ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে একের পর এক ডাকাতি, আতঙ্কিত চালক ও যাত্রীরা চান নিরাপত্তা
Published: 17th, February 2025 GMT
একের পর এক ডাকাতির ঘটনায় ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক যাত্রী ও যানবাহনের চালকদের কাছে আতঙ্কের নাম হয়ে উঠেছে। দিনে-রাতে মহাসড়কে চলাচলকারী যানবাহন থামিয়ে ডাকাতেরা অস্ত্রের মুখে যাত্রীদের সর্বস্ব লুটে নিয়ে যাচ্ছে। এমনকি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পরিচয়েও চলছে ডাকাতি।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, আগে ডাকাতির ঘটনা ঘটলেও ৫ আগস্টের পর তা বেড়েছে। বিমানবন্দর হয়ে দেশে ফেরা প্রবাসী, রাজধানীতে আসা ব্যবসায়ী, গাড়িচালক ও স্থানীয় তৈরি পোশাকশ্রমিকেরা বেশি ডাকাতি, ছিনতাইয়ের শিকার হচ্ছেন। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই ‘ঝামেলা এড়াতে’ মহাসড়কে ডাকাতির শিকার ব্যক্তিরা মামলা করতে চান না। অনেক সময় পুলিশও ডাকাতির ঘটনায় ছিনতাইয়ের মামলা কিংবা শুধু জিডি নিয়েই দায় শেষ করেন। কিছু ঘটনায় হওয়া মামলায় ডাকাত দলের সদস্যরা ধরা পড়লেও জামিনে বেরিয়ে আসামিরা আবার ডাকাতিতে জড়াচ্ছেন বলে জানিয়েছেন পুলিশ কর্মকর্তারা।
ঢাকা–চট্টগ্রাম মহাসড়কে ডাকাতির সুনির্দিষ্ট পরিসংখ্যান আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছে পাওয়া যায়নি। তবে এই মহাসড়কে চলাচলকারী কুমিল্লা অঞ্চলের হালকা যানবাহনের চালকেরা নিজেদের ভার্চ্যুয়াল গ্রুপে শেয়ার করা তথ্যের বরাত দিয়ে বলছেন, গত ছয় মাসে নারায়ণগঞ্জের কাঁচপুর থেকে কুমিল্লার চান্দিনা পর্যন্ত মহাসড়কে অন্তত ১০০ ছিনতাই ও ডাকাতির ঘটনা ঘটেছে। যার বেশির ভাগের ক্ষেত্রে কোনো মামলা হয়নি। অপর দিকে শেষ ছয় মাসে ঢাকা–চট্টগ্রামসহ নারায়ণগঞ্জের বিভিন্ন মহাসড়কে ডাকাতির ঘটনায় অন্তত ১৯টি মামলার তথ্য পাওয়া গেছে।
কুমিল্লার ইলিয়টগঞ্জ এলাকার মাইক্রোবাসচালক সাদেকুর রহমান বলেন, ‘মহাসড়কে ডাকাতি ও ছিনতাইয়ের ঘটনা বেড়ে যাওয়ায় চালকদের জীবন হুমকির মুখে পড়ছে। কারণ, ডাকাত দল যাত্রীদের সর্বস্ব নিয়ে পালানোর সময় কৌশলে চালকদেরই অপরাধী বানাচ্ছে। এতে চালকেরা বিনা অপরাধে আইনি ঝামেলার শিকার হচ্ছেন। আমরা নিরাপদ মহাসড়ক চাই।’
