এই লেখার অনুপ্রেরণা বাংলাদেশের মানুষের দীর্ঘ সংগ্রামী ঐতিহ্য এখানকার উর্বর মাটি আর দেশ ও জনগণের বৃহত্তর স্বার্থে নাগরিকদের নিজেকে বিলিয়ে দেওয়ার দুরন্ত সাহস।
সেই ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন থেকে শুরু। চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠনের নায়ক মাস্টারদা সূর্য সেন, প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদারের নেতৃত্বে পাহাড়তলী ইউরোপিয়ান ক্লাবে সশস্ত্র আক্রমণ, ‘মায়ের ভাষা’ বাংলায় কথা বলার অধিকার আদায়ের নিমিত্তে বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনে বরকত–সালাম–রফিক–জব্বারের জীবনদান, উনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থান, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে লাখে লাখে ছাত্র–শিক্ষক–তরুণ–যুবক–নারী–শিশু–কৃষক–শ্রমিকের আত্মত্যাগ, নব্বইয়ের স্বৈরাচার এরশাদবিরোধী আন্দোলন এবং ২০২৪ সালের ছাত্র-জনতার আন্দোলনে সহস্রাধিক তরুণ–তরুণীর প্রাণহানি আর নানা শ্রেণি–পেশার কয়েক হাজার মানুষের আহত হওয়ার বিনিময়ে স্বৈরাচারের পতন। বারবারই তরুণেরা অগ্রভাগে থেকে দেশের মুক্তিকামী মানুষদের সঙ্গে নিয়ে অসমশক্তির বিরুদ্ধে সাহসী লড়াইয়ে অবতীর্ণ হয়েছেন।
যার সূত্রে আমাদের স্বাধীনতা, আমাদের সার্বভৌমত্ব।
জুলাই-আগস্ট ২০২৪–এর আন্দোলনের আলোচিত সেই ভিডিওর কথা কারও ভুলে যাওয়ার কথা নয়। ‘গুলি করি, মরে একটা, আহত হয় একটা, একটাই যায় স্যার, বাকিডি যায় না’—ইকবাল নামের সেই পুলিশ কর্মকর্তা তখনকার ডিবিপ্রধান হারুন, পুলিশপ্রধান চৌধুরী আবদুল্লাহ আল–মামুনের উপস্থিতিতে তখনকার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খানকে মোবাইলে একটা ভিডিও দেখাচ্ছিলেন। সেই ‘বাকিডি যায় না’ দলের সাহসী তরুণেরাই লড়াইয়ে জয়ী হন, ক্ষমতার পালাবদল হয় বাংলাদেশে। নতুন বাংলাদেশ গড়ার সুবর্ণ সুযোগ সামনে এলেও এ দেশের রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে অনৈক্য আর আদর্শগত মতবিরোধে বিবাদ লেগেই আছে দশকের পর দশক।
দফায় দফায় ‘বিদেশি রেফারি’ আর সংলাপ সংলাপ খেলাক্ষমতাকেন্দ্রিক আমাদের রাজনীতির বিবাদ, বিভাজন ও অনৈক্য নিরসনে মধ্যস্থতায় আসতে হয় বিদেশিদের; কখনো কমনওয়েলথ মহাসচিবের বিশেষ দূত, কখনোবা জাতিসংঘ মহাসচিবের রাজনীতিবিষয়ক সহকারী মহাসচিবকে।
১৯৯৪ সালে বিএনপির শাসনামলে মাগুরা উপনির্বাচনে ব্যাপক কারচুপির অভিযোগ এনে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ সরকারের দাবিতে জোরালো আন্দোলন গড়ে তোলে সংসদের বিরোধী দল আওয়ামী লীগ। অচলাবস্থা নিরসনে কমনওয়েলথের তরফ থেকে দুই পক্ষের মধ্যে সমঝোতার নিমিত্তে আলোচনার উদ্যোগে কমনওয়েলথ মহাসচিবের বিশেষ দূত হিসেবে ঢাকায় আসেন স্যার নিনিয়েন স্টিফেন। অস্ট্রেলিয়ান এই কূটনীতিক বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিদের সঙ্গে বৈঠক করেন। তাঁর দেওয়া একটি সর্বদলীয় সরকার গঠনের প্রস্তাব আওয়ামী লীগ গ্রহণ করেনি; বরং তারা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে অনড় থাকায় সমাধান ছাড়াই ফিরে যেতে হয় স্টিফেনকে।
