চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতে ফেভারিট হিসেবে ভারত ও অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে জোরেশোরে স্বাগতিক পাকিস্তানের নাম উচ্চারিত হচ্ছে। তবে এ তিন দলের সঙ্গে এখন নিউজিল্যান্ডের নামও আসছে। বিশেষ করে চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি শুরুর মাত্র পাঁচ দিন আগে স্বাগতিকদের হারিয়ে ত্রিদেশীয় সিরিজ জয় কিউইদের নিয়ে নতুন করে ভাবতে বাধ্য করছে সবাইকে। অবশ্য আইসিসি ইভেন্টে নিউজিল্যান্ডের ভালো করাটা নতুন কোনো ব্যাপার নয়। গত কুড়ি বছরে বেশ কয়েকটি ফাইনাল তাঁর প্রমাণ।

কিউইদের ফেভারিট হিসেবে ভাবার কারণ হলো, তাদের দুর্দান্ত ফর্ম। ত্রিদেশীয় সিরিজের ফাইনালসহ তিন ম্যাচের তিনটিতেই জিতেছে তারা। এর মধ্যে স্বাগতিক পাকিস্তানকে হারিয়েছে দু’বার। গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, তিন ম্যাচের কোনোটিতেই তাদের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারেনি প্রতিপক্ষ। সবচেয়ে ভালো করছে কিউইদের ব্যাটিং। ২০২৩ বিশ্বকাপের পর এ টুর্নামেন্ট দিয়ে ওয়ানডেতে ফেরা কেন উইলিয়ামসনের নেতৃত্বে ডেভন কনওয়ে, ড্যারেল মিচেলরা দারুণ ব্যাটিং করেছেন। 

কিউইদের শক্তির আরেকটি দিক হলো, বেশ কয়েকজন দুর্দান্ত অলরাউন্ডার রয়েছে তাদের। তাদের জন্য দলটির ব্যাটিং গভীরতা বেড়েছে। পাকিস্তানের বিপক্ষে প্রথম ম্যাচে টপঅর্ডার দ্রুত আউট হলেও ছয় নম্বরে নামা গ্লেন ফিলিপস মারকুটে সেঞ্চুরি করে দলকে শক্ত অবস্থানে পৌঁছে দেন। কিউইদের পেস ইউনিটও ভালো করছে। অভিজ্ঞ ম্যাট হেনরির সঙ্গে দুই নবীন উইল ও’রুকি এবং জ্যাকব ডাফি চমৎকার বোলিং করছেন। উপমহাদেশে বোলিং আক্রমণে বড় ভূমিকা থাকে স্পিনারদের। কিউইদের দুই স্পিনার মিচেল স্যান্টনার ও ডগ ব্রেসওয়েল দারুণ ফর্মে আছেন। ফাইনালে তো স্যান্টনারের (১০-১-২০-২) বোলিংই অন্যতম নির্ধারক ছিল।

কিউইদের জন্য আরও একটি সুখবর হলো, চোটে পড়া মারকুটে টপঅর্ডার রাচিন রবীন্দ্র ও লকি ফার্গুসন সুস্থ হয়ে উঠেছেন। এর মধ্যে রাচিন চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির শুরু থেকেই খেলতে পারবেন বলে জানিয়েছেন কিউই কোচ গ্যারি স্টিড। গতি তারকা ফার্গুসনকে আসরের শেষদিকে পাওয়া যেতে পারে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন কোচ। লাহোরে পাকিস্তানের বিপক্ষে ত্রিদেশীয় সিরিজের প্রথম ম্যাচে চোট পেয়েছিলেন রাচিন। পুরোপুরি ফিট হয়ে নেটেও তিনি ব্যাটিং শুরু করেছেন বলে জানান কোচ। ফার্গুসন চোট পেয়েছিলেন আরব আমিরাতে ফ্র্যাঞ্চাইজি টি২০ লিগ খেলতে গিয়ে। তিনি এখন পাকিস্তানে দলের সঙ্গে রয়েছেন। সুস্থ হয়ে তিনিও বোলিং শুরু করেছেন। ধীরে ধীরে গতি বাড়াচ্ছেন।

.

