ইসলাম কি কোনো ধর্ম নাকি জীবনবিধান?
Published: 17th, February 2025 GMT
বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম ও সবচেয়ে দ্রুত বর্ধনশীল ধর্ম ইসলাম। ইসলামের বর্তমান অনুসারীর সংখ্যা প্রায় ২০০ কোটি, যা বর্তমান বিশ্বের মোট জনসংখ্যার ২৪ দশমিক ৪ শতাংশ। (‘হোয়াই ইসলাম ইজ দ্য ওয়ার্ল্ড ফাস্টেস্ট গ্রোয়িং রিলিজিয়ন’, পিউ রিসার্চ সেন্টার, মাইকেল লিপিকা অ্যান্ড কনরড হাসিকেট)
ইসলাম মূলত কী? এটা কি কোনো ধর্ম, নাকি জীবনবিধান? নাকি কোনো দর্শন বা সংস্কৃতি? ইসলাম আরবি শব্দ। মূল ধাতু ‘সিলমুন’ থেকে শব্দটি উৎপন্ন হয়েছে। কোনো কোনো অভিধানকারের মতে, ইসলামের শাব্দিক অর্থ ‘শান্তি’ ও ‘আত্মসমর্পণ’। (হোয়াট ইসলাম ইজ অল অ্যাবাউট, ইয়াসির ক্বাদি, অনুবাদ: আলী আহমদ মাবরুর, গার্ডিয়ান পাবলিকেশন্স, পৃষ্ঠা ১১৭) কোনো কোনো অভিধানকার বলেছেন, ইসলাম শব্দের বিভিন্ন অর্থ রয়েছে। এর মধ্যে আছে ‘অনুগত হওয়া’ বা ‘আনুগত্য করা’, ‘মেনে নেওয়া’, ‘বিনম্র হওয়া’, ‘নিরাপত্তা’ এবং ‘সমর্পণ’ ইত্যাদি।
আরও পড়ুনমহানবী (সা.)–র রাজনৈতিক তৎপরতা২৩ আগস্ট ২০২৩
শরিয়তের পরিভাষায় ইসলাম হলো, ‘তাওহিদের স্বীকৃতি প্রদান করার মাধ্যমে আল্লাহ–তাআলার কাছে আত্মসমর্পণ করা এবং একমাত্র তাঁর আনুগত্য গ্রহণ করা। বিনাদ্বিধায় তাঁর আদেশ-নিষেধ মেনে চলা এবং তাঁর প্রদত্ত জীবনবিধান অনুসারে জীবন যাপন করা।’ (শারহুল আকাইদিন নাসাফিয়্যা, পৃষ্ঠা ৯১) আর ইসলামি জীবনবিধান মোতাবেক যিনি বা যাঁরা জীবন যাপন করেন, তিনি বা তাঁরা হলেন ‘মুসলিম’। (দৈনন্দিন জীবনে ইসলাম, ইসলামিক ফাউন্ডেশন, পৃষ্ঠা ৩৩)
আভিধানিকভাবে ইমানের সম্পর্ক বিশ্বাসের দিকে বা সঙ্গে আর ইসলামের সম্পর্ক কর্মের দিকে বা সঙ্গে। (কুরআন-সুন্নাহর আলোকে ইসলামী আকীদা, খোন্দকার আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর, আস-সুন্নাহ পাবলিকেশন্স, পৃষ্ঠা ২৭)
আল্লাহ–তাআলার পক্ষ থেকে মুহাম্মদ (সা.) অকাট্যভাবে প্রমাণিত যে আদর্শ ও বিধিবিধান নিয়ে এসেছেন, তা মনে-প্রাণে বিশ্বাস ও অনুসরণ করার নাম ইসলাম (কাওয়াইদুল ফিকহ, মুফতি আমীমুল এহসান, পৃষ্ঠা ১৭৭)
আরও পড়ুনসুরা কাফে আল্লাহ বলেছেন মানুষ সৃষ্টির কারণ২০ আগস্ট ২০২৩আল্লাহ–তাআলা পবিত্র কোরআনে ইরশাদ করেছেন, ‘বলুন! আমার নামাজ, আমার ইবাদত, আমার জীবন ও মরণ জগৎসমূহের মালিকের উদ্দেশ্যে। তাঁর কোনো শরিক নেই। আর আমি এ জন্যই আদিষ্ট হয়েছি এবং আমি প্রথম মুসলিম।’ (সুরা আনআম, আয়াত: ১৬২-১৬৩)
