সংস্কার ও নির্বাচন নিয়ে অন্তর্বর্তী সরকার ও রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে একধরনের টানাপোড়েন চলছিল বেশ কিছুদিন থেকেই। প্রকাশ্যে বক্তৃতা–বিবৃতিও দিয়েছেন কেউ কেউ। আবার রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যেও নানা বিষয়ে মতভেদ পরিলক্ষিত হচ্ছিল।
এই পরিপ্রেক্ষিতে শনিবার জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোর সংলাপটি তাৎপর্যপূর্ণ বলে মনে করি। এই সংলাপে বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী, জাতীয় নাগরিক কমিটি, ইসলামী আন্দোলন, এলডিপি, নাগরিক ঐক্য, জাতীয় পার্টি (কাজী জাফর), খেলাফত মজলিস, গণসংহতি আন্দোলন, গণ অধিকার পরিষদসহ ২৭টি দল ও জোটের প্রায় ১০০ রাজনীতিক অংশ নেন।
সংলাপে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস ছাড়াও প্রায় সব রাজনৈতিক দল ও জোটের নেতারা বক্তব্য দেন। প্রধান উপদেষ্টা ছয় সংস্কার কমিশনের সুপারিশগুলোর ব্যাপারে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠার এ প্রয়াসকে অন্তর্বর্তী সরকারের দ্বিতীয় অধ্যায় হিসেবে অভিহিত করেন।
দেশের নির্বাচনব্যবস্থা, পুলিশ, বিচার বিভাগ, জনপ্রশাসন, সংবিধান ও দুর্নীতি দমন বিষয়ে সংস্কারের জন্য গঠিত কমিশনগুলো ইতিমধ্যে প্রতিবেদন জমা দিয়েছে। পুরো সংস্কারের বিষয়ে ঐকমত্য তৈরির লক্ষ্যে সম্প্রতি প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসকে সভাপতি ও আলী রীয়াজকে সহসভাপতি করে সাত সদস্যের জাতীয় ঐকমত্য কমিশন গঠন করা হয়েছিল। মেয়াদ নির্ধারণ করা হয়েছে ছয় মাস।
প্রধান উপদেষ্টা তাঁর ভাষণে রাজনৈতিক দলগুলোকে স্পষ্ট জানিয়ে দেন, অন্তর্বর্তী সরকার কোনো সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেবে না। এ বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোই সিদ্ধান্ত নেবে। জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের চূড়ান্ত লক্ষ্য সংস্কারের বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মতামতের ভিত্তিতে জুলাই সনদ তৈরি করা।
তবে রাজনৈতিক দলের নেতাদের কণ্ঠে ঐকমত্যের বিষয়ে আশাবাদের কথা শোনা গেলেও সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়া ও নির্বাচনের সময়ের বিষয়ে ভিন্নমত আছে। অনেক দল ন্যূনতম সংস্কার করে দ্রুত জাতীয় নির্বাচনের তাগিদ দিয়েছে। আবার কোনো কোনো দল ব্যাপকভিত্তিক সংস্কারের ওপর জোর দিয়েছে। জাতীয় নির্বাচন আগে না স্থানীয় নির্বাচন আগে হবে, তা নিয়েও বিতর্ক আছে।
জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি আলী রীয়াজ বলেছেন, শিগগিরই দল ও জোটভিত্তিক আলোচনা শুরু হবে। ইতিমধ্যে ৬টি সংস্কার কমিশন তাদের পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন ওয়েবসাইটে দেওয়া হয়েছে। রাজনৈতিক দলগুলো চাইলে ঐকমত্য কমিশন থেকে মুদ্রিত কপিও সংগ্রহ করতে পারবে।
প্রধান উপদেষ্টা ভবিষ্যতে একটি সুন্দর বাংলাদেশ বিনির্মাণের জন্য সংস্কারের ওপর জোর দিয়েছেন, যাতে স্বৈরাচারী ব্যবস্থা আর কখনোই ফিরে না আসতে পারে। এ বিষয়ে মোটাদাগে কোনো রাজনৈতিক দলের দ্বিমত আছে বলে মনে হয় না। অন্তত প্রকাশ্যে সে কথা কেউ বলেননি। রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে তর্কবিতর্ক হতে পারে, কিন্তু কতিপয় বিষয়ে তাদের একমত হতেই হবে। গণতন্ত্রে উত্তরণের জন্য নির্বাচন যে জরুরি, এ কথা কেউ অস্বীকার করবে না। আবার ভবিষ্যতে রাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক কাঠামো সুদৃঢ় করতে সংস্কারকেও অগ্রাহ্য করা যাবে না।
