জাতীয় নির্বাচনের আগে স্থানীয় নির্বাচন হতে দেবো না: ফারুক
Published: 17th, February 2025 GMT
সানবিডি২৪ এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি ফলো করুন
বিএনপির চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা জয়নুল আবদিন ফারুক বলেছেন, বিএনপিকে টপকিয়ে জাতীয় নির্বাচনের আগে স্থানীয় নির্বাচন হতে দেওয়া হবে না।
সোমবার (১৭ ফেব্রুয়ারি) জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে তৃণমূল নাগরিক আন্দোলনের উদ্যোগে আয়োজিত নাগরিক সমাবেশে তিনি এসব কথা বলেন। স্থানীয় নির্বাচনের আগে জাতীয় নির্বাচনের দাবিতে এই সমাবেশ করা হয়।
বৈষম্যবিরোধীদের প্রতি ইঙ্গিত করে জয়নুল আবদিন ফারুক বলেন, অনেকেই বলেন, দিল্লি-তুরস্কর মতো দল করবেন। যে আদলে দল করেন আমাদের কোনও বাধা নেই। কারণ এ দেশে বহু দলীয় গণতন্ত্রের প্রবক্তা স্বাধীনতার ঘোষক জিয়াউর রহমান। আমাদের নেতা তারেক রহমান বলেছেন, দল করেন আর দলে আসেন, দেশের বিরুদ্ধে যে ষড়যন্ত্র হচ্ছে তার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ান।
বিএনপি অতীতেও জনগণের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেনি, ভবিষ্যতেও করবে না মন্তব্য করে তিনি বলেন, আর একটি দল আছে যারা স্বাধীনতাবিরোধী ছিল; তাদের উদ্দেশে বলতে চাই, কীসের তালবাহানা শুরু করেছেন আপনারা? এই সরকারকে দোষারোপ করার জন্য কী তালবাহানা শুরু করেছেন? গণতন্ত্রের স্বপক্ষের শক্তি বিএনপি; তারা এখনও রাস্তায়। জনগণের অধিকার আদায়ের জন্য বিএনপি আন্দোলন-সংগ্রাম করে যাবে যে পর্যন্ত না জনগণের অধিকার ফিরে আসে।
প্রধান উপদেষ্টা ড.
আয়োজক সংগঠনের সভাপতি মোহাম্মদ মফিজুর রহমান লিটনের সভাপতিত্বে নাগরিক সমাবেশে আরও বক্তব্য রাখেন– বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা হারুনুর রশিদ, যুগ্ম মহাসচিব অ্যাডভোকেট আব্দুস সালাম আজাদ, নির্বাহী কমিটির সদস্য মাইনুল ইসলাম প্রমুখ।
এম জি
উৎস: SunBD 24
কীওয়ার্ড: ব এনপ
এছাড়াও পড়ুন:
আধিপত্যের বিরুদ্ধে বাংলা ভাষা
