প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, অন্তর্বর্তী সরকার রাজনৈতিক দলগুলোর ওপর সংস্কার প্রস্তাব চাপিয়ে দেবে না। তবে তিনি দীর্ঘ মেয়াদে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন আয়োজনের আইনি কাঠামো তৈরির জন্য সংস্কার প্রক্রিয়া সঠিকভাবে এগিয়ে নিতে দলগুলোর প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন।

গতকাল শনিবার ঢাকার ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোর বৈঠকে এসব কথা বলেন ড.

ইউনূস। সভাপতির বক্তব্যে নেতাদের উদ্দেশে তিনি বলেন, ‘সংস্কার আমরা সঠিকভাবে করতে পারলে বাঙালি জাতি যতদিন টিকে থাকবে, ততদিন আপনাদের অবদান থেকে যাবে।’

জুলাই-আগস্ট গণঅভ্যুত্থানে শহীদ ও আহত যোদ্ধাদের স্মরণ করে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘অন্তর্বর্তী সরকারের ছয় মাসে প্রথম ইনিংস বা প্রথম অধ্যায় শেষ হয়েছে। আজ রাজনৈতিক সংলাপের মাধ্যমে দ্বিতীয় অধ্যায় শুরু হলো। দ্বিতীয় পর্বের স্রষ্টা হিসেবে আপনারা সংস্কার সুপারিশ জাতির সামনে আনবেন। আপনাদের সহযোগিতা করবেন কমিশনের সদস্যরা। আলাপ-আলোচনা করে ঠিক করুন, যেন আমরা দ্রুত কাজে নেমে পড়তে পারি। নির্বাচনের মাধ্যমে যে সরকার গঠিত হবে, কেউ যেন তা নিয়ে প্রশ্ন তুলতে না পারে।’

তিনি বলেন, ‘দেশের ঐক্য ও বিদেশের সমর্থন বিবেচনা করে সংস্কার কমিশন সুপারিশ করেছে। এ মূল্যবান সম্পদ বাংলাদেশের ইতিহাসে রক্ষিত হবে। সবাই মিলে পরামর্শ দেন কোনগুলো বাস্তবায়ন করব। নীতিমালা বানিয়ে দিলে স্বচ্ছভাবে দেশ চলতে থাকবে। কলকাঠি নাড়ানো ছাড়া যে একটা দেশ নিয়মের মধ্যে চলতে পারে, সেটিই আমাদের করতে হবে।’

ড. ইউনূস বলেন, ‘সংস্কার এমনভাবে হয়, যাতে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম আমাদের প্রতি কৃতজ্ঞ থাকে। ঐকমত্য কমিশনের সদস্যরা তাদের জায়গা থেকে ভালো কিছু দেওয়ার চেষ্টা করেছে। এখান থেকে কতটুকু গ্রহণ করব, কীভাবে অগ্রসর হব, এ জন্য আপনাদের সঙ্গে আলোচনা করা। আপনারা জনগণের প্রতিনিধি, তাই আপনাদের সঙ্গে এ নিয়ে একটা বাস্তবভিত্তিক আলোচনা হতে হবে। এমন মজবুতভাবে আইনকানুন করব, যাতে সবাই মেনে চলে এবং একটি সুন্দর সমাজ তৈরি করা যায়।’
তিনি বলেন, ‘আমাদের পক্ষ থেকে সুপারিশগুলো নিয়ে এসেছি। চাপানোর ক্ষমতা আমাদের নেই। আমরা কেবল বুঝাব কেন প্রয়োজন এবং কীভাবে করা যায়। বাকিটা আপনাদের কাজ। একটু রদবদল করলে দেখবেন সুন্দর হয়ে যাবে। আমরা কেবল সাচিবিক কাজ করে দেব।’

