পুরোনো পথে অপুষ্টি দূর হবে না
Published: 17th, February 2025 GMT
দেশে তীব্র অপুষ্টিতে ভুগছে প্রায় সাড়ে তিন লাখ শিশু। ঢাকা শহরের বস্তিতে বাস করা শিশুদের ৪০ শতাংশই খর্বকায়। অপুষ্টিতে ভোগা শিশুদের বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশ কম হওয়ার পাশাপাশি তাদের মৃত্যুঝুঁকি বেশি। পুরোনো পথে হাঁটলে দেশের অপুষ্টি দূর হবে না।
গতকাল রোববার বিকেলে প্রথম আলো কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত ‘বাংলাদেশের শিশুপুষ্টি পরিস্থিতি: বিদ্যমান অবস্থা ও উন্নয়নের পথ’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে দেশের শীর্ষস্থানীয় পুষ্টিবিদ, শিশুস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ, মাতৃস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ও জনস্বাস্থ্যবিদেরা এ কথা বলেন। আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র বাংলাদেশ (আইসিডিডিআরবি) ও প্রথম আলো যৌথভাবে এই বৈঠকের আয়োজন করে। অনুষ্ঠানে দেশে শিশুপুষ্টি পরিস্থিতির বিশ্লেষণের পাশাপাশি অপুষ্টি প্রতিরোধে করণীয় বিষয়ে মতামত তুলে ধরা হয়।
শুরুতে দেশের বিদ্যমান পুষ্টি পরিস্থিতি সম্পর্কে মূল বক্তব্য উপস্থাপন করেন আইসিডিডিআরবির নির্বাহী পরিচালক অধ্যাপক তাহমিদ আহমেদ। তিনি বলেন, দেশে পাঁচ বছরের কম বয়সী ২৪ শতাংশ শিশু খর্বকায়। এদের বয়সের তুলনায় উচ্চতা কম। একই বয়সের ১১ শতাংশ কৃশকায়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাকে উদ্ধৃত করে আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন এই পুষ্টিবিদ বলেন, এ ধরনের শিশু ১৫ শতাংশ হলে তা জরুরি পরিস্থিতির শামিল। বাংলাদেশ সেই অবস্থার কাছাকাছি।
তাহমিদ আহমেদ বলেন, অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে বেড়ে ওঠা ও অপুষ্টিতে ভোগা শিশুর অন্ত্রে প্রদাহ দেখা দেয়। তারা খাদ্য থেকে পুষ্টিকর উপাদান গ্রহণ করতে পারে না। এসব শিশুর রোগ প্রতিরোধক্ষমতা কম হয়, এদের মৃত্যুঝুঁকি বেশি, এদের মস্তিষ্কের বিকাশ কম হয়। তিনি বলেন, ‘গবেষণায় দেখা গেছে, অপুষ্টির শিকার শিশুদের ক্ষেত্রে মুখে খাওয়ার টিকার কার্যকারিতা কম।’
বয়স ছয় মাসের পর থেকে শিশুকে মায়ের দুধের পরিপূরক খাবার খাওয়াতে হয়। এ বিষয়ে বক্তব্য উপস্থাপনের সময় ঢাকা মেডিকেল কলেজের শিশু বিভাগের সাবেক প্রধান ও বিশিষ্ট শিশুস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক আবিদ হোসেন মোল্লা বলেন, অধিকাংশ ক্ষেত্রে শিশুকে মানসম্পন্ন পরিপূরক খাদ্য দেওয়া হচ্ছে না, শিশু পরিমাণমতো খাদ্য পাচ্ছে না, শিশুর খাদ্যে কোনো বৈচিত্র্য থাকে না এবং দিনে যতবার খাওয়ানোর কথা, ততবার খাওয়ানো হয় না। পরিপূরক খাদ্যের ক্ষেত্রে এসব ঘাটতি শিশু অপুষ্টিতে ভূমিকা রাখছে।
শিশুর অপুষ্টি শুরু হয় মাতৃগর্ভ থেকে—এমন মন্তব্য করেন জনস্বাস্থ্য পুষ্টি প্রতিষ্ঠানের ল্যাবরেটরি বিভাগের প্রধান শ্যামল কুমার রায়। তিনি বলেন, পুষ্টি বিষয় জরিপের তথ্য সঠিক হওয়া বাঞ্ছনীয়। অতীতে জরিপের তথ্য প্রকাশে বাধা দেওয়ার অভিযোগ আছে।
শিশুর পুষ্টি ও মায়ের পুষ্টি একই সূত্রে গাঁথা বলে মন্তব্য করেন অবস্টেট্রিক্যাল অ্যান্ড গাইনোকোলজিক্যাল সোসাইটি অব বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট অধ্যাপক ফারহানা দেওয়ান। তিনি বলেন, শিশু গর্ভে থাকার সময় মায়ের স্বাস্থ্য ঠিক থাকতে হবে, শিশুকে বুকের দুধ খাওয়ানোর সময়ও মায়ের স্বাস্থ্য ঠিক থাকতে হবে। না হলে এর প্রভাব পড়বে শিশুর ওপর। মা রক্তস্বল্পতায় ভুগলে, মায়ের রোগ প্রতিরোধক্ষমতা কম থাকলে অপরিণত শিশু জন্মের ঝুঁকি থাকে।
ব্যাপক অপুষ্টির কারণঅপুষ্টি বা দেশের মানুষের মধ্যে অণুপুষ্টিকণার পরিস্থিতি বা তার কারণ জানার জন্য নিয়মিত জরিপ হওয়া দরকার বলে মন্তব্য করেন বাংলাদেশ জাতীয় পুষ্টি পরিষদের উপপরিচালক মো.
