রংপুরের বদরগঞ্জ ও তারাগঞ্জ উপজেলায় কৃষিজমির উপরিভাগের উর্বর মাটি (টপ সয়েল) গিলছে ৮৩টি ইটভাটা। কতিপয় কৃষক নগদ টাকার লোভে ওই মাটি ইটভাটায় বিক্রি করছেন। এতে জমি উর্বরতা শক্তি হারাচ্ছে। এতে কৃষি বিভাগের লোকজন উদ্বিগ্ন হয়ে পড়লেও কৃষকেরা তেমন বুঝতে পারছেন না বলে জানিয়েছেন কৃষিবিদেরা।
গত এক সপ্তাহে সরেজমিনে প্রথম আলোর দুই প্রতিবেদক ওই দুই উপজেলার বিভিন্ন এলাকার মাঠ ঘুরে দেখেছেন, কৃষিজমির উপরিভাগের মাটি তিন-চার ফুট গর্ত করে ট্রাক্টরে বিভিন্ন ইটভাটায় নিয়ে যাওয়া হচ্ছে।
এলাকার লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ইটভাটার মালিকেরা এই মাটি কিনছেন। কৃষকেরা এর ক্ষতিকর দিক বুঝতে পারছেন না।
মাটি কেটে নেওয়ায় জমির উর্বরতা শক্তি আবার ফিরতে ১৫ থেকে ২০ বছর লেগে যেতে পারে। তাই কৃষকদের জমির মাটি বিক্রি না করার পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে। ধীবা রানী, কৃষি কর্মকর্তা, তারাগঞ্জবদরগঞ্জ উপজেলা কৃষি কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, বদরগঞ্জে ৭১টি ইটভাটা রয়েছে। একেকটি ইটভাটা ৫-১৫ একর পর্যন্ত কৃষিজমিজুড়ে স্থাপিত। বিভিন্ন দ্বন্দ্বে ১১টি ভাটা এবার বন্ধ রয়েছে। চলতি বছর ৬০টি ইটভাটায় কাঁচা ইট পোড়ানো হচ্ছে। এই ইট তৈরিতে ব্যবহার করা হচ্ছে কৃষিজমির উপরিভাগের মাটি। ৬০টি ইটভাটার মধ্যে ৫১টির বৈধ কাগজপত্র নেই। তারাগঞ্জে ২২টি ইটভাটার ১৯টির বৈধ কোনো কাগজপত্র নেই।
১৩টি ইটভাটার ব্যবস্থাপকের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, প্রতিটি ইটভাটায় বছরে ৫০ থেকে ৮০ লাখ কাঁচা ইট পোড়ানো হয়। একেকটি ইটের ওজন সাড়ে তিন কেজির বেশি।
কৃষকেরা আবাদি জমির মাটি কেন বিক্রি করছেন, এ বিষয়ে অন্তত ৫০ কৃষক ও ৪ জন কৃষি কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, কৃষকেরা সাংসারিক যাবতীয় ব্যয় সামাল দেন ফসল বিক্রি করে। পাশাপাশি সেই টাকা ফসল চাষাবাদেও ব্যয় করেন, কিন্তু দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির কারণে তাঁরা ব্যয় সামাল দিতে পারছেন না। অনেক সময় উৎপাদিত ফসলের ন্যায্যমূল্য তাঁরা পান না। কখনো উৎপাদন খরচ ওঠে না। এবার অনেকে আলু লাগিয়ে লোকসানের দুশ্চিন্তায় ভুগছেন। ১০০ টাকা কেজি দরে আলুবীজ কিনে সেই আলু ১০ টাকা কেজিতে কৃষকেরা বিক্রি করছেন। এবারে বিভিন্ন সবজি চাষেও কৃষকেরা লোকসান গুনেছেন। এসব কারণে অভাব–অনটনে পড়ে তাঁরা অনেকে নগদ টাকার জন্য আবাদি জমির মাটি বিক্রি করছেন।
সরেজমিনে জানা গেছে, বদরগঞ্জের মধুপুর ইউনিয়নের রাজারামপুর মৌজায় ইটভাটা রয়েছে ২৫টি। সেখানে এক্সকাভেটরের (ভেকু) সাহায্যে কৃষিজমির মাটি কেটে ট্রাক্টরে তুলতে দেখা গেছে। সেখানে কথা হয়, ট্রাক্টরশ্রমিক আনারুল ইসলামের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘জমির মালিক মাটি বেচাইচে ইটভাটার মালিকের গোড়োত। হামাক অর্ডার (আদেশ) করছে হামরা কাটি নিয়া যাওচি। ভালো–মন্দ হামার বুঝার দরকার নাই।’