ইসলামের সংজ্ঞা বা পরিচয়ের বিষয়টি সবচেয়ে সহজভাবে বিখ্যাত হাদিসে জিব্রাইল থেকে পাওয়া যায়। হজরত জিব্রাইল (আ.) একবার মানুষের বেশে উপস্থিত হয়ে রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর কাছে জিজ্ঞাসা করলেন, হে মুহাম্মদ! আমাকে ইসলাম সম্পর্কে বলুন! রাসুলুল্লাহ (সা.) বললেন, ‘আল্লাহ–তাআলা ছাড়া সত্য কোনো মাবুদ বা ইলাহ নেই এবং মুহাম্মদ (সা.) আল্লাহর রাসুল—এ কথার সাক্ষ্য প্রদান করা, নামাজ কায়েম করা, জাকাত আদায় করা, রমজান মানে রোজা রাখা এবং সামর্থ্যবানের জন্য হজ পালন করা, এটাই হলো ইসলাম।’ রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর উত্তর শুনে জিব্রাইল (আ.) বললেন, ‘আপনি সত্য বলেছেন।’ (বুখারি, হাদিস: ৮)
আবদুল্লাহ ইবনে উমর (রা.) থেকে বর্ণনায় আছে যে রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘পাঁচটি স্তম্ভের ওপর ইসলাম প্রতিষ্ঠিত। স্তম্ভগুলো হলো—১. আল্লাহ ছাড়া কোনো সত্য মাবুদ বা ইলাহ নেই এবং মুহাম্মদ (সা.) আল্লাহর রাসুল, এ কথার সাক্ষ্য প্রদান করা। ২. নামাজ কায়েম করা। ৩. জাকাত আদায় করা। ৪. রমজান মাসে রোজা রাখা এবং ৫. সামর্থ্য হলে হজ পালন করা। (মুসলিম, হাদিস: ১৬)
আরও পড়ুনসাহাবিদের যুগে বিয়ে০৮ এপ্রিল ২০২৩ইসলাম আল্লাহ–তাআলার পক্ষ থেকে নাজিল হওয়া একমাত্র মনোনীত ও চূড়ান্ত বা পরিপূর্ণ ধর্ম। ইসলাম ছাড়া অন্য কোনো ধর্ম কেউ গ্রহণ করতে চাইলে তা কবুল বা গ্রহণযোগ্য হবে না। পবিত্র কোরআনে আল্লাহ–তাআলা ইরশাদ করেছেন, ‘ইসলাম আল্লাহ–তাআলা কর্তৃক মনোনীত একমাত্র দ্বীন বা ধর্ম।’ (সুরা আলে ইমরান, আয়াত: ১৯)
এ ব্যাপারে আরও ইরশাদ হয়েছে, ‘আজ আমি তোমাদের জন্য তোমাদের দ্বীনকে পূর্ণাঙ্গ করলাম ও তোমাদের প্রতি আমার অনুগ্রহ সম্পূর্ণ করলাম এবং ইসলামকে তোমাদের দ্বীন হিসেবে মনোনীত করলাম। (সুরা মায়েদা, আয়াত: ৩)
প্রসিদ্ধ তাফসির–বিশারদ সাহাবি আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, ‘এই আয়াত পবিত্র কোরআন নাজিলের শেষ দিককার আয়াত। এরপর বিধিবিধান–সম্পর্কিত আর কোনো আয়াত নাজিল হয়নি। হজরত আদম (আ.)-এর যুগ থেকে যে সত্য ধর্ম ও খোদায়ি নিয়ামতের অবতরণ ও প্রচলন শুরু হয়েছিল এবং পরবর্তী প্রত্যেক যুগে প্রত্যেক ভূখণ্ডের অবস্থা অনুযায়ী আদম সন্তানের মধ্যে নিয়ামত বণ্টনের যে ধারা অব্যাহত ছিল, আজ সে নিয়ামত ও ধর্ম পরিপূর্ণ আকারে শেষ নবী মুহাম্মদ (সা.) ও তাঁর উম্মতকে প্রদান করা হলো।’ (তাফসীরে মাআরেফুল কোরআন, মুফতি মুহাম্মাদ শফী, অনুবাদ: মাওলানা মুহিউদ্দীন খান, পৃষ্ঠা ৩০৯)
আরও পড়ুনবিজ্ঞ ও সাহসী সাহাবি আবদুর রহমান ইবনে আউফ (রা.)১২ জুলাই ২০২৩পবিত্র কোরআনে আরও ইরশাদ হয়েছে, ‘কেউ ইসলাম ছাড়া অন্য কোনো ধর্ম বা দ্বীন গ্রহণ করতে চাইলে তা কখনো কবুল হবে না। (সুরা আলে ইমরান, আয়াত: ৮৫)