ঘটনা অনেক, মামলা কমথানাগুলো থেকে পাওয়া পুলিশের হিসাব বলছে, গত ছয় মাসে মহাসড়কে ডাকাতির ঘটনায় নারায়ণগঞ্জের তিনটি থানায় অন্তত ১৯টি মামলা হয়েছে। এর মধ্যে রূপগঞ্জ থানায় ১৩টি, বন্দরে ৪টি ও আড়াইহাজারে ২টি মামলা হয়েছে। এসব মামলায় অভিযুক্ত হিসেবে ৩৫ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। গত ছয় মাসে সিদ্ধিরগঞ্জ থানায় চারটি ছিনতাই মামলা হলেও সোনারগাঁ থানায় কোনো মামলা হয়নি। যদিও এ সময়ে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের সোনারগাঁ অংশে বেশ কিছু ডাকাতির ঘটনার খবর পাওয়া গেছে। গত ৮ ডিসেম্বর সোনারগাঁর মেঘনা টোল প্লাজা এলাকায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কেন্দ্রীয় সদস্যসচিব আরিফ সোহেলসহ নেতাদের বহনকারী একটি গাড়িতে ডাকাত দল আক্রমণ করে। এ সময় নেতাদের মারধর করে মালামাল লুটে নেওয়া হয়।
এত কষ্ট করে বিদেশে অর্থ উপার্জন করেছি, কিন্তু ঘরে ফিরেছি শূন্য হাতে। ঘরে আমার দুইটা ছেলে, তাদের জন্য একটা চকলেটও আনতে পারিনি। সেদিন মনে হচ্ছিল প্রাণটা নিয়ে অনেক কষ্টে ঘরে ফিরেছিছিনতাইয়ের শিকার মো.আবু হানিফ, কুমিল্লার বুড়িচং উপজেলার আরাগ আনন্দপুর গ্রামের প্রবাসী
মামলার পরিসংখ্যান দিয়ে ঘটনার ভয়াবহতা বিচার করা যাবে না বলে মনে করেন নারায়ণগঞ্জের সাবেক ও বর্তমান দুজন পুলিশ কর্মকর্তা। নাম প্রকাশ না করার শর্তে তাঁরা প্রথম আলোকে বলেন, মহাসড়কে ডাকাতি ও ছিনতাইয়ের পর সর্বোচ্চ ১০ শতাংশ ঘটনায় ভুক্তভোগীরা পুলিশের কাছে আসে। মামলা হয় আরও কম। কোনো ক্ষেত্রে ডাকাতির মামলা না নিয়ে চুরি কিংবা ছিনতাই মামলা নেওয়া হয়। কখনো আবার সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করে ভুক্তভোগীদের থানা থেকে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। ফলে প্রতিনিয়ত মহাসড়কে ছিনতাই-ডাকাতি হলেও পুলিশের খাতায় তার সামান্যই উল্লেখ থাকে।
মহাসড়ক এলাকায় দায়িত্ব পালনকারী আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা বলছেন, অধিকাংশ ক্ষেত্রে ডাকাতি কিংবা ছিনতাইয়ের শিকার যাত্রীরা ভয়ে দ্রুত এলাকা ছাড়েন। আদালত ও থানার হয়রানির ভয়ে তাঁরা মামলা এড়িয়ে যান। বড় ধরনের ডাকাতির ঘটনা ঘটলে মামলা হয়। এরপর পুলিশ জড়িত ব্যক্তিদের গ্রেপ্তার করলেও দ্রুতই তাঁরা জামিনে বের হয়ে আবার ডাকাতিতে জড়াচ্ছেন।
গত ৮ ডিসেম্বর ছিনতাইকারীদের হামলায় ক্ষতিগ্রস্ত বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কেন্দ্রীয় সমন্বয়কদের বহনকারী গাড়িউৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: ড ক ত র ঘটন য় ন র য়ণগঞ জ র ছয় ম স
এছাড়াও পড়ুন:
পুলিশের জনসম্পৃক্ত কর্মকাণ্ডে ভাটা
গত বছর ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর ভেঙে পড়েছিল পুলিশি ব্যবস্থা। নাজুক আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি সামাল দিতে সরকারকে পড়তে হয় নানা প্রতিবন্ধকতার মুখে। এখনও পুরো স্বাভাবিক হয়ে উঠতে পারেনি পুলিশ। আইন প্রয়োগ করতে গিয়ে বাধার মুখে পড়তে হচ্ছে বাহিনীটিকে। এমন পরিস্থিতিতেও বন্ধ আছে কমিউনিটি পুলিশিং কার্যক্রম। ওপেন হাউস ডে ও উঠান বৈঠকের মতো কার্যক্রম সেভাবে দৃশ্যমান নয়। ফলে পুলিশের সঙ্গে জনগণের দূরত্ব বেড়েছে। জনগণ-পুলিশ ইতিবাচক সম্পৃক্ততার কর্মকাণ্ডে ভাটা দেখা দিয়েছে।
আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে জনগণের সঙ্গে পুলিশের মাঠ পর্যায়ের সদস্যদের সম্পর্ক আরও সহযোগিতামূলক ও বন্ধুত্বপূর্ণ করার প্রয়োজনীয়তার ওপর গুরুত্ব দিচ্ছেন বিশিষ্টজন। তারা বিস্তৃত পরিসরে জনসম্পৃক্ত কর্মসূচি চালু করার কথা বলছেন। জনতার সঙ্গে পুলিশের ভঙ্গুর সম্পর্ক পুনঃস্থাপনে এসব কার্যক্রম ভালো ফল আনতে পারে বলে মনে করছেন তারা। পুলিশ সংস্কার কমিশনের সুপারিশেও জনমুখী ও জবাবদিহিমূলক পুলিশ বাহিনী গড়ে তুলতে কমিউনিটি পুলিশিংয়ের ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। এটিকে প্রাতিষ্ঠানিকীকরণে আইনি কাঠামোর কথাও বলা হয়েছে।
সাবেক পুলিশ মহাপরিদর্শক মোহাম্মদ নুরুল হুদা বলেন, বর্তমান পরিস্থিতির কারণেই হয়তো কমিউনিটি পুলিশিং কমিটিগুলো স্তিমিত হয়ে আছে। এগুলো পুনরুজ্জীবিত করতে হবে। এখন রাজনৈতিক নেতারা আগের মতো তৎপর নেই; ওয়ার্ড পর্যায়ে সরকারের প্রতিনিধি নেই। তাই সামাজিক নেতাদের সঙ্গে কথা বলতে হবে। সমাজে যাদের মতামতের গুরুত্ব আছে, তাদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতে হবে। এটি শুধু এখনকার জন্য নয়, সব সময়ের জন্যই দরকার। আস্থা ফিরিয়ে আনার জন্য এবং আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে কাজ করার জন্য এটি জরুরি।
সমাজ ও অপরাধ বিশেষজ্ঞ এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক ড. তৌহিদুল হক বলেন, বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের সঙ্গে পুলিশের সংযোগ স্থাপনের মধ্য দিয়ে আস্থার সম্পর্ক গড়ে তুলতে কমিউনিটি পুলিশিং, বিট পুলিশিং ও ওপেন হাউস ডে চালু করা হয়। পুলিশ এখন নৈতিক ও মনোবল সংকটের মধ্যে আছে, আইন প্রয়োগ করতে গিয়ে বিভিন্ন বাধা ও প্রশ্নের মুখে পড়ছে, শারীরিক ও মানসিক আক্রমণের শিকার হচ্ছে। এ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে পুলিশের কমিউনিটিভিত্তিক কার্যক্রম যত বাড়ানো যাবে, মানুষের সঙ্গে সংযোগ বা সম্পর্কের জায়গাটা তত বেশি আস্থা-বিশ্বাসের হবে। এলাকাভিত্তিক অপরাধীরা কোণঠাসা থাকবে। পুলিশ সম্পর্কে মানুষের যে ভুল ধারণা, তা দূর হবে।