কতকাল আগে দার্শনিক হেরেক্লিটিস কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলছিল কথাটা যে, জগতে সব কিছুই সর্বদা বদলে যাচ্ছে। ভাষার ব্যাপারে এ বক্তব্য খুবই সত্য। সমস্ত জীবিত ভাষাই সর্বক্ষণ বদলাচ্ছে। কিন্তু এটা কোনো দুঃখের ব্যাপার নয়, ভাষার জন্য; আনন্দের ব্যাপার বটে। জীবনের নিয়মই এই ক্রমাগত বদলাতে থাকে। যে-পরিবর্তন দেখে হেরেক্লিটিস দুঃখ পেয়েছিল তার কারণও জীবনের ভেতরেই রয়েছে। কারণটা হলো দ্বন্দ্ব ভাষাও বদলায় দ্বন্দ্বের কারণেই। প্রকাশের সঙ্গে প্রকাশিতব্যের একটা বিরোধ চলতে থাকে। গ্রহণের ইচ্ছা ও গ্রহণের ক্ষমতার ভেতর একটা ঝগড়া বাঁধে। এবং উভয় দিক থেকেই ভাষা প্রতিবাদ করে তার নিজের বিরুদ্ধে। সেই প্রতিবাদেই সে এগোয়; ক্রমাগত। এই ঘটনা যদি না ঘটে, যদি থেমে যায় দ্বন্দ্ব তথা প্রতিবাদ, তাহলে বুঝতে হবে তার মৃত্যু অত্যাসন্ন।
ব্যাপারটা বাংলা ভাষার ক্ষেত্রেও পুরোপুরি সত্য। এ ভাষা এগিয়েছে, বিস্তৃত হয়েছে, গভীর হয়েছে, নিজের বিরুদ্ধে নিজে দাঁড়িয়ে। তার বিরুদ্ধে আরো একটি প্রতিপক্ষ ছিল। সে হলো রাষ্ট্র। রাষ্ট্র কখনো মিত্র ছিল না বাংলা ভাষার। মিল ছিল না বললে সবটা বলা হয় না, বলতে হয় রাষ্ট্র ছিল শত্রুপক্ষ।
অনেক ভাষার ইতিহাসে দেখা যায় রাষ্ট্র সাহায্য করছে ভাষাকে, তার বিকাশে। প্রাচীন গ্রিসে অতি উৎকৃষ্ট সাহিত্য সৃষ্টি হয়েছে, তার ভাষা একটা ছিল না, ছিল সেখানে অনেক ক’টি উপভাষা; নগর রাষ্ট্র এথেন্স ঠিক করে দিলো কোনটি হবে মান ভাষা, এবং সেটিই ভাষা হলো সাহিত্যের ও যোগাযোগের; সে-ভাষাতেই গ্রিক সাহিত্য এসে পৌঁছেছে পরবর্তী পৃথিবীর কাছে। একই ঘটনা ঘটেছে পরের কালে ইংল্যান্ডে, ফ্রান্সে, জার্মানিতে, ইতালিতে। রাষ্ট্র ছিল ভাষার অনুকূলে, রাষ্ট্রভাষা ও জাতীয় ভাষা ছিল অভিন্ন, কেননা দেশ ছিল স্বাধীন। এসব দেশে একাধিক উপভাষা চালু ছিল, যেমনটা থাকা স্বাভাবিক। রাষ্ট্র মান-ভাষা ঠিক করে দিয়েছে, সেই ভাষাই মূল ভাষা হয়েছে একাধারে সাহিত্যের ও রাজদরবারের, যেমনি সম্ভ্রান্তের তেমনি জনগণের।
এও দেখেছি আমরা যে ভাষার গঠনে বড় লেখকেরা খুব বড় ও সাংগঠনিক ভূমিকা পালন করেছেন যেমন দান্তে, লুথার ও পুশকিন। দান্তে প্রাচীন ল্যাটিনের আধিপত্য ভেঙে আধুনিক ইতালীয় ভাষার যে-অভ্যুদয় তার প্রধান সংগঠক ছিল; কাজটা করেছিল তিনি তাঁর লেখার মধ্য দিয়ে। মার্টিন লুথার যদিও ধর্মযাজকই, তবু বাইবেলের জার্মান অনুবাদের ভেতর দিয়ে নিজের মাতৃভাষাকে মুক্তির দিকে নিয়ে গেলেন। তেমনি ভাবে পুশকিনও রুশ ভাষার সংগঠনে অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। মুখের ভাষাকে তাঁরা সাহিত্যের ভাষায় পরিণত করেছেন।
