জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের উদ্যোগে ২৭টি রাজনৈতিক দল ও জোটের ১০০ প্রতিনিধির সঙ্গে বৈঠকের ঘটনাটি তাৎপর্যবহ। কমিশনের প্রধান ড. মুহাম্মদ ইউনূসের ভাষায়, এটা সরকারের ‘দ্বিতীয় অধ্যায়ের শুরু’। অন্তর্বর্তী সরকারের ছয় মাস ইতোমধ্যে পূর্ণ হয়েছে। একটা ‘লন্ডভন্ড অবস্থা’য় তাদের দায়িত্ব নিতে হয়েছিল– প্রধান উপদেষ্টার এ বক্তব্যে কোনো ভুল নেই। পরিস্থিতির প্রত্যাশিত উন্নতি হয়নি– সেটাও বলতে হবে। হাসিনা সরকার যে জায়গায় দেশটি রেখে গেছে, সেখান থেকে টেনে তোলা অবশ্য কঠিন। উল্লিখিত বৈঠকে ক্ষমতাচ্যুত শাসক ও তার সহযোগীদের দিক থেকে অব্যাহতভাবে বাধা তৈরির যে কথা প্রধান উপদেষ্টা বলেছেন, সেটা জনগণেরও অভিজ্ঞতা। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি আর পণ্যবাজারেও তার বিরূপ অভিজ্ঞতা হচ্ছে। আছে এমনকি নিকট ভবিষ্যৎ নিয়ে দুর্ভাবনা। এর মধ্যে সরকারের দ্বিতীয় অধ্যায়ের সূত্রপাত নিয়েও জনগণের কম আগ্রহ নেই। 

হাসিনা-পরবর্তী সরকার সংস্কারের মধ্য দিয়ে নির্বাচনের দিকে এগোবে– এ বিষয়ে সবাই একমত। ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ অবশ্য মাঠে নেই। এ প্রক্রিয়ায় তাদের মতামতের অপেক্ষাও কেউ করছে না। ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে সংলাপ শুরুর দিন উল্টো বরং ক্ষমতাচ্যুত দলটির বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রশ্ন সামনে এসেছে। গণঅভ্যুত্থানে অংশগ্রহণকারীরা অবশ্য এ প্রশ্নে একমত নয়। জুলাই আন্দোলন দমনে হাসিনা সরকারের ভয়াবহ নিষ্ঠুরতার দিকটি জাতিসংঘ মানবাধিকার কমিশনের প্রতিবেদনে সামনে আসার পরও এ প্রশ্নে একমত নয় সব রাজনৈতিক দল। তবে নিষিদ্ধকরণের দাবিটি জোরদার হয়েছে। হাসিনা গংয়ের বিচারের দাবি আরও জোরদার। ভারতে আশ্রিত শেখ হাসিনাকে ফেরত চেয়ে নথি পাঠানোর কাজও এর মধ্যে সম্পন্ন। বিচারের এ প্রক্রিয়াকে সংশয়মুক্ত ও মানসম্পন্ন রাখার চ্যালেঞ্জ অবশ্য রয়েছে সামনে। সরকারের দ্বিতীয় অধ্যায়ে সংস্কারের পাশাপাশি বিচারে অগ্রগতিও সবাই দেখতে চাইবে। 

নিবন্ধটি লেখার দিন সংবাদপত্রে দেখছি জুলাই গণঅভ্যুত্থানে নিহত হয়ে মর্গে পড়ে থাকা মো.

