছে ভাড়া দেওয়া হয় ৬ হাজার টাকায়। ৩৫০ আসনের পরীক্ষণ থিয়েটার মিলনায়তন ভাড়া নিতে গুনতে হয় ৩ হাজার ৬০০ টাকা এবং স্টুডিও থিয়েটার মিলনায়তনের জন্য ভাড়া দিতে হয় ২ হাজার ৪০০ টাকা। অন্যদিকে জেলা শিল্পকলা একাডেমিতে সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে ৫০১ থেকে ১ হাজার আসনের মিলনায়তনের জন্য প্রথম তিন ঘণ্টা পর্যন্ত ৮ হাজার ৫০০ টাকা ভাড়া দিতে হয়। তবে যে জেলায় শিল্পকলা একাডেমির আধুনিক ভবন হয়েছে, সেসব জেলায় এলইডি সুবিধা ব্যবহার করতে হলে আলাদা টাকা গুনতে হয়। সেখানে মোট ১৪ হাজার টাকা ভাড়া গুনতে হয়। এ ছাড়া তিন ঘণ্টার অতিরিক্ত ব্যবহার হলে প্রতি ঘণ্টায় (এসিসহ) বাড়তি ২,৫০০ টাকা পরিশোধ করতে হয়। কিন্তু ঢাকায় জাতীয় নাট্যশালায় সকাল ৯টা থেকে দুপুর ২টা এবং বিকেল ৩টা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত ব্যবহারে আলাদা কোনো টাকা দিতে হয় না।
শিল্পকলা একাডেমির পরিষদ সভার সিদ্ধান্ত মোতাবেক জেলা শিল্পকলা একাডেমির সেন্ট্রাল এসি সমৃদ্ধ হলের [৫০০ আসন] আসন ভাড়া করা হয়েছে চার হাজার টাকা। স্প্রিন্ট এসির হল ভাড়া [৫০০ আসন] হয়েছে তিন হাজার টাকা। মিলনায়তনে এলইডি লাইট ব্যবহারের ক্ষেত্রে ভাড়া নির্ধারণ করা হয়েছে চার হাজার টাকা।
জেলা শিল্পকলা একাডেমির হল ভাড়া কমায় খুশি সাংস্কৃতিক কর্মীরা। এর মাধ্যমে তৃণমূল পর্যায়ে নাট্যচর্চা আরও প্রসারিত হবে বলে মন্তব্য করেছেন কেউ কেউ। অনেকেই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে শিল্পকলার এ সিদ্ধান্তকে সাধুবাদ জানিয়েছেন।
সংস্কৃতিকর্মী নিথর মাহবুব বলেন, ‘সারাদেশের সংস্কৃতিকর্মীদের জন্য এটি একটি আনন্দের খবর। কর্তৃপক্ষকে এ রকম সিদ্ধান্তের জন্য ধন্যবাদ জানাচ্ছি। এমন সিদ্ধান্তে তৃণমূল পর্যায়ে নাট্যচর্চা আরও প্রসারিত হবে বলে মনে করছি।
খন্দকার শাহ আলম বলেন, ‘দীর্ঘদিনের দাবির বাস্তবায়ন দেখে খুব ভালো লাগল। সারাদেশের সাংস্কৃতিক সংগঠনের পক্ষ থেকে পরিষদ সভাপতি মাননীয় উপদেষ্টা ও পরিষদ সচিব, মহাপরিচালক বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমিসহ সম্মানিত পরিষদ সদস্যগণের প্রতি ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি। এ ধরনের প্রণোদনা সংস্কৃতির বিকাশে ব্যাপক ভূমিকা রাখবে বলে বিশ্বাস করি।’
উৎস: Samakal
এছাড়াও পড়ুন:
সংস্কৃতির ভুবন আলোকিত করে সন্জীদা খাতুনের বিদায়
আজীবন দেশের সংস্কৃতির ভুবন আলোকিত করার গুরুদায়িত্ব পালন করে বিদায় নিলেন সন্জীদা খাতুন। গতকাল মঙ্গলবার ৯২ বছর পূর্ণ করার কিছু আগে প্রয়াত হলেন দেশের এই অগ্রগণ্য সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব। আগামী ৪ এপ্রিল তিনি ৯৩ বছরে পদার্পণ করতেন। জন্মদিনের পরিবর্তে সেদিনে হবে তাঁর স্মরণসভা।