সর্বোপরি গুরুত্বপূর্ণ হলো সংলাপের মধ্য দিয়ে যে সনদ তৈরি হবে, সেটি বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক দলগুলোর একাগ্রতা ও আন্তরিকতা। প্রধান উপদেষ্টা যাকে জাতির সুবর্ণ সুযোগ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন, তার সদ্ব্যবহার করা যাবে কি না, তা পুরোপুরি নির্ভর করবে রাজনৈতিক বোঝাপড়ার ওপর। রাজনৈতিক দলগুলো অতীতের ভুল থেকে শিক্ষা নেবে আশা করি। তবে তাদের সেই বিখ্যাত বাণীও স্মরণ করিয়ে দিতে চাই, ‘ইতিহাসের এটাই শিক্ষা যে, কেউ ইতিহাস থেকে শিক্ষা নেয় না।’
.উৎস: Prothomalo
এছাড়াও পড়ুন:
সংস্কার প্রস্তাব নিয়ে মতামত দিল আরও দুই দল
সংস্কারের গুরুত্বপূর্ণ ১৬৬টি সুপারিশের বিষয়ে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের কাছে লিখিত মতামত জমা দিয়েছে গণফোরাম ও জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশ।
আজ রোববার দল দুটির প্রতিনিধিরা আলাদাভাবে জাতীয় সংসদ ভবনে কমিশনের কার্যালয়ে গিয়ে কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজের কাছে মতামত জমা দেন। এ নিয়ে দেশের ৩৪টি রাজনৈতিক দল কমিশনের কাছে লিখিত মতামত দিল।
আজ প্রথমে সংস্কারের সুপারিশ নিয়ে নিজেদের প্রস্তাব জমা দেয় গণফোরামের সাধারণ সম্পাদক মিজানুর রহমানের নেতৃত্বে আট সদস্যের একটি প্রতিনিধিদল। পরে জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশের পক্ষে সংস্কার প্রস্তাব জমা দেয় দলটির মহাসচিব মাওলানা মঞ্জুরুল ইসলাম আফেন্দীর নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধিদল।
জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম এর আগে সংবিধান সংস্কার কমিশনের সুপারিশের বিষয়ে নিজেদের মতামত জানিয়েছিল। আজ বাকি চারটি সংস্কার কমিশনের সুপারিশের বিষয়ে নিজেদের মতামত জমা দেয় দলটি।
দল দুটির মতামত জমা দেওয়ার সময় জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সদস্য বদিউল আলম মজুমদার উপস্থিত ছিলেন।
সংস্কার বিষয়ে জাতীয় ঐকমত্য গঠনের লক্ষ্যে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন গত ১৫ ফেব্রুয়ারি কাজ শুরু করে।
প্রথম পর্যায়ে গঠিত সংস্কার কমিশনগুলোর মধ্যে সংবিধান, জনপ্রশাসন, নির্বাচনব্যবস্থা, বিচার বিভাগ ও দুর্নীতি দমন কমিশন সংস্কার কমিশনের গুরুত্বপূর্ণ ১৬৬টি সুপারিশের বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মতামত চায় এ কমিশন। সুপারিশগুলো স্প্রেডশিট আকারে ৩৯টি রাজনৈতিক দলের কাছে পাঠানো হয়। ১৩ মার্চের মধ্যে দলগুলোকে মতামত দিতে বলা হয়েছিল।
আরও পড়ুনসংস্কার বিষয়ে ঐকমত্য না হয়ে নির্বাচনে গেলে শঙ্কা দেখা দেবে: জামায়াত১৭ ঘণ্টা আগেআজ এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন জানিয়েছে, এখন পর্যন্ত ৩৪টি রাজনৈতিক দলের কাছ থেকে মতামত পাওয়া গেছে। মতামতের ভিত্তিতে ইতিমধ্যে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলাদাভাবে আলোচনা শুরু করেছে কমিশন। ইতিমধ্যে আটটি রাজনৈতিক দলের সঙ্গে প্রাথমিক পর্যায়ে আলোচনা শেষ করেছে কমিশন। ১৫ এপ্রিল জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক আন্দোলন ও বাংলাদেশ বিপ্লবী কমিউনিস্ট লীগের সঙ্গে এবং ১৭ এপ্রিল বিএনপির সঙ্গে আলোচনায় বসবে কমিশন।
আরও পড়ুনডিসেম্বর থেকে জুনের মধ্যে নির্বাচন করতে সংস্কার এগিয়ে নেওয়ার তাগিদ প্রধান উপদেষ্টার২০ ঘণ্টা আগেআরও পড়ুনসংস্কার নিয়ে মতামত দিল আরও দুই দল০৯ এপ্রিল ২০২৫