গত মৌসুমে আলুর দাম ভালোই পেয়েছেন ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলার বড়গাঁও গ্রামের কৃষক মোহাম্মদ আলম। আর এতেই এবার আরও দুই একর বেশি জমিতে আলু আবাদ করেছেন তিনি। কয়েক দিনের মধ্যেই সেই আলু তোলার উপযোগী হবে। কিন্তু বাজারে এখন দাম কম থাকায় খেতের আলু হিমাগারে সংরক্ষণের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তিনি। তাই আগাম স্লিপের আশায় একের পর এক হিমাগারে হন্যে হয়ে ঘুরে বেড়িয়েছেন। কিন্তু কোথাও স্লিপ পাননি। উপায়ন্তর না দেখে আলু সংরক্ষণের হাল ছেড়ে দিয়েছেন আলম। এই কৃষকের দাবি, হিমাগার কর্তৃপক্ষের যোগসাজশে মজুতকারীরা আলু সংরক্ষণের স্লিপ আগেভাগেই হাতিয়ে নিয়েছেন। ফলে সাধারণ আলুচাষিরা বঞ্চিত হচ্ছেন।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর ঠাকুরগাঁও কার্যালয় সূত্রমতে, চলতি মৌসুমে জেলায় ২৭ হাজার ৫০০ হেক্টর (১ হেক্টর  সমান ২ দশমিক ৪৭ একর) জমিতে আলু আবাদের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়। কিন্তু আবাদ হয়েছে ৩৪ হাজার ৭২৫ হেক্টরের বেশি জমিতে। আর এ থেকে পাওয়া যাবে ৮ লাখ ৬৮ হাজার ১২৫ টন আলু। অন্যদিকে আলু সংরক্ষণের জন্য জেলায় ১৭টি হিমাগার রয়েছে। এসব হিমাগারের ১ লাখ ৪৫ হাজার ৫৩২ টন আলু সংরক্ষণ করা যায়। ফলে চাষিদের উৎপাদিত অধিকাংশ আলুই থেকে যাচ্ছে সংরক্ষণের বাইরে। সংরক্ষণের সুযোগ না পেয়ে কৃষক তাঁদের খেতের আলু বাজারে বিক্রি করে দেন। আর এতেই বাজারে আলুর দাম আরও কমে যাবে।

হিমাগারে আলু রাখার জন্য দুই রকমের বুকিং পদ্ধতি রয়েছে—‘লুজ বুকিং’ ও ‘পেইড বুকিং’। লুজ বুকিং হলো আলু বিক্রি করে হিমাগারের মালিককে ভাড়া শোধ করতে হয়। এবার লুজ বুকিংয়ের রেট হচ্ছে ৫০ কেজি ওজনের এক বস্তা আলু ৪০০ টাকা (প্রতি কেজি আলুর জন্য ৮ টাকা)। তবে জেলার কোনো হিমাগার পেইড বুকিং নেয় না। আলু সংরক্ষণ করতে হিমাগার কর্তৃপক্ষ আগাম স্লিপ বিতরণ করে। এসব স্লিপ নিতে প্রতি বস্তা আলুর বিপরীতে কৃষককে ৫০ থেকে ১০০ টাকা আগাম গুনতে হচ্ছে।

সদর উপজেলার হিমাদ্রী, হাওলাদার, শাহীসহ কয়েকটি হিমাগারে সরেজমিন দেখা যায়, আলু সংরক্ষণের স্লিপ সংগ্রহ করতে একের পর এক কৃষকেরা আসছেন। কিন্তু স্লিপ না পেয়ে তাঁরা ফিরে যাচ্ছেন। কৃষকদের অভিযোগ, প্রকৃত কৃষকেরা আলু সংরক্ষণের স্লিপ সংগ্রহ করতে পারেননি। আর এতে কৃষকেরা তাঁদের উৎপাদিত আলু খেত থেকে তোলার সঙ্গে সঙ্গে বিক্রি করে দিতে বাধ্য হবেন। তাঁরা আগামী মৌসুমের জন্য বীজ আলুও সংরক্ষণ করতে পারবেন না।

বালিয়াডাঙ্গী উপজেলার সাহবাজপুর গ্রামের কৃষক লুৎফর রহমান এবার ছয় একর জমিতে আলু আবাদ করেছেন। আলু সংরক্ষণের স্লিপের সংকটের খবর পেয়ে শহরের কয়েকটি হিমাগার কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। কিন্তু কোনো স্লিপের ব্যবস্থা করতে পারেননি। আজ রোববার সকালে তিনি অভিযোগ করে বলেন, হিমাগার কর্তৃপক্ষ প্রকৃত চাষিদের নয়, কেবল মজুতদার ও ব্যবসায়ীদের কাছে আলু রাখার স্লিপ বিক্রি করেছেন। ফলে এলাকার চাষিরা হিমাগারে আলু রাখার সুযোগ পাচ্ছেন না। এতে আলু আবাদ করে এবার তাঁরা ব্যাপক লোকসানের মুখে পড়বেন।

