বালাম বইয়ের সংকট, পাঁচ বছরেও মিলছে না জমির দলিল
Published: 16th, February 2025 GMT
২০২০ সালের শুরুতে এলাকায় ৩০ শতাংশ জমি কিনে স্থানীয় সাবরেজিস্ট্রার কার্যালয়ে নিবন্ধন করেন ব্যবসায়ী সাইফুল ইসলাম। পাঁচ বছরেও জমির মূল দলিল পাননি তিনি। কিছুদিন আগে জরুরি টাকার প্রয়োজনে জমি বন্ধক রেখে ব্যাংক থেকে ঋণ নিতে চেয়েছিলেন। তবে দলিল না পাওয়ায় তা সম্ভব হয়নি। পরে বাধ্য হয়ে চড়া সুদে একটি বেসরকারি সংস্থা (এনজিও) থেকে ঋণ নিয়েছেন তিনি।
সাইফুল ইসলাম লক্ষ্মীপুর সদর উপজেলার টুমচর গ্রামের বাসিন্দা। শুধু তিনি নন, জমি কিনে নিবন্ধনের পরও মূল দলিল পেতে দেরি হওয়ায় এ ধরনের ভোগান্তিতে পড়তে হচ্ছে লক্ষ্মীপুরের অনেক বাসিন্দাকে। জেলার ছয়টি সাবরেজিস্ট্রারের কার্যালয়ে বালাম বইয়ের তীব্র সংকটের কারণে মূল দলিল পেতে দেরি হচ্ছে। এসব কার্যালয়ে বালাম বইয়ে লেখার অপেক্ষায় পাঁচ বছর ধরে পড়ে আছে প্রায় দুই লাখ দলিল। কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, চাহিদার তুলনায় বালাম বইয়ের সরবরাহ কম থাকায় এ সংকট তৈরি হয়েছে।
জেলার ছয়টি সাবরেজিস্ট্রার কার্যালয়ের মধ্যে পাঁচটিতে বর্তমানে কোনো বালাম বই নেই। এসব কার্যালয় হলো লক্ষ্মীপুর সদর, রায়পুর, রামগঞ্জ, রামগতি ও চন্দ্রগঞ্জ। কেবল কমলনগর সাবরেজিস্ট্রারের কার্যালয়ে কিছু বালাম বই আছে। জেলা রেজিস্ট্রার কার্যালয়ের প্রধান সহকারী সিহাব উদ্দিন এসব তথ্য নিশ্চিত করেছেন। তিনি বলেন, গত নভেম্বর মাসে জেলার ছয়টি কার্যালয়ের জন্য পাঁচ হাজার বালাম বইয়ের চাহিদাপত্র ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে পাঠানো হয়। তবে একটি বইও পাওয়া যায়নি।
লক্ষ্মীপুর জেলা রেজিস্ট্রি কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, বছরে জেলার রেজিস্ট্রি কার্যালয়গুলোতে প্রায় পাঁচ হাজার বালাম বইয়ের প্রয়োজন। তবে এর এক-চতুর্থাংশও পাওয়া যাচ্ছে না। এ কারণে চলতি বছরের জানুয়ারি মাস পর্যন্ত এর আগের পাঁচ বছরের ১ লাখ ৮৯ হাজার ২৫২টি দলিল জমা পড়ে রয়েছে। ২০১৯ সালে যেসব দলিল রেজিস্ট্রি হয়েছে, সেসব জমির ক্রেতা-বিক্রেতারা এখন মূল দলিল পাচ্ছেন।
জেলার তিনজন দলিললেখক জানান, জমি নিবন্ধন হলে প্রমাণস্বরূপ ক্রেতা-বিক্রেতাকে রসিদ দেওয়া হয়। পরে সেই রসিদ জমা দিয়ে মূল দলিল নিতে হয়। কিন্তু দলিল পেতে চার-পাঁচ বছর দেরি হওয়ার কারণে অনেক ক্রেতা রসিদ হারিয়ে ফেলেন। এতে ভোগান্তিতে পড়তে হচ্ছে ক্রেতা-বিক্রেতাদের। এ ছাড়া বালাম বইয়ে না তোলা দলিল সুষ্ঠুভাবে রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে খোয়া যাওয়ার শঙ্কা রয়েছে বলেও জানান তাঁরা।
সদর উপজেলার উত্তর জয়পুর গ্রামের জাহিদুর রহমান, কুশাখালী গ্রামের আবদুল সাত্তার, দত্তপাড়া গ্রামের মো.