বাংলা এই দুই সৌভাগ্যের উভয়টি থেকেই বঞ্চিত। সূচনাকালে এ ভাষায় কোনো দান্তে, লুথার বা পুশকিন এগিয়ে আসেননি। তাকে এগোতে হয়েছে নিজে নিজেই। এগোতে হয়েছে রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে। অতীতের ইতিহাসে বাংলা কখনোই রাষ্ট্রভাষা ছিল না। রাষ্ট্রভাষা ছিল সংস্কৃত, ফার্সি, ইংরেজি; চেষ্টা হয়েছিল উর্দুকে ওই জায়গায় প্রতিষ্ঠিত করবার, সম্ভব হয়নি, তার আগেই রাষ্ট্র ভেঙে গেছে। কিন্তু অতীতে ভাঙেনি, সেকালে মানুষ এতটা বিদ্রোহী ছিল না, একালে যেমন।
বাংলায় পাল বংশের রাজারা রাজত্ব করেছেন। তারা বাঙালি ছিল। তাদের রাজসভায় বাংলার কোনো স্থান ছিল না। সেখানে সংস্কৃত ছিল অপ্রতিদ্বন্দ্বী। তারপরে সেনেরা এসেছেন। তারা তো বাঙালি নন, বিদেশ থেকে এলেন, ভিন্ন তাদের চাল-চলন, ভিন্ন তাদের ভাষা। রাজসভায় সংস্কৃতের ব্যবহার আগের মতোই চলেছে। পাণ্ডিত্যপূর্ণ আলোচনা থেকে প্রার্থনা পর্যন্ত সর্বত্রই ছিল সংস্কৃতের একক আধিপত্য। সংস্কৃত শুধু ভাষা নয়, দেবভাষা; তাই কেবল যে রাজা ও কবিরা তা নন, দেবতারাও চাইতেন সংস্কৃতের চর্চা হোক।
এক সময়ে সেনদের পতন হয়েছে। যারা এসেছেন তারাও বাঙালি নন, তাদের ভাষাও ভিন্ন। পাঠান ও মুঘলদের আমলে রাজভাষা ছিল ফার্সি। সম্ভ্রান্তরাও ওই ভাষাই ব্যবহার করতেন, বাংলা নয়।
এরপর এলো ইংরেজ। আরো দূর থেকে এসেছে, আরো দূরের এক ভাষা নিয়ে, সেই ভাষাকে চাপিয়ে দিয়েছে মানুষের ওপর; ফার্সি গেছে চলে, তার জায়গা দখল নিয়েছে ইংরেজি। এরই মধ্যে বাংলা ভাষার বিকাশ। এ হচ্ছে সাধারণ মানুষের ভাষা, ব্রাত্যজনের, অবহেলিত জনগণের।
সংস্কৃতের সঙ্গে তার একটা সম্পর্ক আছে, কিন্তু সেটা যতটা না আত্মীয়তার তার চেয়ে বেশি বিদ্রোহের। সংস্কৃতের দৃষ্টিতে ভ্রষ্ট সে, অপভ্রংশ। সংস্কৃত ভাষায় লিখিত নাটকে নিম্নবর্গের পাত্র-পাত্রীরা অপভ্রংশে কথা বলতো, গ্রামের লোকের মতো, শহরের লোকদের আমোদ দেবার জন্য। বিদ্রোহটাও ওই রকমেরই ছিল হাস্যকর। কিন্তু বাংলার দিক থেকে ব্যাপারটা কৌতুকের ছিল না, ছিল জীবন-মরণের। বাংলা আত্মসমর্পণ করেনি, করলে শেষ হয়ে যেত।
আত্মসমর্পণ করেনি ফার্সি যুগেও। বাংলার স্বাধীন সুলতানেরা বাঙলা ভাষার প্রতি বিদ্বেষী ছিলেন না, তারা বাংলা সাহিত্যের পৃষ্ঠপোষকতা করেছেন, এই প্রমাণ ইতিহাসে আছে। কিন্তু এ-তো স্বাধীনকে নয়, অধীনকে সাহায্য করা; আধিপত্য চাপিয়ে দিয়ে বলা, এবার তুমি যাও, যত পারো ঘুরে বেড়াও। রাজভাষা কোনো নির্জীব বোঝা নয়, সে অত্যন্ত সজীব, ভেতরে ঢুকে পড়ে, ভেতর থেকে বাধা