কুষ্টিয়া মেডিকেলে আটকে আছে কর্মচারী নিয়োগ, যন্ত্রপাতি নিয়েও জটিলতা; থমকে আছে চিকিৎসা
Published: 16th, February 2025 GMT
কুষ্টিয়া মেডিকেল কলেজের হাসপাতাল পূর্ণাঙ্গরূপে চালু করতে আমলাতান্ত্রিক জটিলতা দেখা দিয়েছে। চিকিৎসক ও নার্স থাকলেও তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির বিপুলসংখ্যক কর্মচারীর নিয়োগ আটকে আছে। এমনকি হাসপাতালে রোগীদের রোগনির্ণয়ে কেনা প্রয়োজনীয় ছোট-বড় ও ভারী যন্ত্রপাতিও হাসপাতাল বুঝে পায়নি। ফলে হাসপাতালে রোগী ভর্তি করে সেবার কার্যক্রম মুখথুবড়ে পড়ে আছে।
গত বছরের ১০ জুলাই ও চলতি বছরের ১০ ফেব্রুয়ারি এই হাসপাতাল পূর্ণাঙ্গরূপে চালুর দাবিতে বিক্ষোভ মিছিল ও মহাসড়ক অবরোধ করেন কলেজটির শিক্ষার্থী ও ইন্টার্ন চিকিৎসকেরা। হাসপাতালটি পূর্ণাঙ্গরূপে চালু না হওয়ায় মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থী, রোগীসহ সাধারণ মানুষের ব্যাপক অসুবিধা হচ্ছে। এ নিয়ে একপর্যায়ে হাসপাতালের পরিচালক আনোয়ারুল কবীর শিক্ষার্থীদের কাছে লিখিত দিয়ে জানান, ২০ দিনের মধ্যে কুষ্টিয়া মেডিকেল কলেজের শিশু ও মেডিসিন বিভাগ চালু করবেন।
১১ ফেব্রুয়ারি হাসপাতালের পরিচালক আনোয়ারুল কবীরের কার্যালয়ে গিয়ে তাঁর কাছে জানতে চাওয়া হয়েছিল, এই ২০ দিনের মধ্যে দুটি বিভাগে রোগী ভর্তি করে সেবা দেওয়া সম্ভব কি না, জবাবে তিনি বললেন, ‘গড নৌজ।’
মেডিকেল কলেজ সূত্রে জানা গেছে, ২০১১ সালে অস্থায়ী ক্যাম্পাসে (কুষ্টিয়া শহরে ম্যাটস ক্যাম্পাস) কুষ্টিয়া মেডিকেল কলেজের শিক্ষা কার্যক্রম চালু হয়। মূল ক্যাম্পাসে শিক্ষা কার্যক্রম চালু হয় ২০২২ সালের এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে। সেখানে ছয়তলা একাডেমিক ভবন, চারতলা করে দুটি হোস্টেল, শিক্ষক ও কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য তিন ও দুই তলাবিশিষ্ট ডরমিটরি, মসজিদ স্থানান্তর করা হয়। তবে মেডিকেল কলেজের হাসপাতাল চালু না হওয়ায় ক্যাম্পাস থেকে প্রায় তিন কিলোমিটার দূরে কুষ্টিয়া জেনারেল হাসপাতালে মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থীরা ক্লিনিক্যাল ক্লাস করেন। শিক্ষার্থীরা দুটি ভাড়া বাসে যাতায়াত করেন। সব মিলিয়ে ক্যাম্পাসে বর্তমানে প্রায় ৩৫০ জন শিক্ষার্থী আছেন।
গণপূর্ত কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, ২০১২-১৩ অর্থবছরে ২৭৫ কোটি টাকা প্রাক্কলন ব্যয় ধরে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় কুষ্টিয়া মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল নির্মাণ প্রকল্পটি অনুমোদন পায়। কুষ্টিয়া শহরের কালিশংকরপুর মৌজায় ২০ একর জমিতে প্রকল্পের নির্মাণকাজ শুরু হয়। বিভিন্ন সময়ে ৫৩টি প্যাকেজে ৫২ জন ঠিকাদার কাজটি করতে থাকেন। ২০১৬ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে কাজ শেষ করার কথা থাকলেও শেষ হয়নি। তখন অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ ওঠায় ২০১৮ সাল পর্যন্ত নানা জটিলতায় কাজ বন্ধ থাকে। ২০১৮ সালে প্রথম দফায় কাজের মেয়াদ ২০১৯ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত বাড়ানো হয়। নির্মাণের ব্যয় বেড়ে দাঁড়ায় ৬১১ কোটি টাকা। কিন্তু এ সময়েও কাজ শেষ করতে পারেননি ঠিকাদারেরা। দ্বিতীয় দফায় ২০২১ সালের ৫ অক্টোবর পর্যন্ত মেয়াদ বাড়ানো হয়। এবার ব্যয় বেড়ে দাঁড়ায় ৬৮২ কোটি টাকা, যা প্রথমে ধরা ব্যয় থেকে ৪০৭ কোটি টাকা বেশি। ওই মেয়াদেও কাজ শেষ না হওয়ায় তৃতীয়বারের মতো ২০২৩ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত মেয়াদ বাড়িয়ে কাজ শেষ হয়।
