ভারতের শেয়ারবাজারের টানা পতন চলছে। গত শুক্রবার শেষ হওয়া সপ্তাহের সব কটি দিনসহ টানা আট দিন পতন হয়েছে শেয়ার সূচকের। সেদিন সেনসেক্স ১৯৯ দশমিক ৭৬ পয়েন্ট পড়ে নেমেছে ৭৬ হাজারের নিচে (৭৫ হাজার ৯৩৯ দশমিক ২১)। আরেক সূচক নিফটি ১০২ দশমিক ১৫ পয়েন্ট পড়ে ২২ হাজার ৯২৯ দশমিক ২৫ অঙ্কে নেমেছে।

৮ দিনে বিনিয়োগকারীরা হারিয়েছেন ২৫ দশমিক ৩১ লাখ কোটি রুপি। তবে শুক্রবার বেড়েছে ডলারের সাপেক্ষে রুপির দর। প্রতি ডলার ২১ পয়সা কমে হয়েছে ৮৬ দশমিক ৭১ রুপি। বিশ্ববাণিজ্য নিয়ে চিন্তা ও বিদেশি বিনিয়োগকারীদের পুঁজি প্রত্যাহার সূচক পতনের অন্যতম কারণ হলেও সংশ্লিষ্ট মহলের মতে, ভারত-যুক্তরাষ্ট্র বৈঠকের ইতিবাচক কিছু দিক আছে। আগামী দিনে সেদিকে নজর থাকবে বাজারের।

সংবাদে বলা হয়েছে, বিদেশি বিনিয়োগকারীরা গত সপ্তাহে ভারতের বাজার থেকে ২১ হাজার ৪ কোটি ২৩ লাখ রুপি তুলে নিয়েছেন। এটাই সূচকের পতনের প্রধান কারণ। যুক্তরাষ্ট্রের নীতির পাশাপাশি বিনিয়োগকারীরা বাজার থেকে তেমন সুবিধা করে উঠতে না পারায় এ পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। বাজারে সৃষ্টি হয়েছে হতাশা।

ভারতের শেয়ারবাজার থেকে টানা বিনিয়োগ প্রত্যাহার করে নিচ্ছে বিদেশি বিনিয়োগকারীরা। দেখা গেছে, চলতি মাসের প্রথম সপ্তাহেও বিনিয়োগকারীরা ৭ হাজার ৩৪২ কোটি রুপির শেয়ার বিক্রি করেছে। এর আগে গত মাসে তারা বিক্রি করেছিল ৭৮ হাজার ২৭ কোটি রুপির শেয়ার। ডিসেম্বরে অবশ্য তারা কিনেছিল ১৫ হাজার ৪৪৬ কোটি রুপির শেয়ার। সব মিলিয়ে ২০২৪ সালে বিনিয়োগ করেছিল মাত্র ৪২৭ কোটি রুপি।

বাজারমহলের মতে, বিদেশি বিনিয়োগকারীদের পুঁজি প্রত্যাহারের পেছনে একাধিক কারণ কাজ করছে। সেগুলো হলো শুল্কযুদ্ধের পরিস্থিতি তৈরি হওয়া; এ ধরনের পরিস্থিতিতে ভারতের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলো বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে বলে আশঙ্কা; ভারতের বাজারে ধারাবাহিক সূচক পতন; পড়তি বাজারে এখনো অনেক কোম্পানির শেয়ারের উচ্চ দর; অক্টোবর-ডিসেম্বরে প্রত্যাশা পূরণ করতে না পারার আর্থিক ফলাফল; চলতি অর্থবর্ষে ভারতের আর্থিক বৃদ্ধির পূর্বাভাস কমে ৬ দশমিক ৪ শতাংশ হওয়া; মূল্যস্ফীতি নিয়ে চিন্তা বহাল থাকার বার্তা, বিশেষত খাদ্য ও জ্বালানি বাদে অন্যান্য পণ্য নিয়ে; ডলারের সাপেক্ষে রুপির রেকর্ড তলানিতে নামায় বিদেশি বিনিয়োগকারীদের মুনাফা হ্রাস।

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: দশম ক

এছাড়াও পড়ুন:

বৈশাখের মালিকানা যেন ফিরেছে জনগণের কাছে

বাংলা বছরের প্রথম দিন, পয়লা বৈশাখ, কেবল একটি দিন নয়—এটি একটি জাতিসত্তার প্রকাশ, বাঙালির আত্মপরিচয়ের এক অমোঘ নিদর্শন। বহু শতাব্দী ধরে এই উৎসব বাঙালির জীবনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে। কালের বিবর্তনে, নানা রাজনৈতিক সংকট আর সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের মধ্য দিয়ে এই উৎসবও কখনো সংকুচিত হয়েছে, কখনো হয়ে উঠেছে নির্দিষ্ট গোষ্ঠীর প্রতীক। যেন তা আটকে ছিল কিছু নির্দিষ্ট বলয়ে, একটি দল বা ঘরানার নিজস্ব আয়োজন হিসেবে। এবারের বৈশাখ সেই নীরব অবরোধ ভেঙে দিয়েছে।

মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ, জাতি-ধর্ম-বর্ণনির্বিশেষে উৎসবে মেতে ওঠা এবং শহরের সীমানা পেরিয়ে গ্রাম পর্যন্ত এর ছোঁয়া—সব মিলিয়ে ১৪৩২ বঙ্গাব্দের প্রথম দিনটি যেন ছিল এক সাংস্কৃতিক জাগরণের সূচনা।

বৈশাখের ইতিহাস ঘেঁটে দেখলে বোঝা যায়, এই উৎসব কখনোই কোনো একক গোষ্ঠীর সম্পত্তি ছিল না। মোগল সম্রাট আকবর কৃষিব্যবস্থাকে সংগঠিত করতে বাংলা সন প্রবর্তন করেছিলেন, যার মাধ্যমে রাজস্ব আদায় সহজ হতো। কিন্তু সময়ের সঙ্গে এই হিসাবের বর্ষপঞ্জি পরিণত হয় উৎসবে। পরিণত হয় বাঙালির মাটির সঙ্গে মিশে থাকা সংস্কৃতির এক অপরিহার্য অংশে।

গ্রামীণ বাংলার বৈশাখ তাই ছিল বটতলার মেলা, হালখাতা, ঢাকঢোল, নাচ-গান, আর লাল-সাদা শাড়ি-পাঞ্জাবির আনন্দ। মানুষের মুখে মুখে থাকা পল্লিগীতি, মুরব্বিদের মুখে নতুন বছরের শুভেচ্ছা, আর বাচ্চাদের হাতে বাতাসা-মুড়ির ঠোঙা—এসব ছিল এই উৎসবের বাস্তব রূপ।

এটি কখনোই শহরের চারুকলা বা ছায়ানটের একক সত্তা ছিল না। তবে শহরকেন্দ্রিক আধুনিকতার ছোঁয়ায়, বৈশাখ ধীরে ধীরে একটি নির্দিষ্ট শ্রেণি ও রাজনৈতিক বলয়ের দখলে চলে যেতে থাকে। বিশেষ করে সামরিক শাসনের পরবর্তী সময়ে, যখন জাতীয়তাবাদী চেতনার বিপরীতে দাঁড় করানো হলো বাঙালি সংস্কৃতিকে, তখন আওয়ামী লীগ এবং সংশ্লিষ্ট সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলো বৈশাখকে তাদের পরিচয় নির্মাণের হাতিয়ার করে তোলে। চারুকলার মঙ্গল শোভাযাত্রা, ছায়ানটের রমনা বটমূলে গান—এসব হয়ে ওঠে বৈশাখের মূল চিত্র। অথচ এতে গ্রামীণ মানুষের উপস্থিতি ছিল না, ছিল না পাহাড়ি জাতিগোষ্ঠী, সাঁওতাল, রাজবংশী, চাকমা কিংবা মারমাদের সংস্কৃতির প্রতিনিধিত্ব।

বৈশাখ যদি বাঙালির হয়, তবে তাকে হতে হবে সর্বজনীন। তাতে থাকতে হবে মুসলিম, হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান; শহরের উচ্চবিত্ত, গ্রামের কৃষক, আদিবাসী গোষ্ঠী এবং প্রান্তিক মানুষের সমান অংশগ্রহণ। সংস্কৃতি কখনোই সংখ্যালঘু গোষ্ঠী বা সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের অনুগত নয়, বরং এটি জনমানুষের আত্মা, যা কেবল তখনই সত্যিকারভাবে প্রসারিত হয়, যখন সেটি সবার জন্য উন্মুক্ত থাকে।