গত ছয় মাসে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক সমর্থনের কথা উল্লেখ করে সরকারপ্রধান বলেন, ‘প্রথম পর্বের অভিজ্ঞতা হলো– সরকার দেশের জনগণের ও আন্তর্জাতিক বিশ্বের সমর্থন দুটিই পেয়েছে। পৃথিবীজুড়ে আমাদের প্রতি বড় রকমের সমর্থন গড়ে উঠেছে। যে কারণে অপরপক্ষ (ক্ষমতাচ্যুত স্বৈরাচারী সরকার) সুবিধা করতে পারছে না। বহু গল্পের চেষ্টা করছে, কিন্তু টিকাতে পারছে না। শেষ পর্যন্ত মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের কাছে গিয়েও গল্প চালাতে পারল না। ছোট রাষ্ট্র, বড়, মাঝারি এবং ধনী– আমাদের সমর্থনে কারও কোনো দ্বিধা নেই।’

তিনি বলেন, ‘কোনো রাষ্ট্রের প্রধানের সঙ্গে যখন আমরা কথা বলি, তারা বলেন আপনাদের কী লাগবে? আমরা আপনাদের সঙ্গে আছি। একটি দেশের সরকার প্রধানের সঙ্গে এর চেয়ে ঘনিষ্ঠভাবে কথা বলা, আর কী হতে পারে। তারা এ পর্যন্ত আমাদের মেনে নিয়েছে এবং ক্রমাগতভাবে তাদের সমর্থন বেড়ে চলেছে। অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক সমর্থন পাওয়ার পরও আমরা নতুন বাংলাদেশ গড়তে না পারলে তা হবে দুর্ভাগ্যের। আমরা এ সুযোগ হাতছাড়া করতে চাই না।’

ড. ইউনূস বলেন, আন্তর্জাতিক মহল আমাদের বলে– তোমাদের অর্থনৈতিকভাবে সহায়তা করতে পারি। কিন্তু সংস্কার তো তোমাদেরই করতে হবে। আন্তর্জাতিক সমর্থন, সহযোগিতা ও শুভেচ্ছা আমাদের জন্য মস্তবড় সম্পদ। আমরা তাদের বহু রকম স্বপ্নের কথা বলেছি। তারা বলেছে, তোমরা করতে পারলে আমাদের সমস্যা নেই। কোনো কোনো শক্তিশালী দেশ আমাদের বিশেষভাবে সহায়তা করতে চায়। তাই বলছি, সংস্কার সম্পন্ন করার ক্ষেত্রে আমাদের ব্যর্থ হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। ব্যর্থ হতে চাই না।

রাজনৈতিক নেতাদের উদ্দেশে তিনি বলেন, ‘যে আইনি ও প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোর মাধ্যমে স্বৈরাচারী সরকার সুযোগ পেয়েছিল, তা থেকে যেন আমরা অন্যরূপে বেরিয়ে আসতে পারি। হাডুডু খেলার ক্ষেত্রে আইন মেনে চললেও দেশকে একটা তামাশায় পরিণত করা হয়েছিল। আইন-নিয়ম বলে কিছু ছিল না। জুলাই বিপ্লবে যারা আত্মাহুতি দিয়েছেন, তারা নির্দেশ দিয়ে গেছেন আমরা যেন সেই আইনকানুন বাদ দিয়ে নতুন বাংলাদেশের জন্য প্রস্তুত হই। কী আইন প্রয়োজন হবে সেগুলো মাথায় রেখে সংস্কার কমিশন করা হয় এবং কমিশন তাদের কাজে যথাসাধ্য চেষ্টা করেছে।’

প্রধান উপদেষ্টা বলেন, আমরা এক লন্ডভন্ড অবস্থার মধ্যে দায়িত্ব নিয়েছিলাম। এ ছয় মাসের অভিজ্ঞতা হলো– দলমত নির্বিশেষে সাধারণ মানুষ ও রাজনৈতিক ব্যক্তি সবাই সরকারকে সহায়তা দিয়েছে। আমাদের মধ্যে অনেক তর্কবিতর্ক আছে। তবে আমাদের মধ্যে ঐক্য আছে এবং সেটি বজায় থাকবে বলে আমার বিশ্বাস।