হাসপাতাল সূত্র জানায়, ৭ তলা ভবনে ৫০০ শয্যার পাশাপাশি ৮৮টি কেবিন, ২৩ শয্যার সিসিইউ, ২০ শয্যার আইসিইউ সেবা আছে। এ ছাড়া জরুরি সেবা দিতে আলাদা আরও ১৩০ শয্যার ব্যবস্থা আছে। এদিকে হাসপাতালের জন্য ২০২২-২৩ অর্থবছরের জুনে অন্তত ৯০ কোটি টাকার যন্ত্রপাতি ও আসবাব কেনা হয়, যা বর্তমানে হাসপাতালের ভবনের ভেতরে পড়ে আছে। এসব যন্ত্রপাতির মধ্যে আছে অত্যাধুনিক এমআরআই মেশিন, সিটি স্ক্যান, এক্স-রে মেশিন, আলট্রাসনোগ্রাম মেশিন এবং অস্ত্রোপচার কক্ষে ব্যবহৃত বিভিন্ন ধরনের যন্ত্রপাতি। অভিযোগ আছে, এই যন্ত্রপাতি কেনাকাটায় অনিয়ম ও দুর্নীতি করা হয়েছে। এ নিয়ে দুদক কেনাকাটার কাগজপত্র নিয়ে তদন্ত করছে।
২০২৩ সালের ১৫ নভেম্বর হাসপাতাল ভবনের একটি অংশে আংশিক বহির্বিভাগ চালু হয়। কুষ্টিয়া-৩ আসনের সংসদ সদস্য মাহবুব উল আলম হানিফের নির্দেশে এটি চালু করা হয়। তবে বর্তমানে হাসপাতালের চিকিৎসকেরা বলছেন, সেটা অবৈধভাবে কোনো অনুমোদন ছাড়াই করা হয়েছিল। এই বহির্বিভাগ সেবা এখনো চলমান। তবে হাসপাতালে রোগী ভর্তি, এমনকি পরীক্ষা-নিরীক্ষাও হয় না।
হাসপাতাল সূত্র জানায়, প্রায় ৩ মাস আগে হাসপাতালে রোগী ভর্তিসহ যাবতীয় কাজে প্রশাসনিক অনুমোদন পায়। হাসপাতালে ৬৩ জন চিকিৎসক, ২৪ জন নার্স ও ৩ জন ওয়ার্ড বয় আছেন। বেডও প্রস্তুত। কিন্তু জরুরি সেবা দেওয়ার জন্য কোনো জনবল নেই। এমনকি ৪১৪ জন তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির জনবল (পরিচ্ছন্নতাকর্মী, নিরাপত্তাকর্মী, লিফটম্যানসহ) নিয়োগ আজও হয়নি। এ ব্যাপারে মন্ত্রণালয়ে ২০ বারের বেশি চিঠি দিয়েও কোনো সদুত্তর পায়নি হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ।
হাসপাতালের উপপরিচালক আনোয়ারুল ইসলাম বলেন, ৫০ জন জনবল পেলেও আপাতত দুটি ওয়ার্ড চালু করা সম্ভব। আর চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরে চাহিদার ৯৮ কোটি টাকার বিপরীতে বরাদ্দ পাওয়া গেছে মাত্র ১৮ কোটি টাকা। হাসপাতালে ২৩টি বিভাগ। শিশু ওয়ার্ড চালাতেই ৮ থেকে ১২ কোটি টাকা ব্যয় হয়।
যন্ত্রপাতি নিয়ে ঠেলাঠেলিহাসপাতালে তড়িঘড়ি করে কেনা প্রায় ৯০ কোটি দামের বিভিন্ন ধরনের যন্ত্রপাতি হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বুঝে নেয়নি, যা হাসপাতালের কয়েকটি বিভাগে ও ভান্ডারকক্ষ পড়ে আছে। এ ব্যাপারে পরিচালক আনোয়ারুল কবীর প্রথম আলোকে বলেন, যাঁরা কিনেছেন এবং কেনাকাটা ও রিসিভ করা কাজে কমিটিতে দায়িত্ব ছিলেন তাঁরা কেউ এ ব্যাপারে বুঝিয়ে দিচ্ছেন না।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন চিকিৎসক বলেন, ভারী ও দামি যন্ত্রপাতির মধ্যে কয়েকটি যন্ত্র স্থাপন করা হয়েছে। বেশির ভাগই প্যাকেটবন্দী হয়ে পড়ে আছে। এসব যন্ত্র নষ্ট হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা আছে। যন্ত্রপাতি নিয়ে দুটি পক্ষের মধ্যে ঠেলাঠেলি চলছে। কেউ বুঝে নিচ্ছে না, আবার কেউ বুঝিয়ে দিচ্ছে না।
