ক্ষমতা বৃদ্ধি নয়, জনসেবক হওয়াই সময়ের দাবি
Published: 16th, February 2025 GMT
ঢাকায় তিন দিনের ডিসি সম্মেলন চলছে বলে কয়েক দিন ধরে ডিসিদের খবর সংবাদমাধ্যমে বেশ গুরুত্ব পাচ্ছে। যে কারণে এ নিবন্ধ লিখতে হচ্ছে, তা হলো, রোববার প্রকাশিত সমকালের এক প্রতিবেদন অনুসারে, এবারের ডিসি সম্মেলনে তারা আইনি ক্ষমতা বাড়ানোর প্রস্তাব করেছেন। এ জন্য ৬৪ ডিসি এবং ৮ বিভাগীয় কমিশনারের কার্যালয়ে লিগ্যাল অ্যাফেয়ার্স লিয়াজোঁ অফিসারের পদ দ্রুত সৃষ্টি করতে বলেছেন তারা, যা নিয়ে ইতোমধ্যে বিতর্ক উঠেছে।
ডেপুটি কমিশনার বা ডিসিকে বাংলায় বলা হয় জেলা প্রশাসক। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক আমলে যখন এ পদটি তৈরি হয়, তার নাম ছিল ডিস্ট্রিক্ট কালেক্টর। জেলার কর-খাজনা আদায়ের কাজ দেখভাল করা ছিল তাঁর প্রধান দায়িত্ব। তৎকালীন কৃষিভিত্তিক সমাজে এ পদের খুব গুরুত্ব ছিল। কিন্তু কালের পরিক্রমায় সেই কৃষিভিত্তিক রাষ্ট্র যখন অনেকটাই শিল্প ও সেবা খাতনির্ভর হয়ে উঠেছে, তখন জেলা কালেক্টরের গুরুত্ব আগের মতো থাকার কথা নয়। এই শূন্যতা ভরাট করার লক্ষ্যেই ডিসি হয়ে যান ডেপুটি কমিশনার বা জেলা প্রশাসক, যদিও ডেপুটি কমিশনারের বাংলা জেলা প্রশাসক হতে পারে না। শুধু তাই নয়, জেলার প্রশাসক হতে গিয়ে ডিসি হয়ে উঠছেন জেলার সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী। এক সময় জেলা পুলিশের সর্বোচ্চ কর্মকর্তাকেও পদমর্যাদায় সমান হওয়া সত্ত্বেও ডিসির খবরদারি মানতে হতো। সাম্প্রতিক কয়েক বছরে নানা কারণে সর্বস্তরে পুলিশের ক্ষমতা বৃদ্ধি পাওয়ায় পুলিশকে তা আর করতে হচ্ছে না। কিন্তু জেলা পর্যায়ে অন্যান্য সরকারি কর্মকর্তাকেই ডিসির খবরদারি মানতে হয়। এ নিয়ে শেষোক্তদের মধ্যে অসন্তোষও কম নয়। এর পরও প্রায় প্রতিবছর জেলা প্রশাসক সম্মেলনে ডিসিরা তাদের ক্ষমতার পরিধি আরও বাড়িয়ে নিতে চেষ্টা করেন।
এবারের ডিসি সম্মেলন চব্বিশের অভ্যুত্থান-পরবর্তী সময়ে এক বিশেষ সময়ে অনুষ্ঠিত হচ্ছে। ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর অধিকাংশ জেলার ডিসি পদে পরিবর্তন আসে। নতুন ডিসি নিয়োগ নিয়ে অসন্তোষের জেরে সেপ্টেম্বরে সচিবালয়ে কর্মকর্তাদের হাতাহাতির ঘটনাও ঘটে। ডিসি পদে কত মধু, এতে বোঝা যায়।
জেলার নির্বাচন ও অন্যান্য প্রশাসনিক কাজ যেহেতু ডিসির আওতাধীন, সেহেতু জেলা প্রশাসকরাও যে বিগত সরকারের অনেকের ‘অপকর্মে’ সহযোগী ছিলেন, তা বলাই বাহুল্য। দীর্ঘসময় ক্ষমতা ধরে রাখতে গিয়ে আওয়ামী লীগ প্রশাসনের ওপর অনেকটাই নির্ভরশীল হয়ে পড়েছিল। গত দেড় দশক ডিসিরা এক ধরনের সরকারি দলের নেতার মতো আচরণ করেছেন। ক্ষমতার বলয়ে থাকা ডিসিরা কতটা খেয়ালখুশিমতো প্রশাসন পরিচালনা করতেন, আমার নিজেরই এমন অভিজ্ঞতা হয়েছে।