আমাদের রাজনীতিকেরা ক্ষমতায় থাকা কিংবা মসনদে ফেরার কুশলী খেলা খেলতে গিয়ে পারস্পরিক সম্পর্ককে এতটাই ‘সতিনসুলভ’ অপ্রীতিকর পর্যায়ে নিয়ে গেছেন যে এই বিবাদ দেশের কোনো বিশিষ্টজন কিংবা পক্ষ দ্বারা মেটানো অসম্ভব হয়ে ওঠে। এ জন্য আনতে হয় বিদেশি সালিসকারী। সেই বিদেশিরাও বারবার দেখে গেছেন আমাদের রাজনীতিকদের ‘আসল রূপ’। এসব ব্যক্তি বিশ্বের নানা আসরে বাংলাদেশের রাজনীতি আর রাজনীতিকদের বিষয়ে তাঁদের লব্ধ অভিজ্ঞতা তুলে ধরেছেন, তাতে নিশ্চয়ই অনেক রক্তের বিনিময়ে অর্জিত এই দেশের মর্যাদা–সম্মান–সুখ্যাতি বাড়েনি। ক্ষমতার লোভ কিংবা মোহ রাজনীতিকদের কাণ্ডজ্ঞানশূন্য করে তোলে। যাঁদের চিন্তাচেতনার এমন অধঃপতন, তাঁদের মতো লোকেরা আজ্ঞাবাহী সুচতুর সরকারি কর্মচারী অসৎ ব্যবসায়ীদের সঙ্গে যোগসাজশে অপরাধলব্ধ অর্থ বিদেশে পাচার করবেন, টাকার বালিশ, তোষকে ঘুমানোর মতো বিকৃতিতে ভুগবেন, এটাই স্বাভাবিক।
নানা প্রাকৃতিক দুর্যোগ—ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস, বন্যা, খরার মতো দুর্যোগ মোকাবিলা করে সংগ্রামী জাতি হিসেবে ফসলের মাঠে আর খেলার মাঠে বিশ্ববাসীর সামনে নিজেদের সক্ষমতার প্রমাণ রাখতে পেরেছে বাংলাদেশ।তবু কিছু আশার আলোবাংলাদেশের বিভিন্ন মেডিকেল কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতিবেশী সার্কভুক্ত দেশগুলোর শত শত শিক্ষার্থী অধ্যয়ন করছেন। এর সিংহভাগ আমাদের তিন দিক বেষ্টন করে থাকা প্রতিবেশী ভারতের। কয়েক দশক ধরেই বাংলাদেশে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করতে আসা শিক্ষার্থীদের মধ্যে সংখ্যায় এগিয়ে ভারতীয়রা। বাংলাদেশ ও ভারতে ব্রিটিশ স্ট্যান্ডার্ড কারিকুলামে চিকিৎসাশাস্ত্র পড়ানো হয় বলে শিক্ষার মানে হেরফের হয় না। বাংলাদেশ যেখানে আশপাশের দেশগুলোর চেয়ে এগিয়ে, তা হলো এখানে স্বল্প ব্যয়ে চিকিৎসাশাস্ত্র অধ্যয়ন করা সম্ভব।
ভারত, নেপাল, ভুটানের শিক্ষার্থীরা এখানে চিকিৎসাশাস্ত্র অধ্যয়ন করে নিজ নিজ দেশে ফিরে গিয়ে আরও উচ্চতর ডিগ্রি অর্জনের পাশাপাশি পেশাগত নীতিনৈতিকতার আলোকে চিকিৎসাসেবায় নিয়োজিত হন। ঘটনাক্রমে উন্নততর চিকিৎসার জন্য ভারতে যাওয়া বাংলাদেশের রোগীরা প্রায়ই শরণাপন্ন হন বাংলাদেশ থেকে পাস করা ভারতীয় বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের। ব্যবধান দুই দেশের চিকিৎসার স্ট্যান্ডার্ডে।
নীতিনৈতিকতার আলোকে চিকিৎসাসেবা দেওয়ার মানসিকতায়, আকাঙ্ক্ষায়।
বাংলাদেশে মানসম্পন্ন চিকিৎসাবিজ্ঞান পড়ানো হলেও এখানে মানসম্পন্ন ও নির্ভর করার মতো উন্নততর চিকিৎসাব্যবস্থা গড়ে উঠল না কেন?