হাসানের লাশ দাফনের খবর। যাত্রাবাড়ীতে পুলিশের গুলিতে নিহত হয় এই দোকান কর্মচারী। অভাবের কারণে পড়াশোনায় এগোতে না পারা ১৯ বছরের এ তরুণ কিছু অর্থ গ্রামের বাড়িতেও পাঠাত। অন্যান্য ক্ষেত্র থেকে উঠে আসা ব্যক্তিদের পাশাপাশি নিতান্ত গরিব ঘরের এই ছেলেরাও হাসিনা সরকারের পতনে নেমে এসেছিল রাস্তায়। অন্তর্বর্তী সরকারের প্রথম কর্তব্য ছিল গণঅভ্যুত্থানের এসব শহীদ ও আহতদের খোঁজ যথাযথভাবে নিয়ে প্রয়োজনীয় সব কিছু করা। সে ক্ষেত্রেও হতাশাজনক খবর কিন্তু কম মিলছে না। সরকার অবশ্য তার ‘সীমাবদ্ধতা’র কথা স্বীকার করে উদ্যোগ জোরদার করছে। ইউনূস সরকারের দ্বিতীয় অধ্যায়ে এ কাজে দৃশ্যমান অগ্রগতিও কাম্য। বিশেষত অর্থাভাবে কারও সুচিকিৎসা যেন ব্যাহত না হয়। কার্যকরভাবে সহায়তা জোগাতে শহীদ ও আহতদের তালিকা তৈরির কাজও যেন দ্রুত এগোয়। চলতি বাজেট থেকে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ অর্থ বেঁচে যাবে বলেই ধারণা। বেসরকারি, এমনকি বিদেশি উৎস থেকেও ওই রকম কাজে অর্থ সহায়তার ঘাটতি হওয়ার কথা নয়। 

অন্তর্বর্তী সরকারের প্রথম অধ্যায়ে ন্যায্য-অন্যায্য দাবিতে রাজপথ দখল করে ‘আন্দোলন’ রচনার চেষ্টা অব্যাহত জনদুর্ভোগের কারণ হয়েছে। শিক্ষাঙ্গনেও মবের তৎপরতা কম দেখা যায়নি। ইউনূস সরকার যেন এসেছে প্রাথমিকভাবে এসব দাবি-দাওয়া মেটাতে! সরকারও এ ক্ষেত্রে তার করণীয় স্পষ্ট করতে পারেনি– বললে ভুল হবে না। ইউনূস সরকারের মেয়াদ সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা না থাকাতেও চারদিক থেকে চাপ সৃষ্টির চেষ্টা বেড়েছে। মবের কাছে আত্মসমর্পণেও এই প্রবণতা ছড়িয়ে পড়েছে, বলতে হবে। সরকার তার দ্বিতীয় অধ্যায়ে এটা কি নিরুৎসাহিত করবে না?
রাজপথ দখলকারীদের প্রতি হালে পুলিশি কঠোরতা অবশ্য দেখা যাচ্ছে। শিল্প শ্রমিকদের ‘অরাজকতা’ ঠেকাতেও সরকার এক পর্যায়ে কঠোর হয়। বিশেষ কিছু ক্ষেত্রে কঠোরতা দেখানোর নীতি অবশ্য সমর্থনযোগ্য নয়। এতে সরকারের ‘শ্রেণি দৃষ্টিভঙ্গি’ নিয়ে প্রশ্ন উঠবে। দ্বিতীয় অধ্যায়ে বাজেটও দিতে হবে সরকারকে। তখন তার নীতিগত অবস্থান সামনে আসবে নতুন করে। সংস্কারের পাশাপাশি বিতর্ক এড়াতে এ লক্ষ্যেও অংশীজনের সঙ্গে মতবিনিময় বাড়াতে হবে সরকারকে। 

কিছুদিনের মধ্যেই শুরু হয়ে যাবে রমজান। এ অবস্থায় শবেবরাত থেকেই কিছু জরুরি পণ্যের বাজার অস্থির হতে শুরু করেছে। রমজানে বরাবরই কিছু ‘অস্বাভাবিক প্রবণতা’ দেখা যায়, যার শিকার ভোক্তাসাধারণ। তারা কিন্তু এবার আশা করে আছে, তেমন কিছু ঘটবে না। অন্তর্বর্তী সরকারকে এ অবস্থায় সময়োচিত সব পদক্ষেপ নিতে হবে। তারা অবশ্য আগেই জরুরি কিছু পণ্যের কর-শুল্ক ব্যাপকভাবে কমিয়েছেন। আমদানি পরিস্থিতিও সন্তোষজনক। দেশে উৎপাদন খাত স্বাভাবিকভাবে কাজ করছে কিনা– সে প্রশ্ন অবশ্য রয়েছে। ‘সাপ্লাই চেইন’ ঠিক রাখা এবং এ ক্ষেত্রে চাঁদাবাজি ঠেকানোও কর্তব্য। বড় ব্যবসায়ীদের সংঘবদ্ধ চাপ যে এখনও আছে– সেটা কিন্তু স্পষ্ট সয়াবিন তেলের কৃত্রিম সংকটে। হাসিনার শাসনামলে যে ব্যবসায়ীরা রাষ্ট্রের বিশেষ আনুকূল্য পেয়ে জাঁকিয়ে বসেছিল, তাদের বিষয়ে নিরপেক্ষভাবে ব্যবস্থা গ্রহণের ধারাও কি জোরদার হবে ‘দ্বিতীয় অধ্যায়ে’? ব্যাংক ও আর্থিক খাত সংস্কারে বাংলাদেশ ব্যাংকের পদক্ষেপ অবশ্য নজর কাড়ছে। সরকারের পরবর্তী অধ্যায়ে বিশেষত মূল্যস্ফীতিতে এর সুফল দেখতে চাইবে মানুষ। 