পুলিশ সদরদপ্তরের গণমাধ্যম ও জনসংযোগ বিভাগের সহকারী মহাপরিদর্শক ইনামুল হক সাগর সমকালকে বলেন, কমিউনিটি পুলিশিং ফোরামের আগের যে কমিটিগুলো ছিল, সেগুলো এখন নেই। তবে জনগণকে সঙ্গে নিয়ে পুলিশের বিভিন্ন কার্যক্রম চলমান। পুলিশ সদস্যরা ওপেন হাউস ডে, উঠান বৈঠক, গাড়িচালক ও হেলপারদের নিয়ে বিভিন্ন সচেতনতামূলক কার্যক্রম অব্যাহত রেখেছেন। ভবিষ্যতে জনগণকে সঙ্গে নিয়ে আরও সংগঠিতভাবে পুলিশিংয়ের প্রচেষ্টা অব্যাহত থাকবে।
সম্প্রতি রাজধানীর বিভিন্ন শপিংমলসহ আবাসিক এলাকার নিরাপত্তায় পুলিশ ও অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বাইরে বেসরকারি কর্মীদের ‘অক্সিলারি ফোর্স’ হিসেবে নিয়োগের কথা জানায় ডিএমপি। তবে এই সিদ্ধান্ত খুব বেশি সাড়া ফেলেনি। আবার কিছুদিন ধরে সিটিজেন ফোরামের মাধ্যমে স্থানীয় বাসিন্দাদের সঙ্গে সম্পর্কের ভিত তৈরির চেষ্টা করছে পুলিশ।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পুলিশের সমাজভিত্তিক কার্যক্রম বাড়ানো প্রয়োজন। স্থানীয় গণ্যমান্য ব্যক্তিদের সঙ্গে পুলিশের সম্পর্ক ভালো হলে কোনো বেআইনি কর্মকাণ্ডে জনগণই বাধা হয়ে দাঁড়াবে।
জনমুখী ও জবাবদিহিমূলক পুলিশ বাহিনী গড়ে তুলতে পুলিশ সংস্কার কমিশনের প্রস্তাবেও বেশ কিছু বিষয় গুরুত্ব পেয়েছে। এতে কমিউনিটি পুলিশিংয়ের ধরন ও বিস্তৃতি কেমন হতে পারে, সে ব্যাপারে আছে কিছু পরামর্শ। বলা হয়েছে, জনবান্ধব পুলিশিং নিশ্চিত করতে কমিউনিটি পুলিশিংয়ের পরিসর বাড়ানো প্রয়োজন। একে কার্যকর করে ‘চেক অ্যান্ড ব্যালান্স’ ব্যবস্থা করে জবাবদিহি বাড়ানোর কৌশল হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা জরুরি। পুলিশ ও জনগণের মধ্যে সম্পর্কে যে ক্ষত সৃষ্টি হয়েছে, তা সারিয়ে তুলতে কমিউনিটি পুলিশিং টেকসই ব্যবস্থা হিসেবে কাজ করতে পারে। সমাজের সৎ ও সবার কাছে গ্রহণযোগ্য ব্যক্তিদের এ ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার দিতে হবে।
বিগত সরকারের দমনপীড়নের হাতিয়ার হয়ে ওঠায় তাদের প্রতি ক্ষোভ রয়েছে মানুষের। এ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে কমিউনিটিভিত্তিক বা জনসম্পৃক্ত কর্মসূচি ভূমিকা রাখতে পারে বলে মনে করেন বিশিষ্টজন। বর্তমানে সীমিত মাত্রায় ওপেন হাউস ডে ও উঠান বৈঠকের মতো কর্মসূচি চলমান থাকার কথা বলা হলেও সেগুলোর কার্যকারিতা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। ঢাকা মহানগরেই এসব কর্মকাণ্ড তেমন দৃশ্যমান নয়। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কমিউনিটি পুলিশিংয়ের মতো কর্মসূচি আবার চালু করলে পুলিশের সঙ্গে সাধারণ মানুষের সেতুবন্ধন দৃঢ় হবে। এলাকাভিত্তিক অপরাধীদের বিষয়ে তথ্য পাওয়া সহজ হবে। আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে আরও স্বচ্ছন্দ হতে পারবে পুলিশ। তবে এটি করতে গিয়ে অতীতের মতো ঢালাওভাবে কারও ওপর দায়িত্ব ছেড়ে দিলে তৃতীয় পক্ষ সুযোগ নেবে। কাউকে অভিযুক্ত করার ভয় দেখিয়ে সুবিধা আদায় বা কোনো কিছু করতে বাধ্য করার ঘটনা অতীতে ঘটেছে। এ কারণে এই ব্যবস্থাকে যথাযথ নজরদারির আওতায় রাখতে হবে।