বস্তুত ইসলাম সব নবী-রাসুলের অভিন্ন ধর্ম। প্রথম নবী আদম (আ.) থেকে শেষ নবী মুহাম্মদ (সা.) পর্যন্ত সবাই এ ধর্ম বা জীবনবিধানের দিকে মানুষকে আহ্বান জানিয়েছেন। (দৈনন্দিন জীবনে ইসলাম, ইসলামিক ফাউন্ডেশন, পৃষ্ঠা ৩৩) মোট কথা, আল্লাহর প্রেরিত সব নবী-রাসুলের প্রচারিত ধর্মে মৌলিকভাবে কোনো পার্থক্য ছিল না। তবে প্রত্যেক নবী-রাসুলকে আলাদা বা ভিন্ন শরিয়ত দান করা হয়েছিল। এ ব্যাপারে পবিত্র কোরআনে আল্লাহ–তাআলা ইরশাদ করেছেন, ‘আমি তোমাদের প্রত্যেকের জন্য আলাদা শরিয়ত ও স্পষ্ট পথ নির্ধারণ করেছি। (সুরা মায়েদা, আয়াত: ৪৮)
হজরত ইব্রাহিম (আ.) সর্বপ্রথম নিজ ধর্মকে ‘ইসলাম’ নামে এবং তাঁর অনুসারীদের ‘উম্মতে মুসলিমা’ নামকরণে অভিহিত করেন। এ ব্যাপারে পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘এটা তোমাদের পিতা ইব্রাহিমের মিল্লাত। তিনি আগে তোমাদের নামকরণ করেছেন মুসলিম।’ (সুরা হজ, আয়াত: ৭৮)
আরও পড়ুনদেখতে মনে হয়েছে পরাজয়, আল্লাহ বলেছেন বিজয়১৮ আগস্ট ২০২৩ইসলামই মানুষের স্বভাবজাত ধর্ম। দ্বীনে ফিতরাত বা সহজাত জীবনবিধান। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘প্রত্যেক শিশু স্বভাবসুলভ সহজাত প্রকৃতির (ইসলামের) ওপর জন্মগ্রহণ করে। এরপর তার পিতামাতা তাকে ইহুদি, খ্রিষ্টান বা আগুনপূজারি বানায়। (বুখারি, হাদিস: ১৩৫৮)
হজরত আদম (আ.) থেকে শুরু করে বিভিন্ন যুগের বিভিন্ন নবী-রাসুলের মাধ্যমে ইসলাম ধর্মের যে ধারা যুগে যুগে অনুসৃত হয়েছে, রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর মাধ্যমে সে ধারার পরিপূর্ণ পরিসমাপ্তি ঘটেছে। তিনিই সর্বশেষ নবী। আখেরি রাসুল। তারপরে আর কোনো নবী বা রাসুলের আগমন এ ধরাতে ঘটবে না এবং তাঁর মাধ্যমে পূর্ববর্তী সব নবী-রাসুলের শরিয়ত বা জীবনবিধান রহিত হয়েছে। সুতরাং বর্তমানে এবং ভবিষ্যতে—কিয়ামত পর্যন্ত ইসলাম বলতে রাসুলুল্লাহ (সা.) কর্তৃক আনীত দ্বীন তথা জীবনবিধানকে বোঝা হবে। (দৈনন্দিন জীবনে ইসলাম, ইসলামিক ফাউন্ডেশন, পৃষ্ঠা ৩৪)
আরও পড়ুনবাল্যবিবাহ নিয়ে ইসলামের অভিজ্ঞতা কী১২ আগস্ট ২০২৩উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: আল ল হ ত আল জ বনব ধ ন ইসল ম র ইসল ম ক কর ছ ন বল ছ ন দ ন কর আগস ট
এছাড়াও পড়ুন:
কালিমা শাহাদাত সত্য সাক্ষ্য
ইসলাম হলো সত্যকে গ্রহণ করা এবং অসত্যকে পরিহার, পরিত্যাগ বা বর্জন করা। ইমান বা বিশ্বাসের মূল কথা হলো কালিমা। কালিমা শাহাদাত হলো ইমান ও ইসলামের পঞ্চ ভিত্তির অন্যতম ভিত্তি। কালিমা অর্থ শব্দ, বাণী বা বাক্য; শাহাদাত অর্থ সাক্ষ্য দেওয়া। কালিমা শাহাদাত অর্থ সাক্ষ্য বাণী। কালিমা শাহাদাত ফারসিতে হয় ‘কালেমায়ে শাহাদাত’; মূল আরবিতে হবে ‘কালেমাহ শাহাদাত’ বা ‘আল কালিমাতুশ শাহাদাত’।