ফেব্রুয়ারির মধ্যে গণঅভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দানকারী ছাত্রদের উদ্যোগে নতুন রাজনৈতিক দল আত্মপ্রকাশের কথা। সরকারের এক তরুণ উপদেষ্টা এ প্রক্রিয়ায় যোগ দিতে অচিরেই পদত্যাগ করবেন বলে খবর রয়েছে। এ ক্ষেত্রে ‘কিংস পার্টি’ গঠনের অভিযোগ কিন্তু এড়ানো যায়নি। এ অবস্থায় অধিকতর অভিযোগ এড়াতে সরকারে থাকা সব ছাত্রনেতারই একযোগে পদত্যাগ করে দল গঠনে নামা উচিত। নইলে অন্তর্বর্তী সরকারের ‘রাজনৈতিক নিরপেক্ষতা’ নিয়ে প্রশ্ন উত্থাপনের সুযোগ আরও বাড়বে। গণঅভ্যুত্থানকারী দলগুলোর মধ্যে অন্তত সরকারের পক্ষপাতহীন ভাবমূর্তি বজায় রাখা প্রয়োজন। নইলে উল্টো অভিযোগ উঠতে পারে– ক্ষমতাচ্যুত শাসকদের বিরুদ্ধে মাঠে থাকা দলগুলোর মধ্যে ‘অনৈক্য’ বাড়াচ্ছে সরকার নিজেই! কোনো কোনো ঘটনা ও বক্তব্যে এমন অভিযোগ উঠতেও শুরু করেছে। 
কীভাবে, কতদিনে, কতখানি সংস্কার করা হবে– সেটা নিশ্চিত হওয়া এ অবস্থায় জরুরি বৈ কি। মূল ছয়টি সংস্কার কমিশনের সুপারিশ নিয়ে এ লক্ষ্যে অচিরেই কাজ শুরু করবে ঐকমত্য কমিশন। সংস্কারের সব উদ্যোগই অবশ্য দরকারি, তবে সব সংস্কার এই মুহূর্তে জরুরি নয়। ‘জরুরি সংস্কার’ প্রশ্নে রাজনৈতিক দলগুলো সহজে একমত হতেও পারবে না। এই ক্ষেত্রে সরকার অবশ্য পূর্ববর্তী ঘোষণায় অটল– ঐকমত্য না হলে সংস্কার নয়। নির্বাচনের সর্বোচ্চ সময়সীমাও ইতোমধ্যে ঘোষিত। অবশ্য বিতর্ক তৈরি হয়েছে– জাতীয় নির্বাচনের আগে স্থানীয় নির্বাচন হবে কিনা। এর ‘বাস্তবতা’ একেবারেই যে নেই, তা নয়। তবে একটি রাজনৈতিক সরকার অর্জনের চেয়ে কোনো কিছুই বেশি জরুরি নয়। এমন নির্বাচনের মাধ্যমে সেটি আসতে হবে, যা নিয়ে প্রশ্ন তোলার সুযোগ অনুপস্থিত। ড. ইউনূস নিজেও এটা বারবার বলছেন। চলতি বছরের মধ্যে জাতীয় নির্বাচনের প্রত্যাশাও জোরদার তাঁর বক্তব্যে। এর মধ্যে রুটিন কাজগুলো সম্পাদনের পাশাপাশি যতখানি সম্ভব জরুরি সংস্কার সারা যায়, ততই মঙ্গল। সংস্কারের পথে রাষ্ট্র মেরামতের কাজ তো নির্বাচিত সরকারের আমলেও অব্যাহত রাখতে হবে।