রায়পুর সাবরেজিস্ট্রি কার্যালয়ের দলিল লেখক সমিতির সাধারণ সম্পাদক মাহাবুবুল হক বলেন, বালাম বই না থাকায় প্রতিনিয়ত লোকজনকে নানা কৈফিয়ত দিতে হয়। বর্তমানে বালামে লেখার জন্য দলিলের স্তূপ হয়ে আছে। জমির ক্রেতা-বিক্রেতারা চরম হয়রানির শিকার হচ্ছেন।
জানতে চাইলে লক্ষ্মীপুর জেলা সাবরেজিস্ট্রার সাবিকুর নাহার প্রথম আলোকে বলেন, বালাম বইয়ের চাহিদার কথা উল্লেখ করে প্রতি মাসে মহাপরিচালক (নিবন্ধন) বরাবরে প্রতিবেদন পাঠানো হয়। কিন্তু আশানুরূপ বালাম বই পাওয়া যাচ্ছে না। তিনি বলেন, বালাম বইয়ের চাহিদা রয়েছে বছরে পাঁচ হাজার। কিন্তু পাওয়া যাচ্ছে ৪০০-৪৫০টি বালাম। তবে এমন সংকট সারা দেশে রয়েছে।
উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: স বর জ স ট র র ব ল ম বইয় র ম ল দল ল প ব ল ম বই চ বছর
এছাড়াও পড়ুন:
সংস্কার ও নির্বাচন দুটোই হতে হবে
এখন কোনো কোনো রাজনৈতিক দল নির্বাচন চায়, সংস্কার চায় না। তাদের মনে রাখা উচিত, জুলাই গণঅভ্যুত্থান কেবল ক্ষমতার পালাবদলের জন্য হয়নি। এই গণঅভ্যুত্থানের আকাঙ্ক্ষা হলো সংস্কার এবং নির্বাচন দুটিই হতে হবে। স্বাধীনতার ৫৩ বছরে রাজনৈতিক দলগুলো কেবল ক্ষমতা পাকাপোক্ত করতে নিজেদের স্বার্থে রাজনীতি করেছে। জনগণকে দেওয়া প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করেছে। এ ধারার আমূল পরিবর্তন করতে হবে।
রাজধানীর ব্র্যাক সেন্টার ইনে গতকাল শনিবার বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) সম্মেলনের দ্বিতীয় দিনে ‘অভ্যুত্থান-পরবর্তী বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক রাজনীতি’ শীর্ষক একটি অধিবেশনে এসব কথা বলেন বক্তারা। গবেষণা সংস্থা সিপিডির সম্মাননীয় ফেলো অধ্যাপক রওনক জাহানের সভাপতিত্বে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন গবেষণা প্রতিষ্ঠান বিআইজিডির সিনিয়র রিসার্চ ফেলো ড. মির্জা এম হাসান।
আলোচনায় অংশ নিয়ে সংবিধান সংস্কারে গঠিত কমিশনের প্রধান অধ্যাপক আলী রীয়াজ বলেন, বর্তমান সংবিধানে প্রধানমন্ত্রীকে তাঁর কাজের জন্য জবাবদিহির আওতায় আনার কোনো ব্যবস্থা নেই। এতে প্রধানমন্ত্রীর স্বেচ্ছাচারী হয়ে ওঠার যথেষ্ট সুযোগ আছে। সংবিধান সংস্কারের প্রস্তাবে প্রধানমন্ত্রীর জবাবদিহি নিশ্চিতের প্রবিধান সংযুক্ত করা হবে।