কালিমা শাহাদাতকালিমা শাহাদাতে এই ঘোষণাই দেওয়া হয়, ‘আশহাদু আল্লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু, ওয়াহদাহু লা শারিকা লাহু; ওয়া আশহাদু আন্না মুহাম্মাদান আবদুহু ওয়া রাসুলুহু।
কালিমা শাহাদাত এর অর্থঅর্থাৎ ‘আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে এক আল্লাহ ব্যতীত আর কোনো মাবুদ নাই, তিনি এক ও একক, তাঁর কোনো শরিক বা অংশীদার নাই; আমি আরও সাক্ষ্য দিচ্ছি নিশ্চয়ই হজরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আল্লাহ তায়ালার অতি প্রিয় খাস বান্দা ও তাঁর প্রেরিত রাসুল।’মহান আল্লাহ তায়ালা হলেন পরম সত্য বা মহাসত্য। এই সত্যের সাক্ষ্যই হলো ইমান বা ইমানের দাবি। সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ মহামানব প্রিয় নবী আখেরি নবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) হলেন মহাসত্যবাদী ও পরম বিশ্বাসী বা বিশ্বস্ত ব্যক্তি। তাঁর সত্য নবুয়ত ও রিসালাতের প্রতি অকুণ্ঠ সমর্থন ও নিঃশর্ত সাক্ষ্য প্রদান ইমানেরই অংশ। তাঁর প্রতি আস্থা, বিশ্বাস ও ভালোবাসা হলো ইমান। তাঁর আনুগত্য ও অনুসরণ হলো ইসলাম।
সাক্ষ্য দেওয়ার পূর্বশর্ত হলো প্রত্যক্ষ করা বা স্বচক্ষে অবলোকন করা বা দেখা। মহান আল্লাহ তায়ালা এমনই পরম সত্য, যা দৃশ্যমান হওয়া দিবালোকের মতো সুস্পষ্ট; তাই এটি প্রত্যক্ষকারীদের অপেক্ষা রাখে না। প্রিয় নবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর সততা ও সত্যবাদিতা জগৎ–খ্যাত ও প্রশ্নাতীত। যারা তাঁর জানের দুশমন ও প্রাণের শত্রু ছিল, তারাও তাঁর সত্যতা ও বিশ্বস্ততার প্রতি দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করেছে। এ বিষয় দুটি উদ্ধৃত হয়েছে এভাবে, ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মালিকুল হাক্কুল মুবিন, মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহি ছদিকুল ওয়াদিল আমিন।’ অর্থাৎ ‘এক আল্লাহ ছাড়া দ্বিতীয় কোনো মাবুদ নেই, তিনি শাসক অধিপতি, তিনিই সুস্পষ্ট ও পরম সত্য; হজরত মুহাম্মদ (সা.) মহান আল্লাহর প্রেরিত রাসুল, চরম সত্যবাদী, ওয়াদা ও অঙ্গীকার রক্ষাকারী এবং পরম বিশ্বস্ত ও অতি বিশ্বাসী। (আল মুফরাদাত, বুখারি)। সব নবী ও রাসুল সত্যবাদী ছিলেন। আল্লাহ তায়ালা কোরআন কারিমে বলেন, ‘আপনি এই গ্রন্থে হজরত ইব্রাহিম (আ.)-এর বিষয় আলোচনা করুন, নিশ্চয় তিনি ছিলেন সত্যবাদী নবী।’ (সুরা- মারিয়াম, আয়াত: ৪১)।