সদর উপজেলার বালিয়া গ্রামের কৃষক শুকানু রায় বলেন, ‘কুনো স্টোরত (হিমাগারে) যাওনি কহো? কুনঠেই স্লিপ পাওনি। স্লিপ পাওয়া না গেইলে আলুলা কম দামতেই বিকাবা (বিক্রি) হবে। লসের কথা ভাবিয়া মাথাখান অ্যালাই নষ্ট হয়া যাছে।’ বালিয়াডাঙ্গী উপজেলার মহাজনপাড়া গ্রামের আলুচাষি আবদুর বাসেদ বলেন, ‘খেত থাকিয়া আলুই উঠিলনি, অ্যালাই স্টোরের স্লিপ নাই। এইখান কথা হইল? এর পেছনত স্টোরের মালিকলার কারসাজি আছে।’

গতকাল শনিবার ঠাকুরগাঁও-পঞ্চগড় মহাসড়কের উত্তরবঙ্গ হিমাগারের সামনে গিয়ে দেখা যায়, সেখানে আলুর আগাম স্লিপ নিতে পঞ্চগড়ের আটোয়ারীর সুবল রায়, আবদুল খলিল, বোদার শরিফুল ইসলাম, ঠাকুরগাঁও সদরের দেবীপুর গ্রামের রমজান আলী, বড়গাঁওয়ের আফাজউদ্দীন, গড়েয়ার কশিরুল হক ও ভুল্লীর নারায়ণ বর্মণসহ কয়েকজন আলুচাষি এসেছেন। সদরের দেবীপুর গ্রামের রমজান আলী বলেন, ‘এইঠেও (এই হিমাগারে) স্লিপ পানুনি। সবাই খালি হাতত ফিরে যাছে। স্টোরত আলুর বীজলা রাখিবা পারিলে তা–ও হয়। আলুর বীজলা রাখিবা না পারিলে বেশি দামে বীজ কিনিবা হবে। এতে আলু আবাদ করা কঠিন হয়া যাবে।’

গত বুধবার সদর উপজেলার আউলিয়াপুর এলাকার শাহী হিমাগারে আলু সংরক্ষণের স্লিপ সংগ্রহ করতে যান একদল কৃষক। স্লিপ না পেয়ে তাঁদের সঙ্গে হিমাগার কর্তৃপক্ষের বাগ্‌বিতণ্ডা হয়। একপর্যায়ে কৃষকেরা হিমাগারে হামলা চালান। সে সময় আলুচাষি আবদুস সাত্তার অভিযোগ করে বলেন, ‘এ বছর আলুর দাম নেই। তার ওপর আবার আলু রাখার রেট বাড়ানো হয়েছে। হিমাগারে আলু রেখে পরে বেশি দামে বিক্রি করব, সে উপায়ও নেই। হিমাগারের মালিকেরা কৃষকদের আগাম বুকিংয়ের স্লিপ দিচ্ছেন না।’

আজ দুপুরে সদর উপজেলার দৌলতপুর এলাকায় আমানত হিমাগারে গিয়ে দেখা যায়, কয়েকজন কৃষক অপেক্ষা করছেন। এ সময় হিমাগারের ব্যবস্থাপক শান্তনু মজুমদার বলেন, ‘আলু সংরক্ষণে আমরা আগাম স্লিপ ছাড়িনি। যাঁরা আগে আসবেন, তাঁরাই আলু সংরক্ষণে সুযোগ পাবেন। এই হিমাগারে দুই লাখ বস্তা আলু সংরক্ষণ করা যায়। ৭০ হাজার বস্তা বীজ উৎপাদন কোম্পানির জন্য বরাদ্দ রেখে বাকিটা ২৫ ফেব্রুয়ারি কৃষকের জন্য ছেড়ে দেওয়া হবে।’


এ বিষয়ে সেলিম রেজা গ্রুপের (শাহী হিমাগার লিমিটেড) ব্যবস্থাপনা পরিচালক দেলোয়ার হোসেন জানান, ঠাকুরগাঁও জেলায় তাঁদের প্রতিষ্ঠানের চারটি হিমাগার রয়েছে। সব হিমাগারেই আগাম বুকিংয়ের স্লিপ শেষ হয়ে গেছে। যেসব কৃষক বছরের পর বছর আলু সংরক্ষণ করেন, তাঁদের অগ্রাধিকার দেওয়া হয়। গত মৌসুমের তুলনায় চলতি মৌসুমে ব্যাপক কৃষক জমিতে আলু আবাদ করেছেন। উৎপাদিত আলুর তুলনায় ধারণক্ষমতা কম হওয়ায় হিমাগারগুলোয় জায়গার সংকট দেখা দিতে পারে।