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: কর ছ ন

এছাড়াও পড়ুন:

মিয়ানমারের গৃহযুদ্ধ পরিস্থিতিতে মার্কিন তৎপরতা

বাংলাদেশের রাজনীতির পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে বিশ্ব ও আঞ্চলিক রাজনীতি এবং কূটনীতির ক্ষেত্রেও দৃশ্যমান কিছু পরিবর্তন ও সমীকরণ লক্ষ্য করা যাচ্ছে। যেমন এ মুহূর্তে যে বিষয়টি আলোচনা ও বিশ্লেষণের দাবি রাখে সেটি হচ্ছে, প্রতিবেশী মিয়ানমারে গৃহযুদ্ধ ও বাংলাদেশের নিরাপত্তা ইস্যু। মিয়ানমারে গৃহযুদ্ধের এই পরিস্থিতিতে আঞ্চলিক ও বৃহৎ পরাশক্তিগুলো তৎপর হয়ে উঠেছে। তাদের সেই পারস্পরিক স্বার্থ ও সমীকরণ যেমন এক ধরনের বোঝাপড়া গড়ে তুলেছে, তেমনি একে অন্যের প্রতি সতর্ক অবস্থানও তৈরি করছে। কেননা, এখানে সব পক্ষের স্বার্থের হিসাব এক নয়। আছে বিভিন্ন পক্ষের নিজস্ব এজেন্ডা।

চীন-রাশিয়া ও কিছু ক্ষেত্রে ভারতের বলয়ে থাকা মিয়ানমার নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা শক্তির আগ্রহ নতুন নয়; কিন্তু কোনোভাবেই তারা এখানে সুবিধা করতে পারছিল না। মিয়ানমারের গৃহযুদ্ধ ও আরাকান আর্মির অগ্রগতি তাদের সেই সুযোগ এনে দিয়েছে। তারা এখন মানবিক সাহায্যের কৌশলে এখানে তাদের কর্তৃত্ব, প্রভাব ও অবস্থান বাড়াতে চায়। 
আমরা দেখেছি, গত ফেব্রুয়ারিতে জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস রোহিঙ্গা ক্যাম্প পরিদর্শনে এসেছিলেন। সেটা কতখানি রোহিঙ্গাদের জন্য মানবিক সহায়তামূলক সফর; কতখানি মিয়ানমার বিষয়ে পশ্চিমা ছকের অংশ, তা ভবিষ্যতে আরও স্পষ্ট হবে। বিভিন্ন সূত্রে জানা যাচ্ছে, সেই সফরে তিনি আরাকান আর্মির সঙ্গে যোগাযোগ রাখার পরামর্শ দিয়েছেন বাংলাদেশকে। এ ক্ষেত্রে তাঁর যুক্তি ছিল, আরাকান আর্মি রাখাইন রাজ্য দখল ও পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ নিলে তখন বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানো সম্ভব হবে।  
সাদা চোখে এই সরল কৌশল সামনে রেখে গুতেরেস বলেছেন, জাতিসংঘের দাতা দেশগুলোও রাখাইন রাজ্যে তাদের সাহায্য সরবরাহের একটি নিরাপদ করিডোর চায়। সেখানে মানবিক সহায়তা পাঠানোর জন্য করিডোরটি প্রয়োজন; যদিও তিনি কোনো সামরিক সাহায্যের বিষয়ে কিছু বলেননি। ইতোমধ্যে পররাষ্ট্র উপদেষ্টা জানিয়েছেন, রাখাইনের জন্য করিডোর দিতে অন্তর্বর্তী সরকার নীতিগতভাবে সম্মত হয়েছে (সমকাল, ২৮ এপ্রিল ২০২৫)।

বাংলাদেশের সীমান্তের ভেতরে আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মির (আরসা) তৎপরতা দৃশ্যমান না হলেও অজানা নয়। সীমান্তের বাইরে আরাকান আর্মি ও চিন ন্যাশনাল ফ্রন্টের যোদ্ধারা মিয়ানমারের সামরিক জান্তাকে উৎখাত করে মিয়ানমারের নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার চেষ্টায় যুদ্ধরত। সেটা না হলেও আপাত তাদের লক্ষ্য আরাকান রাজ্যের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ নেওয়া। 
মার্চ মাসে মার্কিন সামরিক কর্মকর্তা লে. জেনারেল জোয়েল ভাওয়েল বাংলাদেশ সফর করেন। যতদূর জানা যাচ্ছে, তাঁর সফরেরও অন্যতম ইস্যু ছিল মিয়ানমার পরিস্থিতি ও রাখাইনে আরাকান আর্মির নিয়ন্ত্রণ-পরবর্তী হিসাব-নিকাশ। আরাকান আর্মি যাতে রাখাইন রাজ্য দখলে নিতে পারে, সে জন্য যুক্তরাষ্ট্র সহায়তা করবে বলে শোনা যাচ্ছে। রাখাইন রাজ্যে অবাধ প্রবেশের মানবিক সহায়তা করিডোর সেই লক্ষ্যে ব্যবহৃত হতে পারে? নানা কথাই শোনা যাচ্ছে।