জানতে চাইলে পাশের বিবিএল ইটভাটার মালিক মোকছেদুল হক বলেন, ‘ইট তৈরিতে প্রচুর মাটি লাগে। যেখান থেকে পাই, কিনে ইট বানাই।’
বদরগঞ্জের আমরুলবাড়ী, চম্পাতলী, শেখেরহাট, বকশীগঞ্জ, ঘাটাবিল এবং পাঠানের হাট এলাকা ঘুরে একই চিত্র দেখা গেছে।
আমরুলবাড়ী গ্রামের কৃষক সুমন মিয়া বলেন, ‘দুই বছর আগে আমার আবাদি জমির দুই পাশের দুই কৃষক জমির মাটি বিক্রি করায় চার–পাঁচ ফুট গভীর হয়েছে। এখন আমার উঁচু জমিটা ভেঙে পড়ছে।’
রামনাথপুরের কৃষক আবদুল হামিদ বলেন, ‘বাধ্য হয়া আবাদি ভুঁইয়ের মাটি ইটভাটায় ব্যাচে দিচু। ওরা (ইটভাটার মালিক) গাড়িপ্রতি (ট্রাক্টরপ্রতি) মাটির দাম দেওচে ৩০০ টাকা।’
বদরগঞ্জ কৃষি কার্যালয়ের উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা মহেববুল ইসলাম বলেন, ‘কয়েক বছর ধরে কৃষকেরা অভাবে পড়ে ফসলি জমির উপরিভাগের মাটি বিক্রি করছেন। ইটভাটার মালিকেরা তিন-চার ফুট গভীর করে মাটি খুঁড়ে ইটভাটায় নিচ্ছেন। আগে এসব উঁচু জমিতে ধানসহ সবজির চাষ হলেও নিচু হওয়ায় এখন আর সবজির চাষ হয় না। তুলনামূলক ধানের ফলনও অর্ধেক কমেছে। আমরা চেষ্টা করেও কৃষকদের মাটি বিক্রি করা থেকে নিবৃত্ত করতে পারছি না।’
তারাগঞ্জের উত্তর পাড়া গ্রামের মাটি ব্যবসায়ী এনামুল হক বলেন, ‘কৃষকেরা জমির মাটি ব্যাচায়, আমরা কিনি। জোর করি তো কারও জমির মাটি কাটি আনি না।’
তারাগঞ্জ উপজেলার ইকরচালী, সয়ার, কুর্শা, আলমপুর ও হাড়িয়ারকুঠি ইউনিয়নের বিভিন্ন জায়গায় গিয়ে দেখা গেছে, ইটভাটার মালিকের নিযুক্ত লোকজন কৃষকের আবাদি জমির মাটি কেটে ট্রাক্টরে করে নিয়ে যাচ্ছেন। তাঁরা আগামী বছরের জন্য মাটি কিনে ইটভাটায় মজুতও করছেন।
তারাগঞ্জের বালাপাড়া গ্রামের কৃষক মমিনুল হক বলেন, ‘আবাদি জমির মাটি বেচলে ক্ষতি হয়, এইটা তো জানি না।’ ওই ইউনিয়নের ইটভাটার আরেকজন মালিক এজাজুল হক বলেন, ‘মাগনায় তো কায়ও মাটি দ্যায় না, অভাবের সময় হামারটে টাকা নিয়া যায়। পরে জমির মাটি কাটি আনি।’
তারাগঞ্জের উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা ধীবা রানী বলেন, ফসল উৎপাদনে জমির উপরিভাগের উর্বর এক ফুট মাটি কাজে লাগে। এ মাটিতেই প্রয়োজনীয় জৈব পদার্থ থাকে। দেদার মাটি কেটে নেওয়ায় জমির উর্বরতা শক্তি আবার ফিরতে ১৫ থেকে ২০ বছর পর্যন্ত লেগে যেতে পারে। তাই কৃষকদের জমির মাটি বিক্রি না করার পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে।
বদরগঞ্জ উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা সেলিনা আফরোজ বলেন, ‘উপরিভাগের মাটি কেটে নিলে জমির উর্বরতা শক্তি হ্রাস পায়। আমরা কৃষকদের আবাদি জমির মাটি বিক্রি না করার পরার্মশ দিয়ে যাচ্ছি, কিন্তু তাঁরা অভাবে পড়ে টাকার জন্য তা বিক্রি করছেন।’
বদরগঞ্জের ইউএনও মো.
উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: ইটভ ট র ম ল ক র উপর ভ গ র ম ট ক ষকদ র ইটভ ট য় করছ ন
এছাড়াও পড়ুন:
সার্বক্ষণিক চালু রাখতে হবে ‘হেল্প লাইন’
ঈদের টানা ৯ দিনের ছুটিতে পুরো দেশ। বন্ধ ব্যাংকের শাখা। এ অবস্থায় সব এটিএম বুথে সার্বক্ষণিক অর্থ সরবরাহ স্বাভাবিক রাখার পাশাপাশি সব ধরনের অনলাইন লেনদেন ব্যবস্থা সক্রিয় রাখতে গত বৃহস্পতিবার আগাম নির্দেশনা দিয়ে রেখেছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
গ্রাহক কোনো সমস্যার সম্মুখীন হলে অভিযোগ জানাতে বা সমাধান পেতে ব্যাংকের সঙ্গে যোগাযোগের জন্য সার্বক্ষণিক হেল্প লাইন চালু রাখার নির্দেশনা রয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংকের সার্কুলারে। এসব নির্দেশনা সত্ত্বেও ঢাকাসহ দেশের নানা অঞ্চলে বিভিন্ন ব্যাংকের এটিএমে টাকা না থাকা এবং লেনদেন বন্ধ থাকার ঘটনা রয়েছে।
দেশে বর্তমানে সরকারি ও বেসরকারি মিলে ৬১ ব্যাংকের প্রায় ১৩ হাজার এটিএম বুথ সক্রিয়। এর মধ্যে সর্বাধিক বুথ পরিচালনা করছে ডাচ্-বাংলা ব্যাংক। ব্যাংকটির প্রধান অর্থ কর্মকর্তা (সিএফও) মোহাম্মদ সহিদ উল্লাহ গতকাল শনিবার সমকালকে জানান, দেশব্যাপী তাদের সব বুথ সচল আছে।
ওই সময় পর্যন্ত কোনো অভিযোগ ছিল না। তিনি বলেন, প্রতিটি বুথেই তৃতীয় পক্ষের মাধ্যমে পর্যাপ্ত টাকা রাখার ব্যবস্থা করা আছে। ঈদের আগের দিন ও পরের দিন টাকা রাখা হবে। শুধু ঈদের দিন ছুটি থাকবে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পেমেন্ট সিস্টেমস বিভাগ থেকে জারি করা ওই সার্কুলারে বলা হয়, ডিজিটাল ব্যাংকিং সেবা সার্বক্ষণিকভাবে খোলা রাখতে
হবে। এটিএম বুথ, অনলাইন ব্যাংকিং ও মোবাইল ব্যাংকিং সেবা চালু থাকবে। গ্রাহকের সুবিধার্থে এটিএম বুথগুলোতে পর্যাপ্ত টাকা রাখারও নির্দেশনা দেওয়া হয়।
বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর প্রধান নির্বাহীদের প্রতি নির্দেশনাসহ সার্কুলারটি জারি করা হয়। একই সঙ্গে সব মোবাইল ব্যাংকিং সার্ভিস প্রোভাইডার, পেমেন্ট সার্ভিস প্রোভাইডার ও পেমেন্ট সার্ভিস অপারেটরদের প্রতিও সার্কুলারে তাদের নিরবচ্ছিন্ন সেবা চালু রাখতে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সার্কুলারে এটিএম সেবা প্রদানকারী ব্যাংকগুলোকে বলা হয়, সার্বক্ষণিক এটিএম সেবা নিশ্চিত করতে হবে। কোথাও কোনো কারিগরি ত্রুটি দেখা দিলে তা দ্রুততম সময়ের মধ্যে নিরসন করতে হবে। এটিএম বুথে পর্যাপ্ত টাকা এবং নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। প্রয়োজনে সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের কর্মকর্তাদের এটিএম বুথ পরিদর্শনের ব্যবস্থা করতে হবে।
মোবাইল ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিস প্রদানকারী ব্যাংক এবং তা তাদের সহযোগী কোম্পানির প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রতিও সার্বক্ষণিক লেনদেন ব্যবস্থা চালু রাখার নির্দেশনা দেওয়া হয় এবং এজেন্ট পয়েন্টে পর্যাপ্ত নগদ অর্থ রাখতে বলা হয়েছে। একই সঙ্গে ডিজিটাল ব্যাংকিংয়ের সাইবার নিরাপত্তা এবং সব ধরনের জালিয়াতি প্রতিরোধে সব ধরনের ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে বলা হয়েছে। ডিজিটাল ব্যাংকিংয়ে কোনো সাইবার হামলার বার্তা পেলে সঙ্গে সঙ্গে গ্রাহককে সতর্ক করার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
সার্কুলারে ছুটি চলাকালে যে কোনো অঙ্কের লেনদেনের তথ্য গ্রাহকের মোবাইলে এসএমএস অ্যালার্ট সার্ভিসের মাধ্যমে অবহিত করতে বলেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। ইলেকট্রনিক পদ্ধতিতে সব ধরনের পেমেন্ট সেবার ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় সতর্কতা অবলম্বনের জন্য গণমাধ্যমে প্রচার চালাতেও নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।