কয়েক বছর আগের কথা। তখন প্রাথমিক শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষা দিয়েছিলাম। লিখিত পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হিসেবে জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে ভাইভা দিতে গেলাম। তখন চাঁদপুরে জেলা প্রশাসক ছিলেন মাজেদুর রহমান খান। তিনি সাক্ষাৎকার নেওয়ার জন্য বোর্ড গঠন করলেন পাঁচ-ছয়জনের। কিন্তু অদ্ভুতভাবে আমরা যারা সাক্ষাৎকারপ্রার্থী ছিলাম, দেখলাম একজন একজন করে না নিয়ে ১০-১২ জনের একটা গ্রুপ করে ডাকছেন। আমাদের গ্রুপে সম্ভবত ১০ জন ছিলেন। এর মধ্যে নারী-পুরুষ উভয়েই ছিলেন। ডিসি সাহেব বোর্ড-প্রধান। সবাই একসঙ্গে সালাম দিয়ে প্রবেশ করলাম। সবার উদ্দেশে বিশেষজ্ঞ প্রশ্ন করছেন, উত্তরও সবাই একসঙ্গে দিয়েছেন। আবার ল্যাপটপে গানের কয়েক কলি ছেড়ে বলা হলো, পরের কলি কী, কে গেয়েছেন এই গান। সবাই একসঙ্গে উত্তর দিলাম। এভাবে কিছুক্ষণ থেকে আমাদের সবার একসঙ্গে ভাইভা শেষ। ডিসির সে ভাইভায় আমি উত্তীর্ণ হতে পারিনি। সম্মিলিতভাবে সাক্ষাৎকার নিয়ে কীরূপে তিনি প্রার্থী বাছাই করলেন, আমার জানা নেই।
ডিসিদের ক্ষমতার বলয়ে এটা সামান্য ঘটনাই বলা চলে। কারণ জেলার অন্য প্রায় সবার ওপরেই ছড়ি ঘোরান। এমনকি নির্বাচিত প্রতিনিধিদের সঙ্গেও তাদের দ্বন্দ্বের কথা আমরা জানি। তাদের ক্ষমতার কাছে অনেক ক্ষেত্রে নির্বাচিত প্রতিনিধিরাও অসহায়। অথচ সাংবিধানিকভাবে নির্বাচিত প্রতিনিধিদেরই প্রাধান্য থাকার কথা। তা ছাড়া ডিসিরা প্রশাসন ক্যাডারের হওয়ায় শিক্ষা, স্বাস্থ্য ইত্যাদি ক্যাডারের ওপরেও সহজে কর্তৃত্ব ফলান। যে কারণে মাঠ পর্যায়ের অন্যান্য সরকারি দপ্তরে তাদের ভূমিকা নিয়ে অসন্তোষ বিরাজমান।
যেখানে ডিসিদের ক্ষমতা সমপর্যায়ের, অন্য বিভাগের কর্মকর্তাদের মর্যাদার সঙ্গে সমন্বয় করা দরকার, সেখানে ডিসিদের ক্ষমতার পরিধি বাড়ানোর প্রবণতা অগ্রহণযোগ্য। এ কারণেই সেখানে সংস্কার জরুরি। আমরা দেখেছি, জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন ইতোমধ্যে ‘জেলা প্রশাসক’ পদবি পরিবর্তন করে ‘জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ও জেলা কমিশনার’ করার সুপারিশ করেছেন। সেই সংস্কার কতটা বাস্তবায়ন হয়– নিশ্চয় দেখার বিষয়। এ সরকারের অল্প সময়ে বাস্তবায়ন নিশ্চয় কঠিন। সে জন্য রাজনীতিকদের ঐকমত্য দরকার। কিন্তু আরও জরুরি, ডিসিদের মানসিকতার পরিবর্তন। সাংববিধানিকভাবে সব সরকারি চাকরিজীবীই জনগণের সেবক। জেলা প্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে জনসেবার মানসিকতা গুরুত্বপূর্ণ। পাশাপাশি অন্য ক্যাডারের সঙ্গে সদ্ভাব বজায় রাখাও দরকার। বর্তমানে ডিসিদের হাতে যে ক্ষমতা আছে, তা ব্যবহার করে তিনি চাইলে জেলায় ইতিবাচক অনেক পরিবর্তন আনতে পারেন।
তিন দিনের ডিসি সম্মেলন রোববার উদ্বোধন করেছেন প্রধান উদেষ্টা ড.