আরও পড়ুনআল্লাহর কাছে যে দোয়া করেছিলেন নবী সোলায়মান (আ.) ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ইসলামের শিক্ষাসমূহের প্রধান তিনটি শিক্ষা হলো:সত্যতা, পবিত্রতা ও প্রেম। আল্লাহ তায়ালাকে পেতে হলে তাঁর প্রতি প্রেম থাকতে হবে; তাঁর প্রিয়তম মানুষ হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর প্রতি বিশ্বাস ও ভালোবাসা থাকতে হবে, থাকতে হবে পূর্ণ আনুগত্য; এটাই হলো প্রেম।
আল্লাহ তায়ালা পবিত্র, তিনি ‘সুব্বুহুন কুদ্দুস’ তথা পরম পবিত্র; তাঁর প্রিয় হাবিব হজরত মুহাম্মদ (সা.) সর্বদা পবিত্র জীবন যাপন করেছেন। তাই আল্লাহ ও তাঁর রাসুল হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর প্রেমিক হতে হলে তাকে পবিত্র জীবন যাপন করতে হবে; এটাই হলো পবিত্রতা।
ইমান ও ইসলামের জন্য যেহেতু জীবনের পবিত্রতা শর্ত, তাই বিশ্বাসী মোমিন বান্দাকে সদা সত্যাশ্রয়ী হতে হয়; এটাই হলো সত্যতা। আশেক ও মাশুকের মাঝে আড়াল থাকে না, সুতরাং এখানে মিথ্যার অনুপ্রবেশের সুযোগই থাকে না। মিথ্যার ধূম্রজাল হলো বেড়া বা আড়াল; মিথ্যা যেখানে আসে সেখানে প্রেম থাকে না।
সত্যতা মানুষকে সব কলুষ ও কালিমা থেকে পবিত্র করে, পবিত্রতা মানুষের মাঝে প্রেমভাব জাগ্রত করে; শুদ্ধাচারের প্রতি উদ্বুদ্ধ করে, শুদ্ধাচার বা পবিত্রতা মানুষকে সত্যতা বা পরম সত্যে উপনীত করে।
সত্য সাক্ষ্যদানের মাধ্যমেই মোমিনের ইমানের সূচনা হয়; তাই মোমিন ব্যক্তির সারা জীবন এই সত্যকে আঁকড়ে ধরে রাখতে হয়; এ যে তার ইমান, তার বিশ্বাস। বিশ্বাসের সঙ্গে প্রতারণা বা বিশ্বাসঘাতকতা আত্মপ্রবঞ্চনার শামিল।
সত্য ব্যতীত মানুষ মোমিন হয় না; মুসলমান কখনো অসত্য বলে না। ইসলামে সব সময় সত্য বলা ও সত্য সাক্ষ্য দেওয়া ফরজ ইবাদত ও জরুরি কর্তব্য বলে পরিগণিত। এই সত্যতা মনোজগতে, চিন্তাচেতনায়, কল্পনায় ও পরিকল্পনায়। এই সত্যতা মুখের ভাষায়। এই সত্যতা যাবতীয় কর্মকাণ্ডে, অঙ্গপ্রত্যঙ্গে। সত্যতা বা সততা প্রতিটি কদমে বা পদক্ষেপে; সত্যতা বা সততা প্রতিটি ছোঁয়া বা স্পর্শে; সত্যতা বা সততা প্রতিটি দৃষ্টি–পলক বা ভ্রু-কুঞ্চনে; সত্যতা বা সততা প্রতিটি ধ্বনিতে, প্রতিটি শব্দে ও প্রতিটি বাক্যে; সত্যতা বা সততা প্রতিটি শ্রবণে ও অনুভবে।
আরও পড়ুননামাজ বিশ্বাসীদের কাছে মিরাজ ২৭ জানুয়ারি ২০২৫অসত্য ভাষণ, মিথ্যা বিবৃতি, মিথ্যা অভিযোগ, মিথ্যা সাক্ষ্য সমাজকে কলুষিত করে। এর দ্বারা ন্যায়বিচার বা সুশাসনের বিলুপ্তি ঘটে। সৎশাসনের অভাবে সমাজে অন্যায়, অত্যাচার, জুলুম, অনাচার বেড়ে গিয়ে অরাজকতার সৃষ্টি হয়।