চলতি মাসে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দায়িত্বপ্রাপ্ত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দুই উপসহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী বাংলাদেশে আসেন। তাদের সঙ্গে যোগ দেন মার্কিন নিযুক্ত মিয়ানমারের রাষ্ট্রদূত। বাংলাদেশে তারা বৈঠক করেন। সেখানে কী নিয়ে আলোচনা হয়েছে, বাংলাদেশের মিডিয়ায় তেমন আলোকপাত হয়নি। যদি সামরিক সহায়তার আলোচনা থেকে থাকে, সে ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অবস্থান কী হবে?    
আরও প্রশ্ন হচ্ছে, কোন কোন দেশ মিয়ানমারের গৃহযুদ্ধে জড়িয়ে পড়ছে? মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের পাশের চিন রাজ্যটিও আরাকান আর্মি দখল করেছে। এ অঞ্চলের বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠীর নাম ‘চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট’। এরা যৌথভাবে সামরিক জান্তার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছে। এই চিন ন্যাশনাল ফ্রন্টের সঙ্গে বাংলাদেশের পার্বত্যাঞ্চলের এক সময়ের আলোচিত সন্ত্রাসী সংগঠন ‘কুকি চিন গোষ্ঠী’র যোগাযোগ থাকার সংবাদ বিভিন্ন সময় পত্রপত্রিকায় এসেছিল। 

এটা স্পষ্ট, আরাকান আর্মি ও চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট এ দুই শক্তিকে সমর্থন দিয়ে মিয়ানমার সামরিক জান্তাকে উৎখাতে ইন্ধন দিচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ভারতও। তারাও আরাকান আর্মির রাখাইন রাজ্যের পূর্ণ দখল দেখতে চায়। তাদের স্বার্থ ভারতের মিজোরামের সঙ্গে থাইল্যান্ডের সংযোগ। বাংলাদেশে আত্মগোপনে থাকা আরসাপ্রধানের হঠাৎ গ্রেপ্তারের কারণ যা-ই হোক; এই অঙ্ক মেলানো যায়, জান্তার বিরুদ্ধে যুদ্ধে আরসা ও আরাকান আর্মির সংযোগ ঘটিয়ে দেওয়া গেলে সেটা হবে রাখাইনের ‘গেম চেঞ্জার’। 

প্রশ্ন হচ্ছে, এসব হিসাব-নিকাশে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের প্রসঙ্গটি কতটা গুরুত্ব পাচ্ছে? বাংলাদেশের প্রধান এজেন্ডা সেটাই হওয়া উচিত। আরাকান আর্মির রাখাইন রাজ্য নিয়ন্ত্রণের সঙ্গে রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানোর যে কৌশলের কথা বলা হচ্ছে, সে ক্ষেত্রে মনে রাখতে হবে জান্তা সরকার চীন-রাশিয়ার সমর্থনে টিকে আছে। শুধু তাই নয়; বিদ্রোহীদের সঙ্গেও চীনের ঘনিষ্ঠ কৌশলগত যোগাযোগ আছে। চীন বঙ্গোপসাগর এলাকাজুড়ে কৌশলগত অবস্থান ও নিজেদের সামরিক প্রভাব বাড়াচ্ছে। শেখ হাসিনার শাসনামলে চীন থেকে সাবমেরিন কেনা হয়েছিল। রোহিঙ্গা ইস্যুতে বাংলাদেশ চীন, ভারত, যুক্তরাষ্ট্রকে নিয়েই সমাধান চেয়ে এসেছে। বঙ্গোপসাগর ঘিরে এই পরিস্থিতিতে রাশিয়া কি নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করবে? এ কারণেই কি তাদের তিনটি যুদ্ধজাহাজ বাংলাদেশে ‘শুভেচ্ছা সফর’ করেছিল? 
রোহিঙ্গা প্রত্যাবর্তনে মিয়ানমার ও রাখাইন রাজ্যের ক্ষমতা কাঠামোর এই পরিবর্তনের পরিস্থিতিকে কাজে লাগানোর যুক্তিকে সমর্থন করা যেতে পারে। কিন্তু সীমান্ত খুলে দেওয়ার মাধ্যমে কোনো আঞ্চলিক প্রক্সি যুদ্ধের ঝুঁকি তৈরি সমীচীন হবে না।
    
ড. মঞ্জুরে খোদা: লেখক-গবেষক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক 

সম্পর্কিত নিবন্ধ