জুলাই-আগস্ট অভ্যুত্থানে স্বৈরাচারী সরকারের চালানো নির্মম নির্যাতনের বিষয়ে জাতিসংঘ মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনের প্রতিবেদনের কথা উল্লেখ করেন তিনি। ড. ইউনূস বলেন, জাতিসংঘের এ প্রতিবেদন হলো আমাদের প্রতি বিদেশিদের আরেকটি সমর্থন। এখন কারও বানানো বয়ান আর কেউ শুনবে না, ওইটা চূড়ান্ত। একেবারে অক্ষরে অক্ষরে তারা বলে দিয়েছে, কাকে কোথায় মারা হয়েছে। বাংলাদেশ ঘিরে যে অপপ্রচার চলছিল, এ প্রতিবেদন তা বন্ধ করে দিয়েছে।

‘আমাদের চূড়ান্ত লক্ষ্য জুলাই সনদ তৈরি’
বৈঠকে সমাপনী বক্তব্যে প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূস বলেন, জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের চূড়ান্ত লক্ষ্য হলো, সংস্কারের বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মতামতের ভিত্তিতে একটি সনদ তৈরি করা। সেটাই হবে জুলাই সনদ। সনদ তৈরির পর বাস্তবায়নের পথ বের হয়ে যাবে।

জুলাই সনদ তৈরি করা ছাড়া মুক্তি নেই উল্লেখ করে তিনি বলেন, সংলাপের মাধ্যমে বের হয়ে আসবে প্রস্তাবের পেছনে এতগুলো দল একমত। পরে সনদ যখন হয়ে যাবে, তখন সেটা প্রকাশ করা হবে। যাতে মানুষ জানতে পারে, কোন রাজনৈতিক দল কত প্রস্তাবে একমত হয়েছে। এই সনদকে আমরা জাদুঘরে সংরক্ষণ করব।

প্রধান উপদেষ্টা আরও বলেন, সংস্কারের বিষয়ে একমত না হলে আমাদের মুক্তি নেই। সারাদেশের মানুষ বলবে, তোমরা সনদে সই করলে না, সংস্কার করলে না, আমাদের ওপর চাপিয়ে দিয়ে গেলে।

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: ড ইউন স আম দ র ম আম দ র প র জন ত ক আপন দ র সনদ ত র দলগ ল র সরক র ই সনদ ন আমর

এছাড়াও পড়ুন:

বেড়েছে অভিজ্ঞতা কমেছে ক্রয়াদেশ

সংযুক্ত আরব আমিরাতের দুবাইয়ে শেষ হয়েছে পাঁচ দিনের গালফুড মেলা। মেলায় বাংলাদেশের ৪১টি প্রতিষ্ঠান এবার ৩৪ দশমিক ৫৯ মিলিয়ন বা তিন কোটি ৪৫ লাখ ডলার নিশ্চিত ক্রয়াদেশ পেয়েছে। গতকাল শুক্রবার মেলার শেষ দিনে বাংলাদেশ কনস্যুলেটের কমার্শিয়াল উইং এ তথ্য জানায়। 