এই একচেটিয়া সংস্কৃতিচর্চা একসময় এমন পর্যায়ে গিয়ে পৌঁছায় যে ধর্মীয় রক্ষণশীলদের একটি বড় অংশ এবং রাজনৈতিকভাবে ভিন্নমতাবলম্বী মানুষদের কাছে পয়লা বৈশাখ হয়ে উঠে বিতর্কিত—যেন এটি একটি ‘লিবারেল’ বা ‘আওয়ামী’ উৎসব। এই মনোভাব সমাজে যে সাংস্কৃতিক বিভাজন তৈরি করেছিল, তা আমাদের জাতিসত্তার বৈচিত্র্যময় রূপকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। কিন্তু এবারের বৈশাখ ছিল এক অন্য রকম অভিজ্ঞতা। শহর আর গ্রাম একসঙ্গে মিশে গেল যেন একসুতোয় বাঁধা উত্সবে। আর এই উৎসব ছিল সবার—কোনো নির্দিষ্ট ঘরানার রাজনৈতিক পরিচয়ে বিশ্বাসীদের নয়, বরং প্রত্যেক সেই মানুষের, যিনি নিজেকে বাঙালি বলে ভাবেন, এমনকি বাঙালি ছাড়া অন্যান্য জাতিগোষ্ঠীর মানুষেরও।  

এই বছর রাজপথে ছিল ছায়ানটের গান, স্কুলপড়ুয়া বাচ্চাদের নাচ, ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর ঐতিহ্যবাহী পোশাকে র‍্যালি এবং বিভিন্ন রাজনৈতিক অরাজনৈতিক সংগঠনের তত্ত্বাবধানে আয়োজিত লোকজ মেলা। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হওয়া ভিডিওগুলোতে দেখা গেছে, কোথাও গ্রামের স্কুলমাঠে ব্যানারহীন বৈশাখী অনুষ্ঠান, আবার কোথাও পাহাড়ি অঞ্চলে মারমা বা ত্রিপুরা সংস্কৃতির অংশ নিয়ে বৈশাখ উদ্‌যাপন। এসব আয়োজন প্রমাণ করেছে—মানুষ নিজের উৎসব নিজের মতো করে ফিরিয়ে নিচ্ছে।

এই অংশগ্রহণ শুধু সাংস্কৃতিক নয়, একধরনের রাজনৈতিক প্রতিবাদও বটে। উৎসবের ওপর একচেটিয়া অধিকার প্রত্যাখ্যান করে মানুষ এবার বলেছে—এটি তাদের দিন, তাদের আনন্দ, তাদের পরিচয়। এটা যেন ছিল নিঃশব্দ এক সাংস্কৃতিক অভ্যুত্থান, যেখানে না আছে দলীয় পতাকা, না আছে আদর্শগত হম্বিতম্বি। আছে কেবল ভালোবাসা, শিকড়ের টান আর জাতিসত্তার মৃদু অথচ দৃঢ় ঘোষণা।

বৈশাখ যদি বাঙালির হয়, তবে তাকে হতে হবে সর্বজনীন। তাতে থাকতে হবে মুসলিম, হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান; শহরের উচ্চবিত্ত, গ্রামের কৃষক, আদিবাসী গোষ্ঠী এবং প্রান্তিক মানুষের সমান অংশগ্রহণ। সংস্কৃতি কখনোই সংখ্যালঘু গোষ্ঠী বা সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের অনুগত নয়, বরং এটি জনমানুষের আত্মা, যা কেবল তখনই সত্যিকারভাবে প্রসারিত হয়, যখন সেটি সবার জন্য উন্মুক্ত থাকে।

সুতরাং এবারের বৈশাখ একটি বার্তা দিয়েছে। বার্তা দিয়েছে যে সাংস্কৃতিক মালিকানা ফিরে যাচ্ছে জনগণের হাতে। এই ধারা যেন অব্যাহত থাকে। বৈশাখ হবে আরও বৈচিত্র্যপূর্ণ, আরও অংশগ্রহণমূলক অর্থাৎ সব ধরনের রুচি, চিন্তা ও সংস্কৃতিকে ধারণক্ষম। এই সমাজচিত্রই হোক আগামীর বাংলাদেশ, যেখানে উৎসব মানে বিভাজন নয়, বরং মিলনের সেতুবন্ধন।

শাহরিয়ার মোহাম্মদ ইয়ামিন যুগ্ম সদস্য সচিব, বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক ছাত্রসংসদ, শিক্ষার্থী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

সম্পর্কিত নিবন্ধ