ভুট্টাক্ষেতে পড়ে ছিল আ.লীগ কর্মীর ছেলের রক্তাক্ত লাশ
Published: 17th, February 2025 GMT
চুয়াডাঙ্গার দামুড়হুদায় ভুট্টাক্ষেত থেকে মাসুদ হাসান রনজু (২৫) নামে এক কলেজছাত্রের রক্তাক্ত মরদেহ উদ্ধার করেছে পুলিশ। রোববার রাত ৮টায় জরুরি সেবা ৯৯৯-এ কল পেয়ে দামুড়হুদা মডেল থানা পুলিশের একটি দল ঘটনাস্থলে গিয়ে মরদেহটি উদ্ধার করে।
নিহত মাসুদ হাসান রনজু দামুড়হুদা সদর ইউনিয়নের বদনপুর গ্রামের বাসিন্দা আজিজুল মীরের ছেলে। আজিজুল মীর আওয়ামী লীগের সক্রিয় কর্মী ছিলেন বলে স্থানীয় সূত্র জানিয়েছে। এটি রাজনৈতিক শত্রুতার কারণে সংঘটিত হত্যাকাণ্ড কিনা, তা খতিয়ে দেখছে পুলিশ।
ঘটনার পরপরই চুয়াডাঙ্গা জেলা পুলিশের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার কনক কুমার দাস, সহকারী পুলিশ সুপার জাকিয়া সুলতানা, ও দামুড়হুদা মডেল থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) হুমায়ুন কবির ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন।
দামুড়হুদা মডেল থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) মশিউর রহমান জানান, নিহতের মাথা ও শরীরের বিভিন্ন স্থানে ধারালো অস্ত্রের আঘাতের চিহ্ন পাওয়া গেছে, যা পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ডের ইঙ্গিত দেয়।
স্থানীয়রা জানান, রোববার সকালে একই গ্রামের হুমায়ুন কবীরের স্যালো মেশিনে পানি দিতে যান মাসুদ হাসান রনজু। স্যালো মেশিন চালু করে দিয়ে হুমায়ুন কবীর বাড়ি চলে আসেন, আর মাসুদ একাই ভুট্টার জমিতে সেচের কাজ করছিলেন। দুপুর গড়িয়ে বিকেল হলেও বাড়িতে না ফেরায় তার বাবা আজিজুল মীর ছেলের জন্য খাবার নিয়ে মাঠে যান। সেখানে ডাকাডাকি করেও তাকে না পেয়ে বাড়ি ফিরে আসেন। পরিবারের অন্যদের জিজ্ঞাসা করে জানতে পারেন, রনজু এখনও ফেরেনি। এরপর তার মোবাইল ফোনে একাধিকবার কল করলেও সাড়া পাননি।
পরিবারের সদস্যদের নিয়ে পুনরায় মাঠে গিয়ে তারা স্যালো মেশিনের পাশে রনজুর মোবাইল ফোন ও স্যান্ডেল পড়ে থাকতে দেখেন। পরে আশপাশে খোঁজাখুঁজি করে ভুট্টাক্ষেতের মধ্যে তার রক্তাক্ত মরদেহ দেখতে পান।
দামুড়হুদা মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো.