সংশ্লিষ্টরা জানান, ক্ষমতার পালাবদলের পর আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি সামাল দিতেই পুলিশের হিমশিম অবস্থা। তাই কমিউনিটি পুলিশিং কমিটি পুনর্গঠন বা সক্রিয় করার দিকে মনোযোগ দেওয়া যায়নি। আগের কমিটিগুলো এখন কার্যকর নেই। নতুন করে কমিটি গঠনের বিষয়ে কোনো নির্দেশনা আসেনি। শোনা যাচ্ছে, আগের মতো না হয়ে কিছুটা নতুন আঙ্গিকে কমিটি হতে পারে। এখন সারাদেশে নাগরিক কমিটি গঠন করা হয়েছে। তাদের সঙ্গে পুলিশের নিয়মিত যোগাযোগ রয়েছে। আগামী পুলিশ সপ্তাহে নাগরিকদের নিয়ে একটি আয়োজন রাখার পরিকল্পনা করা হচ্ছে।
জনসম্পৃক্ত পুলিশ গড়তে ১৯৯৩ সালে ময়মনসিংহে এবং পরের বছর ঢাকার দুটি থানায় কমিউনিটি পুলিশিং চালু হয়। ২০০৫ সালে জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচির (ইউএনডিপি) সহায়তায় পুলিশ সংস্কার কর্মসূচির আওতায় সারাদেশে এই কার্যক্রম ছড়িয়ে দেওয়া হয়। এই কার্যক্রমকে আরও গতিশীল করতে বিভিন্ন এলাকাকে ‘বিট’ হিসেবে ভাগ করে চালু হয় বিট পুলিশিং। প্রতিটি বিটের দায়িত্বপ্রাপ্ত পুলিশ কর্মকর্তা সংশ্লিষ্ট এলাকার আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে স্থানীয়দের সঙ্গে সুসম্পর্ক রাখতেন। জনসচেতনতা বাড়াতে উঠান বৈঠকের মতো কর্মসূচি নিতেন। তাদের তদারক করতেন থানার জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তারা।
কমিউনিটি পুলিশিং কমিটির বড় কর্মপরিধি ছিল ঢাকা মহানগরে। ৫০টি থানার পুলিশকে সহায়তা করতেন কমিউনিটি পুলিশিং সদস্যরা। এখন তাদের কার্যক্রম নেই। তবে ঢাকাসহ সারাদেশেই নাগরিক কমিটি গঠন করা হয়েছে। ঢাকা মহানগর পুলিশের গণমাধ্যম ও জনসংযোগ বিভাগের উপকমিশনার মুহাম্মদ তালেবুর রহমান সমকালকে বলেন, ঢাকায় আমরা সিটিজেন ফোরাম বা নাগরিক কমিটি গঠন করেছি। তারা আমাদের নানা পরামর্শ ও তথ্য দিয়ে সহায়তা করেন। সংশ্লিষ্ট থানার কর্মকর্তারা কমিটিগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ রাখছেন। এ ছাড়া সহায়ক পুলিশরাও অপরাধ দমনে ভূমিকা রাখবেন।
পুলিশ সংস্কার কমিশনের প্রস্তাবে বলা হয়, কমিউনিটি পুলিশিংকে আগে কেবল অপরাধ দমনের কৌশল হিসেবে সীমাবদ্ধ রাখা হতো। তবে সুনির্দিষ্টভাবে ছাত্রদের সমন্বয়ে এ ব্যবস্থা চালু করা যেতে পারে। যুক্তরাজ্য, ভারতসহ অনেক দেশে ছাত্রদের মাধ্যমে কমিউনিটি পুলিশিং পদ্ধতি চালু আছে। এ ছাড়া দেশে বিভিন্ন অফিস ও বাড়িতে বেসরকারি নিরাপত্তারক্ষী আছেন। তাদের পদ্ধতিগত কাঠামোর মাধ্যমে জনসম্পৃক্ত কাজে যুক্ত করলে নিরাপত্তা সুসংহত হবে। দেশে গ্রাম আদালত ও চৌকিদারি ব্যবস্থা বিদ্যমান। স্থানীয় ব্যবস্থাকে যথাযথভাবে কাজে লাগিয়ে অপরাধ দমন ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব। কমিউনিটি পুলিশ ব্যবস্থার জন্য বাজেট বরাদ্দেরও পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।