হাসান মামুন: সাংবাদিক, কলামিস্ট

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: র জন ত গণঅভ য ত থ ন ক ষমত চ য ত সরক র র প এ অবস থ ঐকমত য ইউন স অবশ য

এছাড়াও পড়ুন:

বেরোবির জুলাই গণঅভ্যুত্থানে আহত শিক্ষার্থীদের মাঝে চেক হস্তান্তর

বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের (বেরোবি) জুলাই-আগস্ট গণঅভ্যুত্থানে আহত শিক্ষার্থীদের মাঝে সম্মাননা সনদ ও চেক হস্তান্তর করা হয়েছে।

মঙ্গলবার (১৫ এপ্রিল, ২০২৫) দুপুরে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক ভবনের সিন্ডিকেট সভা কক্ষে জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশনের পক্ষ থেকে বেরোবি উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. শওকাত আলী। এ সময় ২৫ জন আহত শিক্ষার্থীকে সনদ ও চেক প্রদান করা হয়।

অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপাচার্য বলেন, “২০২৪ সালের জুলাই-আগস্ট গণঅভ্যুত্থানে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়সহ সারাদেশের শিক্ষার্থীরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে নতুন বাংলাদেশ বিনির্মাণে অবদান রেখেছেন। শিক্ষার্থীদের এই ঋণ পরিশোধ করার মতো নয়।”

তিনি জুলাই বিপ্লবের আহত শিক্ষার্থীদের দ্রুত সুস্থতা কামনা করে বলেন, “বেরোবির আহত শিক্ষার্থীদের চিকিৎসা সেবায় এগিয়ে আসার জন্য জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশনকে আন্তরিক ধন্যবাদ জানাচ্ছি। এছাড়াও আহত শিক্ষার্থীদের সুচিকিৎসার ব্যাপারে দিকনির্দেশনা প্রদান করায় রংপুর মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষসহ মেডিকেল বোর্ডকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি।”

ছাত্র পরামর্শ ও নির্দেশনা দপ্তরের পরিচালক অধ্যাপক মো. ইলিয়াছ প্রামানিকের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে জুলাই ফাউন্ডেশনের ভেরিফিকেশন প্রধান মো. হারুন-অর-রশিদ, বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার মো. হারুন-অর রশিদ, প্রক্টর মো. ফেরদৌস রহমান, মেডিকেল সেন্টারের ডেপুটি চিফ মেডিকেল অফিসার ডা. এএম শাহরিয়ার প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।

ঢাকা/সাজ্জাদ/মেহেদী

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • বিএনপি-ঐকমত্য কমিশনের সংলাপে ঐকমত্য কম
  • কিছু বিষয় এমন আছে, যেগুলো দলীয় ফোরামে আলোচনা করতে হবে: সালাউদ্দিন
  • কতগুলো বিষয়ে একমত, তা এখনই বলতে পারব না: সালাহউদ্দিন আহমদ
  • নির্বাচনী সংস্কারের পর ইসিকে দল নিবন্ধনের দাবি জানাল এনসিপি
  • সংবিধান সংশোধন-সংক্রান্ত মৌলিক প্রস্তাবের বিষয়ে আলোচনার মাধ্যমে এক জায়গায় আসার চেষ্টা করবে বিএনপি
  • ঐকমত্য তৈরিতে আলোচনা চালিয়ে যাবে বিএনপি: সালাউদ্দিন আহমেদ
  • অধিকার আদায়ে সড়ক অবরোধের সংস্কৃতি
  • প্রধান উপদেষ্টা একটি দলকে সন্তুষ্ট করতে নির্বাচনের সময় বললে অন্যরা অসন্তুষ্ট হতো
  • বেরোবির জুলাই গণঅভ্যুত্থানে আহত শিক্ষার্থীদের মাঝে চেক হস্তান্তর
  • জাতীয় সনদ তৈরির মাধ্যমে জাতির আকাঙ্ক্ষিত রাষ্ট্র সংস্কারের দিকে অগ্রসর হতে পারব: আলী রীয়াজ