সত্যের বিপরীত হলো মিথ্যা বা অসত্য। মিথ্যা বলা হারাম ও চরম পাপকার্য। হাদিস শরিফে রয়েছে, ‘মিথ্যা পাপের জননী।’ (বুখারি শরিফ)। ‘সত্য মানুষকে মুক্তি দেয়, মিথ্যা মানুষকে ধ্বংস করে দেয়।’ কারণ, মানুষ যখন হারাম বা পাপকার্য সংঘটন করে, তখন তার ইমান বা বিশ্বাস তার সঙ্গে সক্রিয় থাকে না। তখন তার ইমান বা বিশ্বাস তার থেকে আলাদা হয়ে শূন্যে ঝুলতে থাকে; যতক্ষণ পর্যন্ত সে ওই মিথ্যায় বা পাপে লিপ্ত থাকে। (বুখারি শরিফ ও মুসলিম শরিফ)। পুনরায় তওবা করে অনুতপ্ত হয়ে মিথ্যা ও পাপ বর্জনের দৃঢ় প্রত্যয় গ্রহণ করলেই ইমান আবার তার কাছে ফিরে আসে। (ফাতাওয়া আলমগিরি)।
মিথ্যার পরিণতি সম্পর্কে আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘তোমরা জগতে ভ্রমণ করো ও দেখো, মিথ্যাবাদীদের কী পরিণতি হয়েছিল!’ (সুরা আলে ইমরান, আয়াত: ১৩৭)।
আরও পড়ুনঅর্থ বুঝে নামাজ পড়ার ফজিলত১৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৫রোজ কিয়ামতে হাশরের ময়দানে বিচারের সময় মানুষ নিজের প্রতি সাক্ষ্য দেবে। যারা ইহজগতে মিথ্যা বলে অভ্যস্ত তারা পরকালে মিথ্যা; তারা নিষ্পাপ পবিত্রাত্মা ফেরেশতাদের বিরুদ্ধে মিথ্যা অভিযোগ তুলবে। তখন মহান আল্লাহ তায়ালা তাদের জবান বন্ধ করে দিয়ে তাদের পাপ সম্পাদনকারী অঙ্গপ্রত্যঙ্গের সাক্ষ্য নেবেন। ‘আজ আমি তাদের মুখে সিলমোহর করে দেব; তাদের হস্তসমূহ আমার সঙ্গে কথা বলবে এবং তাদের পাগুলো সাক্ষ্য দেবে, যা তারা (মিথ্যা-পাপ) অর্জন করেছিল। (সুরা-ইয়াসিন, আয়াত: ৬৫)। এমতাবস্থায় গত্যন্তর না দেখে কিছু লোক সত্য স্বীকার করবে (যদিও সেদিন তা কোনো কাজে আসবে না)।
একমাত্র সত্য সাক্ষ্য ও ন্যায় বিধানই পারে সমাজে দেশে বা রাষ্ট্রে শাস্তি বজায় রাখতে ও শৃঙ্খলা আনতে। আল্লাহ ন্যায়বান, তিনি ন্যায়বিচার করবেন।
প্রতিটি হারাম কর্ম ও হারাম বস্তু কবিরা গুনাহ বা বড় পাপ। মিথ্যা হলো পাপের আকর বা মহাপাপ। স্বেচ্ছায় অভ্যাসে প্রকাশ্যে কবিরা গুনাহ করলে এবং তা থেকে খাঁটি তাওবা না করলে তাকে ফাসিক বলা হয়। ফাসিক অর্থ গুনাহগার বা পাপাচারী; ইসলামি আদালতে ফাসিকের সাক্ষ্য গ্রহণযোগ্য নয়। কারণ সে কালিমা শাহাদাতের সাক্ষ্য ভঙ্গ করেছে। সুতরাং মোমিনের উচিত মৃত্যু পর্যন্ত সারা জীবন কালিমা শাহাদাতের সাক্ষ্যের ওপর দৃঢ় অবিচল থেকে স্বীয় ইমান ও ইসলাম রক্ষা করা।
মুফতি মাওলানা শাঈখ মুহাম্মাদ উছমান গনী: যুগ্ম মহাসচিব, বাংলাদেশ জাতীয় ইমাম সমিতি, সহকারী অধ্যাপক, আহ্ছানিয়া ইনস্টিটিউট অব সুফিজম।
আরও পড়ুনকবর জিয়ারতে কী করব, কী করব না১৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৫