সংশ্লিষ্ট একাধিক কর্মকর্তা বলেছেন, বর্তমানে পুলিশের প্রায় সব গুরুত্বপূর্ণ পদে আছেন নতুন মুখ। অনেক এলাকায় অপরাধের তথ্য পুলিশ সময়মতো পায় না। কমিউনিটি পুলিশ ব্যবস্থা কার্যকর হলে দ্রুত নাগরিকদের কাছ থেকে অপরাধের তথ্য পাওয়া যাবে। আবার অনেক জায়গায় অপরাধীকে ধরতে গিয়ে ‘মব ভায়োলেন্সের’ মুখোমুখি হচ্ছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। স্থানীয় গণমান্য ব্যক্তিদের সঙ্গে পুলিশের সম্পৃক্ততা আরও জোরদার হলে বেআইনি কর্মকাণ্ডে জনগণই বাধা হয়ে দাঁড়াবে। কমিউনিটি পুলিশিংয়ের কমিটিতে যাতে মাদক কারবারিসহ বিতর্কিত লোকজন যুক্ত না হতে পারে, সেটি নিশ্চিত করতে হবে। তা না হলো সমাজে ভুল বার্তা যাবে।
সরেজমিন যা দেখা গেল
রাজধানীর কয়েকটি থানা ঘুরে কমিউনিটি পুলিশিং, ওপেন হাউস ডে ও উঠান বৈঠক নামে কোনো কার্যক্রম চলমান থাকার তথ্য মেলেনি। কিছু ক্ষেত্রে নতুন করে গঠিত হয়েছে সিটিজেন ফোরাম বা নাগরিক কমিটি। এর মাধ্যমে জনসম্পৃক্ততা বাড়ানোর চেষ্টা করছে পুলিশ। তাদের নিয়ে মতবিনিময় সভা হচ্ছে। সেই সঙ্গে থানা এলাকার বিভিন্ন বিটে আলাদাভাবে বৈঠকের আয়োজন করা হচ্ছে। এর বাইরে মসজিদে গিয়ে, বিভিন্ন সামাজিক-সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে গিয়ে পুলিশ কর্মকর্তারা জনগণের সঙ্গে কথা বলছেন, সহযোগিতা চাচ্ছেন।
সম্প্রতি হাতিরঝিল থানায় গিয়ে দেখা যায়, ডিউটি অফিসারের কক্ষের সামনে কয়েকজন নারী দাঁড়িয়ে কথা বলছেন। তারা বিরোধ-সংক্রান্ত একটি সমস্যা সমাধানে পুলিশের সহায়তা চাইতে এসেছেন। তারা জানান, পুলিশের সেবায় পরিবর্তন এসেছে। কেউ থানায় এলে পুলিশ তাঁর বক্তব্য মনোযোগ দিয়ে শুনছে; দ্রুত সাড়া দেওয়ার চেষ্টা করছে।
হাতিরঝিল থানার ওসি মোহাম্মদ রাজু বলেন, মানুষের মনে আস্থা ফিরিয়ে আনতে নানারকম উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এলাকার নানা শ্রেণি-পেশার মানুষকে নিয়ে সিটিজেন ফোরাম গঠন করা হয়েছে। তাদের নিয়ে দুই মাস আগে একটি মতবিনিময় সভার আয়োজন করা হয়। এতে উপস্থিত প্রায় ৫০০ জনের মধ্যে ফুটপাতের ব্যবসায়ী, রিকশাচালকসহ সমাজের বিভিন্ন পর্যায়ের মানুষ ছিলেন। তাদের অভিযোগ, তাদের চাওয়া, তাদের সমস্যা আমরা গুরুত্বসহকারে শুনেছি এবং সে অনুযায়ী সেবা দেওয়ার চেষ্টা করছি।