দেয় মাতৃভাষার বিকাশকে। রাজদরবারে যে ভাষা চালু থাকে সেটিই হয় সম্ভ্রান্ত জনের ভাষা, সম্ভ্রান্তরাই হয় আদর্শ। সাধারণ মানুষ তাদেরই অনুকরণ করতে থাকে, ভক্তিতে কিছুটা, অনেকটাই ভয়ে। সংস্কৃতের বিরুদ্ধে যেমন, ফার্সির বিরুদ্ধেও তেমনি বিদ্রোহ করেই বাংলাকে এগোতে হয়েছে। বাংলা শান্ত কোমল ভাষা, তার বাক্য গঠন ‘না’টা আসে শেষে, যেন না-পারতে আসা; শুরুতে কিংবা মধ্যে সে ‘না’ বলে না, বলে শেষে এসে; কিন্তু ভাষা হিসেবে তাকে ‘না’ বলে বলেই এগোতে হয়েছে; অনেকটা শান্ত নদীর মতোই, সে তার দু’ধারের ও সামনের সব প্রতিবন্ধককেই অমান্য করে, নীরবে, এতো নীরবে যে মনে হয় বশ্যতা স্বীকার করেছে, কিন্তু স্বীকার তো করেনি, করলে হারিয়ে যেতো কোথায়, নিশ্চিহ্ন হয়ে যেতো কবে।
এ কাজটা ফ্রাইডে’রা করে না। ড্যানিয়েল ডিফো’র ‘রবিনসন ক্রুশো’ নামের উপন্যাসে ফ্রাইডে ধর্মান্তরিত হয়ে যায়, ভাষান্তরিতও হয়ে যায়। ধর্মান্তরের চেয়েও ভাষান্তর মৌলিক ঘটনা; ধর্ম ভোলা অনেক সহজ, ভাষা ভোলার তুলনায়। রবিনসন ক্রুশো ফ্রাইডে নিমক ও ইংরেজি ভাষা দু’টোই খাইয়েছিল পরিণামে ফ্রাইডে কখনো নিমকহারামি করেনি। ভাষা তো কেবল ভাষা নয়, সে চিন্তারও অংশ হয়ে যায়, স্থায়ী হয়ে বসে পড়ে চেতনায়, এবং প্রভাব বিস্তার করতে থাকে বংশপরম্পরায়।
হ্যাঁ, বাংলা প্রভাব নিয়েছে। সংস্কৃতের প্রভাব তো ছিলই, সেখান থেকেই উৎপত্তি, তদুপরি সংস্কৃতভাষীদের শাসনাধীনে ছিল বাঙালি; শাসকরা তাদের প্রভাব ভাষার ওপর ফেলেছেন, যেমন ফেলেছেন মানুষের জীবনের ওপর। শাসনাধীন থাকার কারণে ফার্সির প্রভাবও রয়েছে বাংলার শব্দভাণ্ডারে। পর্তুগিজ যাজক ও ব্যবসায়ীদের সঙ্গে যোগাযোগের দরুন তাদের শব্দও পাওয়া যাবে। কিন্তু মূলধারা কখনোই কারো কাছে আত্মসমর্পণ করেনি। সর্বদাই প্রতিবাদের ও সৃষ্টির পথ ধরে এগিয়েছে সে, ওই নদীর মতো, যার ধারা প্রবাহে অনেক শাখা ও উপনদী এসে মেলে, কিন্তু কোনোটিই মূল প্রবাহকে বিচ্যুত করতে পারে না, আপন ধারা থেকে।
পরে এলো ইংরেজ। ইংরেজ শাসন বাংলা ভাষার অনেক উপকার করেছে বলে প্রসিদ্ধি আছে। তা করেছে বৈকি; অস্বীকার করবে কে। আধুনিক গদ্যের সৃষ্টি ইংরেজ আমলেই, আধুনিকতার সৃষ্টিও এই সময়েই। বাক্যের যতিচিহ্নগুলো আমাদের দিয়েছে, কোথায় কতটা থামতে হবে সেটা জানিয়েছে, শিখিয়েছে গতি যোগ করবার কলা-কৌশল। তারা ছাপাখানা প্রতিষ্ঠা করেছে; ভাষার চর্চা যার ফলে সহজ হয়েছে। কিন্তু ইংরেজ আমাদের বাংলা গেলাতে আসেনি, চায়ওনি; চেয়েছে ইংরেজি গেলাতেই। বলেছে মেনে নাও, মেনে নিয়ে স্বাধীনভাবে বাংলার চর্চা করো। কথাটা পাঠানরা বলেছে একভাবে, ইংরেজরা বলেছে অন্যভাবে, কিন্তু মূল বক্তব্য অভিন্ন। এ হচ্ছে অধীনের স্বাধীনতা, অধীন হয়ে স্বাধীন হওয়া, হয়তো-বা অধীনতাকেই স্বাধীনতা বলে ভুল করা।