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: ম ড ক ল কল জ র শ চ ক ৎসক প রথম
এছাড়াও পড়ুন:
রোজার ৯ পণ্যের আমদানি বেড়েছে
রমজান মাস ও ঈদে চাহিদা বাড়ে এমন ৯টি ভোগ্যপণ্যের আমদানি উল্লেখযোগ্য পরিমাণ বেড়েছে। পণ্যগুলো হলো– চিনি, সয়াবিন তেল, ডাল, মটর, ছোলা, পেঁয়াজ, রসুন, আদা ও খেজুর। চলতি অর্থবছরের অক্টোবর থেকে চলতি বছরের জানুয়ারি পর্যন্ত এসব পণ্যের আমদানিতে গড়ে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৩৯ শতাংশ। এর মধ্যে ছোলা ও মটর ডালের আমদানিতে সর্বোচ্চ প্রবৃদ্ধি হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের এক প্রতিবেদনে এ তথ্য তুলে ধরা হয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে, পণ্য আমদানির এই ইতিবাচক প্রবৃদ্ধি বাজারে সরবরাহ ব্যবস্থা স্বাভাবিক ও পণ্যের মূল্য সহনীয় রাখতে সহায়ক হবে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তারা জানান, ব্যাংক-গ্রাহক সম্পর্কের ভিত্তিতে নগদ মার্জিনের হার নির্ধারণ ও বিলম্বে আমদানি মূল্য পরিশোধের সুযোগ দেওয়ায় রোজার আগে এসব পণ্যের আমদানি বেড়েছে।
গত ১১ নভেম্বর উল্লেখিত ৯টিসহ ১১ ধরনের ভোগ্যপণ্য আমদানিতে বিলম্বে মূল্য পরিশোধের অনুমতি দিয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করে বাংলাদেশ ব্যাংক। রমজানের আগে পণ্য মূল্য সহনীয় পর্যায়ে রাখা ও সরবরাহ নির্বিঘ্ন রাখতে আমদানির ক্ষেত্রে লেনদেন সহজ করতে এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এ সুবিধা বহাল থাকবে আগামী ৩১ মার্চ পর্যন্ত। এর আগে এসব পণ্য আমদানির ক্ষেত্রে ব্যাংক-গ্রাহক সম্পর্কের ভিত্তিতে নগদ মার্জিনের হার নির্ধারণের সুযোগ দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। গত ৬ নভেম্বর এ-সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, ব্যাংক-গ্রাহক সম্পর্কের ভিত্তিতে শূন্য মার্জিনেও এসব পণ্যের এলসি করা যাবে। এসব পদক্ষেপের ফলে অত্যাশ্যকীয় পণ্যগুলোর আমদানি বেড়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন বলছে, এই চার মাসে চিনি আমদানি হয়েছে ৪ লাখ ৫৪ হাজার ৩৪ টন। এটি আগের অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে ২০ শতাংশ বেশি। এ সময়ে সয়াবিন তেল আমদানি ৩৪ শতাংশ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫ লাখ ৯৮ হাজার ২৫২ টন। ডাল জাতীয় পণ্যের আমদানি ৪৪ শতাংশ বেড়ে হয়েছে ১ লাখ ৫৭ হাজার ৮৩৭ টন। ছোলা আমদানি হয়েছে ৯৭ হাজার ৫৫৫ টন, যা গত অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে ৬৪ শতাংশ বেশি। খেজুরের আমদানি ২ শতাংশ বেড়ে হয়েছে ১৪ হাজার ৪২০ টন।
আলোচ্য সময়ে সর্বোচ্চ ৮৫ শতাংশ আমদানি বেড়েছে মটর ডালের। এ সময়ে পণ্যটির আমদানি হয়েছে ২ লাখ ২ হাজার ৮৪৫ টন। এ বছর দেশে পর্যাপ্ত পেঁয়াজ উৎপাদন হওয়ার পরও এই চার মাসে পণ্যটির আমদানি ২ শতাংশ বেড়ে হয়েছে ২ লাখ ৮০ হাজার ৬১১ টন। রসুনের আমদানি ২০ শতাংশ বেড়ে হয়েছে ৬১ হাজার ৩৮১ টন। আদার আমদানি ৫৬ শতাংশ বেড়ে হয়েছে ৫২ হাজার ৫১৫ টন।