‘মায়ের আঁচল ব্যাকটেরিয়ার খনি’ মন্তব্য করে আন্তর্জাতিক সংস্থা ওয়াটারএইড সাউথ এশিয়ার আঞ্চলিক পরিচালক খায়রুল ইসলাম বলেন, ছোট ছোট বিষয়ে মনোযোগী হওয়া, সঠিক বার্তা দেওয়া খুবই জরুরি। মা কাজ করেন, প্রতিটি কাজ শেষে হাত মোছেন আঁচলে। সেই অপরিষ্কার আঁচল দিয়ে শিশুর মুখ পরিষ্কার করেন। এক হাতে সাবান মেখে অন্য হাতে হাতল চেপে নলকূপের বিশুদ্ধ পানি ব্যবহার করা কঠিন। তিনি বলেন, প্রবহমান ধারার জন্য নলের পানি ভালো, কিন্তু এই পানি পায় দেশের মাত্র ১৫ শতাংশ মানুষ।
শিশু অপুষ্টির অন্যতম কারণ ‘জাঙ্ক ফুড’ সংস্কৃতির বিস্তার। এ বিষয়ে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মাতৃ ও শিশুপুষ্টিবিষয়ক ন্যাশনাল প্রোফেশনাল অফিসার ফারিয়া শবনম বলেন, শিশুদের বাণিজ্যিক খাবার খাওয়া আশঙ্কাজনকভাবে বেড়ে গেছে। এক বছরের শিশুকে বাণিজ্যিক খাবার খাওয়ানো হচ্ছে। এসব খাবারে অতিরিক্ত চর্বি, অতিরিক্ত চিনি ও অতিরিক্ত লবণ থাকে। এসব খাবারের প্রচার সবচেয়ে বেশি হয় ইলেকট্রনিক মাধ্যমে। বিজ্ঞাপনের ব্যাপকতায় ঘরের খাবারের বিষয়গুলো চাপা পড়ে যাচ্ছে, সাধারণ খাবারের ধারণা বদলে যাচ্ছে।
সিলেট বিভাগে খর্বকায় শিশুর হার সবচেয়ে বেশি (৩৪ শতাংশ) বলে উল্লেখ করেন সিলেট এম এ জি ওসমানী মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক মো. জিয়াউর রহমান চৌধুরী। তিনি বলেন, জন্ম ওজন কম হলে, আয়োডিনযুক্ত লবণ না খেলে, বুকের দুধ না খেলে শিশু অপুষ্টির শিকার হয়। মা–বাবার তৃতীয় ও চতুর্থ সন্তানের অপুষ্টির ঝুঁকি থাকে। মায়ের বয়স, শিক্ষা ও ওজন কম থাকলে শিশুর পুষ্টির ঘাটতি থাকে।
প্রতিরোধে করণীয়দুনিয়ায় সবচেয়ে হতভাগা পথের নবজাতক। এদের নিয়ে কাজ করেন শিশু ও মাতৃস্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের পরিচালক মো. মুজিবুর রহমান। তিনি বলেন, পথে পাওয়া নবজাতকের মা, বাবা কেউ থাকে না। এসব শিশুর অপুষ্টির ঝুঁকি বেশি। এ ধরনের শিশুদের জন্য ‘মিল্ক ব্যাংক’ তৈরির একটি প্রচেষ্টা তিনি চালিয়ে যাচ্ছেন।
বাংলাদেশ শিশু হাসপাতাল ও ইনস্টিটিউটের পরিচালক অধ্যাপক মাহবুবুল হক বলেন, অল্প বয়সে বিয়ে হলে কার্যত একটি অপরিণত শিশুর জন্ম দেয় আরেকটি শিশু। এটি বন্ধ করতে হলে বাল্যবিবাহ বন্ধ করতে হবে।
অপুষ্টি দূর করতে হলে দৃঢ় প্রতিশ্রুতি দরকার বলে মন্তব্য করেন জাতীয় পুষ্টি সেবার লাইন ডিরেক্টর অধ্যাপক আনজুমান আরা সুলতানা। তিনি বলেন, অপুষ্টির বিষয়গুলো ঠিকভাবে জানতে হবে, ঠিকভাবে জানাতে হবে।
আলোচনায় অংশ নিয়ে স্বাস্থ্য খাত সংস্কার কমিশনের সদস্য এবং কমিউনিটি ক্লিনিক হেলথ সাপোর্ট ট্রাস্টের চেয়ারম্যান অধ্যাপক আবু মুহাম্মদ জাকির হোসেন বলেন, অপুষ্টি দূর করতে বহু পক্ষের সমন্বয় প্রয়োজন। তিনি বলেন, জাতীয় বাজেটে স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ বাড়ানোর বিষয়গুলো আলোচনায় আছে। মাঠপর্যায়ের স্বাস্থ্যকর্মীদের কাজ সুনির্দিষ্ট করার সুপারিশ দেওয়া হচ্ছে। স্বাস্থ্য ও পুষ্টির প্রশিক্ষণ অর্থবহ করার চেষ্টা চলছে।