বাংলাদেশ যদি ভালো চিকিৎসক তৈরি করতে পারে, তাহলে রোগীদের কাছে ‘আশা-ভরসার কেন্দ্রবিন্দু’ ভালো চিকিৎসক তৈরি করতে পারবে না কেন? গলদটা কোথায়, তা খুঁজে বের করে সে অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণের মাধ্যমে পরিস্থিতি থেকে উত্তরণ সম্ভব।
পেঁয়াজ রাজনীতির খেলায় জিতল বাংলাদেশপেঁয়াজ রাজনীতির খেলা খেলতে গিয়ে প্রতিবেশী ভারত বরং আমাদের উপকারই করেছে। স্থানীয় কৃষিজীবীদের পাশাপাশি দেশের বিভিন্ন কৃষিভিত্তিক গবেষণা, উৎপাদন ও বিপণন প্রতিষ্ঠানের অক্লান্ত প্রচেষ্টায় দেশে পেঁয়াজের উৎপাদন বেড়েছে বহুগুণ। তাতে কারও কূটকৌশল কিংবা চোখ রাঙানোকে ভবিষ্যতে আমাদের পাত্তা না দিলেও চলে। সুখবরটা দিতে হয়তো আর বেশি দিন অপেক্ষা করতে হবে না, বাংলাদেশ পেঁয়াজ উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করেছে।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের (সরেজমিন উইং, ডিএই-২০২৩) সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, গত বছর দেশে পেঁয়াজের চাহিদা ৩০ লাখ মেট্রিক টনের বিপরীতে উৎপাদন হয়েছে ৩৯ লাখ মেট্রিক টন। তবু গত এক বছরে স্থানীয় চাহিদা মেটাতে শুধু ভারত থেকেই সাত লাখ মেট্রিক টন পেঁয়াজ আমদানি করতে হয়েছে। কারণ, সঠিক পরিচর্যা ও সংরক্ষণের অভাবে উৎপাদিত পেঁয়াজের ২৫ থেকে ৩০ শতাংশ নষ্ট হয়ে যায়। তা ছাড়া নড়বড়ে বিপণনব্যবস্থা ও কার্যকর নজরদারি না থাকায় বাজারে অস্থিরতা লেগেই থাকে। তবু এত দিন অনাবাদি থাকা জমিতে পেঁয়াজ চাষ করায় উৎপাদন বেড়েছে, বাজার তুলনামূলক স্থিতিশীল রয়েছে এবার।
পাশাপাশি দেশের কৃষিবিজ্ঞানীদের গবেষণালব্ধ নানা রকম উচ্চফলনশীল জাতের উদ্ভাবন নীরবে বিশাল এক বিপ্লব এনেছে সামগ্রিক কৃষিক্ষেত্রে। আমাদের দেশটা এমন একটা দেশ, যেখানে উর্বর মাটি, আবহাওয়া নাতিশীতোষ্ণ, অল্প পরিশ্রমে বিপুল পরিমাণে ফসল ফলে।
এখন পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে পরিকল্পনা নেওয়া হোক রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে। স্লোগান উঠুক, আমাদের ফসল ফলাব আমরাই—চাল, পেঁয়াজ, আলুসহ নানা কৃষিপণ্যে স্বনির্ভর হব আমরা। সেই পরিকল্পনা বাস্তবায়নে নেওয়া হোক যথাযথ পদক্ষেপ।
জুলাই-আগস্ট ২০২৪–এর ছাত্র-জনতার আন্দোলনে সরকার পরিবর্তিত হলে বাংলাদেশে পেঁয়াজের পাশাপাশি আলু, চাল রপ্তানিও বন্ধ করার ঘোষণা দেয় ভারত সরকার।
পাশাপাশি কলকাতা, ত্রিপুরা, শিলিগুড়ির আবাসিক হোটেল কর্তৃপক্ষ বাংলাদেশের নাগরিকদের সেবা না দেওয়ার ঘোষণা দিয়ে দীর্ঘদিনের বিদ্যমান বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ককে আচমকাই বৈরিতার চাদরে ঢেকে দেয়। সেটা কাটিয়ে উঠতে তেমন বেগ পেতে হয়নি আমাদের।