এ বিষয়ে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর ঠাকুরগাঁও কার্যালয়ের উপপরিচালক সিরাজুল ইসলাম জানান, আলু আবাদের ক্ষেত্রে হিমাগারের জায়গাসংকট একটি মারাত্মক সমস্যা। বীজ আলু সংরক্ষণের জন্য কৃষকদের সুবিধা দিতে হবে। কৃষকেরা তাঁদের বীজ আলু হিমাগারে সংরক্ষণে ব্যবস্থা করতে না পারলে পরের মৌসুমে আলুর আবাদ কমে যাওয়ার আশঙ্কা আছে।

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: সদর উপজ ল র ব যবস থ আল চ ষ র জন য কর ছ ন উৎপ দ

এছাড়াও পড়ুন:

আমরা তরুণদের হাতে বাংলাদেশ তুলে দিতে চাই: জামায়াত আমির

বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর আমির ডা. শফিকুর রহমান বলেছেন, ‘‘আল্লাহ তুমি সাক্ষী থাকো, আমরা তোমার কোরআনের ভিত্তিতে একটা ইনসাফের মানবিক বাংলাদেশ চাই। যেখানে সবাই সবাইকে সম্মান করবে, ভালোবাসবে। তুমি আমাদের সেই বাংলাদেশ দান করো।’’

তরুণদের উদ্দেশে তিনি বলেন, ‘‘হে তরুণেরা তোমরা জেগে ওঠো। যে সমাজে তরুণরা জেগে ওঠে, সেই সমাজ আল্লাহ বদলায়ে দেন।’’

২৪ এর আন্দোলনকারীদের ‘স্যালুট’ জানিয় জামায়াতের আমির বলেন, ‘‘তোমরা জীবন বাজি রেখে লড়াইয়ের কারণে আল্লাহ আমাদের আপাতত মুক্ত করেছেন। এবার চিরমুক্তির জন্য জেগে ওঠো। শপথ নাও, বাংলাদেশকে কোরআনের আলোকে গড়বই ইনশাআল্লাহ। চুল পাকা, দাঁড়ি পাকা আমিও তোমাদের সঙ্গে সামনের কাতারে থাকব।’’

তিনি বলেন, ‘‘তরুণেরা আমাদের স্বপ্ন। আমরা আগামীর বাংলাদেশ তরুণদের হাতে তুলে দিতে চাই।’’

শনিবার (২২ ফেব্রুয়ারি) সকালে লক্ষ্মীপুর আদর্শ সামাদ সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে জেলা জামায়াতের উদ্যোগে আয়োজিত গণজমায়েতে প্রধান অতিথির বক্তব্যে ডা. শফিকুর রহমান এসব কথা বলেন।

জামায়াত আমির বলেন, ‘‘অতীতে সোনার বাংলা কায়েম করতে গিয়ে শ্মশান বাংলা কায়েম করা হয়েছে। কোরআনই একমাত্র সোনার বাংলার গ্যারান্টি দিতে পারে, আর কিছু দিতে পারবে না।’’

তিনি বলেন, ‘‘যারা কোরআন সহ্য করতে পারেন না, তাদের বিনয়ের সঙ্গে বলতে চাই। এই দেশের আপামর জনতা বাঁচতে চায় কোরআন বুকে নিয়ে, মরতে চায় কোরান বুকে নিয়ে; আল্লাহর সামনে দাঁড়াতে চায় কোরআন বুকে নিয়ে। আমাদের কোরআন থেকে বিচ্ছিন্ন করা যাবে না।’’

তিনি বলেন, ‘‘দেশে যতগুলো ইসলামী দল আছে, তাকিয়ে দেখুন- ৫ আগস্টের পর থেকে এখন পর্যন্ত কোথাও কোনো নেতাকর্মী কারো ওপর জুলুম, চাঁদাবাজি, দখলবাজি করেছে? উত্তরা না। এর কারণ তারা কোরআনকে সম্মান করে এবং বুকে ধারণ করে। তারা আল্লাহকে ভয় করেন। যাদের অন্তরে আল্লাহর ভয় আছে, তারা জুলুম করতে পারে না। তারা মানুষকে সৃষ্টির সেরা জীব হিসেবে দেখে।’’

জেলা জামায়াতের আমির মাস্টার রুহুল আমিন ভূঁইয়ার সভাপতিত্বে ও মো. ফারুক হোসাইন নুর নবীর সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি হিসেবে বক্তব্য রাখেন বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মাওলানা এ টি এম মাসুম, কেন্দ্রীয় কর্মপরিষদ সদস্য কাজী দ্বীন মোহাম্মদ, শাহজাহান চৌধুরী, ড. মুহাম্মদ রেজাউল করিম, অ্যাডভোকেট আতিকুর রহমান প্রমুখ।

দীর্ঘ ২৮ বছর পরে লক্ষ্মীপুরে খোলা ময়দানে জামায়াতের কেন্দ্রীয় নেতাদের উপস্থিতিতে গণজমায়েত অনুষ্ঠিত হলো। এর আগে, ১৯৯৬ সালে লক্ষ্মীপুরে খোলা ময়দানে জামায়াতের সমাবেশ হয়।

ঢাকা/লিটন/রাজীব

সম্পর্কিত নিবন্ধ