আলী রীয়াজ বলেন, সংবিধান সংস্কারের ক্ষেত্রে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে প্রতিষ্ঠান শক্তিশালী করে তোলার ওপর। বিগত সরকারের সময়ে দেশের গণতান্ত্রিক ও রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে চরমভাবে দুর্বল করে ফেলা হয়, যা প্রধানমন্ত্রীকে কর্তৃত্ববাদী হওয়ার পথ প্রশস্ত করে। ভবিষ্যতে যাতে এমন ধারার পুনরাবৃত্তি না হয়, সেজন্য সংবিধানে বিশেষ অনুচ্ছেদ যুক্ত করার প্রস্তাব করা হয়েছে।
আলী রীয়াজ আরও বলেন, জুলাই-আগস্ট গণঅভ্যুত্থাকে কেউ কেউ ‘বিপ্লব’ বলেন। আদতে এটা বিপ্লব ছিল না। বিপ্লব হলে বিভিন্ন কমিশন গঠন করার দরকার হতো না। তিনি উল্লেখ করেন, সংবিধান সংস্কার কমিশন তাদের প্রস্তাব দিয়েছে। এখন রাজনৈতিক দলগুলোর ওপর নির্ভর করবে তারা কতটুকু গ্রহণ করবে।
সিপিডির চেয়ারম্যান অধ্যাপক রেহমান সোবহান বলেন, অতীতের ক্ষমতার চর্চা ছিল অর্থের ও ক্ষমতা কুক্ষিগত করে রাখার জন্য। আদর্শের চর্চার প্রভাব খুব একটা ছিল না। জাতীয় সংসদের প্রধান থেকে শুরু করে ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য পর্যন্ত সবাইকে এ ধারায় চলতে দেখা গেছে। আওয়ামী লীগ চলে গেলেও সেই টাকার প্রভাবের শূন্যতা পূরণ হয়ে যাচ্ছে।
তিনি বলেন, দাবি আদায় করতে লোক জড়ো করা এবং সহিংসতা রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এখান থেকে বের হওয়ার রাস্তা খুঁজতে হবে।
অধ্যাপক রওনক জাহান বলেন, সবাই সংস্কার চান। তবে কী সংস্কার চান, তা সুস্পষ্ট করা উচিত। সংস্কার কেবল আইনের পরিবর্তনের মধ্যে আটকে থাকলে হবে না। আইন অনেক আছে। সমস্যা রাজনৈতিক চর্চার। বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার রাষ্ট্র ব্যবস্থায় অনেকগুলো সংস্কারের জন্য কাজ করছে। এরই মধ্যে অনেক সংস্কার প্রস্তাবও এসেছে। তবে সংস্কার প্রস্তাবের অনেকগুলো আইন পরিবর্তনের জন্য। সত্যিকার অর্থে, গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে চাইলে জনগণকে সিদ্ধান্ত গ্রহণের মূল ভূমিকা রাখতে হবে।
তিনি বলেন, রাজনৈতিক চর্চার পরিবর্তনের জন্য অন্তর্বর্তী নির্দলীয় সরকার ব্যবস্থা চালু করা হয়েছিল। কিন্তু সেই সরকার ব্যবস্থাকেও রাজনীতিকীকরণ করা হয়েছিল। রাষ্ট্রক্ষমতাকে ব্যবহার করে ক্ষমতা ধরে রাখার চর্চাও দেখা গেছে। প্রতিবছর সম্পদের হিসাব প্রকাশ করবে– ‘দিন বদলের’ কথা বলে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় এসে সে প্রতিশ্রুতি রাখেনি। কীভাবে মানুষ এটা বিশ্বাস করবে, রাজনৈতিক দলগুলো যে প্রতিশ্রুতি দিয়ে ক্ষমতায় আসছে, সেই প্রতিশ্রুতি রাখবে।
সিনিয়র আইনজীবী ব্যারিস্টার সারা হোসেন বলেন, বিগত সরকারের সময়ও অনেক কথা বলা হয়েছে। কিন্তু ওই কথা শোনার বা শুনে তা আমলে নিয়ে কাজ করা হয়নি। সংবিধান সংশোধনের কথা হচ্ছে। এটা করতে হলে তা কীভাবে যুগোপযোগী হয়, তা নিয়ে ভাবতে হবে।