কারও দয়া পেতে নয়; বরং আমাদের নাগরিকেরা তাঁদের উপার্জনের টাকা ব্যয় করে ভারতে যান কেনাকাটা, চিকিৎসা কিংবা বেড়াতে। ভারতের ভিজিট ভিসা বন্ধ থাকায় এখন তাঁরা যাচ্ছেন অন্য দেশে।
আমরা পারি, আমরা পারবআমাদের তরুণেরা যুব বিশ্বকাপ ক্রিকেট চ্যাম্পিয়ন হয়েছে, নারী ফুটবল দল সাফ নারী ফুটবলে শিরোপা লাভ করেছে। উভয় ক্ষেত্রেই প্রতিপক্ষ শক্তিশালী ভারতকে হারিয়েই বিজয়ীর হাসি হেসেছে আমাদের খেলোয়াড়েরা, সঙ্গে পুরো দেশ।
নানা প্রাকৃতিক দুর্যোগ—ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস, বন্যা, খরার মতো দুর্যোগ মোকাবিলা করে সংগ্রামী জাতি হিসেবে ফসলের মাঠে আর খেলার মাঠে বিশ্ববাসীর সামনে নিজেদের সক্ষমতার প্রমাণ রাখতে পেরেছে বাংলাদেশ।
প্রতিবেশীর দেখানো উপেক্ষা, অসম্মান আমাদের ভেতরে তৈরি করুক জেদ, জাগিয়ে তুলুক আত্মসম্মানবোধ।
মুহাম্মদ লুৎফুল হায়দার ব্যাংকার
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: র র জন ত ক ক ষমত র আম দ র উৎপ দ সরক র ব যবস
এছাড়াও পড়ুন:
রেমিট্যান্সের নতুন রেকর্ড
বাংলাদেশে চলতি মার্চ মাসের ২৬ তারিখ পর্যন্ত রেকর্ড পরিমাণ রেমিট্যান্স এসেছে। এ সময় পর্যন্ত প্রবাসীরা ব্যাংকিং চ্যানেলের মাধ্যমে বৈধ পথে পাঠিয়েছেন ২৯৪ কোটি ৫০ লাখ মার্কিন ডলার। দেশীয় মুদ্রার এর পরিমাণ ৩৬ হাজার ২২৩ কোটি ৫০ লাখ টাকা (প্রতি ডলার ১২৩ টাকা হিসেবে)। দৈনিক গড়ে রেমিট্যান্স এসেছে ১১ কোটি ৩২ লাখ ডলার বা ১ হাজার ৩৯৩ কোটি ২১ লাখ টাকা।
বৃহস্পতিবার (২৭ মার্চ) বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালের মার্চের ২৬ দিনে রেমিট্যান্স এসেছিল ১৬১ কোটি ৪০ লাখ মার্কিন ডলার। চলতি মার্চ মাসের ২৬ পর্যন্ত যে পরিমাণ রেমিট্যান্স এসেছে, তা আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় ৮২ দশমিক ৪০ শতাংশ বেশি।
চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের জুলাই থেকে মার্চের ২৬ তারিখ পর্যন্ত দেশে রেমিট্যান্স এসেছে ২ হাজার ১৪৩ কোটি ৫০ লাখ মার্কিন ডলার, যা আগের অর্থবছরের তুলনায় ২৮ দশমিক ৪০ শতাংশ বেশি। আগের অর্থবছরে একই সময় রেমিট্যান্স এসেছিল ১ হাজার ৬৬৯ কোটি ২০ লাখ মার্কিন ডলার।
চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের জুলাইয়ে ১৯১ কোটি ৩৭ লাখ ৭০ হাজার ডলার রেমিট্যান্স এসেছে, আগস্টে এসেছে ২২২ কোটি ৪১ লাখ মার্কিন ডলার, সেপ্টেম্বরে ২৪০ কোটি ৪৭ লাখ মার্কিন ডলার, অক্টোবরে ২৩৯ কোটি ৫০ লাখ মার্কিন ডলার, নভেম্বর মাসে ২১৯ কোটি ৯৯ লাখ মার্কিন ডলার, ডিসেম্বর মাসে ২৬৩ কোটি ৮৭ লাখ মার্কিন ডলার, জানুয়ারি মাসে ২১৮ কোটি ৫২ লাখ মার্কিন ডলার এবং ফেব্রুয়ারিতে এসেছে ২৫২ কোটি ৭৬ লাখ মার্কিন ডলার।
ঢাকা/এনএফ/রফিক