ইংরেজ আমলে খ্রিষ্টান মিশনারিরাও বাংলা শিখেছেন, বাংলায় বই লিখেছেন, কিন্তু বিদ্রোহী সৃষ্টির লক্ষ্যে নয়, অনুগত সৃষ্টির লক্ষ্যেই। পরে ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ একটা ভূমিকা রাখলো। রাষ্ট্র এলো বাংলার সেবায়। তাতে বাংলার উপকার হয়নি। ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ যে পণ্ডিতদের কাজে লাগিয়েছিল তাঁদের অনুরাগ ছিল সংস্কৃতের প্রতি, বাংলার প্রতি নয়। ফলে বাংলা গদ্য সংস্কৃতভারাক্রান্ত হয়ে পড়বে, এবং তা জনগণের ভাষা রইবে না এমন একটা আশঙ্কা দেখা দিয়েছিল। ইংরেজ শাসনে রাষ্ট্রের পক্ষপাত ফার্সির প্রতি ছিল না, ছিল সংস্কৃতের প্রতি, কারণ ফার্সিওয়ালাদের সঙ্গে যুদ্ধ করে তবেই ইংরেজের শাসন প্রতিষ্ঠিত করতে হয়েছে, সে হিসেবে ফার্সি শত্রুর ভাষা। বাংলা থেকে ফার্সি শব্দ তাড়িয়ে দিয়ে সে-জায়গায় সংস্কৃত আসুক এ কাজ সাহেবরা বেশ পছন্দ করতো, পণ্ডিতরা তো করবেই। চেষ্টা ছিল বাংলাকে সংস্কৃত ভাষার অনুগত করে রাখার। কিন্তু সে-উদ্যোগ সফল হয়নি। বাংলা এগিয়ে গেছে, প্রতিবাদ করে। প্রতিবাদ আসলে ছিল দু’টো, একটি ইংরেজির বিরুদ্ধে অপরটি ইংরেজদের পক্ষপাতপুষ্ট সংস্কৃতবাহুল্যের বিরুদ্ধে। একটি বড়, অপরটি ছোট, কিন্তু দুটি অভিন্ন।
যেমনটি স্বাভাবিক, ইংরেজও তাই চেয়েছিল। চেয়েছিল বাঙালি নয়, এদেশে অসংখ্য ছোট-বড় ফ্রাইডে তৈরি হোক। ঔপনিবেশিক শাসক হিসেবে রবিনসন ক্রুশো শেক্সপীয়রের প্রসপেরোর তুলনায় অনেক বেশি দক্ষ। প্রসপেরো জাদুবিদ্যা প্রয়োগ করেছে, রবিনসন প্রয়োগ করলো ভাষাবিদ্যা। এ কৌশলটা যে অধিক কার্যকর কে তা অস্বীকার করবে। ভাষার শক্তি সম্পর্কে একটি শিশুও খবর রাখে, যা ফ্রয়েড খুব সুন্দরভাবে দেখিয়েছেন। তিনি দেখিয়েছেন যে, শিশু সহজেই বুঝে ফেলে কথা দিয়ে কেমন করে বয়স্কদের বশে আনা যায়। শিশু যা বোঝে একালের ঔপনিবেশিক সরকার তা বুঝবে না কেন। রবিনসন যা করেছে তার নির্জন দ্বীপে সেই একই কাজ অনেক ব্যাপক ও দক্ষ উপায়ে ইংরেজ করেছে আমাদের দেশে।