৫৩ বছরে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়ন হয়নি এবং এ কারণে নব্বই বা চব্বিশে গণঅভ্যুত্থান হয়েছে বলে মত দেন সিপিবির সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স। তিনি বলেন, সমাজ ও রাষ্ট্র ব্যবস্থার গভীরে বৈষম্য রয়ে গেছে। মানুষ শান্তি চায়, ভয়ের পরিবেশে বাঁচতে চায় না। তারা চায় সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে তাদের কথা শোনা হোক। স্থানীয় সরকার ব্যবস্থাকে জবাবদিহি করার ব্যবস্থার মধ্য দিয়ে জনগণের মতকে প্রতিষ্ঠা করার পথে এগোনো সহজ হতে পারে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজের অধ্যাপক ড. আসিফ শাহান বলেন, অর্গানাইজেশন এবং ইনস্টিটিউশনের মধ্যকার পার্থক্য করতে হবে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কার্যক্রমকে জবাবদিহির আওতায় আনতে হবে কঠোরভাবে।
জাতীয় নাগরিক কমিটির সহআহ্বায়ক সারোয়ার তুষার বলেন, অতীতের সরকার ব্যবস্থায় মানুষের কথা শোনার কোনো ব্যবস্থা ছিল না। প্রধান রাজনৈতিক দলগুলো যে প্রতিশ্রুতি দিয়ে ক্ষমতায় এসেছিল, তারা সে প্রতিশ্রুতি রাখেনি।
তিনি বলেন, জুলাই গণঅভ্যুত্থানের আগে সুষ্ঠু নির্বাচনই ছিল মানুষের প্রধান আকাঙ্ক্ষা। কিন্তু গণঅভ্যুত্থানের পর মানুষের আকাঙ্ক্ষা কেবল নির্বাচনে আটকে নেই। অতীতের সরকার ব্যবস্থাগুলোতে দেখা গেছে, সর্বোচ্চ ৪০ শতাংশ মানুষের ভোট নিয়ে সংসদে দুই-তৃতীয়াংশের বেশি আসন পেয়েছিল এবং তারা সংবিধান বদলের অধিকার পেয়ে ইচ্ছামতো পরিবর্তন করেছে। নতুন বাংলাদেশের মানুষ এর বদল চান। কেবল ক্ষমতার পালাবদল করে দিতে এ গণঅভ্যুত্থান হয়নি।
বিএনপিসহ প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর দ্রুত নির্বাচন আয়োজনের দাবি বিষয়ে সারোয়ার তুষার বলেন, তারা হয়তো সংস্কার চায় না। তিনি উল্লেখ করেন, জনগণের মতামতকে গুরুত্ব দিতে হলে স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করতে হবে। এখন স্থানীয় সরকার ব্যবস্থার নামে আছে স্থানীয় প্রশাসন ব্যবস্থা। এর বদল করতে হবে।
বক্তারা আরও বলেন, নিজেদের পক্ষে কথা বলার জন্য রাষ্ট্র ব্যবস্থায় প্রতিনিধি পাঠানোর পর যদি জনগণ দেখেন তাদের পক্ষে ওই প্রতিনিধি কথা বলছেন না, তাহলে তাকে ফেরত নেওয়ার ব্যবস্থাও থাকা উচিত। রাজনৈতিকগুলো গণতন্ত্রের কথা বললেও নিজেরা গণতন্ত্রের চর্চা করে না। মুখে জনগণই সব ক্ষমতা উৎস– এমনটা বললেও সংসদে নিজ দলের বিরুদ্ধেই কথা বলতে পারে না।