রাজধানীর স্কয়ার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় গতকাল বেলা ৩টা ১০ মিনিটে হৃৎস্পন্দন থেমে যায় সন্জীদা খাতুনের (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)। তাঁর ছেলে পার্থ তানভীর নভেদ ও পুত্রবধূ লাইসা আহমদ লিসা জানিয়েছেন, তাঁর হৃদ্যন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ (হার্ট অ্যাটাক) হয়েছিল। বেশ কিছুদিন ধরেই তিনি সুস্থ ছিলেন না। তাঁর ছিল কিডনির জটিল রোগ। নিউমোনিয়াতেও আক্রান্ত হয়েছিলেন। ১৯ মার্চ তাঁকে স্কয়ার হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। এরপর নেওয়া হয় আইসিইউতে। অবস্থার বিশেষ উন্নতি হয়নি।
সন্জীদা খাতুনের বড় মেয়ে অপালা ফরহাদ নভেদ আগেই প্রয়াত। ছেলে পার্থ তানভীর নভেদ আর মেয়ে রুচিরা তাবাসসুম নভেদসহ অনেক আত্মীয়স্বজন ও দেশ-বিদেশে অসংখ্য গুণগ্রাহী রেখে গেছেন বহু গুণের অধিকারী অনাড়ম্বর জীবন যাপন করা এই মানুষটি। তাঁর ছেলেমেয়েরা জানিয়েছেন, মরদেহ রাতে হিমঘরে রাখা হবে।
সর্বজনের শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য আজ বুধবার দুপুর সাড়ে ১২টায় আনা হবে তাঁর হাতে গড়া দেশের অগ্রগণ্য সংগীত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ছায়ানট সংস্কৃতি–ভবনে। সন্জীদা খাতুনের অনেক নাতি–নাতনি ও ঘনিষ্ঠ বহু আত্মীয় বিদেশে অবস্থান করছেন। তাঁরা শেষবিদায় জানাতে আসবেন। সে কারণে দাফনের দিনক্ষণ পরে ঠিক করা হবে। ৪ এপ্রিল সন্জীদা খাতুনের জন্মদিনে ছায়ানটে স্মরণসভা করার পরিকল্পনা করা হলেও সময় এখনো ঠিক হয়নি।
সন্জীদা খাতুনের কীর্তির ধারা বিচিত্র। তিনি ছিলেন একাধারে শিক্ষক, গবেষক, শিল্পী, সংগীতজ্ঞ, সংগঠক ও সক্রিয় সাংস্কৃতিক নেত্রী। ছিলেন ছায়ানট ও রবীন্দ্রসঙ্গীত সম্মিলন পরিষদের সভাপতি। ব্যতিক্রমী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নালন্দার প্রতিষ্ঠাতা। জনসাধারণের সাংস্কৃতিক বোধের উন্নয়ন এবং মুক্ত–উদার মানবিক সমাজ নির্মাণের অবিরাম প্রচেষ্টাই ছিল তাঁর জীবনের ব্রত। তাঁর মৃত্যুর সংবাদ ছড়িয়ে পড়ার পরে দেশের শিল্প–সাংস্কৃতিক অঙ্গনে শোকের ছায়া নেমে আসে। আত্মীয়স্বজন ছাড়াও তাঁর সহযোদ্ধা, সহশিল্পী, ছাত্রছাত্রী ও গুণমুগ্ধরা শোকার্ত চিত্তে স্কয়ার হাসপাতালে ছুটে যান। অনেকেই ছিলেন অশ্রুসিক্ত।
মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি মফিদুল হক হাসপাতালে প্রথম আলোকে বললেন, তিনি দীর্ঘ জীবন পেয়েছিলেন এবং জীবনকালটা মানুষের জন্য উজাড় করে দিয়েছেন। জনমানসে সংগীত, শিল্প, সাহিত্যের বোধ সৃষ্টি এবং এর সঙ্গে সামাজিক–সাংস্কৃতিক দায়বদ্ধতার বোধ সঞ্চার করে গেছেন। বিপুলভাবে তিনি বাঙালির জীবন সমৃদ্ধ করে তোলার কাজ করেছেন। তাঁর মতো দ্বিতীয় কেউ নেই।
রবীন্দ্রসঙ্গীত সম্মিলন পরিষদের সহসভাপতি ও শিল্পী বুলবুল ইসলাম বলেন, দেশে রবীন্দ্রসংগীতের প্রসার ও সংস্কৃতিচর্চার ক্ষেত্রে ওয়াহিদুল হক, জামিল চৌধুরী ও সন্জীদা খাতুন—এই তিনজনের ভূমিকা পথিকৃতের মতো। তাঁরা সাংস্কৃতিক আন্দোলনের মাধ্যমে রাজনৈতিক আন্দোলনের পথ সুগম করেছেন। দুজন আগেই প্রয়াত। এখন তৃতীয়জনও চলে গেলেন। নিজেকে অভিভাবকহীন মনে হচ্ছে।
ছায়ানটের তবলার শিক্ষক এনামুল হক ওমর বললেন, যে অসাধারণ সাংগঠনিক দক্ষতায় তিনি সারা দেশের সাংস্কৃতিক কর্মী ও শিল্পীদের সংগঠিত করেছেন, ছায়ানটকে পরিচালনা করেছেন, তার তুলনা হয় না। তাঁর প্রয়াণ জাতির জন্য অপরিমেয় ক্ষতি।