উৎস: Samakal
এছাড়াও পড়ুন:
টানা ৭২ ঘণ্টা যুদ্ধ করি
ময়মনসিংহের ফুলবাড়িয়া উপজেলার রাঙ্গামাটিয়া বাজারের পাশে বানার নদীতীরে বধ্যভূমিতে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে মহান মুক্তিযুদ্ধের রক্তিম লাল স্মৃতি স্মারক। এই বাজারেই ছিল পাকিস্তান সেনাবাহিনীর শক্তিশালী ক্যাম্প। এই ক্যাম্পে নিরীহ বাঙালিদের ধরে এনে নৃশংসভাবে হত্যা করত পাকিস্তানি সেনারা। পাশবিক নির্যাতনের শিকার হতো শত শত নারী। দিন-তারিখ ঠিক মনে নেই, তবে শুক্রবার ছিল। আর শুক্রবারই এই অত্যাচারের ইতি টানতে টানা ৭২ ঘণ্টা যুদ্ধ করে এই ক্যাম্প গুঁড়িয়ে দেয় আমার মুক্তিযোদ্ধারা। এখন অবহেলায় পড়ে থেকে বধ্যভূমিটি, একপাশে জমেছে ময়লার ভাগাড়। নতুন প্রজন্মের অনেকের স্মৃতিতে এই যুদ্ধ ধূসর হলেও এখনও তা অটল সত্তরোর্ধ্ব আমার মতো রবীন্দ্র চন্দ্রের কাছে। রোজ একবার এই জায়গাটায় এসে দাঁড়াই। আজ বাড়িতেই সারাদিন, শরীরটা খুব একটা ভালো না, তাই সারাদিন বাড়িতেই। কদিন পরেই ২৬ মার্চ, কত স্মৃতি এসে ভিড় করছে চোখের কোণে।
আমার মায়ের নাম কিরণ বালা, আমার বয়স যখন ছয়-সাত, তখন মা মারা যান। মাকে হারিয়ে অনাদরে শৈশব কাটে আমার, সেই থেকে ঘরছাড়া। লজিং পড়াতাম পার্শ্ববর্তী শিবগঞ্জ এলাকায়। আলামিন উচ্চ বিদ্যালয়ে ভর্তি হই। দশম শ্রেণিতে পড়া অবস্থায় দেশ উত্তাল হয়ে ওঠে, মুক্তিযুদ্ধ অনিবার্য হয়ে পড়ে। বন্ধুরা মিলে রেডিওতে রেসকোর্স ময়দানে ৭ মার্চের ভাষণ শোনার পর সিদ্ধান্ত নিলাম মুক্তিযুদ্ধে যাব। দুই চাচাতো ভাইকে সাথে নিয়ে রাতের আঁধারে বাড়ি ছাড়ি। চলে যাই টাঙ্গাইলের সখিপুরের গহিন গজারি বনে, মুক্তিযোদ্ধাদের গোপন এক ক্যাম্পে।
জায়গাটার নাম বয়ড়াতলী, সেখানে কাদেরিয়া বাহিনীতে যোগদান করার পর শুরু হয় আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ট্রেনিং। চাচাতো দুই ভাই সুকুমার চন্দ্র দত্ত ও সুবোধ চন্দ্র দওকে নিয়ে আমাদের তৎকালীন কোম্পানি কমান্ডার আলী হোসেন লাল্টুর নেতৃত্বে ৪১ দিনের ট্রেনিং শেষ করি। এর মধ্যেই কানে আসে কত পরিচিত মানুষের মৃত্যু সংবাদ, কত ঘরবাড়ি পুড়িয়ে ফেলার খবর। তার মধ্যে সবচেয়ে কষ্ট দেয় পাকিস্তানি সেনারা একটি বাড়িতে আগুন দিলে সবাই দৌড়ে পালিয়ে যায়। কিন্তু ঘরে একজন বৃদ্ধ ছিল। বেরোতে পারেনি। শেষ পর্যন্ত ঘরেই পুড়ে মারা গেছে। তাই মনে মনে বিষিয়ে ছিলাম প্রতিশোধ নেওয়ার। হঠাৎ খবর আসে, আমাদের প্রথম যুদ্ধ করতে যেতে হবে রাঙ্গামাটিয়া। রাঙ্গামাটিয়া ক্যাম্প গুঁড়িয়ে দিতে হবে। এরপর সিদ্দিকালি বাজার আমাদের নতুন ক্যাম্প থেকে কমান্ডারের নির্দেশে অ্যাম্বুশে চলে যাই ৭৫ জন মুক্তিযোদ্ধা।