অনুষ্ঠানের শেষ পর্যায়ে আইসিডিডিআরবির নির্বাহী পরিচালক তাহমিদ আহমেদ বলেন, জন্মের পর মায়ের দুধ খাওয়া শিশুদের হার বাড়াতে হবে, দুই সন্তানের মাঝে জন্মের সময় ২৪ মাসের বেশি করতে হবে, গর্ভবতী মায়েদের বিশ্রামে গুরুত্ব দিতে হবে।
দুই ঘণ্টার ওপর চলা এই গোলটেবিল বৈঠক সঞ্চালনা করেন প্রথম আলোর সহকারী সম্পাদক ফিরোজ চৌধুরী।
উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: পর স থ ত
এছাড়াও পড়ুন:
জুলাই বিপ্লব পরিষদের দোয়া ও ইফতার মাহফিল
জুলাই বিপ্লব পরিষদের আয়োজনে রাজধানীর উত্তর যাত্রাবাড়ীর নূর কমিউনিটি সেন্টারে মঙ্গলবার বিশেষ দোয়া ও ইফতার মাহফিল অনুষ্ঠিত হয়েছে। এতে জুলাই গণঅভ্যুত্থানে শহীদ ও আহতদের পরিবারের প্রতি শ্রদ্ধা এবং রাজনীতিসহ বিভিন্ন বিষয় নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা হয়।
অনুষ্ঠানে বিভিন্ন রাজনৈতিক ও ছাত্র সংগঠনের নেতারা, বিশিষ্ট ব্যক্তিরা উপস্থিত ছিলেন। বক্তারা দেশের চলমান সংকট উত্তরণের জন্য ঐক্যবদ্ধ প্রয়াস জরুরি বলে মত দেন।
জাতীয়তাবাদী যুবদলের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সদস্য মো. আহসান উল্লাহ তুষার বলেন, জুলাই অভ্যুত্থান ছিল অন্যায়ের বিরুদ্ধে এক ঐতিহাসিক প্রতিরোধ, যা ভবিষ্যতেও গণতান্ত্রিক আন্দোলনের প্রেরণা হয়ে থাকবে।
মাহফিলে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশ জাতীয় পার্টির (বিজেপি) মহাসচিব সাউদ মতিন, জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) সংগঠক (দক্ষিণাঞ্চল) এবং জুলাই বিপ্লব পরিষদের যুগ্ম আহ্বায়ক মো. রাকিব হোসেন, এনসিপির যুগ্ম মুখ্য সংগঠক (দক্ষিণাঞ্চল) এস এম শাহরিয়ার, বিপ্লবী ছাত্র পরিষদের আহ্বায়ক আব্দুল ওয়াহেদ, বাংলাদেশ ছাত্রপক্ষের সদস্য সচিব আশরাফুল ইসলাম নির্ঝর, বিপ্লবী ছাত্র পরিষদের ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় শাখার আহ্বায়ক মো. আরিফুল ইসলাম এবং জুলাই বিপ্লব পরিষদের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী কমিটির স্থায়ী সদস্য সাদিল আহমেদ প্রমুখ।
এছাড়াও জুলাই বিপ্লব পরিষদের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী কমিটির স্থায়ী সদস্য শাহনেওয়াজ ফাহাদ ভার্চ্যুয়ালি উপস্থিত ছিলেন। ন্যায়বিচার ও মানবাধিকারের সংগ্রাম আরও বেগবান করতে তরুণদের আরও সক্রিয় হওয়ার আহ্বান জানান শাহনেওয়াজ ফাহাদ।
অনুষ্ঠানে ইফতার মাহফিলে শহীদ ও আহতদের আত্মত্যাগের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানানো হয়। বিশেষ দোয়া পর্বে তাদের আত্মার মাগফিরাত, আহতদের সুস্থতা এবং দেশের শান্তি ও অগ্রগতি কামনা করা হয়।