সন্জীদা খাতুনের মৃত্যুতে শোক জানিয়েছে ছায়ানট, উদীচী, চারণ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগসহ বিভিন্ন সাংস্কৃতিক সংগঠন।
সন্জীদা খাতুনের জন্ম ১৯৩৩ সালের ৪ এপ্রিল। তাঁর বাবা কাজী মোতাহার হোসেন ছিলেন জাতীয় অধ্যাপক। মা সাজেদা খাতুন গৃহিণী। সন্জীদা খাতুন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৫৪ সালে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে স্নাতক, ১৯৫৫ সালে ভারতের বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর এবং ১৯৭৮ সালে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন। শিক্ষকতা দিয়ে তাঁর কর্মজীবন শুরু। দীর্ঘকাল অধ্যাপনা করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে।
বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের শুরুতেই এতে জড়িয়ে পড়েন। মুক্তিযুদ্ধকালে কলকাতায় সংগঠিত করেন বাংলাদেশের শিল্পীদের। শিল্পী কামরুল হাসানের নেতৃত্বে সন্জীদা খাতুন ব্রতচারী আন্দোলনে যোগ দিয়েছিলেন।
সন্জীদা খাতুনের প্রথম গানের গুরু ছিলেন সোহরাব হোসেন। তাঁর কাছে তিনি দীক্ষা নেন নজরুলসংগীত, আধুনিক বাংলা গান ও পল্লিগীতির। প্রথমে রবীন্দ্রসংগীত শিখেছেন প্রখ্যাত হুসনে বানু খানমের কাছে। এরপর তালিম নেন শৈলজারঞ্জন মজুমদার, আবদুল আহাদ, কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়, নীলিমা সেনদের মতো বিখ্যাত রবীন্দ্রসংগীতশিল্পীদের কাছ থেকে।
আইয়ুব খানের কঠোর শাসনকালে নানা বাধা অগ্রাহ্য করে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্মশতবর্ষ উদ্যাপনে তিনি ও সংগীতজ্ঞ ওয়াহিদুল হক অন্যতম ভূমিকা পালন করেছিলেন। এরই ধারাবাহিকতায় দেশের ঐতিহ্যবাহী সংগীত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ছায়ানটের যাত্রা শুরু। ১৯৬৭ সালে তাঁরা রমনার বটমূলে প্রথমবারের মতো বাংলা নববর্ষের প্রথম দিন পয়লা বৈশাখে আয়োজন করে প্রভাতি গানের আসর। ছায়ানটের এই অনুষ্ঠান থেকেই প্রাণিত হয়ে নববর্ষ উদ্যাপন এখন দেশজুড়ে বিপুল এক অসাম্প্রদায়িক উৎসব। ধর্মীয় উগ্রবাদীরা ছায়ানটের এই প্রভাতি গানের আসরে ২০০১ সালে ভয়াবহ বোমা হামলা চালালেও অনুষ্ঠানের ধারাবাহিকতায় ছেদ পড়েনি।
এসব সাংগঠনিক কর্মকাণ্ডের বাইরে সন্জীদা খাতুনের গবেষণা ও রচনার কাজও কম নয়। তাঁর রচিত গ্রন্থের সংখ্যা ২০টির অধিক। রবীন্দ্রসংগীতের ভাবসম্পদ, কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত, স্বাধীনতার অভিযাত্রা, সাহিত্য কথা সংস্কৃতি কথা, নজরুল মানস ইত্যাদি তাঁর উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ।
সন্জীদা খাতুন দেশে একুশে পদক ও বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার পেয়েছেন। এ ছাড়া সম্মানিত হয়েছেন ভারত সরকারের পদ্মশ্রী পদক, পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকারের দেশিকোত্তম পুরস্কার এবং কলকাতার টেগোর রিসার্চ ইনস্টিটিউটের রবীন্দ্র–তত্ত্বাচার্য উপাধিতে।