এবারের নিশ্চিত ক্রয়াদেশ গত বছরের তুলনায় অর্ধেকেরও কম। গত বছর মেলায় ক্রয়াদেশ ছিল প্রায় ১০৭ মিলিয়ন বা ১০ কোটি ৭০ লাখ ডলার। এবার অংশগ্রহণকারী প্রতিষ্ঠানগুলো সম্ভাব্য ক্রয়াদেশ পেয়েছে প্রায় ২৯ দশমিক ১৬৩ মিলিয়ন বা ২ কোটি ৯১ লাখ ডলার। ব্যবসায়ীরা বলছেন, মেলার সুফল হলো, পারস্পরিক সম্পর্ক বৃদ্ধি ও অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেছে দেশের প্রতিষ্ঠানগুলো। তবে বাংলাদেশিদের ভিসা জটিলতার কারণে দেশীয় বায়ার না পাওয়ায় ক্রয়াদেশ কমেছে। মেলায় স্থান সংকুলান নিয়েও ছিল অভিযোগ। আগামী বছর আরও বড় পরিসরের ভেন্যু ঘোষণা দিয়ে এ আসরের ইতি টানেন সংশ্লিষ্টরা।
বাংলাদেশ এগ্রো প্রসেসরস অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক সহসভাপতি সৈয়দ মো. শোয়াইব হাসান বলেন, ভিসা জটিলতা থাকায় এবার মেলায় অংশগ্রহণকারী ছাড়া দেশীয় বায়াররা তেমন অংশ নিতে পারেননি। দূতাবাস ও রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর চেষ্টায় শেষ মুহূর্তে ৮২ জন ভিসা পান। এতে মেলায় বাংলাদেশের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা গেছে।
বোম্বে সুইটস অ্যান্ড কোম্পানি লিমিটেডের মহাব্যবস্থাপক খুরশীদ আহমাদ ফরহাদ বলেন, প্রতিবছর বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠানগুলো নতুন নতুন অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করছে। এ মেলায় বিশ্বের নানা প্রান্ত থেকে খাদ্যপণ্য উৎপাদনকারী ও বাজারজাত প্রতিষ্ঠানগুলো অংশ নিচ্ছে। তারা কীভাবে পণ্যের গুণগত মান বৃদ্ধিতে কাজ করছে, সেসব বিষয়ে বাংলাদেশি ব্যবসায়ীরা আইডিয়া নিতে পারছেন। বৈশ্বিক বাজারের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় টিকতে হলে দেশীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে পণ্যের প্যাকেজিংয়ের ওপর আরও জোর দিতে হবে। 

বাংলাদেশ এগ্রো প্রসেসরস অ্যাসোসিয়েশনের (বাপা) সভাপতি আবুল হাসেম সমকালকে বলেন, এ বছর আমরা ২৫ মিলিয়ন বা আড়াই কোটি ডলার নিশ্চিত ক্রয়াদেশের টার্গেট নিয়ে মেলা শুরু করি। কত ক্রয়াদেশ এসেছে, তার চেয়েও বড় বিষয়– এ মেলার কারণে আমরা নিয়মিত বায়ার পাচ্ছি। মেলায় হয়তো তারা ছোট অর্ডার করছেন। কিন্তু পর্যায়ক্রমে তাদের চাহিদা আরও বাড়বে।
গত দুই আসরে বাংলাদেশি ব্যবসায়ীরা স্থান সংকুলানের অভিযোগ তুলে আসছেন। এ বিষয়ে এবার মেলা কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনা করেছে রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি)। সে অনুযায়ী আগামী আসরে জায়গা বাড়ানোর আশ্বাস পেয়েছে বাংলাদেশ।
রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর ভাইস চেয়ারম্যান আনোয়ার হোসেন সমকালকে বলেন, এবারও আমাদের প্রতিষ্ঠানগুলো আশাব্যঞ্জক সাড়া পেয়েছে। কিছু জায়গায় আমরা দেখেছি, বেশির ভাগ প্রতিষ্ঠান একই রকম পণ্য নিয়ে মেলায় এসেছে। পণ্যের বৈচিত্র্য না থাকলে প্রত্যাশা অনুযায়ী ফল পাওয়া যায় না। আগামীতে মেলায় অংশগ্রহণে ইচ্ছুক প্রতিষ্ঠানগুলোকে পণ্যে বৈচিত্র্য আনতে হবে।
এদিকে গালফুডের পরবর্তী আসরে দুবাই ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারের সঙ্গে ভেন্যু হিসেবে যোগ করা হবে দুবাই এক্সপো সিটি। এক মাস এগিয়ে আগামী বছর জানুয়ারির শেষ সপ্তাহে দুটি আলাদা ভেন্যু নিয়ে বৃহৎ পরিসরে মেলার ঘোষণা দিয়েছে আয়োজক প্রতিষ্ঠান।

সম্পর্কিত নিবন্ধ