এমনকি মাইকেল মধুসূদন দত্তও তো ফ্রাইডেই হতে চেয়েছিলেন। ধর্ম, ভাষা সবই ত্যাগ করেছিলেন তিনি, ইংরেজিতেই লিখছিলেন। কিন্তু ভেতরের যে বাঙালিটি ছিল, মেধাবান ও বিদ্রোহী, সেটিই বিদ্রোহ করল ফ্রাইডে হবার জন্য রাষ্ট্রীয় প্ররোচনার বিরুদ্ধে। মহাকাব্যে তিনি ছিন্ন করলেন পয়ারের বন্ধন; প্রহসনে উগ্র আধুনিকতা ও সনাতনীদের দৌরাত্ম্যকে। প্রত্যাখ্যান করলেন ইংরেজিকে, লেখক হতে চাইলেন না ‘ক্যাপটিভ লেডি’র। পা ছিল মাটিতে, প্রাণে ছিল বিদ্রোহ, তাই তো তাঁকে রণপা পায়ে চড়িয়ে হাঁটতে হয়নি, তাইতো তিনি বাংলা ভাষাকে এগিয়ে দিয়ে গেলেন যেমন সম্পদে তেমনি সম্ভ্রমে।
অনেকে মনে করেন বাংলা গদ্যের সূত্রপাত রামমোহন থেকেই। তাঁর আগে চিঠিপত্রের, দলিল দস্তাবেজের, ধর্মপ্রচারের জন্য একটা ভাষা ছিল, কিন্তু প্রকৃতই যাকে গদ্য বলে, যে হচ্ছে আদান-প্রদানের ভাষা তা ছিল না। রামমোহনের জীবন প্রতিবাদের ঘটনাপঞ্জি। তিনি যেখানে থাকবার কথা সেখানে রইলেন না। কর্মচারী হয়ে রইলেন না ইংরেজদের, যদিও শুরু করেছিলেন সে-ভাবেই। স্বাধীন ব্যবসায় ধরলেন। আরবি-ফার্সিতে লিখতেন, সে-অভ্যাস ত্যাগ করলেন, ইংরেজিতেও লিখেছেন, কিন্তু ইংরেজির লেখক হলেন না, চর্চা করলেন বাংলার, যেটি একটি বড় প্রতিবাদ বটে। সংস্কৃতিতে লিখিত শাস্ত্রীয় গ্রন্থ বাংলায় অনুবাদ করলেন, শাস্ত্রব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহীর ভঙ্গিতে। গদ্য লিখে একেশ্বরবাদ ও অসাম্প্রদায়িকতা প্রচার করলেন, পুরোপুরি বিদ্রোহী হিসেবে।
সতীদাহের বিরুদ্ধে দাঁড়ালেন অত্যন্ত দৃঢ়তার সঙ্গে। আবার ইংরেজ পাদ্রীদের সঙ্গে লিপ্ত হলেন দ্বন্দ্বে; সংবাদপত্রের স্বাধীনতার পক্ষে বললেন।
পাদ্রী ও পণ্ডিতদের ভূমিকায় বিদ্রোহ না-থাকাটাই বাংলা গদ্যের সৃষ্টিতে তাদের ভূমিকাটিকে খর্ব করে দিয়েছে, ঠিক যেমন ভাবে রামমোহনের বিদ্রোহ তাঁর ভূমিকাকে বড় করেছে। বাংলা গদ্যকে আমরা রামমোহনের বিদ্রোহকে বাদ দিয়ে ভাবতেই পারি না; সংস্কৃত, ফার্সি ও ইংরেজির আধিপত্যের বিরুদ্ধে তিনি দাঁড়িয়েছিলেন সেই অন্ধকার কালে। না, তিনি জার্মানির লুথার নন, বাংলা ভাষাকে জনগণের কাছে নিয়ে যাননি, তার গঠনের বৈপ্লবিক ভূমিকার দাবিও তিনি করবেন না, কিন্তু সংস্কৃত, ইংরেজি ও আরবি-ফার্সি এই তিন ভাষার তিনমুখী আধিপত্যের বিরুদ্ধে বাংলাকে যে সম্ভ্রান্ত ও অগ্রগামী করে গেলেন তাতে সন্দেহ কী।
লেখক
ইমেরিটাস অধ্যাপক
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়