সবুজ পাহাড়ের লাল ‘আমিলা’ যাচ্ছে সারা দেশে
Published: 16th, February 2025 GMT
পার্বত্য চট্টগ্রামের খাগড়াছড়িতে বাণিজ্যিকভাবে চাষ হচ্ছে চুকাই। স্থানীয়ভাবে ‘আমিলা’ নামে পরিচিত এই ফলটি চাষ করে কৃষকেরা লাভবান হচ্ছেন। একসময় তেমন চাহিদা না থাকলেও এখন সারা দেশেই কদর বেড়েছে ফলটির। খাগড়াছড়িতে উৎপাদিত আমিলা পাইকারেরা কিনে দেশের নানা প্রান্তে বিক্রি করছেন।
বিভিন্ন অঞ্চলে মেসতা বা মেসতা গোলা নামেও পরিচিত এই ফল। চাকমা ভাষা থেকেই মূলত আমিলা নামটি পাহাড়ে বেশি পরিচিতি পেয়েছে। মারমারা এটিকে ‘পুং’ বলে, যার অর্থ টক। আর ত্রিপুরারা বলেন ‘মুখ্রোই বৌথাই’। তবে যে নামেই ডাকা হোক ভিটামিন–সমৃদ্ধ এবং ভেষজ গুণে ভরা এই ফলের কদর বাড়ছে দিন দিন। পাহাড়ে বাণিজ্যিকভাবে এর চাষ শুরু হয়েছে কয়েক বছর ধরে।
খাগড়াছড়ি কৃষি বিভাগের গবেষকেরা জানান, একসময় দেশের সবখানে দেখা মিললেও মালভেসি পরিবারের এই উদ্ভিদের সংখ্যা বেশ কমে গেছে। তবে সিলেট, চট্টগ্রাম ও পার্বত্য চট্টগ্রামে এখনো চুকাই বা আমিলার দেখা মেলে। এটি বর্ষজীবী উদ্ভিদ। গাছ দেখতে খাটো ও ঝোপালো হয়। ফুলের রং হলুদ, তবে মাঝের অংশ মেরুন রঙের। পাতা লালচে–সবুজ, ফল লাল। এটি ভিটামিন বি-৬ ও ভিটামিন সি–সমৃদ্ধ। ঠোঁটের কোণে ঘা, কোষ্ঠকাঠিন্য, প্রস্রাবে জ্বালা-পোড়া, চর্মরোগসহ নানা রোগের উপশম করে। চিংড়ির তরকারি বা টক ঝোলে আমিলা পাতা পড়লে রান্না সুস্বাদু হয়। পাহাড়িরা এই ফলের খোসা দিয়ে টক রান্না করেন। প্রাকৃতিকভাবে পেকটিন–সমৃদ্ধ বলে এই ফলের খোসা দিয়ে কোনো রাসায়নিক ছাড়া সহজেই জেলি তৈরি করা যায়।
পাহাড়ের বাসিন্দাদের কাছে অত্যন্ত জনপ্রিয় এই ফল দিয়ে তরিতরকারির স্বাদ যেমন বাড়ানো যায়, তেমনি জ্যাম আর চাটনি তৈরির জন্যও এই ফল অতুলনীয়। তা ছাড়া ফলটি শুকিয়ে চা তৈরিতে ব্যবহৃত হয়, যা ‘রোজেলা চা’ হিসেবে পরিচিত। পাহাড়ের খাবার হোটেলগুলোতেও রান্না হয় আমিলা। খাগড়াছড়ি শহরের পানখাইয়াপাড়া এলাকার সিস্টেম রেস্টুরেন্টের পরিচালক আচিং মারমা প্রথম আলোকে বলেন, আমিলা ফলের রান্না করা টকের চাহিদা রয়েছে প্রচুর। এ ছাড়া আমিলা দিয়ে ছোট মাছ, মাংসও রান্না করা হয়। স্যুপেও আমিলা দেওয়া হয়।
খাগড়াছড়ির স্কুলশিক্ষক সুজিতা চাকমা আমিলা সম্পর্কে বলেন, এই ফলের পাতার টক ঝোল করা হয়। ফলের বিচি ফেলে শুকিয়ে চা প্রস্তুত করা যায়। এ ছাড়া জ্যাম, জেলি তৈরি করা যায় ফল দিয়ে। ফলের বিচি যে কোনো জায়গায় বর্ষা মৌসুমে ফেলে দিলে নিজ থেকে চারা উঠে। তেমন পরিচর্যা করতে হয় না।
পাহাড়ে বাসিন্দারা একসময় শুধু নিজেদের খাওয়ার জন্য বাড়ির আঙিনার আশপাশে আমিলা রোপণ করতেন। তবে বর্তমানে বাণিজ্যিকভাবে এর চাষ হচ্ছে। অনেকে জুমে ও পতিত জমিতে আমিলার চাষ করছেন। পাতা ও ফল বিক্রি করে লাভের মুখও দেখছেন। খাগড়াছড়ির বিভিন্ন বাজার ঘুরে দেখা গেছে, এক আঁটি আমিলা পাতা বিক্রি হচ্ছে ১০-১৫ টাকায়। আর ফল প্রতি কেজি বিক্রি হচ্ছে ১০০-১৫০ টাকায়।