মাহফুজুর রহমান মানিক: জ্যেষ্ঠ সহসম্পাদক, সমকাল
mahfuz.manik@gmail.com
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: দ র ক ষমত র অন য ন য সরক র র একসঙ গ কর ছ ন
এছাড়াও পড়ুন:
পোশাক রপ্তানি বাড়াতে একসঙ্গে কাজ করার প্রত্যয় বিজিবিএ ও বিজিএমইএর
দেশের পোশাক রপ্তানি বাড়াতে একসঙ্গে কাজ করবে বাংলাদেশ গার্মেন্টস বায়িং হাউস অ্যাসোসিয়েশন (বিজিবিএ) ও বাংলাদেশ গার্মেন্ট ম্যানুফেকচারার্স এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিজিএমইএ)। বিজিবিএর ইফতার ও দোয়া মাহফিলে দুই সংগঠনের নেতারা এমন প্রত্যয় ব্যক্ত করেন।
রাজধানীর উত্তরা ক্লাবে শনিবার বিজিবিএ সদস্য ও বিভিন্ন ব্যবসায় সংগঠনের প্রতিনিধিদের নিয়ে এ ইফতার অনুষ্ঠিত হয়।
এতে বক্তারা বলেন, ২০৩০ সালের মধ্যে ১০০ বিলিয়ন ডলার পোশাক রপ্তানির লক্ষ্য বিজিবিএর। এটি বাস্তবায়ন করতে হলে বিজিএমইএ ও বিজিবিএর মধ্যে যে দূরত্ব সেটি কমিয়ে আনতে হবে। বিজিএমইএ, বিজিবিএ ও বিকেএমইএকে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে দেশের জন্য ও ব্যবসায়ীদের জন্য কাজ করতে হবে।
অনুষ্ঠানে বক্তৃতা করেন চৈতি গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও বিজিএমইএর আসন্ন নির্বাচনে সম্মিলিত পরিষদের প্যানেল লিডার আবুল কালাম, জেএফকে সোয়েটারের ব্যবস্থাপনা পরিচালক বিএনপি নেতা কফিল উদ্দিন, টর্ক গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক কামাল উদ্দিন, এজিআই গ্রুপের চেয়ারম্যান চিত্রনায়ক অনন্ত জলিল, বিজিবিএর সভাপতি মোফাজ্জল হোসেন পাভেল, বিজিবিএর ভাইস প্রেসিডেন্ট একেএম সাইফুর রহমান ফরহাদ।
বিজিবিএর সভাপতি মোফাজ্জল হোসেন পাভেল বলেন, টেকসই বাণিজ্যের জন্য বিজিবিএ ও বিজিএমইএর মধ্যে যে গ্যাপ সেটি দূর করতে হবে। আমাদের যে লক্ষ্যমাত্রা ২০৩০ সালের মধ্যে ১০০ বিলিয়ন ডলার পোশাক রফতানি, সেটি নিশ্চিত করতে হলে সবাইকে একযোগে কাজ করতে হবে। বাণিজ্যের ক্ষেত্রে যেসব বাধা আছে সেগুলো দূর করতে হবে।
বিজিবিএর ভাইস প্রেসিডেন্ট একেএম সাইফুর রহমান ফরহাদ বলেন, ব্যবসায়ের ক্ষেত্রে নতুন নতুন যেসব চ্যালেঞ্জ তৈরি হবে, সেগুলো মোকাবিলা করে আমাদের সামনে এগিয়ে যেতে হবে। বায়িং হাউস সেক্টরে হাজার হাজার মানুষের কর্মসংস্থান হয়েছে, লাখ লাখ পরিবার এই সেক্টরের ওপর নির্ভরশীল, সবার কথা মাথায় রেখে উৎপাদনের সঠিক পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে। পোশাক রপ্তানির ক্ষেত্রে সরকারসহ সংশ্লিষ্ট সেক্টরগুলোর সহায়তা জোরদার করতে হবে।