আমাদের সাথে ভারী অস্ত্র বলতে দুটো এলএমজি আর থ্রি নট থ্রি রাইফেল ও গ্রেনেড ছিল। এলএমজি চালাত সেনাবাহিনীর লোক। শক্তিশালী হাতিয়ার। চারটি কোম্পানিতে থাকা প্রায় আড়াইশ মুক্তিযোদ্ধা চারদিক থেকে অ্যাম্বুশ করে ফায়ার শুরু করলাম। শুরু হলো তুমুল গোলাগুলি। এর মধ্যে খবর আসে, মিলিটারিদের একটি গাড়ি গোলাবারুদ ও সৈনিকসহ অন্যত্র সরে পড়ছিল। পশ্চিমদিকে সন্তোষপুর দিয়ে যাবে গাড়িটি। ঠিক তখন দুটো এলএমজিসহ একদল মুক্তিযোদ্ধা মিলে আমরা ওত পেতে থাকি, কিন্তু শেষ রক্ষা হলো না। গুলির মুখে পড়ে মিলিটারিরা যেখান থেকে কেউ বেঁচে ফিরতে পারেনি। ব্রাশফায়ারে এদিক-ওদিক ছিটকে পড়ে। এরপর চলল টানা ৭২ ঘণ্টা যুদ্ধ। টানা যুদ্ধ চলাকালে বোমা মেরে রাঙ্গামাটিয়া ব্রিজটি ভেঙে ফেললাম আমরা। এতে আরও বেকায়দায় পড়ে পাকিস্তানি সেনারা। এদিকেও যেতে পারে না, ওদিকেও না। পরে খবর পেলাম, আমাদের সঙ্গে থাকা গোলাবারুদ ও রসদ ফুরিয়ে গেছে। কোম্পানি কমান্ডারের নেতৃত্বে আমরা পিছু হটি। আমাদের ১০ জন মুক্তিযোদ্ধা নিহত হয় রাঙ্গামাটিয়ার যুদ্ধে। অবশ্য অন্তত ৩০০ পাকিস্তানি সেনাও মারা যায়। পরে তাদের ট্রাক ভরে লাশগুলো নিয়ে যায় ওরা। এত লাশ এই এলাকায় মানুষ আগে কখনও দেখেনি। কিন্তু এর পরে আরও পাকিস্তানি সেনা এসে সমস্ত গ্রাম পুড়িয়ে দিয়েছিল। রণাঙ্গনে চারটি বড় ধরনের যুদ্ধে জীবন বাজি রেখে সম্মুখে থেকে মুক্তিযুদ্ধ করেছি।
সব শেষে কেশরগঞ্জ বাজার যুদ্ধ ছিল আরও রক্তক্ষয়ী। গুলি করতে করতে নদীর কাছে চলে আসি আমি আর আমার বন্ধু। হঠাৎ করেই আমার সহযোদ্ধার পায়ের ওপর গুলি লাগে। পরে আমি কাঁধে করে সরিয়ে নিয়ে ওর জীবন বাঁচিয়েছিলাম। সেই বন্ধু এখনও বেঁচে আছে। আমি মনে করি বঙ্গবন্ধুর ৭ মাচের্র ভাষণ আমাদের উজ্জীবিত করেছে, আন্দোলিত করেছে। রণাঙ্গনে মেজর জিয়ার স্বাধীনতার ঘোষণা আমাদের মুক্তির পথ দেখিয়েছিল, উদ্বেলিত করছিল।
একমাত্র দেশকে ভালোবেসে, দেশের মানুষকে একটা স্বাধীন দেশ উপহার দিতেই যুদ্ধে যাওয়া আমাদের। স্বাধীনতার এত বছর পরে এসেও প্রশ্ন জাগে, কতটা স্বাধীন হলাম আমরা?
নতুন প্রজন্মকে অবশ্যই মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস জানতে হবে, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা হৃদয়ে লালন করে দেশকে গড়তে হবে।
অনুলিখন
কবীর উদ্দিন সরকার হারুন
ফুলবাড়িয়া প্রতিনিধি, ময়মনসিংহ