খাগড়াছড়ির ভাইবোনছড়া এলাকার কলেজপড়ুয়া এক তরুণ অনিময় ত্রিপুরা বলেন, এক রেস্তোরাঁয় রোজেলা চা পান করে শখের বশে গত বছর বাড়ির পাশে কয়েকটি গাছ লাগিয়েছিলেন। নিজের জন্য পরিপক্ব কিছু ফল শুকিয়ে বাড়িতে রাখার পরও দুই হাজার টাকার ফল বিক্রি করেছেন। এ বছর শুধু বাড়ির চারপাশে নয়, জুমের একটি অংশেও আমিলা চাষ করেছেন। পাইকাররা প্রতিদিন আসেন কাঁচা ফল কেনার জন্য। তবে তিনি ফল শুকিয়ে চা হিসেবে বিক্রি করবেন।
পানছড়ি বাজারে আমিলা বিক্রি করতে এসেছিলেন মরাটিলা এলাকার বাসিন্দা চাইলাউ মারমা। ঘরের চারপাশে পাঁচ বছর ধরে আমিলা চাষ করেছেন তিনি। এ বছর দুই হাজার টাকায় আমিলা পাতা বিক্রি করেছেন। ফল বিক্রি করেছেন তিন হাজার টাকার। সামনে আরও পাঁচ থেকে ছয় হাজার টাকার ফল বিক্রি করতে পারবেন বলে জানালেন।
খাগড়াছড়ি বাজারের ফল ব্যবসায়ী আবদুল মালেক বলেন, খাগড়াছড়ির বিভিন্ন বাজার আর পাড়ায় পাড়ায় ঘুরে পাইকারি দরে আমিলা কেনেন ৫০ থেকে ৮০ টাকায়। আর বিক্রি করেন ১০০ থেকে ২৫০ টাকায়। এসব আমিলা তিনি চট্টগ্রাম, ফেনী, নোয়াখালী, কুমিল্লা, সিলেট আর ঢাকায় নিয়ে গিয়ে বিক্রি করেন। বিশেষ করে রেস্তোরাঁ আর জ্যাম-জেলি তৈরির কারখানায় আমিলা ফলের প্রচুর চাহিদা রয়েছে।
খাগড়াছড়ি কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক বাছিরুল আলম বলেন, আমিলা প্রচুর ক্যালসিয়াম ও লৌহসমৃদ্ধ ফল। আমিলা চাষে কোনো সার ও সেচ দিতে হয় না। পাহাড়ি এলাকা ছাড়াও সমতলেও সাথি ফসল হিসেবে আমিলা চাষ করা যায়। এর বাণিজ্যিক সম্ভাবনাও প্রচুর।
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: ফল ব ক র র জন য চ ষ কর পর চ ত কর ছ ন
এছাড়াও পড়ুন:
সত্যের পয়গাম
প্রাচীন ইরাকে ‘মেসোপটেমিয়া’ রাজ্যের রাজধানী ছিল বাবেল। মেসোপটেমিয়ার শাসক ছিল নমরুদ। খুবই অহংকারী আর দাম্ভিক। একদিন সে স্বপ্ন দেখল—আকাশে একটি নতুন তারা উদিত হয়ে চাঁদ আর সূর্যের আলোকেও নিষ্প্রভ করে দিয়েছে। স্বপ্নটি নমরুদকে আতঙ্কিত করে তুলল। সে জ্যোতিষীদের ডেকে স্বপ্নটির ব্যাখ্যা জিজ্ঞেস করল। তারা বলল, ‘আপনার রাজ্যে এমন এক শিশুর জন্ম হবে, যার হাতে আপনার ও আপনার রাজত্বের অবসান ঘটবে।’ সেই শিশুর জন্ম কত তারিখে হবে—জ্যোতিষীরা তা-ও বলে বলে দিয়েছিল। নমরুদ নির্দেশ দিল, ওই তারিখে যত পুত্রসন্তান জন্মগ্রহণ করবে, প্রত্যেককে হত্যা করা হবে। রাজ্যের সর্বত্র চৌকি বসিয়ে দেওয়া হলো, প্রত্যেক গর্ভধারণকারী নারীকে জেলখানায় আবদ্ধ করা হলো।
আযর নামে এক কাঠমিস্ত্রির স্ত্রীও ছিল সন্তানসম্ভবা, কিন্তু আল্লাহর কুদরতে তার শরীরে গর্ভধারণের চিহ্ন দেখা যেত না। তিনি পালিয়ে এক গুহায় চলে যান, এবং সেখানে ইবরাহিম (আ.)-এর জন্ম হয়। ওদিকে নির্দিষ্ট দিনে জন্মগ্রহণকারী প্রত্যেক ছেলেকে হত্যা করা হলে নমরুদের মন শান্ত হলো। একসময় সে স্বপ্নের কথা ভুলেও গেল।
আরও পড়ুনআবু বকরের (রা.) মা যেভাবে মুসলমান হন০৫ এপ্রিল ২০২৫ইবরাহিম (আ.) গুহাতেই বড় হতে থাকেন, আল্লাহ-তাআলা সেখানেই তাকে হেদায়েত দেন। তিনি কৈশোরে উপনীত হলে মা তাকে বাড়িতে নিয়ে আসেন। তিনি আশ্চর্য হয়ে দেখেন শহরের সব মানুষ এক আল্লাহর পরিবর্তে কাঠের দেবদেবীর পূজা করে। আর সেই মূর্তি তৈরি করে কিনা তারই পিতা আযর! (সিরাত বিশ্বকোষ, ১/৩০১-৩০২, ইফাবা)
তিনি সর্বপ্রথম নিজ পরিবারে দাওয়াত দেওয়া শুরু করেন। তিনি পিতাকে বলেন, ‘আপনি কি মূর্তিকে উপাস্য বলে মানেন? আমি তো আপনাকে আর আপনার সম্প্রদায়কে স্পষ্ট ভ্রষ্টতার মধ্যে দেখছি।’ (সুরা আনআম, আয়াত: ৭৪)
কিন্তু আযর তার কথা শুনল না। ইবরাহিম (আ.) ক্ষান্ত হলেন না, তিনি যুক্তি-তর্কের মাধ্যমে দাওয়াত দেওয়া শুরু করেন।
বাবেলের অধিবাসীরা বিভিন্ন গ্রহ-নক্ষত্রে বিশ্বাস রাখত। মনে করত এরাও খোদা। কিন্তু গ্রহ-নক্ষত্র তো আল্লাহর মাখলুকমাত্র, উদিত হয় আবার অস্ত যায়। যিনি বিশ্বজগতের প্রতিপালক, তার উদয়-অস্ত হতে পারে না। তিনি চিরঞ্জীব, তার কোনো আদি-অন্ত নাই। এই কথাগুলো বোঝানোর জন্য ইবরাহিম (আ.) কৌশলের আশ্রয় নিলেন, এক সন্ধ্যায় লোকজনকে উদ্দেশ্য করে বললেন, ‘এই যে তারকা, (ধরে নিলাম) এটা আমার প্রভু!’ একটু বাদে যখন তারকাটি ডুবে গেল, তিনি বললেন, ‘যেসব জিনিস ডুবে যায়, তার প্রতি আমার কোনো ভালোবাসা নাই!’ তারপর সব গ্রহ-নক্ষত্রকে আলোহীন করে চাঁদের উদয় হলো। তিনি বললেন, ‘এটাই আমার প্রভু!’ কিন্তু একসময় চাঁদও ডুবে গেল। তিনি বললেন, ‘আমার প্রভু যদি আমাকে পথ না দেখান, তবে নিশ্চয় আমি পথহারাদের দলে শামিল হব।
আরও পড়ুনইসলামের শত্রু আবু জাহেলের মা তিনি ০৪ এপ্রিল ২০২৫পরদিন যখন সবদিক আলোকিত করে সূর্য উঠলো, তিনি বললেন, ‘এটাই আমার প্রভু, এটাই সবগুলোর চেয়ে বড়!’ এক পর্যায়ে সূর্যও ডুবে গেল, তিনি বললেন, ‘হে আমার জাতি, তোমার যেসব জিনিসকে আল্লাহর অংশীদার মনে করো, আমি তা থেকে মুক্ত। আমি একনিষ্ঠভাবে তার দিকে মুখ ফিরাচ্ছি যিনি আসমান ও জমিন সৃষ্টি করেছেন এবং আমি মুশরিকদের অন্তর্ভুক্ত নই।’ (তাফসীরে তাবারী, ৯/৪৫৬, ইফাবা)
এ কথা শুনে তার জাতি বাদানুবাদ শুরু করে দিল। তারা বলল, তুমি দেবতাদের ভয় করো, এ ধরনের কথাবার্তা বোলো না। ইবরাহিম (আ.) বললেন, ‘তোমরা কি আল্লাহর ব্যাপারে আমার সঙ্গে বাদানুবাদ করছ, অথচ তিনি আমাকে সঠিক পথ দেখিয়েছেন? তোমরা যে জিনিসকে তার অংশীদার বানিয়েছ, আমি তাকে ভয় করি না। কিন্তু আল্লাহ যা ইচ্ছে তা-ই করতে পারেন। প্রতিটি বস্তু সম্পর্কে আমার প্রতিপালকের জ্ঞান পরিব্যাপ্ত, তোমরা কি তা বুঝবে না?’ (সুরা আনআম, আয়াত: ৭৬-৮০)
কিন্তু তারা সত্যকে অস্বীকার করল। কাফেরেরা এমনই। তারা না মানে ‘যুক্তি’ আর না মানে যুক্তির ঊর্ধ্বে গিয়ে ‘বিশ্বাস’। তারা কেবল অন্ধের মতো নফসের অনুসরণ করে যায়।
আরও পড়ুনমদিনায় মুনাফেকির উদ্ভব কেন হয়েছিল০৩ এপ্রিল ২০২৫